ঘুম ভেঙে/ ২য় পর্ব

নদীতে ঢেউ ওঠে, কিছু ঢেউ উঠতে গিয়েও আর ওঠে না, ভেঙে যায়। জাহাজঘাটের পাশ দিয়ে বজরা নৌকা ভেসে যাওয়ার সময় নৌকার ধাক্কায় কিছু ঢেউয়ের ছন্দপতন ঘটে, ঘাটে এসে গড়ার আগেই ভেঙে পড়ে। যারা নদীতে ছিপ ফেলেছে, তারা কিছু স্রোতের অনিবার্য প্রপাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পাঁচিলঘেরা বাগানটার বাইরের সীমানা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পাই, দুষ্টু ছেলের দল বাগানের ভেতর ছুটোছুটি করছে, ওরা সবাই মিলে কোনওমতে পাঁচিল টপকে বাগানে ঢুকে পড়ার উৎসব উদযাপন করছে পাঁচিলের গায়ে লোহার স্কেল দিয়ে আঘাত করেকরে। স্কুল পালিয়ে বাগানে! ওদের কেউ বাধা দিচ্ছে না, বাগানের মালিক কিংবা মালী আজ এখানে নেই। সেদিনই, কিংবা আরেকদিন। আমি একটা বেঞ্চিতে বসে আছি। সে বেঞ্চির তক্তা সবুজ রঙের, লোহা কিংবা ওরকম শক্ত কিছু দিয়ে তৈরি, সিংহের বেপরোয়া থাবায়ও সে বেঞ্চি নির্ঘাত অক্ষত থেকে যাবে। পার্কের বুড়ো তত্ত্বাবধায়করা খুঁজে খুঁজে ওদেরই বয়সি কিংবা বয়সের আগে বা বয়সের ভারে অকর্মণ্য ছেলে-বুড়োর সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সেই পার্কের সবুজ ঘাসের উপর রৌদ্র পিছলে পড়ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে আর কিছু প্রজন্মের অকাট্য দূরত্বটাও ঘুচিয়ে দিচ্ছে। আমি জুতোর আগায় কিছু বৃত্ত এঁকেএঁকে হাঁটছি বালির রাস্তায়, কনক্রিটের চত্বরে, ধুলোভরা সদ্যশুকনো কাদায়। কিছু চোখের নিরাপদ প্রশ্রয়ে মাটির বুকে অবলীলায় বসিয়ে দিচ্ছি আমার নামের আদ্যক্ষর।

হাঁটতে হাঁটতে কোনও এক মহান মানুষের সমাধিস্তম্ভের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ি। এমনও হতে পারে, ওই স্তম্ভটি এমন কারও স্মরণে নির্মিত, যিনি আদৌ মহান ছিলেন না, তবে তাঁকে মহান হিসেবে জানানো হয়েছে। এই পৃথিবীকে অনেক কিছুই জানানো হয়েছে, যেগুলি অসঙ্গত। কিছু কীর্তিস্তম্ভ আর কিছু ইতিহাসবহ প্রান্তর ঘুরে ফিরে যাওয়ার পথে প্রাচীন এক সেতুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চট করে বাঁধের স্বপ্ন দেখে ফেলি। একটা বাঁধ তো লাগেই, না? যাদুঘরে না গেলে পাপ হয়, শুনেছি। গেলাম ওখানেও। দেখলাম, স্তব্ধতার মহাসংগীত বেজে চলেছে। সে সংগীত যে সবাইই শুনছে, তা নয় যদিও! সমুদ্রের মাছগুলিকে ভূগর্ভস্থ কাঁচের ঘরে আটকে রেখে প্রজার মনোরঞ্জনের যে রাষ্ট্রীয় আয়োজন, তাও দেখলাম। রাতের বাগানে ফোয়ারার জল কেমন করে আলো ছড়ায়, তা, আর পরের দিন মধ্যদুপুরে যারা ব্যস্ত হয়ে থাকবে নানান অনুষঙ্গে, ওদের উচ্ছ্বাস, এইসব দেখার ফাঁকে চোখে এল, কিছু অবসরপ্রাপ্ত বুড়ো খোকা বাগানের ক্রিস্টমাস গাছের ছায়ায় বসে তাসের আসর জমিয়েছে। দেখি, দেখতে ভাল লাগে, তাই দেখি।

কাছেই একটা বেঞ্চিতে বয়সের দাবিতে ন্যুব্জ এক বৃদ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, এই পুরনো আকাশে আর জায়গা হবে না বোধহয়, অন্য আকাশের খোঁজ করতে হবে। বাঁচতে তো একটা আকাশ লাগেই! তাঁর দৃষ্টি স্থির, তিনি নড়ছেন না। একটি ছড়ি দুইহাতে শক্ত করে চেপে ধরে সেখানে থুতনি রেখে শূন্যতার দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্ভাবনার স্মৃতিতে ডুবে আছেন। আমি অপার বিস্ময়ে সেই বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলাম, তাঁর প্রচ্ছন্ন শক্তির কি দুর্বলতার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম। দেখলাম, তাঁর মধ্যে দুর্বলতার লেশমাত্রও নেই। তাঁর ঠোঁট নড়ছে না, সেখান থেকে একবিন্দুও লালা ঝরে পড়ছে না। ওদিকে তাঁর চোখের পাতা পড়ছে না বললেই চলে। সূর্যের দিকে তাকালে তাঁর চামড়ার ভাঁজ টের পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি তাঁর ছায়ার ব্যাপারে খুব সতর্ক হতে শিখে গিয়েছিলেন। হয়তো আগেভাগেই তিনি বয়সের কিছু ছাপ রেখে এসেছিলেন অচেনা কোথাও, সূর্যের ছায়ায় যা চেনা হয়ে উঠছিল ক্রমশই। বৃদ্ধ মানুষটি কি তবে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন? যদি ওরকমই হয়, তবে এটা নিঃসংশয়ে বলে দেয়া যায়, তিনি প্রকৃতপক্ষে কিছুটা সূর্যঘড়ির মতোই আচরণ করতে শুরু করেছিলেন। তবে আরও একটু সময় ওইখানে থেকে গিয়ে সংশয় দূর করার মতো অতোটা স্থৈর্য আমার ছিল না হয়তো! ফিরে এসেছিলাম। আমি এরকম ফিরেই আসি!

