একবাটি মুরগির ঝোলে-কেনা সুখ

 
সিআরবি’তে গিয়েছিলাম।


আমি ওখানে প্রায়ই যাই। ঘুরতে-যাওয়া আমার মূল উদ্দেশ্য থাকে না। আমার উদ্দেশ্য থাকে এমন কিছু মানুষকে টার্গেট-করা, যাদের আসলেই সাহায্যের দরকার। তবে এমন কাউকেই আমি বেছে নিই, যার ভেতর কোনও প্রকার চাটুকারিতা বা অভিনয় করে অন্যদের ইমোশনকে ব্যবহারের উদ্দেশ্য থাকে না।


সাধারণত ভিক্ষুকদের আমি তেমন একটা টাকাপয়সা দিই না, কারণ বেশিরভাগ ভিক্ষুকের পকেটে আমার পকেটের তুলনায় দ্বিগুণ টাকা থাকে। বেশিরভাগ ভিক্ষুকই নিখুঁতভাবে তাদের আরোপিত আবেগ আর চোখের জলের ক্ষমতা ব্যবহার করে সবার কাছ থেকে টাকা আদায় করে নেয়। কিছু ভিক্ষুক আছে, যারা কাঁদতে কাঁদতে বুক ফাটিয়ে ফেলে, চোখের জলে রাস্তা ভাসিয়ে দেয়। এসব মূলত তাদের অভিনয়মাত্র, একপ্রকার ইমোশনাল ওয়েপন। অভিজ্ঞতা বলে, এদের বেশিরভাগই ভণ্ড প্রকৃতির হয়।


তবে সত্যিকারের অভাবী ভিক্ষুকও আছে, তাদের দেখলে আমি ভালোই চিনতে পারি।


এই যেমন, রাস্তাঘাটে প্রায়ই দেখা যায়, হাত-পা কাটা অথবা হাত-পা নেই-ই অথবা এতই অসুস্থ যে মরার মতো শুয়ে আছে, এরকম অনেক ভিক্ষুকই আপনার আমার চেয়ে ঢের বড়লোক। এটা ওদের ভিক্ষাবৃত্তি নয়, এটা ওদের একপ্রকার আয়েশি ব্যবসা। এজন্য এই ধরনের লোকদের আমি কখনও এক টাকাও দিই না।


তবে আমি ওখানে যাবার সময় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ রাখি সাহায্যের দরকার এমন কাউকে সাহায্য করতে। সাহায্যটা আসলেই দরকার এরকম কাউকে খুঁজে বের করার জন্য আমি প্রয়োজনে প্রায় কয়েক ঘণ্টাও অবজার্ভ করি। চুপচাপ বসে থাকি, তবে অবজার্ভেশন চলতে থাকে।


যেটাই হোক, আজ গিয়েছিলাম সিআরবি’তে। বসে আছি একটা জায়গায়। খুঁজছি। বেশ কয়েকজনকে তালিকায় রাখলাম। তবে আশেপাশে লোকজন বেড়ে গেলে আমি জায়গাটা পরিবর্তন করি।


আর এক জায়গায় বসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম।


দেখলাম, একটা ছেলে, বয়স নয় কি দশ। ওজন মাপানোর মেশিন নিয়ে রাস্তায় বসে জনে জনে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, “স্যার/ম্যাম, ওজন মাপাবেন?” একজন মানুষকে এক বারের বেশি জিজ্ঞেস করছে না। বেশ নম্র ও ভদ্র। চোখে-মুখে গাম্ভীর্য। তেমন একটা হাসছে না। কেউ ওজন মাপালে হালকা খুশি হয়, মৃদুহাসি দিয়ে মেশিন নামিয়ে ঠিকঠাক ওজন মাপিয়ে দিচ্ছে। এক বার ওজন মাপালে তিন টাকা করে নিচ্ছে।


দেখলাম, তেমন কেউ মাপাচ্ছে না ওজন। কেউ ওজন মাপালে যে মৃদুহাসির রেখা তার চোখে দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে, সে হাসিরেখায় অনেক রকমের অভাবের সীমা পরিসীমা আঁকা আছে, আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সংকুচিত হয়ে-যাওয়া ঠোঁটের কোনায় যে তিন টাকার অসীম প্রয়োজনবোধ লেপটে আছে, সে তিন টাকার ওজন তার কাছে তিনশো কোটি টাকারও অনেক বেশি।


দেখলাম, তার কাজে কোনও আলস্য নেই, চাটুকারিতা নেই। চোখে-মুখে দায়িত্বের গভীর ও অভ্যস্ত ছাপ।


