এক লালপরীর নীলজীবন/ শেষ অংশ

 
‘এভাবে কেন কথা বলছ? আমরা দুজন তো গল্পও করতে পারি। কাজ কি করতেই হবে?’ ‘মানে? করতেই হবে মানে? এখানে এসেছেন কেন তা হলে, সিরিয়াসলি? এখান থেকে বের হয়ে বলবেন, পলি ভালো সার্ভিস দেয় নাই, ব্যবহার ভালো না, ফ্রেন্ডলি না, আর রবিন ভাইয়ের মার খাওয়াবেন, না?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওমা, কী বল! রবিন ভাই তোমাদের মারে? গায়ে হাত তুলে?’ মেয়েটা ওর ঠোঁটের এককোনায় উপহাসের হাসি ছড়িয়ে দিয়ে হাসতে গিয়ে থেমে গেল। আমি তার চোখের দিকে ঠায় তাকিয়ে আছি। কী জানি কথা বলতে গিয়ে থেমে যাচ্ছে সে। এবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম কী? মেয়েটা সামান্য বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আমার নাম পলি। বললাম তো একটু আগে, খেয়াল করেননি? এটা আমার ছদ্মনাম। এই লাইনে কেউ আসল নাম ইউজ করে না। এখানে নামের কোনও দাম নাই, শুধুই কামের দাম। এটা নামের না, কামের জায়গা। হা হা হা! আচ্ছা স্যার, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি ভার্জিন? মানে কখনও করেন নাই কারও সাথে? বউ গার্লফ্রেন্ড কিছু নাই? ছিলও না? কিংবা কোনও ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’ টাইপ কোনও রিলেশন…নাই?’


আমি কাঁচুমাচু হয়ে একটু হেসে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ সরি, আমি ভার্জিন। আজকেই ফার্স্টটাইম। এরকম জায়গায় আগে কখনও আসিনি। গার্লফ্রেন্ড ছিল, ব্রেকআপ হয়ে গেছে। ওর সাথে মেকআউট পর্যন্ত হয়েছে, তবে লাস্টস্টেজ পর্যন্ত যাইনি আমরা। সুযোগ পাইনি বা সাহসে কুলায়নি।’ আমার উত্তর শুনেই পলি কল কল করে হেসে উঠল। খেয়াল করলাম, পলির হাসিটাও বেশ দারুণ! ঝরনার জলের মতো কল কল হাসি। সত্যিই খুব স্নিগ্ধ সারল্যমাখা সেই হাসি।


আমি বলে চললাম, ‘শোনো পলি, সরাসরি বলি, আমি তোমার সাথে কিছুই করব না। আমি শুধু তোমার কথা শুনব। তোমার সাথে কথা বলব। তোমাকে যে আমার ভালো লাগেনি, তোমার অ্যাপ্রোচ ভালো না, এরকম কিছু না। তবে আমার ইচ্ছে করছে না, মন সায় দিচ্ছে না। প্লিজ, এটা আমার রিকোয়েস্ট। তুমি আমাকে এভাবেই সময় দাও, আমি কথা দিচ্ছি, রবিন ভাই কিছুই জানবে না। আমি দুইবার কাজের ফুলপেমেন্ট করে দিব। নো প্রবলেম! আর আমি তো লেখালেখি করি একটু, তোমার জীবনের গল্পটা আমার কাজে লাগবে হয়তো।’


‘ওরে বাবা! আপনি লেখক! আপনি পলিকে নিয়ে গল্প লিখবেন? তাই অতগুলি টাকার বিনিময়ে আমার সাথে গল্প করতে চাইছেন? বাহ্‌ বাহ্‌! এত দামি গল্প লিখবেন, স্যার…তাও আমার মতো একটা সস্তা মেয়েকে নিয়ে!...কিন্তু আমি কেন টাকাটা নেব কাজ না করেই? আমি কি ভিক্ষুক? আপনি আমাকে করুণা করতে চাইছেন?’
‘প্লিজ, এটাকে এভাবে নিচ্ছ কেন? এই যে ধরো, তুমি আমাকে সময় তো দিচ্ছ, তাই না? ওটা করলেও এই সময়টাই দিতে। তোমার সময়ের তো দাম আছে। তুমি জাস্ট তোমার সময়ের দামটা নেবে, আর কিছুই না। ওটা তো তোমার প্রাপ্য!’
…এইটুকু বলেই ওর হাতে একটা ১০০০ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘আমি তোমার ভাইয়ের মতো, এটা তুমি পার্সোনালি রাখো। এটা এক্সট্রা হিসেবে দিলাম।’
আমার দিকে কপালকুঁচকে তাকিয়ে টাকাটা হাতের মুঠোয় চেপে দলা করে পলি সেটা ছুড়ে মারল! ‘কীসের ভাই মারাচ্ছেন? আমার কোনও ভাইটাই নেই, সবাই আমার কাস্টমার। আমি কাজ করে খাই, ভিক্ষা নিই না। গল্প করছেন, ঠিক আছে, করেন। এইসব ভুগিচুগি বাদ দেন।’