তবু আমিও উনার মতো হতে চাই, এক আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্য আকাশ খুঁজতে চাই। কিন্তু আমি তা করতে পারছি না। সম্ভবত বয়স অল্প হওয়ার কারণে এবং বৃদ্ধের মতো করে ভাববার অভিজ্ঞতা বা স্থিরতা নেই বলেই এমনটা হচ্ছে। আমি খুব সহজেই অস্থির হয়ে পড়ি। আমি বালির উপরে হাঁটার সময় বালিতে পা ঘষেঘষে হাঁটি। ধীরস্থির কেউ ওরকম করবে না, আর ওরকম করে হাঁটলে হাঁটার আনন্দও পাওয়া যায় অল্প। আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে আটকে থাকে না, নিজের অজান্তেই অন্যদিকে চলে যায়। আমি বাম হাতের পাঁচটি আঙুল ডান হাতের পাঁচটি আঙুলের ফাঁকেফাঁকে রেখে দিই, আবার সরিয়ে নিয়ে আসি। কখনও দুই হাত পরস্পরের সাথে শক্ত করে আটকে রাখি আঙুলের নিপাট বাঁধনে। আবারও আলগা করে দিই। আমার পা দুইটি আমাকে যেদিকে নিয়ে যায়, আমি সেদিকেই চলে যাই। আমার কোনও ব্যক্তিগত গন্তব্য বা যাত্রাপথ নেই। আমি কখনও কখনও হারিয়ে যাই, কী সব অচেনা বৃত্তে ঘুরতে থাকি। হারাতে ভাল লাগে। যারা হারাতে পারে না, ওদের অনেক দুঃখ। মাঝেমাঝে এমন হয়, কিছু হাস্যকর লক্ষ্য স্থির করি। অবশ্য, সেগুলির একটাতেও আমার আগ্রহ বেশিক্ষণ আটকে থাকে না। আমি খুব দ্রুত কোনও কিছুর উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।

কখনও, আমি হুট করেই কোনও একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়ি। অনেকক্ষণ সময় কাটাই। কিছু বই হাতে নিই, উল্টাই, দোকানের লোকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু পাতা ভাঁজ করে রাখি। এমন ভাবখানা, যেন পরেরবার এলে ওই জায়গাগুলি পড়ে নেব। আসলে এমনিই করি ওই কাজটা! একটাও বইয়ের এক লাইনও পড়ে দেখি না, যদিও বইয়ের পাতার দিকেই তাকিয়ে থাকি দীর্ঘ সময় ধরে। কোনও চিত্রকর্ম দেখলে খুব আগ্রহ নিয়ে ওটার সামনে থামি, ডানেবাঁয়ে মাথা ও ঘাড় বাঁকিয়ে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বা পেছনের দিকে হেলে বা যেকোনও পাশে বেঁকে চিত্রকর্মটি ভালভাবে দেখার চেষ্টা করি। অনেকক্ষণ ধরেই। একসময় আবিষ্কার করি, এতক্ষণ আমি আসলে কিছুই দেখছিলাম না। আমি এরকমই করি। প্রতিবারই। গ্যালারি থেকে বের হয়ে আসার সময় কমেন্টবুকে আমি চিত্রকর্ম সম্পর্কে অনেক সুন্দর ও দুর্বোধ্য কিছু কথা, যতটা সম্ভব, প্যাঁচানো ভঙ্গিতে লিখে দিয়ে কমেন্টের নিচে আমার অপাঠ্য স্বাক্ষর, অন্য কোনও ফোন নম্বর ও ভুল ঠিকানা লিখে রেখে আসি, যদিও আমি ওইসব চিত্রকর্মের অর্থ বা অনর্থ কিছুই বুঝিনি।

কখনওবা, একটা ক্যাফেতে ঢুকে সবচে পেছনের টেবিলে বসে যেকোনও একটা খবরের কাগজ প্রতিটি লাইন ধরেধরে পড়ি, গভীর মনোযোগের সাথে। একসময় বুঝতে পারি, আমি আসলে এতক্ষণ যা পড়েছি, তার কিছুই আমার মনে রাখিনি। এটা একটা ভাল ব্যায়াম। পড়ে যাওয়া, পড়ার সময় আনন্দ পাওয়া, তারপর সবই ভুলে যাওয়া। কত দামিদামি তথ্য আমার চোখের সামনে গিজগিজ করছে, আর আমি কিনা তার কিছুই না পড়ে সব কিছুই পড়ে নিচ্ছি। আসলে আমি পড়ছি, তবে কিছুই মনে রাখছি না। এই স্টাইলে পড়ার একটা অন্য রকমের মজা আছে। সাহিত্যে কে নোবেল পেলেন আর স্বামীর পরকীয়া স্ত্রী হাতেনাতে ধরে ফেলার পর কী ঘটল, দুইই আমার কাছে সমান, এই দুই খবরের কোনওটিই আমি মনে রাখব না। কোন শহরের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে আর সে শহরের সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে, কিংবা কোথায় কোন ব্যাংক ডাকাতি হল বা পৃথিবীতে আরও একজন সিঙ্গেল মাদারের সংখ্যাবৃদ্ধি হল, এইসবের কিছুই আমাকে টানে না। বরং গোটা পৃথিবীতে প্রেমিকপ্রেমিকারা পরস্পরকে একই ধরনের মিথ্যে কথা শতাব্দীর পর শতাব্দী লিখে চলেছে এবং সেগুলি গ্রহণও করে ফেলছে, সম্ভবত, সামনেও ফেলবে, এই ব্যাপারটা আমাকে সত্যিই বিস্মিত করে।