ধরে নিই, তার বয়স নয় বছর। মাত্র নয় বছর বয়স। এই বয়সটা তার দস্যিপনা করার বয়স, এই বয়সে বন্ধুদের সাথে নিয়ে ওই পুকুরপাড়টায় দৌড়ঝাঁপ করে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। এ-গাছ থেকে ও-গাছে গাছাগাছি করে গাছমালিকের প্যাঁদানি খাওয়ার কথা। এ-পাড়া ও-পাড়া দৌড়াদৌড়ি করে সন্ধ্যাবেলায় মায়ের পিটুনি খাওয়ার কথা, পড়তে না বসার অপরাধে বাবার হাতে চড়থাপ্পড় খেয়ে অভিমানে রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। বন্ধুদের সাথে মারামারি করে এসে বাবার বেতের মারের ভয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে কাঁপার কথা।


তার ভাগ্যে এসবের কিছুই ঘটেনি। দারিদ্র্য তার নয় বছরের বয়সকে টেনেহিঁচড়ে নব্বই বছরে নিয়ে গেছে।


জীবন সবাইকে সব কিছু দেয় না। স্রষ্টা কাউকে মন দিলো তো ধন দিলো না, ধন দিলো তো মন দিলো না। এরকমই হয়।


গোটা মহাবিশ্বের সমগ্র আয়তনে ঈশ্বরপ্রদত্ত বসবাসের অনেক জায়গা থাকলেও সেখানে এদের মতো অসহায়দের জন্য তিলপরিমাণও ঠাঁই মিলে না।


খেয়াল করলাম, এদিক ওদিক গিয়ে সে একটা জায়গায় বারবার ফিরে যাচ্ছে, ছোট্ট একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করে আবার ফিরে আসছে, ফেরত এসে আবার নতুন কাউকে দেখলে ওজন মাপাবে কি না জিজ্ঞেস করছে। দেখে কৌতূহল জাগল।


হাঁটতে হাঁটতে সেখানটায় গেলাম। দেখলাম, মাঝবয়সী একজন মহিলা। মহিলার কোলে ছোট্ট বাচ্চা। বয়স তেমন হয়নি, কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে, দারিদ্র্যের চাবুক ওঁর পুরো শরীরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়সের ছাপ ঢুকিয়ে দিয়েছে বেশ জোর করেই। এই ছাপের ভার ওঁর ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বয়সের যৌবনকে একশো বা দুশো বছরের পুরনো চাদরে ঢেকে দিয়েছে।


পাশে গিয়ে বসলাম। দেখলাম, আমার দিকে ওঁর তেমন নজর নেই। উনি কোলে-থাকা নয়-দশ মাসের বাচ্চাকে মনোযোগ দিয়ে আদর করছেন, বাচ্চাটাকে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসাতে চাইছেন, বাচ্চাও কেমন গলগল করে হেসে হেসে মায়ের চোখে-মুখে আঁচড় কাটছে আর শব্দ করে হাসছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর বুকে এটাই তার একমাত্র চর, মায়ের মুখই তার পুরো একটা খেলনাঘর, এ ঘর তার একার।


খানিক বাদে বাদে ওজন-মাপানো ছেলেটিও এসে এসে কোলে তুলে বাচ্চার চোখে-মুখে-গালে আদর ডলে দিয়ে আবার মায়ে কোলে রেখে তার নিজের কাজে ফিরে যাচ্ছে।


আমি দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি।


মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওজন-মাপানো ছেলেটা আপনার কে হয়? মহিলা এবার হাসিটা খানিক থামিয়ে জবাব দিলেন, আমার ছেলে, নয় বছর বয়স।…বলেই কেমন উদাস হয়ে গেলেন। দেখলাম, আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে অদূরেই কাজে ব্যস্ত-থাকা ছেলের দিকে মমতাময় করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে আছেন। হয়তো উনি তখন অতীতে ডুবে গিয়ে জীবনের নৃশংসতার দুয়ারে বারবার হোঁচট খাচ্ছেন। মুখে কিছুই বলছেন না, তাঁর চোখে অনেক কথা জমে আছে। সব কি আর বলা যায়?


ওঁর উদাসীনতায় বাধ সেধে আমি জিজ্ঞেস করে ফেললাম, কে কে আছে আপনার? ঘর-সংসার, স্বামী? প্রশ্ন শুনে ছেলের উপর থেকে করুণ দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে ফের তাকিয়ে রইলেন। আমি এবার ওঁর চোখ পড়তে শুরু করলাম। দেখলাম, ওঁর চোখে-মুখে রাজ্যের অব্যক্ত যন্ত্রণা ভর করে বসল। কীসের জানি আতংক ওখানটায়। মুখে উনি কিছুই বলছেন না, কিন্তু ব্যথাতুরা চোখ দুটো অনেক কথাই বলে যাচ্ছে।


দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে এবার উনি বলতে শুরু করলেন।…আমার একটা ঘর ছিল। আমার ওই ঘরে আমার নিজের একটা মানুষ ছিল। আমার ওই ঘরটায় সুখের ছড়াছড়ি ছিল। বড় সুখের দিন ছিল আমাদের। বড় ভালোবাসার ঘর ছিল আমাদের। একসময় ঘরে তিনবেলা রান্না হতো। রিকশা চালিয়ে সংসার চললেও ঘরে তেমন অভাব ছিল না। মাসের শেষে হয়তো কখনও কখনও চাল ফুরোত, ডালের পরিমাণ কমত। মুরগি-পোলাও রান্না না হলেও সপ্তাহে অন্তত একবার ভালো খাবার রান্না হতো। আমার ঘরে টাকার অভাব থাকলেও ভালোবাসা আর সুখের কোনও অভাব ছিল না। সারাদিন কড়ারোদে রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে জীবনটা আমাদের ভালোই চলত। চক্রাকারে ঘোরা ওই তিনচাকায় একটা সুন্দর, সুখী সংসার বাঁধা ছিল। সেখানে বাঁধা ছিল তিনটা জীবন।


একটা একরুমের ঘরে তিনটা প্রাণের ঠাসাঠাসি বসবাস ছিল। সকালের সূর্যের মৃদুহাসিতে আমার দিনগুলো উপচে পড়ত। দুপুর ও বিকেলের খুনসুটিতে আমাদের ঘরটাতে আসন্ন সুখের ঝাপটায় জীবন উথলে উঠত। আর সন্ধে ঘনালে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি নিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মানুষটি আমার ঘরে ফিরে আসত। তালপাতার হাতপাখায় বাতাস করতে করতে দুটো চিড়ে-মুড়ি মুখে চিবুতে চিবুতে আমাদের সন্ধের ঘরটায় জ্যোৎস্না ঢলে পড়ত। কখনও কখনও ওই জ্যোৎস্না-চাদরে নিজেদের মুড়িয়ে তার বুকে মাথা রেখে আমরা সামনের দিনগুলোর সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতাম।


সুখ ছিল। ভারি সুখ ছিল অভাবী সংসারটায়।


একদিন। আমার মানুষটা ঘরে ফিরেছে। চোখেমুখে ক্লান্তি। অসুখের ছাপ। আমি তাড়াতাড়ি ভাত রেঁধে বেড়ে দিলাম। মানুষটা তেমন খেতে পারছে না। একটু খেয়েই গলাৎ করে বমি করে দিল। কী হলো কী জানি! আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। মানুষটার বুকে হাত দিয়ে মালিশ করলাম। আমার কাঁধে ভর দিয়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম। কেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। কথা বলছে না, চোখ খুলছে না। তার নীরবতার সাথে পাল্লা দিয়ে আমার অস্থিরতা বেড়ে চলেছে।


মধ্যরাতে মানুষটার গায়ের জ্বর হড়মড় করে বেড়ে গেল। ছুঁয়ে মনে হলো যেন সূর্যের সমস্ত তাপ তার শরীরে জমে আছে! এমনি করে একসময় সকাল হলো। ততক্ষণে জ্বর দ্বিগুণ হয়ে বেড়েছে।


লেপের নিচে-থাকা একশো ত্রিশ টাকা থেকে একশো টাকার নোটটা নিয়ে জ্বরের ওষুধ আনিয়েছি। খাওয়ালাম। দুপুর হতে হতে তার অসুস্থতা আরও বাড়তে লাগল। কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব, এমন সাধ্য আমাদের ছিল না। ঠিকমতো ভাতই তো জুটে না! জ্বরের ওষুধের বাইরে আরও ডাক্তার, ওষুধপত্র তো স্রেফ বিলাসিতা।


আমাদের কাছে সহজে-পাওয়া বিলাসিতা হলো চাঁদের আলো, সন্ধের জোনাকি, রাত্রির ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, কিংবা বর্ষার টুপটুপ বৃষ্টির পানিতে গা-ভিজানো।


মানুষটা কিছুই খেতে পারছে না, কিছু খেলেই হড়মড় করে বমি করে দিচ্ছে। ছেলেটা তার বাবার পাশে বসে বসে কেমন ব্যথাব্যথা চোখে বারবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে। আমি উথালপাতাল করছি। কী করব কী করব, ভেবে উঠতে পারছিলাম না।


সন্ধে ঘনাল। হঠাৎ মানুষটার ছটফটানি বাড়তে লাগল। এর পর চুপ। অনেকক্ষণ পর চোখ খুলল। চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কী জানি খুঁজছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিছু লাগবে?...ঠোঁট দুটোকে একটু ফাঁক করে বহু কষ্টে কথা বের করে বলল, আমার পোলাটা কই, তারে একটু দেখতাম!


উঠোনে এককোণে বসে-থাকা ছেলেকে ডেকে আনলাম। দেখলাম, বাপে-পুতে চোখে চোখে অনেক কথা হচ্ছে। বহু কষ্টে হাত বাড়িয়ে ছেলের গালে, চোখে, মুখে, মাথায় হাত বুলাচ্ছে। চোখ বেয়ে টপটপ করে জল ঝরছে। ওই ঝরে-পড়া জলের ফোঁটায় অঢেল বেদনা আর দুঃস্বপ্ন মেশানো ছিল। তখন বুঝিনি।


দেখলাম, কিছুই বলছে না দুজনের কেউই। শুধুই তাকিয়ে আছে। মানুষটা বারবারই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরছিল!