এবার আমি সত্যিই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম। নার্ভাস ফিল করছিলাম। আমি এমন সময় সাধারণত চকলেট খাই। পকেট থেকে আর একটা স্নিকারস বের করে খুলে নিজে এককামড় দিয়ে ওর মুখের দিকে কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘প্লিজ, মাথাটা একটু ঠান্ডা করে চকলেট খাও, ভালো লাগবে। আমাকে যতটা খারাপ লোক ভাবছ, আমি ততটা খারাপ লোক না। আমার সাথে একটু স্বাভাবিকভাবে কথা বলো। রিকোয়েস্ট করছি!’ দেখলাম, এইবার সে কেমন জানি শান্ত হয়ে গেল, হাঁ করে আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে চকলেটে একটা কামড় দিল। আমি চকলেটের বাইরের মোড়কটা একটু নামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘পলি, খাও খাও। আমি তোমার ভাইয়ার মতো। খাও।’


খেয়াল করলাম, পলির ঠোঁটদুটো কাঁপছে, চোখদুটো ছলছল করছে, আইল্যাশ থেকে মাশকারা নিচের দিকে লেপটে যাচ্ছে। সে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো, কাজলঢাকা ওই দুচোখে সইতে-না-পারা অনেক ব্যথা, বলতে-না-পারা অনেক কথা লুকানো আছে। ঠিক এই মুহূর্তে তার চোখের অভিনয়নিপুণ কাজলও ব্যথায়-ভরা চোখের ভাষা গোপন করে রাখতে পারছে না।


আমি সস্নেহে তার মাথায় হাত রেখে বললাম, ‘এই পেশায় কেন এসেছ? পড়াশোনা কর? বাড়িতে কে কে আছেন তোমার? তোমার বাবা কী করেন?’ পলি মাথানিচু করে কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে গেল। যেন কলিজাফেড়ে নাকগলে একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে তার বুক ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেল। আমি টের পেলাম, সেই বিষাদ আমাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।


খানিক বাদে নীরবতা ভেঙে সে কথা বলতে শুরু করল। ‘আমার পরিচয় দিয়ে কী করবেন, স্যার? আমরা তো ইউজ করার জন্য, পরিচয় জানার জন্য না। বাবা-মা বাদে এই জীবনে প্রথম কেউ আমাকে এমন ভালোবাসা দিয়ে চকলেট খাওয়াল।’ সে বলে যেতে লাগল, ‘আমার আসল নাম দিনা। আয়েশা সিদ্দিকা দিনা। আমি আমাদের এলাকার একটা কলেজে অনার্স সেকেন্ডইয়ারে পড়ি। আমরা দুই বোন এক ভাই। আমাদের পরিবারে তেমন অভাব ছিল না। বাবা ছোটখাটো একটা কেরানির চাকরি করতেন। তাতে টেনেটুনে ভালোই চলত সংসার। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবা আমাদের তিন ভাই-বোনের কপালে চুমু খেতেন, আমি অনেক বড় হয়ে গেলেও বাবার চোখে কখনও ঠিক বড় হয়ে উঠিনি। বাবাকে আমি অনেক ভালোবাসি। আমি আগে থেকেই একটু অলস টাইপের। রাতে ঘুমানোর আগে সবাই নিজহাতে খেলেও আমি কখনও নিজহাতে খেতাম না। ওই যে বাবা খাইয়ে দেবেন, সে আশায়। সারাদিন ছোটাছুটি হইহুল্লোড় হাসাহাসি আর সুখেভরা ছিল আমাদের ঘরটা। আমি পরিবারের সবার বড়। আমার ছোট এক ভাই আর এক বোন।