কিন্তু এইসবে আমার কী এসে যায়? এইসবের অর্থ যা-ই হোক না কেন, আমিই-বা তা নিয়ে ভাবছি কেন? আমার সামনে পড়েথাকা সময়টা কাটিয়ে দেয়াই তো আমার একমাত্র কাজ। কোথায় কী হল, কী হল না, তা জেনে আমার কী কাজ? প্রতিদিন প্রতিক্ষণ একের পর এক কিছু অস্পষ্ট বক্ররেখা আমার চোখের সামনের দেয়ালে আঁকাবাঁকা পথে উপর থেকে নেমে যায়। ওগুলি দেখতে চাইলে, ধরতে চাইলে দৃষ্টিকে কিছু সময়ের জন্য স্থির রেখে দিতে হয়। ওগুলি উপর থেকে নামে, নিচে নেমে আসে, কখনও লাফিয়ে উঠে আবার উপরে চলে যায় বা একপাশে সরে যায়। একসময় দৃষ্টি আবছা হয়ে আসে। সামনের সবকিছু ঝাপসা লাগে। এই অনুভূতিটি চমৎকার। রেখাগুলির সাথে কিছু বৃত্তও থাকে। মজার ব্যাপার হল, রেখাগুলি দুইটি রেখার পাশাপাশি অবস্থানের ফলে সৃষ্ট, প্রতিটি বৃত্তের ভেতরে অন্তত আরও একটি বৃত্ত আছে। আলোর দিকে তাকালে এটা সবচাইতে ভাল বোঝা যায়। আমি পৃথিবীর প্রতি উদাসীন, এ উদাসীনতার অর্থ মূর্খতা নয়, দ্রোহ নয়, অভিমানও নয়। এটি কেবলই উদাসীনতা। সব কিছুরই অন্য অর্থ খুঁজতে যাওয়ার কোনও অর্থ নেই। অজ্ঞ থেকে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে, আমি সে আনন্দের কথা নতুন করে বলতে চাইছি না, বরং কোনও কিছু পড়ার মধ্যে, জানার মধ্যে একইসাথে যে ক্লান্তি ও আনন্দ কাজ করে, আমি তা নিয়ে বিন্দুমাত্রও বাড়াবাড়ির বিপক্ষে। আনন্দের জন্য বই পড়তেই হবে, এমন নয়। আনন্দ পাবার অনেক অন্য জায়গাও আছে।

আমি নগ্নতার বিপক্ষে নই, আবার পোশাকের বিপক্ষেও নই। যার যেমনি করে থাকতে ভাল লাগে, সে তেমনি করেই থাকুক। নগ্নতাও সুন্দর, পোশাকও সুন্দর। সৌন্দর্য খুবই আপেক্ষিক একটা ব্যাপার। অনেকেই নিজেকে সুন্দর দেখাবে ভেবে না খেয়ে থাকে। ভাবে, মরতেই তো হবে, না খেয়েই মরি! এদিকে আমি, না খেয়ে মরে যাওয়ার চাইতে বরং খেয়ে মরে যেতে বেশি ভালোবাসি। এমন নয় যে আমার খেয়ে মরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, আমার আসলে ওরকম মনে হয়। আমার আসলে মরে যাওয়ার কোনও অভিজ্ঞতা নেই, তবু আমার প্রায়ই মরে যেতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীতে সব কিছুরই একটা ফার্স্ট টাইম আছে। প্রথম নদীদেখা, প্রথম পাহাড়ছোঁয়া, প্রথম স্কুলেযাওয়া, প্রথম সিনেমাদেখা, প্রথম শেভকরা, প্রথম চুমুখাওয়া, প্রথম শরীরমেশানো। এরকমই তো প্রথম মরেযাওয়া! আমি খাই। আমি ঘুমাই। আমি হাঁটি। আমি পোশাক পরি। আমি কখনও নগ্ন হয়ে ঘুমাই, ঘরের মধ্যে নগ্ন শরীরে হাঁটি, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নগ্নতা নিজেই দেখি। এইসব আচরণ আর কাজ আমার ব্যক্তিগত। এখানে পয়সার কোনও ব্যাপার নেই। পয়সার ব্যাপার নেই বলেই এইসব দামি। আপনার কিংবা অন্য কারও কাছে আমার এইসব কাজের কী মানে, তা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমি যা পরি, যা খাই, যা পড়ি, তা দেখে খুব সহজেই আমাকে চিনে ফেলা যাবে না। একসময় যেত। ওটা আমার ভুল ছিল। নিজেকে সহজেই চিনিয়ে দেয়া এক ধরনের ভুল। এখন নিজেকে কোনও কিছু দিয়ে চেনাতে আর ভাল লাগে না। ব্যাপারটা খুব অবসাদের, বিরক্তকর, কখনও মর্মন্তুদও। এই যেমন ধরুন, আমি নগ্ন হয়ে ঘুমালাম। আমি ধরে নিলেন, আমি নগ্নতাবাদী। এমনও তো হতে পারে, আমার গরম লাগছে কিংবা স্রেফ ইচ্ছে হল বলেই আমি নগ্ন হয়ে ঘুমিয়েছি। আপনি কখনও নগ্ন হয়ে ঘুমিয়ে দেখেছেন, কেমন লাগে? ভাল লাগতেও তো পারে! তাহলে আমারটাকে বাতিলের খাতায় রাখছেন কেন না জেনেই? এটা নিয়ে বিশ্লেষণ করার সত্যিই কিছু নেই। কত ছোটো একটা জীবন, আর আমরা কিনা অন্যদের সম্পর্কে নিজেদের নিয়মে ভেবেই এই জীবনটাকে কাটিয়ে দিই। কোনও মানে হয়?