রাত্রে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। আমি তার পাশেই শুয়েছি। রাত বাড়ছে।


সারাদিন তার জন্য এটা ওটা, একাজ ওকাজ করতে করতে ক্লান্ত থাকায় আমি যে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম, জানি না।


সকাল হলো। ভাঙাভাঙা জানালার মরচেধরা গ্রিল ভেদ করে সূর্যের আলো আমার ঘরে ঢুকে পড়ছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে উঁকি দিয়ে দেখি, বাপ-ছেলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। ছেলের মুখ বাপের বুকের ভেতর জড়ো জড়ো হয়ে আটকে আছে। বাপের এক হাতের উপর ছেলের মাথা, আর একটা হাত ছেলেকে জড়িয়ে ধরার মতো করে ছেলের গায়ের উপর রাখা।


ছেলে গভীর ঘুমে। মুখ হাঁ করে বাপের মুখের কাছাকাছি। দুজনে নিঃশব্দে আরামে শুয়ে আছে। আমি মানুষটার পিঠে হাত দিয়ে জ্বর কমেছে কি না দেখছি। দেখলাম, সারাশরীর বরফের মতো ঠান্ডা। হাত দিয়েই আমি তাড়াহুড়া করে তার কপালে, পিঠে, গায়ে বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম। হালকা ধাক্কা দিয়ে দিয়ে মানুষটাকে বারবার ডাকছি। যে মানুষকে কখনও ঘুম থেকে ডাকতে হয়নি, সেই মানুষটাই আমার বারবার ডাকে কোনও সাড়া দিচ্ছে না। তার হাত ধরে টানলাম। হাত দুটো কেমন হাড়ের মতো শক্ত হয়ে আছে। নড়ানো যাচ্ছে না।


ব্যাপারটা কী! আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে চিৎকার দিয়ে বারবার মানুষটাকে ডাকছি! আমার চিৎকারে ছেলে তড়িঘড়ি করে উঠে গেল। আমার ছেলের বাবা ছেলেকে ঠিক যেভাবে জড়িয়ে ধরে রেখে ঘুমিয়ে ছিল, ঠিক ওরকমই হয়ে আছে। নড়ছে না, চড়ছে না। শক্ত হয়ে আছে।


এবার আমার সারাদুনিয়া ভেঙে পড়ল। আমার তীব্র চিৎকারে আশেপাশের লোকজন দৌড়ে এল। আমি অস্থির হয়ে গায়ে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে তাকে বারবার ডেকে চলেছি, কিন্তু কিছুতেই মানুষটার ঘুম ভাঙল না।


একজন বৃদ্ধ গা ছুঁয়ে পরখ করলেন। ইন্না-লিল্লাহি পড়তে পড়তে কেঁদে ফেললেন। বললেন, অনেক আগেই ইন্তেকাল করেছে।


আমার মানুষটা আর বেঁচে নেই!


আমি আবারও চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে তাকে জড়িয়ে ধরে উঠানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই যেন তার নীরবতা ভাঙছেই না!


আমি বুঝলাম, সূর্য-ওঠা এই সকালটাতে আমার সূর্যটাই ডুবে গেল।


এবার ছেলেটা আমার সশব্দে কেঁদে উঠে বাবা বাবা করে বাবাকে বারবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে ডেকে চলেছে। কিন্তু বাবা তার কিছুই বলছে না। ঠিক যেভাবে পুত্রকে শেষবার জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই জড়িয়ে ধরার ভঙিতেই চুপচাপ, নির্জীব, নিথর হয়ে আছে। যেন আজ পৃথিবীর সকল নীরবতা মানুষটা একাই অধিকারে নিয়ে নিয়েছে!


সংসারের সকল দায়িত্ব আমার একার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বাড়ির সামনের পুকুরপাড়টায় সে নীরবে শুয়ে আছে। ওখানে তিনচাকার প্যাডেল নেই, ক্লান্তির লেশমাত্রও নেই, অভাবের টানাটানি নেই। শুধুই নিরবচ্ছিন্ন শান্তি!