দুই বছর আগের কথা। তখন আমি সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছি। সেদিন রোববার। প্রতিদিনের মতো বাবা সকালের নাস্তা সেরে আমাদের তিন ভাইবোনের সবার কপালে চুমু খেয়ে অফিসে গেলেন। দুপুরে বাবাকে ফোন করে বললাম, আসার সময় আমার জন্য পিৎজা আনবে। বাবা কখনও আমার কথা ফেলতেন না। পৃথিবী উল্টে যাক, সূর্যটা গলে যাক, চাঁদটা ভেঙেচুরে ঝরে পড়ুক, বাবা আমার পছন্দের জিনিস নিয়ে ঠিকই ঘরে ফিরবেন, এটাই জানতাম আমি।


পিৎজা কিনে ফিরছিলেন বাবা। রিকশায়। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে। রিকশা চলছে। হঠাৎ রিকশার ঠিক বিপরীত দিক থেকে একটা কাভার্ডভ্যান এসে বাবার রিকশাটাকে জোরে ধাক্কা মারল। বাবা রিকশা থেকে ছিটকে ১৫-২০ ফুট সামনে মাঝরাস্তায় এসে পড়লেন। ঠিক ওই সময়ই পেছন থেকে আসা আর একটা দূরপাল্লার বাস বাবার পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। একটা পা ওখানেই দুভাগ হয়ে যায়। প্রচণ্ড ব্যথায় বাবা শুধু একবার চিৎকার করে উঠেছিলেন। তার পর বাবার আর হুঁশ নেই। জ্ঞান ফেরার পর বাবা আবিষ্কার করলেন, তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। একটা পা সম্পূর্ণ আলাদা, আর একটা পা কোনওমতে ঝুলে আছে।


বাবা আমাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ডাক্তার জানালেন, যে পা-টা আছে, সেটাও ঊরুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হবে। পাঁচ সদস্যের পুরো একটা পরিবারের ভার কাঁধে নিয়ে ছুটে-চলা আমার বাবার দুটো পা-ই ফেলে দিতে হলো। আমাদের পরিবারের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেল। আমরা পথে বসে গেলাম।


জমানো কিছু টাকা আর জমিজমা যা ছিল, সব বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা করা হলো। সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে গিয়ে বাবাকে জীবিত ফিরে পেলাম ঠিকই, তবে বাবার অবস্থা হয়ে গেল মৃতের মতোই বা তার চেয়েও খারাপ। বাবা চাকরি করতে পারছেন না, মা বেকার, আর আমরা উঠতিবয়সি তিন-তিনটা ক্ষুধার্ত মুখ। বাবার পা দুটো অচল হয়ে গেলেও আমাদের কারও পেট কিন্তু অচল হয়ে যায়নি। ঋণ করতে করতে কেউ আর ঋণই দিচ্ছিল না। আমি টিউশনি ধরলাম, কিন্তু টিউশনির টাকায় পেরে উঠছিলাম না। ন্যাশনাল ভার্সিটির পলিটিকাল সায়েন্সে পড়া সেকেন্ডইয়ারের একটা মেয়ে কী-ইবা এমন টিউশনি পায়, বলুন? তখন আমার ছোট ভাই পড়ে ক্লাস নাইনে, বোন সামনের বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে। আমাদের সাজানো সংসারে ঘোরঅমাবস্যা নেমে এল।


বাবার চিন্তায় চিন্তায় মা কেমন যেন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিছুদিন আমাদের কিছু আত্মীয়ের বাসায় বাসায় গিয়ে কাজ করতেন, অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তাও আর করতে পারেন না। বাবা-মা দুজনই এবার শয্যাশায়ী। বয়স আমার তখনও ততবেশি হয়নি, কিন্তু জীবনের বাস্তবতা আমার বয়সকে টেনেহিঁচড়ে বাবার বয়সে নিয়ে গেল। চোখের সামনে কোনও পথই খোলা পাচ্ছিলাম না। আমার পড়াশোনা, বাবার চিকিৎসা, মায়ের চিকিৎসা, ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনা, পরিবারের খরচ, সবই এসে পড়ল আমার কাঁধে। আমি তখন কী করি? কে দেবে আমাকে চাকরি? কে করাবে ওঁদের চিকিৎসা? আমার ছোট ভাই-বোনকে দেখাশোনাই-বা কে করবে? সমাজ? এই দেশ? টিউশনি করে এতকিছু কুলিয়ে-ওঠা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না।