আমি দিনে একবার বা দুইবার খাই। এর বেশি খাই না, এমন নয়। আমার আসলে খেতে মনে থাকে না, মনে থাকলে খেতে ইচ্ছে করে না কিংবা খাবার কিনতে যেতে ইচ্ছে করে না। এমনও হয়, আমার পকেটে খাবার কেনার টাকাই থাকে না। তখন আমার একটা প্রেম করতে ইচ্ছে করে। কেউ একজন আমার খাওয়ার ব্যাপারটা দেখাশোনা করুক। পর মুহূর্তেই সে ইচ্ছেটা উবে যায়। আসলে আমার কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। আচ্ছা, একটা টুকরো মাংস। কয়েক টুকরো আলুভাজি, অবশ্য ওটাকে ওরা ফ্রেঞ্চফ্রাই নামে ডাকে। এক গ্লাস রেড ওয়াইন। এইসব তো কেবলই প্রোটিন আর অন্যান্য কিছু খাদ্য উপাদান। লোকে কেন বলে এইসবের নামই ভালোবাসা? রেস্তোরাঁয় যেতে হয় এইসব খেতে, না গেলে নাকি ভালোবাসা হয় না! এই অনুভূতির অর্থটা আমার কাছে ঠিক স্পষ্ট না। ওই মাংস দিয়ে তৈরি বিফস্টিক, এটাও কারও কারও মনে ঝড় তুলে দেয়! কিছু মামুলি আলুভাজি, ওটাকে আদর করে বলতেই হবে ফ্রেঞ্চফ্রাই কিংবা ওয়েজেস্‌! এক গ্লাস লাল রঙের মদ, এটা নাকি অনিশ্চিত জীবনকে পথ বাতলে দেয়! সেখানে আবার কতকত ক্যাটাগরি! আচ্ছা, পাকস্থলি এইসবের পার্থক্য বোঝে? বুঝলে তো সবকিছুরই শেষটা একই রঙের হতো না! আমাকে ক্ষমা করবেন, হলদে রঙটা আমার ভাল লাগে।

একই জিনিস, কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর ভিন্ন জিনিস হয়ে যায়। অভক্ষ্য শক্ত মাংস হয়ে যায় বিফস্টিক। তাজা আলু নিমিষেই হয়ে যায় চিপস বা ফ্রেঞ্চফ্রাই। আঙুর বা পচাভাত হয়ে যায় সুস্বাদু মদ। সে মদ নিয়ে আবার কিছু লোক কবিতাও লিখে ফেলে! রান্নাঘরে বিষণ্ণ মুখে বেচারারা ঢুকে, আর বেরিয়ে আসে লোভনীয় সব পোশাকে, দেখলেই জিভে জল এসে যায়। আমরা কাউকে বা কোনও কিছুকে কী নামে ডাকছি, তা নির্ভর করে সেটি বা তিনি কী নামের যোগ্য, তার উপর। ওরকম না হলে আমি পৃথিবীর সব মেয়েকেই প্রিয়তমা ডেকে বসে থাকতাম! আহা, তখন কত ভাল হত! কোনও কিছুর বাইরের রূপ তার অর্থ ও গ্রহণযোগ্যতা বদলে দেয়। আমরা তো ভালই আছি, ভাল খাচ্ছি, ভাল অনুভব করছি। কিন্তু কিছু দুঃখ, কিছু বিপত্তি, কিছু গ্লানি এর সাথে যুক্ত হয়ে আছে। কীরকম? আলুভাজি খেলে ভুঁড়ি বাড়ে। মাংস খেলে বাড়ে দম্ভ। ওদিকে মদটাও মানুষকে ক্রমেই কেমন যেন খিটখিটে করে দেয়, কাউকে কাউকে অবশ্য প্রেমে মাতাল করেও রাখে! এইসব নিয়ে ভাবতে হয় না। খাবার সামনে এলে খেয়ে ফেলতে হয়। সকালের, দুপুরের, রাতের, যে কোনও বেলারই খাবার হোক না কেন, কোনও ব্যাখ্যা বা যুক্তি ছাড়াই খেয়ে ফেলা ভাল। আমি চুপচাপ রেড ওয়াইন খেয়ে নিই, বিফস্টিক কিংবা ফ্রেঞ্চফ্রাই খেয়ে ফেলতে আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি জানি, যা ইচ্ছে তা-ই খেলে মৃত্যু কাছে চলে আসে। খেতে মজা, মরতে সোজা! তবু খাবার সামনে চলে এলে মৃত্যুর কথা মাথায় আসে না।

আমি কোথাও যেতে হলে অনেক ঘোরাপথে যাই। সোজাপথে হাঁটতে ভাল লাগে না। সোজাসুজি চলে যাওয়ার মধ্যে আনন্দ কম। একটু ঘুরে গেলে কেমন জানি এক ধরনের আবিষ্কারের আনন্দ পাওয়া যায়। আমি স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে চলে যাই, প্রার্থনালয় গুনতে থাকি, অনবদ্য ভাস্কর্যগুলি দেখি। পাবলিক টয়লেটগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, রেস্তরাঁগুলিতে ঢুঁ মারি। কোন কোন পাবলিক টয়লেটের কমোডের ফ্লাশ কাজ করে না, কোথায় কোথায় বেসিনে সাবান রাখে না, সবই আমার মুখস্থ। বড়বড় দালান ওঠে, দেখতে ভাল লাগে। রাস্তা হয়, ফ্লাইওভার ওড়ে। দেখতে ভাল লাগে। শহরের নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত হয়, পাহাড় ভেঙে ফ্ল্যাট গজায়। জঙ্গল কেটে সাফ! পশু পালায়, মানুষ ঢোকে। এইসব দেখি, ভাবি। কী ভাবছি, বুঝতে পারি না। আবারও ভাববার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এরপর আমার রুমে ফিরে সরু বিছানায় টুক্‌ করে শুয়ে পড়ি।