মানুষটা যখন মারা যাচ্ছিল, তখন আমার পেটের ভেতর আর একটা পেট। বড় শখ ছিল, এবার তার একটা রাজকন্যা হবে। কন্যার লম্বা লম্বা চুল থাকবে। আদর করে চুলে বিলি কেটে দিবে, তেল লাগিয়ে দিবে, বাপ-বেটি মিলে কত খুনসুটি হবে! মেয়ের নাম রাখবে শিউলি, তার প্রিয় ফুলের নামে। মানুষটা ফুল বড় ভালোবাসত। সে মারা যাবার কয়েক মাস পর আমার সন্তান দুনিয়ায় এল। তবে মেয়ে নয়, ছেলে। সে তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে, কেবল আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখে মেরে ফেলেছে।


আমি দেখলাম, এবার ওঁর ঠোঁট দুটো কাঁপাকাঁপা, চোখ দুটো ছলছল। আটকাতে-চাওয়া চোখের জলটুকু গিলে ফেললেও ঠোঁট দুটো যন্ত্রণায় কাঁপছে। ওই চোখের ভেতরে অনেকগুলো রঙিন স্বপ্নপোড়া ছাই পৃথিবীর সব নিয়মকে ভেঙেচুরে তোলপাড় করে দিচ্ছে। আমি যতই ওঁর চোখ পড়ছি, ততই একটা ধোঁয়া ধোঁয়া পোড়া-জগতের অতল জলসীমানায় তলিয়ে যাচ্ছি।


জিজ্ঞেস করলাম, তো আন্টি, আপনি চলেন কীভাবে? ওই ছেলের ইনকামে হয়? এবার উনি পৃথিবীর চেয়েও ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলেন, সারাদিন খেটেও সামান্য টাকা পায়, সারাদিনে কয় জনেই-বা ওজন মাপায়! কিন্তু পেট তো এত কিছু মানে না!


বুঝলাম, ওজন মাপানোর ওই মেশিনে মানুষের ওজন ধরে ঠিকঠাকই, কিন্তু ক্ষুধার ওজন ওই মেশিনটা ঠিক ধরতে পারে না। কেবলই মানুষের ওজন ধরতে-পারা ওই মেশিনটায় পুরো একটা সংসারের ওজন দাঁড়িয়ে আছে, যার ভার ওই মেশিনটা বইতে পারে না।


এবার উনি গড়গড় করে বলতে লাগলেন, ছেলের ইনকামে তেমন কিছুই হয় না। ঘরভাড়া, লাকড়ি-খরচ, খাবার খরচ…এত এত খরচ যে পেরে উঠি না! মানুষের বাড়িতে কাজ নিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা বাচ্চা সাথে নিতে দেয় না। বলে, বাচ্চা না নিয়ে কাজে যেতে। আপনিই বলেন, তাও হয় নাকি? কাকে দিয়ে আসব বাচ্চা? কে দেখবে? এই অবুঝ বাচ্চাটার আমি ছাড়া আর কে-ইবা আছে? কী আর করব! একবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে আর একবাড়িতে যাই। পেট তো ক্ষুধা মানে না, ক্ষুধা তো মানবতা বোঝে না! আমি না খেয়ে থাকলেও সমস্যা নাই, কিন্তু আমি না খেলে যে বাচ্চাটা আমার দুধ পায় না। আমি-ইবা খাই কোথা থেকে? ওই বড়বড় দালানবাড়ির বড়বাবুরা তো আমাদের ঘরের ডেকচির ভাত জুটে কি না, তার খবর জানে না। ওই বড়বাবুদের বাচ্চারা নামিদামি এটা-ওটা খেতে পেলেও আমার বাচ্চা তো বুকের দুধটুকুও পায় না। ওরা টেবিলে-সাজানো হরেকরকম মজার পদ দিয়ে ভাত খেলেও আমার ঘরে যে ভাতের ফেনটুকুও জুটে না, তার খবর কি ওরা জানে? ঈশ্বর তো ওদের ঘরে থাকে! বড়বাবুদের এত এত যত্নআত্তিরে ওদের ঘরে এত ব্যস্ততার ভিড়ঠেলে আমার ঘরে নজর দেবার মতো সময়ই-বা ঈশ্বরের কই? এ-বাড়ি ও-বাড়ি অনেক খুঁজেও বাসার কাজ পাই না। পেলেও বেশিদিন আমাকে রাখে না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হয়। বাচ্চা তো এত কিছু বুঝে না! মাঝেমধ্যে কেঁদে উঠলে কাজ ফেলে রেখে একটু কোলে নিলেই বড়বাবুদের কাজে নাকি ঢের ঢের হেলা পড়ে যায়! আমাকে কিছু দিন রেখে কাজ থেকে বের করে দেয়। কিন্তু পেট তো ক্ষুধা মানে না, আমার পেটের সাথে যে আরও একটা পেটের সংযোগ থেকে গেছে! আমি নাহয় না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারি, বড় ছেলেটা নাহয় এখানে ওখানে, এই দোকানে, ওই দোকানে চেয়েটেয়ে খেতে পারে, কিন্তু আমার অবুঝ বাচ্চাটা তো আমার বুকের দুধ ছাড়া আর কিছুই খেতে পারে না! সে তো আর কিছু চাইতেও পারে না, আবার সহ্যও করতে পারে না। সন্তানের ক্ষুধা সহ্য করতে পারে, এমন মা দুনিয়ার কোথাও নাই। পথেঘাটে অনাদরে পড়ে-থাকা মা-কুকুরটিও তার সন্তানের ক্ষুধা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। আর আমি তো মানুষ! আমার কী করে সে সহ্যক্ষমতা থাকবে? নিজে তো না খেয়ে কয়েক দিন কোনওরকমে কাটিযে দিতে সমস্যা ছিল না, সমস্যা হলো আমার পেটের সাথে জড়িয়ে-থাকা বাচ্চাটার পেট! তাই যখন ঘরে একদম কিছুই থাকে না, তখন মাঝেমাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে ভিক্ষা করি…তবে এলাকা থেকে অনেক দূরে গিয়ে, বোরকা পরে, নেকাব বেঁধে। আশেপাশের লোকজন জানে না এ-কথা। তবে সব সময় ভিক্ষা করি না, যখন ছেলের টাকায় একদমই চলে না, তখন চুপিচুপি ভিক্ষা করতে যাই। তবে বাচ্চাটা একটু বড় হলে, হাঁটতে জানলে আমি আবার বাসায় কাজ নেব। ভিক্ষা করতে শরম লাগে, আত্মসম্মানে খুব বাধে। অথচ দেখেন, ক্ষুধার এই ত্রিসীমানায় ঈশ্বরের বসবাস নেই। উনি ভারি ব্যস্ত ওই বড়বাবুদের বড় বড় ভোজ-আয়োজনে! এই তো, আর কটা মাস পরেই ছেলেটা হাঁটতে শিখবে। হাঁটতে শিখলে ছেলেকে বড় ছেলের কাছে দিয়ে আমি মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করব। তবে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ভিক্ষা করলেও ছেলেকে কখনও ভিক্ষা করতে দিই নাই। সে করতেও চায় না।