একদিন আমার এক বান্ধবীর মাধ্যমে রবিন ভাইয়ের সাথে পরিচয়। তিনি আমার অবস্থার কথা শুনলেন। শুনে বললেন, তোকে চাকরি কে দেবে? দিলেও ৮-১০ হাজার টাকার বেশি স্যালারি তো পাবি না। কী লাভ হবে তোর? তোর চোখের সামনে তোর বাবা-মা বিনাচিকিৎসায় মরে যাবে। তোর নিজের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, তোর ছোট ভাই-বোন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। কী লাভ? কে দেখবে তোদেরকে? এর পর আরও নানান কথার ছলে তিনি আমাকে সরাসরিই বললেন, শরীর বেচতে হবে, শরীর! পারবি? অনেক টাকা পাবি! সমাজের মুখে লাথি মার, তোর ঘর তো চলবে। নিজেও ভালো থাকতে পারবি। মাসে অন্তত ৩০-৪০ হাজার টাকা কামাতে পারবি। খোঁজ নিয়ে দেখ, অনেক ভালো জবেও এত টাকা স্যালারি দেয় না। কী? পারবি না?


রবিন ভাই যখন বলছিলেন, শরীর বেচতে হবে, আমার মাথায় তখন কেবলই ঘুরছিল, আমার পরিবারকে বাঁচাতে হবে। শরীর বেচতে হবে কি করতে হবে, সেটা বড় কথা না। মাসে ৩০ হাজার টাকাও যদি পাই, সেটা তো অনেক টাকা! আমাদের পরিবারটা তো বেঁচে যাবে। আমার কাছে তখন আমার এই তুচ্ছ শরীরের চেয়েও, আমার সমাজের চেয়েও, আমার পরিবার অনেক অনেক বড়। কিছুক্ষণ ভাবলাম। যদি সমাজ, লোকচক্ষু এসবের পরোয়া করি, তবে কী হতে পারে? কেউ কি এসে দুইটাকা দিয়ে যাবে? সমাজ কি আমার ঘরে পাতিলের ঢাকনাটা তুলে কখনও দেখতে এসেছে আমার ঘরে ভাত রাঁধা হয়েছে কি না আজ? না, সমাজের হাতে এত সময় নেই আমার ক্ষুধার্ত পেটে দুমুঠো ভাত-দেবার। ভাইয়া, ক্ষুধার ঘরে তো খোদাও থাকে না, সমাজ কী করে থাকবে? যে সমাজ আমার পেটের খবর রাখে না, সে সমাজের পরোয়া করে আমি আমার পরিবারকে উপোস রাখব? তা কী করে হয়?


সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এ পেশায় নামব। যখন পেটে খুদা কিলবিল করে, সমাজকে পরোয়া করার এত সময় কই? আমার ভরা রূপ-যৌবন আমি টাকায় বেচব। সমাজের অবধারিত নিয়মের মুখে লাথি মেরে আমি হয়ে গেলাম পুরাদস্তুর একজন পতিতা, মাগি, বেশ্যা---যা-ই বলেন…যাকে ভদ্রভাষায় বলা হয়: কলগার্ল। হ্যাঁ ভাইয়া, আমিই সেই কলগার্ল, যার সাথে শোয়া যায়, কিন্তু যাকে নিয়ে হাঁটা যায় না। আমিই সেই মেয়ে, যাকে জীবনে লাগে, কিন্তু জীবনে রাখা যায় না।


প্রথম প্রথম ভারি কষ্ট হতো, ঘেন্না হতো নিজের শরীরটাকে, কিন্তু আমার এই ঘৃণিত শরীর বেচে যখন আমার ঘর দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে, বাবা-মায়ের চিকিৎসা হয়, তখন আমার এই পুরুষখাদ্য শরীরের প্রতি আমার নিজেরই অনেক ভালোবাসা জন্মে গেল। হ্যাঁ, আমি এই শরীরটার অনেক যত্ন নিই, প্রপার ডায়েট মেইনটেইন করি, এমনকি জিমেও যাই। হা হা হা!


আবার পুরুষই এই শরীরটাকে ভয়ংকর কষ্ট দিয়ে ভোগ করে নেয়, যে টাকাটা দেয়, সেই টাকাটা কড়ায়গন্ডায় উশুল করে নেয়। কেউ কেউ তো ড্রিংক করে প্রচণ্ড মারধরও করে, প্রটেকশন নিতে চায় না, সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয় গায়ে, চুল আর শরীর ধরে অযথাই হ্যাঁচকা টানাটানি করে…এসবে নাকি তারা মজা পায়। বাধা দিলে বলে, বকশিস দেবো, সহ্য কর! তাও বাধা দিলে কমপ্লেইন করার থ্রেট দেয়, ধরে মারে। পলিদের এসব চুপচাপ মেনে নিতে হয়। কেউ কেউ বিয়ের অফার দেয়, আই লাভ ইউ টাভ ইউ বলে একাকার করে ফেলে, শুনে আমার খুব হাসি পায়। বুঝতে পারি, নেশায় আছে। নেশা ছুটে গেলে আমিও ঠিকই ছুটে যাব। হয়ও তা-ই!