সিলিংয়ের সূক্ষ্ম ফাটলগুলি আবারও গুনতে থাকি। নিজের সাথে নিজে প্রায়ই তাস খেলি। নিজেকেই নিজের প্রতিপক্ষ বানাই। এরপর প্রতিপক্ষের তুরুপের তাস নিজের কাছে নিয়ে আসি। কখনওবা, চারটি টেক্কা বাদ রেখে খেলি। বাকি ৪৮টা কার্ডের খেলা চলে। রাজ্যের মোড়লদের সরিয়ে রেখে রাজ্যে ঘুরতে অনেক মজা। আমি বাঁধা নিয়মেই খেলি, এমন নয়। কখনও নিজের নিয়ম নিজেই বানিয়ে নিই। সবচাইতে ক্ষমতাবান কার্ডগুলির ক্ষমতা কেড়ে নিই। প্রজাদের রাজার ঘাড়ে বসাই। ওদেরও তো রাজার ঘাড়ে বসতে ইচ্ছে করে, তাই না? সবচাইতে দুর্বল কার্ডটিকেও জিতিয়ে দিই। কখনও মন চাইলে রাজাকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিই। রাজা বুঝুক, ক্ষমতা মাত্র কিছু সময়ের জন্য থাকলে কেমন লাগে! এখানে জেতার সম্ভাবনা নেই, হারার আশংকা নেই। এখানে কেবলই খেলার আনন্দ আছে। অতো জিতে বা হেরে কী হয় আসলে? প্রজারা রাজার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলে ওদেরই রাজা বানিয়ে দিলে অনেক মজা! দেখা যায়, ওরা সবাই মিলে ভয়ে রাজার আসন ছেড়ে পালায়! অতো ভার নিতে শক্ত কাঁধ লাগে। সবাই তা পারে না। আমি ভাবি, হারলে হারব। অতো নিয়ম মেনে খেলতে পারব না। যেমন করে খেলতে ভাল লাগে, তেমন করেই খেলব। আমার সবচাইতে বড়ো সুবিধে হল, বাঁচতে হলে আমাকে জিততেই হয় না। তোমরা যেটাকে হেরেযাওয়া বল, আমার কাছে ওটা স্রেফ বাঁচার একটা অংশ। জেতাও তা-ই। তাস খেলায় আমি খুব কমই জিতি। জিততে খুবই ক্লান্ত লাগে। জিতলে কী একটা বোঝা মাথায় ভর করে থাকে। সেই বোঝাটি বয়ে বেড়ানোর মানুষ আমি নই!

আমি হেরে যাই, এবং পরের বারও হেরে যাই। আমি হারতেই থাকি। আমার মধ্যে জিতে যাওয়ার কোনও দায় নেই, দায়িত্ব নেই, বাড়তি কোনও চাপ নেই। আমি নির্ভার হয়ে বাঁচতে ভালোবাসি। তবে আমি জিততে জানি না, এমন কিন্তু নয়! আমি হারতে চাই বলেই হারি। যে কোনও খেলায় জেতার অনেক ব্যাকরণ বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, হেরেযাওয়ার কোনও ব্যাকরণ কেউ কখনও লেখেনি। হেরেযাওয়ার ব্যাকরণ জানতে হলে আমার সাথে কথা বলতে হবে। আমি হেরেযাওয়ার ব্যাকরণের স্রষ্টা। আমি কার্ডগুলি শাফল করি, নিজেকে ও প্রতিপক্ষকে তাস বুঝিয়ে দিই, টেক্কাগুলি সরিয়ে নিই, এরপর খেলা চলতে থাকে। এলোমেলোভাবে। গুছিয়ে খেলতে ভাল লাগে না, যেমন করে খেলতে ইচ্ছে করে, তেমন করেই খেলতে ভাল লাগে। একসময় খেলাটা একটা ধাঁচে চলে আসে। সে ধাঁচ অভিনব ও ব্যক্তিগত। ধাঁচটা আমার নিজের বানানো। অন্যদের চোখে ওটাও এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। ওরা যা ভাবতে চায়, ভাবুক। ওদের ভাবনায় আমার কিছুই এসে যায় না। আমি আমার নিয়মে বা অনিয়মে খেলি। খেলা চলছে। সেটাই বড়ো কথা। খেলা চলছে মানেই এখনও বেঁচে আছি। দ্য গেম ইজ অন! বেঁচে থাকলে অনেক ব্যাকরণ বানিয়ে ফেলা যায়। খেলা নতুন করে শুরু করা যায় কিংবা আর কখনওই শুরু না করেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। আমার ধৈর্য হারায় না, আমি অসীম ধৈর্য বুকে রেখে হেরে যেতে পারি। সবাই তা পারে না। আমি পারি, কেননা আমি হারার জন্যই খেলি। জিততে বুদ্ধি লাগে, হারতে সাহস লাগে। আমি কখনও কখনও খেলায় চিটও করি। কখন? যখন দেখি, আমি প্রায় জিতেই যাচ্ছি। আমি নিজের কাছে জিততে চাই না। আমি নিজেকে ভারি করে রাখতে চাই না। ওরা সবাই জিতে যাক, আমি হারতেই জন্মেছি!

আমার কাছে জেতার কোনও দাম নেই। হেরে যেতে হলে জেতাকে দূরে সরিয়ে রেখে খেলতে হয়। জেতার যদি কিছু দাম থাকে, তবে এইটুকুই যে, আমি কখন জিতে যাচ্ছি, বুঝতে হয়, জেতাকে চিনতে হয়, এবং কায়দা করে দূরে সরিয়ে দিতে হয়। জিতলে আর খেলতে ইচ্ছে করে না, যদি পরেরবার হেরে যাই, সে ভয়ে। হেরে গেলে খেলা চলতে থাকে। আমি পরেরবারও হেরে যাওয়ার লোভেই খেলি। আমি জিততে চাই না বলেই একবার জিতে গেলে পরেরবারও জিতে যাওয়ার ভয়ে হয়তো আমার আর খেলতেই ইচ্ছে করবে না। আমি চাই, খেলাটা টিকে থাকুক। দীর্ঘ সময় ধরে খেলাটা চলুক। এখানে হারজিত মুখ্য নয়। মাঝেমাঝে আমি সারা দুপুর ধরেই খেলি। কখনওবা ঘুম থেকে উঠেই নেসক্যাফের কাপ হাতে খেলতে বসে পড়ি। সারারাতই না ঘুমিয়ে তাস খেলে কাটিয়ে দিয়েছি, এমন অনেক রাত আমার জীবনে এসেছে, সামনেও আসবে। সত্যি বলতে কী, তাস খেলায় এমন কিছু নেই, যেটা আমাকে মুগ্ধ করে রাখে। এর চাইতে বাথরুমে ঢুকে নিজের নগ্ন শরীরে জলঢালাও অনেক ভাল। আরেকটা দারুণ খেলা হল, বিছানায় শুয়েশুয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা, একদৃষ্টিতে। চোখের কর্নিয়াতে কিছু অস্বচ্ছ আঁকাবাঁকা রেখা আর বৃত্ত—দুই বা আরও বেশি স্তরের, কেমন করে যেন উপর থেকে নিচে নেমে আসে, কখনওবা একপাশে সরে যায় ফুড়ুৎ করেই, চোখের পলক পড়ে গেলে ওরা আবার উপর থেকে নামে, নতুন কিছু রেখা আর বৃত্ত, অপেক্ষা করে থাকতে ইচ্ছে করে কখন ওরা নামবে, সেই আশায়। তবু আমি কার্ডটাই বেশি খেলি। ওটাতে আমার আবেগ জড়িয়ে আছে। আমি হেরে গেলে বেঁচে থাকার আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়ি।