কথা শেষ হতে না হতেই দেখি, উনি মাথা নিচু করে রেখেছেন, চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে, কিন্তু কোনও শব্দ হচ্ছে না।


তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে। এই নিভুনিভু সূর্যের আলো ওঁর অন্ধকার জগতের নিকষ কালোরংটিকে আরও গাঢ় করে দিচ্ছে। উনি কাঁদছেন চুপচাপ। মাথা নিচু করে কাঁদছেন, কেউ না বুঝে মতো করে কাঁদছেন, ধরা না পড়ার মতো করে কাঁদছেন।…খানিকবাদে কোলের ছেলে দুষ্টুমির ছলে নড়েচড়ে ওঠায় ওঁর ধ্যান ভেঙে গেছে। এবার পুরোদমে তিনি চারপাশের জগতে ফিরে এসেছেন। ঠোঁট দুটোকে জোর করে হাসিয়ে উনি ছেলেকে আদর করতে লাগলেন। আমিও সেই আদরের সুন্দর দৃশ্যে যোগদান করলাম।


এবার চোখে-মুখে খুশির রেশ ছড়িয়ে নাক-মুখ মুছতে মুছতে উনি বলতে লাগলেন, জানেন, আমার বড় ছেলেটা খুব লক্ষ্মী, ওজন মেপে যে টাকা পায়, ওটা দিয়ে তরিতরকারি কিনে দিয়ে সন্ধ্যার পর সে এখন একটা প্রাইভেটে যায়, তিন দিন হলো। সেই স্যার ওর কাছ থেকে টাকা নেন না। সে স্কুলে পড়ে, পড়তে নাকি তার ভালো লাগে।


দেখলাম, এবার ওঁর চোখে-মুখে রাজ্যের কল্পনারা দোল খাচ্ছে। বড় ছেলের দিকে আবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৃদু হেসে হেসে কী জানি ভাবছেন। হয়তো ভাবছেন, পৃথিবীর সব দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ছেলে একদিন ভারি বড় হয়ে উঠবে, পড়ালেখা শিখে বড়মানুষ হবে। এই দুর্দিন, অভাবের দিন আর থাকবে না। একদিন ওদের ঘরেও বড়বাবুদের ঘরের মতো হরেকপদের রান্না হবে। মাছ-মাংস, পোলাও-বিরিয়ানির ডেকচি একদিন ওদের চুলোতেও টুংটাং শব্দ করবে। একদিন ওদের ছাদওয়ালা একটা ঘর হবে, সে-ঘরে বর্ষায় বৃষ্টির পানি ঢুকবে না, শীতের রাতে কম্বল থাকবে, গরমের দিনে ভোঁভোঁ করে ঘুরে এমন দিল-জুড়িয়ে-দেওয়া ঠান্ডা বাতাসের ফ্যান থাকবে। একদিন ছেলের পায়ে ভালো স্যান্ডেল থাকবে, গায়ে জামা থাকবে, ঈদে পায়েস-ফিরনি, নুডলস ওদের ঘরেও রান্না হবে। সেদিন ওই ওজন মাপানোর মেশিনে সুখ মাপা হবে!