আজকের আগ পর্যন্ত একজনকেও পেলাম না, যে একটু মমত্ব দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে পলির দিকে তাকিয়েছে। এই যে রবিন ভাইকে দেখছেন, কাস্টমারের সাথে কখনও যদি ভুল ব্যবহার করে ফেলি, উনি কাস্টমারের সামনেই অবিশ্বাস্য রকমের দুর্ব্যবহার করতে শুরু করে দেন, কখনও কখনও গায়ে হাতও তুলেন। কখনও টাকা কেটে রাখেন, পুরো টাকা দেন না। কাস্টমারদের সাথে উনি তো ফেরেশতার মতো ব্যবহার করেন, আর আমাদের সাথে তাঁর আচরণ কুকুরের চেয়েও খারাপ। ভাইকে আবার কিছু বলা যাবে না যদি আর কাস্টমার না দেয়, আমাকে আর না ডাকে, এই ভয়ে। রবিন ভাই কিন্তু আপনাকে কোনও না কোনওভাবে ব্ল্যাকমেইলও করতে পারেন। আপনার বিশ্বাস অর্জন করে আপনার মনের মধ্যে ঢুকে যাবেন, এর পর তাঁর আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে, মোক্ষম আঘাতটা করবেন। আপনি বুঝতেও পারবেন না কখন আপনি ফেঁসে গেছেন। অতএব, খুব সাবধান!


আর হ্যাঁ, আমার আয়রোজগার ভালোই হয়। দুইজন মাঝবয়সি ব্যবসায়ী আছেন, আমি যাঁদের রক্ষিতা হয়ে আছি। ওঁদের একজন আমাকে তিনটা দেশে ঘুরতেও নিয়ে গেছেন। উনি অবশ্য অন্যজনের চেয়ে একটু বেশিই বয়সি, ওঁকে বুড়োই বলা যায়। বুড়োরাই ভালো, কম পরিশ্রমে কম সময়ে বেশি টাকা আদায় করা যায় বুড়োদের কাছ থেকে। বুড়োরা চান একটু আন্তরিক সঙ্গ, একটু উষ্ণ ব্যবহার, একটু হাসিমাখা ভালোবাসা---সে ভালোবাসা হোক মেকি, তবুও…! ওঁরা প্রচণ্ড ভালোবাসাহীনতায় ভোগে! আমাকে কাস্টমারদের অনেকে খুশি হয়ে বকশিস দেয়, রেগুলার কাস্টমারদের কেউ কেউ মোবাইলে টাকা বিকাশ করে। জানেন ভাইয়া, আমি সার্ভিস দেওয়ার পর প্রাপ্য টাকার বাড়তি নেওয়ার আশায় হাতপাততে শিখে গেছি।


এই সমাজ আমাদের শরীরে ভর করেই হাঁটে। সমাজের অনেক বড় বড় মানুষের বেডরুমে পলি গেছে, ওঁদের চেহারা পলি খুব কাছ থেকেই দেখেছে। ওঁদের অনেকেই সুশীল সমাজের, টিভির টকশোতে দেখা যায়। তবুও দেখুন না, সমাজের কোথাও আমাদের কোনও জায়গা নেই। এ সমাজ ভদ্রলোকের মুখোশই চেনে কেবল, মুখটা আর চেনে না। হয়তো তা চেনার সাহসটাই করে না। এ সমাজ পলিকে হেল্প করতে পারে না, তবে জাজ ঠিকই করতে আসে একদৌড়ে। আমার পেটের খবর না রেখে যে সমাজে আমার শরীরের খবর রাখে, আমি এমন সমাজের মুখে লাথি মারি, থুতু মারি!