বেঁচেথাকা। খুব সুন্দর একটা কথা। ভাবতে ভাল লাগে, বুঝতে আরও ভাল লাগে। বেঁচেথাকার সময়টাতে লোকে কী করে? কে কী করে, জানি না। তবে আমি আপাতত নিজেকে জ্যান্ত রাখছি নানান ভাবে, কখনও নিজেকে বিপদে ফেলি, আবারও সবকিছু সামলে নিই। কিছু প্ল্যান করি, সেগুলি একটার সাথে আরেকটা জোড়া লাগাই। এই কাজে প্রায়ই ব্যর্থ হই। কিছু বাড়তি আপদ এসে হাজির হয়। ওসব আপদের কোনও শাস্তি নেই, বরং আপদ এলেই ভাল, সত্যিই খুব ভাল, তখন জীবনের কিছু অনুষঙ্গে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। লোকে ভুল করলেই তার পা মাটিতে থাকে! যা-ই হোক, মাত্র আটচল্লিশটা তাস আমাকে রুমের মধ্যে আটকে রাখে। সেখানে টেক্কা নেই, সেখানে রাজা নেই। রাজা যেখানে ভয় দেখায় না, সেখানে বেঁচেথাকা বড়ো আনন্দের। খুব হিসেব করে যখন হারের দিকে এগোতে থাকি, ঠিক তখুনিই যদি জিতে যাওয়ার কোনও ক্ষীণ আশংকা দেখা দেয়, তখন খুব ক্লান্তি অনুভব করি। সামনের দিকে যাওয়ার ব্যাপারে আমি কিছু কৌশল অনুসরণ করি। আমি বেঁচে আছি ওসব কৌশল নিয়েই। আমার জিততে হবে না, আমি হেরে গিয়ে ভালই আছি, আমার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, আমি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী, এইসব বোধ নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি এখনও নিজেকে জ্যান্ত রেখেছি।

অন্ধকার। চোখ বন্ধ করলাম। খুললাম। ওটা আবারও হচ্ছে। কী ওটা? চোখের ভেতরে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেখা আর বৃত্তের নিচের দিকে নেমে আসা। দুই স্তরে, ধীরে, হেলেদুলে, এপাশওপাশ করেকরে। ওরা আসে, হারিয়ে যায়। চোখ খুলছি, বন্ধ করছি। ওরা কখনও কর্নিয়ার একেবারে মধ্যখানে এসে পড়ে। ওখানেই থেকে যায় অনেকক্ষণ ধরে। ওরা আগের মতোই আছে। কিছু আছে চাকতি কিংবা বুদ্বুদ আকৃতির। আর কিছু আছে গাছের ভাঙা কচি ডাল কিংবা ফুলের মাঝখানের বাঁকানো দণ্ডটির মতো। খুব দারুণ লাগে যখন দেখি, ওই রেখা, বৃত্ত, বুদ্বুদ মিলেমিশে একসাথে কেমন জানি কল্পনার পৌরাণিক দৈত্যের অবয়ব নিচ্ছে! আমি ওদের দেখি। আমি ওদের ঠিক পর মুহূর্তেই হারিয়ে ফেলি। তখন ওদের আবারও খুঁজে বের করি। হারিয়ে গেলে খুঁজতে হয়। তবে হারিয়ে গেলে সব কিছুই খুঁজতে হয় না। যা খুঁজতে ইচ্ছে করে, যা হারিয়ে গেলে মনকেমন করে, তা-ই খুঁজতে হয়। আমি চোখ রগড়ালে ওই বৃত্ত আর রেখাগুলি হারিয়ে যায়, কল্পকাঠামোর দল ভেঙেচুরে হারিয়ে যায়। ওরা তবু ফিরে আসে আবারও, আমিই ওদের ফিরিয়ে আনি।

সময় কাটে। আমার ঘুম পায়। আমি বইটা পাশে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ি। সব কিছু ঘোলাটে, ঝাপসা। চোখের সামনে সবই কাঁপছে। আমার শ্বাস স্বাভাবিক। ঘণ্টা ঘুরে দিন আসে, দিন ঘুরে সপ্তাহ আসে, সপ্তাহ ঘুরে ঋতু আসে। আমার ওতে কিছু এসে যায় না। আমি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেই রাখি। কখনও আবিষ্কার করি, অনেক ভাল লাগছে। কেন ভাল লাগছে, বোঝার চেষ্টা করি। মনে হয়, আমি মুক্ত, আমাকে তেমন কিছুই ভাবায় না, আমি কোনও কিছুতেই খুশি হই না, কোনও কিছুতেই বিরক্ত হই না, তাই আমার ভাল লাগে। জীবন ক্ষয়ে যায়। বাঁচতে বাঁচতে ক্ষয় এসেই যায়। নতুন এলে পুরনো ক্ষয়ে যায়। আমার জীবনে যা নতুন, তা-ই পুরনো। আমার জীবনে কোনও ক্ষয় নেই। কিছু মুহূর্ত হারিয়ে যায়, কিছু সুখ এসেই যায়, আনন্দ পাই, কখনও কিছু নতুন আবেগ এসে আমাকে ভারি করে দেয়। আমি বেঁচে আছি একটা চমৎকার বন্ধনীর ভেতরে। আমি, আমার দুইদিকে দুই দেয়াল। সে দুই দেয়ালের শেষটা দেখা যায় না।