এপারে সূর্য ক্রমেই ডুবে গিয়ে অন্য কোনও পারে উবুউবু করে উঁকিঝুঁকি মেরে উঠে দাঁড়াচ্ছে। এপারে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত গভীর হচ্ছে, ওপারে রাত ফুরিয়ে সকাল মিটিমিটি হাসছে। এবার ওঁর বেশ তাড়া পড়ে গেল…হায় হায়, ঘরে যেতে হবে, রাঁধতে হবে! বলেই উনি উঠে যেতে চাইছেন। উঠতে উঠতে বলতে লাগলেন, অনেকদিন ধরে ঘরে শুধুই আলুর ভাজি রান্না হচ্ছে, ছেলেটা একদমই খেতে চায় না, কিন্তু আবার না-ও করে না! কী করবে, বয়স কম হলেও সে বুঝে অনেক, অনেকদিন ভালো কিছু রান্না হয়নি, আজকে হাতে কিছু টাকা আছে, কালও কিছু টাকা উঠাতে পারলে একটা মুরগি আনব, রেঁধে খাওয়াব ছেলেটাকে, সে অনেক খুশি হবে।…এ কথাগুলো বলার সময় ওঁর চোখে-মুখে আগামীকাল পুত্রকে মুরগির মাংস রান্না করে খাওয়াতে পারার কী যে ভীষণ এক আনন্দ…সেই স্বামীহারা অভাগিনীর চেহারার ঔজ্জ্বল্যকে দ্বিগুণ, তিনগুণ, শতগুণ আলোকিত করে তুলেছে।


…অথচ একটা মুরগি, কেবল একটা মুরগি…সেই একটা মুরগির মাংসে একরাজ্য সুখ মিশে আছে! সেই সুখে পেটের ক্ষুধা নয়, সন্তানকে খাওয়াতে পারার সুখ মিশে আছে! কারও কাছে সুখের মানে বড় বড় দালান, ব্রান্ডেড গাড়ি…আর কারও কারও কাছে সুখের মানে ছেলের মুখে একটুকরো মুরগির মাংস ও একবাটি মাংসের ঝোল।


উনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমি ওঁর আরও একটু কাছে ঘেঁষে বললাম, আন্টি, আপনার মোবাইল-ফোন আছে? উনি বললেন, হ্যাঁ মা, আছে। আমি বললাম, নাম্বারটা একটু আমাকে দেন। দেখলাম, খুব ভাঙাচোরা অনেক পুরনো একটা নোকিয়া সেট। উনি ফোন বের করতে করতে বলতে লাগলেন, ছেলের বাবার মোবাইল এটা। যখন বেঁচে ছিল, খুব শখ করে দেড়হাজার টাকা জমিয়ে এটা কিনেছিল সে অনেক বছর আগে। এখন আমি ব্যবহার করি। আমার মা এখনও বেঁচে আছে। মাঝেমাঝে যখন মনটা খুব পোড়ে, তখন মায়ের সাথে কথা বলি, ভাইয়ের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করি। দেখা তো হয় না, তাই কথা বলে দুঃখ মিটাই। আপন বলতে মা আর এক ভাই আছে। ভাই রাস্তার কাজ করে। বিয়ে করেছে। ভাই-ই দেখে আমার মাকে। কিন্তু ভাইয়ের বউ আমার মা-টাকে তেমন সহ্য করতে পারে না। আমার খুব ইচ্ছা করে, আমি মাকে আমার কাছে নিয়ে আসি, কিন্তু আমি নিজেই তো ভাত পাই না। ভাইয়ের সাথে থাকলে দুটা কিলঘুসি খেয়ে হলেও দুবেলা ভাত তো পায়, বেঁচে তো আছে, এটাই বড় কথা।


…নম্বর বিনিময়ের পর উনি ছেলের গায়ের ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে হেসে হেসে ছেলেকে আদর করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে দাঁড়িয়ে ওঁর হাত ধরে একটা হাজার টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললাম, আজ একটা মুরগি কিনে নিয়েন, রেঁধে ছেলেকে খাওয়াবেন। আর প্রতিমাসে আপনার ছেলের পড়াশোনার খরচ আমি আপনাকে এখানে এসে দিয়ে যাব, সাথে ভালোমন্দ কিছু রেঁধে খাওয়ার জন্য আপনাকে আমার সাধ্যমতো কিছু টাকা দিব। ছেলেকে পড়াবেন আর পড়ার সুযোগ দিবেন।


জগতের সকল বিস্ময় চোখে নিয়ে উনি আমার দিকে বোবার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎই আমার হাতটা সজোরে চেপে ধরে সেই চেপে-ধরা হাতটির উপর মাথা নিচু করে চুপ হয়ে রইলেন। দেখলাম, এবারও উনি নিঃশব্দে কাঁদছেন। আমার হাতের তালুর বিপরীত দিকের চামড়ায় ঠান্ডা ঠান্ডা জলের ফোঁটা টপটপ করে পড়ছে।