আমি এমন এক অসীম শূন্যতার মধ্যে আছি, যে শূন্যতা প্রতিশ্রুতিতে পরিপূর্ণ, যেখান থেকে আমি কিছুই পাওয়ার প্রত্যাশা করি না। আমি অদৃশ্য, স্বচ্ছ, অনাবিল। বয়েচলা সময়ের মধ্যে আমাকে পাবে না, ফুরিয়েযাওয়া দিনগুলির দিকে তাকিয়ে দেখবে, সেখানেও আমি নেই। ঋতুর পরিক্রমায় কিংবা সময়ের প্রবহমানতায় আমাকে খুঁজে পায়নি কেউ কখনওই। আমার অস্তিত্ব অন্য কোথাও। এই যে টিকে আছি, সে টিকেথাকায় আনন্দ নেই, দুঃখও নেই। কোনও ভবিষ্যৎ কিংবা অতীত নেই। কী আছে তবে? তেমন কিছুই না, তবু যদি শুনতেই চান তো বলি: ওই বিকল কলটা থেকে মেঝের উপর টুপটুপ শব্দে জল পড়ছে, গোলাপি রঙের প্লাস্টিকের গামলায় ছয়টা মোজা পচছে, সিলিংয়ের একটু নিচ দিয়ে উড়েচলা মাছিটা কিংবা শামুকের গতিতে নিজের জীবনটাকে চলতে দেখা অথর্ব লোকটার অভিশাপ, ছাদের কোণায় একটা গাছের পাতা ঝরে পড়ছে অবিরত, আমার বিছানার নিচে একটা ইঁদুর খেলছে। এ-ই তো! এর বাইরে বলার মতো তেমন কিছুই আমার নেই।

একসময়, এই শীতলতা ভাল লাগে। চোখের মধ্যে এক ধরনের সুখ খেলা করে। আমার ভূতুড়ে অস্তিত্ব একটু একটু করে আলোর মুখ দেখে। ক্লান্ত ঠোঁটে প্রশান্তি নেমে আসে, সেখানে তিক্ততা নেই, কোনও অনুযোগও নেই। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। কাউকে ছুঁই না, শুধুই হেঁটে যাই। পোশাক নিয়ে ভাবতে হয় না। পুরনোটাই সবসময় দারুণ লাগে। খুব সাবধানে পরলেও সব পোশাকই একসময় ছিঁড়ে যায়। ছেঁড়া পোশাকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে ওয়াও বলি! এটাও এক ধরনের বেঁচেথাকা। এটাকে বেঁচেথাকা বলে না, এমন রায় দেওয়ার তুমি কে? এই যে দেখছ না আমি তো বেঁচে আছি এমনি করেই! নির্দিষ্ট করে কাউকেই আমার ভাল লাগে না, আমার সবাইকেই ভাল লাগে। এরকম নিঃস্পৃহতা নিয়েও ভালই তো আছি! এই যে হাঁটি, বেড়াই, এসব আসলে এক ধরনের ইশারা। সে ইশারা কেউ বুঝে ফেলুক, আমি চাই না। যার নিজস্ব কোনও ইশারা নেই, তার বাঁচার কোনও মানে নেই। খুব প্রয়োজন না হলে আমি তেমন কোনও কথা না বলেই কাটিয়ে দিতে পারি দিনের পর দিন। বাঁচতে হলে কথা বলতেই হয় না। আমি অনেক চেষ্টা করেও আমার মুখ থেকে এখনও পর্যন্ত প্লিজ, হ্যালো, থ্যাংক ইউ, গুডবাই, এই কয়েকটি শব্দগুচ্ছ বের করতে পারিনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, ওসব বলার কোনও মানেই নেই। ওগুলি মানুষ কেবল বলার জন্যই বলে। কোনদিকে যেতে হবে, তা আমি কারও কাছ থেকে জানতে চাই না। আমি ঘুরে বেড়াই। কোনও নির্দিষ্ট দিকে নয়, সামনে, পেছনে, পাশে কিংবা আদৌ কোনও দিকেই নয়। কারও কথামতো চলতে না হওয়ার চাইতে আনন্দ আর কীসে আছে? আমি হাঁটি। আমার কাছে দিনে হাঁটা, বিকেলে বা সন্ধেয় হাঁটা কিংবা রাতে হাঁটা বলে কিছু নেই। আমি হাঁটি সময়কে মাথায় না রেখেই। সব সময়ের চেহারাই একই রকমের, সব জায়গার চেহারাই একই রকমের।