…এই জলবিন্দু আনন্দের, কৃতজ্ঞতার, ভালোবাসার। মুখে ধন্যবাদ বলতে-না-জানা এসব নিচুতলার মানুষগুলোর ভালোবাসায় তিলপরিমাণও খাদ থাকে না। অথচ এই নিখাদ ভালোবাসার খোঁজ কেউ রাখে না। এসব খাদহীন ভালোবাসা, এসব বিহ্বল সুখগুলো এককদম পেরিয়ে দুইপলক খুঁজলেই পাওয়া যায়, অথচ আমরা সুখ খুঁজতে যাই টাইলস-বাঁধা নানান ফ্লোরে অথবা দামি রেস্টুরেন্টের দামি প্লেটারে।


নিজের হাতটা কোনওমতে ছাড়িয়ে নিয়ে ওঁর চোখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে আমি দ্রুতগতিতে সামনের দিকে চলে যাচ্ছি। আমার চলে-যাবার পথের দিকে অবাকদৃষ্টিতে ভারী ভারী কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসার বৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে উনি ঠায় মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছেন। চুপচাপ তাকিয়ে আছেন আমার চলে-যাবার পথটার দিকে। মনে মনে হয়তো ভাবছেন, পুরো পৃথিবী স্বার্থের সুতোয় বাঁধা থাকলেও সেখানেই কিছু মানুষ এই সুতোর বাইরে ভালোবাসার সুতোয় বাঁধা। হয়তো ভাবছেন, মানুষের আকৃতিতেও কিছু ঈশ্বর থাকে। বড় বড় বাবুদের ভিড় ঠেলে কেউ কেউ ঘাসে-জমা শিশিরফোঁটায় ভালোবাসা বিলিয়ে ভালোথাকার আশ্রম খুঁজে পায়। মনে মনে তিনি সত্যি কী ভেবেছেন, তা আমার জানা হয়ে ওঠেনি।


বাসায় ফিরছি। রিকশায় উঠলাম। ব্যাগে দুশো টাকা আছে। এই দুশো টাকা নিয়ে আমি বাসায় ফিরছি। হাতে-থাকা এই দুশো টাকার ওজনকে আমার কাছে কোটি টাকার চেয়েও ভারী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, জগতের সকল শ্রেষ্ঠ ধনীর চেয়েও ধনী আমি। মনে হচ্ছে, জগতের অর্ধেকটা ধন, ঐশ্বর্য আর সুখের মালিক একা আমিই!


চারপাশটা দেখে দেখে যাচ্ছি। ভালোই লাগছে। ফুরফুরে হাওয়া। এই পৃথিবীতে কেবলই শান্তি আর শান্তি। একহাজার টাকা দিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা দামের ‘সুখ’ কিনে ব্যাগে ভর্তি করে আমি ঘরে ফিরছি। একহাজার টাকা! মাত্র একহাজার টাকা! এই একহাজার দিয়েই এত এত সুখ কিনে ফেলেছি কত অনায়াসেই!


চোখে বারবার ভাসছে, আজ রাতে একটা ভাঙাচালের অভাবী ঘরে তিনটা ক্ষুধার্ত মানুষ মুরগির মাংস ও মুরগির ঝোল দিয়ে মহাআনন্দে গাপুসগুপুস করে ভাত খাচ্ছে। খেতে খেতে কোনও এক অচেনা নাম-না-জানা অপরিচিত রক্তের সম্পর্কহীন একটা মানুষের ছবি ওদের চোখে-মুখে বারবার ভেসে উঠছে। দুহাত তুলে শুকরিয়া বলে বারবার ওই মানুষটিকে ওরা তিনজন নিঃশব্দে ভালোবাসা জানাচ্ছে। তাদের চোখে-মুখে ক্ষুধামুক্তির মিছিলের আলো! আজ রাতে কোনও এক ক্ষুধায়-ঠাসা ভাঙাঘরে একবাটি মাংসের ঝোল রান্না হবে!


রিকশায় বসে বসে এপাশ ওপাশ খুঁজছি। বাসায় ফিরে আসতে আসতে অদ্ভুত এক শান্তির আবেশে নিজের কাছেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি মনে হচ্ছে। আগামীবার ঠিক একইভাবে পাঁচশো বা একহাজার দিয়ে আমি কয়েক কোটি টাকার সুখ কিনে আবার ঘরে ফিরব। এত অল্প টাকার পুঁজিতে এমন লাভজনক সুখী-ব্যবসার খোঁজ আর কেউ জানে না…আহা, আমি তা জেনে গেছি! আমি খুঁজে চলেছি আগামীকাল, আগামীপরশু বা তার পরের দিন এত কম টাকায় ঠিক কোথায়, কোন বাড়ি, কোন অভাবী সংসার থেকে সুখ কিনতে পাওয়া যাবে! আগামীবার ঠিক কোন ঘরে আবার একবাটি মাংস রান্না হবে…আমি খুঁজছি।