আমার কখনওই কোনও তাড়া থাকে না, আমি হারিয়ে যাওয়ারও ভয় নেই। আমার ঘুম পায় না, আমার জেগে থাকতে ইচ্ছে করে না। খিদে লাগে না, তবে খেতেও আপত্তি নেই। সময় আমাকে যেদিকে নিয়ে যায়, আমি সেদিকেই চলে যাই। আমার কোনও নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ নেই। আমার প্রিয় পাখি কাক, কেননা একমাত্র ওকেই খুঁজতে হয় না, এমনিই সামনে চলে আসে। খুঁজেটুজে কোনও পাখিকে প্রিয় বানানোর কোনও আগ্রহ আমার নেই। ধূসর কাকের ধূসর ঝাঁকে সামনের রাস্তাটাকে দেখতে ধূসর লাগে। কেন লাগে? সেখানে আলো নেই? নাকি আছে, কিন্তু আমার চোখে পড়ছে না? নাকি ধূসর রঙের কাকগুলিই সব কিছু ধূসর করে রেখেছে? যেখানে কোনও কোলাহল নেই, সেখানেও কান পাতলে এক ধরনের কোলাহলের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। একটি দেয়াল, কিছু মানুষ, একটি গাছ, কিছু জল, একটি বারান্দা, কয়েকটি বাগানবৃতি। ওদিকটায় বিজ্ঞাপনের পোস্টারের রং আর ঠোঁট, শানবাঁধানো রাস্তা, পথিকদের প্রিয় চৌমাথাটি। দোকানের থ্যাবড়া মুখের উপর চকচকে বিজ্ঞাপনী গোঁফ। ফুটপাথের ধারে লেখা: থামুন। রাস্তার ধারে লেখা: ওদিকে যান। কিছু নামের স্রোত চোখের সামনে না চাইতেও এসে যায়। মেয়েদের চুলের ফিতে আর কাঁটা বিক্রি হচ্ছে ওদিকটায়, দেখা যাচ্ছে। এখানে মানুষের চেয়ে পায়ের ছাপ বেশি। ট্রাফিক আইল্যান্ডের উপর কয়েকটা পাগল চিৎকার করে হাসছে, ওদের গায়ে কাপড় নেই।

আমি হাঁটি, কখনও হাঁটি না। আমি ঘুমাই, কখনও ঘুমাই না। আমি পেপার কিনি, কখনও কিনি না। আমি খাই, কখনও খাই না। কখনও বসে থাকি, কখনও হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকি, কখনও স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকি। অন্ধকার অডিটোরিয়ামে এক কোণায় বসে ছিলাম একবার। অনেকক্ষণ ধরে। কেন ছিলাম, মনে নেই। হয়তোবা তার কোনও কারণই ছিল না! ইচ্ছে করলে সিগারেট ধরাই, না করলেও ধরাই। রাস্তা পার হই, মন চাইলে নৌকায় চড়ে নদী পার হই। নদী খুঁজে না পেলে একটু থেমে দাঁড়াই, আবার খুঁজতে থাকি। রাস্তার কোনও এটিএম বুথে আমার কার্ডটা ঢুকিয়ে দেখি, ওটা এখনও সচল আছে কি না। কার্ডে টাকা নেই, কখনও থাকেও না। আমার কার্ডে টাকা লাগবে না, আমার শুধু কার্ডটা লাগবে। এবং, ওটা সচল অবস্থাতেই লাগবে। কেন লাগবে? ভাল লাগে, তাই লাগবে। এটিএম বুথে ঢুকে কার্ডটা চেক করতে আমার ভাল লাগে।

ঔদাসীন্য এমন একটা ব্যাপার, যার কোনও শুরু নেই, শেষ নেই। এটি একটি অপরিবর্তনীয় অবস্থা, অনড় জড়তা। শুরুতে যা ছিল, শেষেও তা-ই থাকে, শুরুর আর শেষের প্রতিচ্ছবি একই। রাস্তায় লাল আলো জ্বললে রাস্তা পার হই না, বরং অন্য সময় পার হই। গাড়ি চলছে, আমি হাত দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে বা কৌশলে এঁকেবেঁকে রাস্তা পার হচ্ছি, এটাই আমার ভাল লাগে। সিগারেট ধরাতে হলে বাতাস বাঁচিয়ে ধরাতে হয়, শীতের সকালগুলিতে শরীরের জন্য ওমের ব্যবস্থা করতে হয়, মাঠ থেকে ফিরে ঘামে ভিজেযাওয়া ট্রাউজারস বদলাতে হয়, মোজা ধুয়ে দিতে হয়, এর সাথে অন্তর্বাস। কেউ ধোয় সপ্তাহে একবার, আমি একটু বেশিবার, যার যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য আরকি। এর কোনও নিয়ম নেই, এটা নিয়ে হৈচৈ করার কিছু নেই। পৃথিবীর কোনও কিছুরই নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম নেই। কেউ যদি অনিয়মে চলে সে নিজে ভাল থাকে এবং ওতে কারও কোনও ক্ষতি বা অসুবিধে না হয়, তবে ওই অনিয়মই তার জন্য নিয়ম। সময় ও স্থান ভেদে নিয়মের পরিবর্তন হয়। আমরা যা বুঝি না, বুঝি না বলেই বাতিল করে দিই, তারও নিজস্ব একটা ভাষা আছে। সে ভাষা আমাদের পরিচিত ভাষার মতো নয়। এমন-কী আমাদের চেনা কোনও ইশারার মতোও নয়।

কখনও এমন হয়, হয়তো আমার ধৈর্য আছে, কিন্তু আমার অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে না। আমি চাইলেই পালাতে পারি, কিন্তু আমি বন্দিত্বই চাইছি। আমি চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি, কিন্তু আমার কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। আমি কিছুই মন দিয়ে শুনি না, তবে শুনি সবকিছুই। আমার কাছে শোনার অর্থ, স্রেফ কানে আসা। আমি তাকাই, কিন্তু দেখি না। আমার রুমের সিলিংয়ে ফাটল, মেঝেতে ফাটল। আমি ওসব ফাটলের রেখাগুলিকে নিজের মতো করে জোড়া লাগিয়ে নানান ধরনের মানচিত্র আঁকি। আমার চোখের মধ্যে যে রেখাগুলি নামে আর ওঠে, আমি সেগুলির কিছু দেখতে পাই দেয়ালের ভাঁজে, মেঝের ভাঁজে। কিছু বুনো গাছ, নষ্ট কলটি থেকে জলপড়ার শব্দ, কিছু থ্যাবড়া পাথর। রাস্তায় গাড়ি ছুটছে, কিছু মেঘ একলা, আকাশ কালো হয়ে আসছে একেক সময়। এইসব দেখি, এইসব ভাবি। আমার অস্তিত্বের কোনও সীমা নেই, শুরু নেই, শেষ নেই। আমি এখানে ছিলাম, এখানেই আটকে আছি। দুটোই স্বেচ্ছায়। এর নাম নির্বাসন নয়, এর নাম যাপন। আমার যাপন চলে আমার মর্জিতেই।