ভাবছেন, বাবা-মা কি জানে না আমি কী করি? আমি বাসায় জানিয়েছি, আমি একটা বিদেশি কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভের জব করি। চাকরির প্রয়োজনে আমাকে বাইরে বাইরে থাকতে হয়। এরকম আরও কিছু বানানো গল্প বাসায় বলেছি। বাবা-মা এইটুকুই জানে। এতেই তাঁরা সন্তুষ্ট। হয়তো এর চেয়ে বেশি কিছু জানার বা বোঝার উপায় কিংবা দুঃসাহস, কোনওটাই বাসার কারও নেই।’


…বলেই আর কিছু বলতে পারল না দিনা। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। দেখলাম, সামনে থাকা বালিশের পেটে শক্ত করে মুখগুঁজে সে হু হু করে কেঁদেই চলেছে। এই দৃশ্য সহ্য করে স্বাভাবিক থাকা আমার পক্ষে সহজ নয়। আমি ওয়াশরুমে গেলাম। বেসিনে কল ছেড়ে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে দিয়ে চোখ লাল করে ফেললাম। ওকে আমার অশ্রু দেখিয়ে কী লাভ?


রুমে এসে দেখি, পলি নয়, একজন দিনা তখনও কেঁদেই চলেছে। দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে বেজে চলেছে। ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ততা জানান দিচ্ছে ঘড়ি। কারও খোঁজ নেবার সময় কারও নেই। সমাজের চোখে যে একজন দেহোপজীবিনী, সেও কোনও এক পরিবারের একজন দায়িত্বশীল কর্তা। শরীর বেচে সে পাঁচটা মুখে ভাত তুলে দেয়, অসুস্থ বাবা-মায়ের দেখাশোনা করে, ভাই-বোন ও নিজের পড়াশোনার সকল খরচ চালায়। যখন এই পলিরা না খেয়ে পড়ে থাকে, তখন ওদের মুখে একমুঠ ভাত তুলে দেওয়ার দায়িত্ব কখনও সমাজের অনুভূত হয় না, অথচ পলিরা যখন পরিবার বাঁচাতে ও নিজে বাঁচতে শরীরের কাপড় খোলে, তখন আবার সমাজের চোখ খুলে একেবারে সামনে বেরিয়ে আসে। এমন সমাজের মুখে লাথি মেরেও পলিরা ঠিকই বেঁচে থাকে।


যে সময় অন্য মেয়েরা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসে বাদাম চিবোয়, বাবার টাকার আদ্যশ্রাদ্ধ করে, সে সময় পলিরা পৃথিবীর চোখে জঘন্যতম পথে নেমে আসে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে। যে সময়টাতে পলির পড়াশোনা করার কথা, ঘুরেফিরে জীবনটাকে উপভোগ করার কথা, সেই সময়টাতে ওকে গোটা পরিবারের বোঝা কাঁধে নিয়ে এক হাত থেকে আর এক হাতে বদলাতে হয়, বিছানায় শুয়ে অপরিচিত লোকজনের নিপুণ প্রেমিকা হয়ে উঠতে হয়। এ-ও একটা জীবন! সমাজের চোখে পলিরা অপবিত্র, অস্পৃশ্য, অশুচি। সমাজ ওদের আলাদা করে নাম দিয়েছে মাগি, অথচ ওদের যারা সেই ‘অপবিত্র’ করে, ওই ভদ্রলোকদের আলাদা কোনও নাম এ সমাজ দেয়নি।


দিনা এখনও কাঁদছে। ওর চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রুর ছদ্মবেশে টুকরো টুকরো স্বপ্ন ঝরে পড়ছে। সেইসব স্বপ্নে একজন অসুস্থ বাবার মুখ আছে, একজন অসুস্থ মায়ের মুখ আছে, পাঁচটি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখ আছে। সেই খোঁজ কেউ কোনও দিনই পাবে না। আমি ওকে বাধা দিলাম না। দিনা কাঁদুক, পলিও কাঁদুক! পলিদের অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়, হয়তো ওরা কাঁদার সময়টুকুই পায় না। তাই আজ সে বুক উজাড় করে কাঁদুক।


এদিকে সময় অনেক গড়ালো, প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা কেটে গেল। আমি পলির মাথায় হাত রেখে টিস্যু দিয়ে ওর চোখের জল মুছে দিচ্ছি। আচমকাই সে আমায় অবাক করে দিয়ে ভেজাচোখে আমার হাতের তালুর উল্টোপিঠে চুমু খেয়ে বলল, ‘ভাইয়া, এতটা সম্মান কেউ কখনও দেখায়নি আমাকে, এতটা স্নেহ দিয়ে কেউই কখনও বাঁধেনি আমাকে। আমাকেও ভালোবাসা যায়, শুধু শরীর নয়, আমার মনটাকেও দেখা যায় যদি দেখার সেই দৃষ্টি থাকে। পলি যতদিন বেঁচে থাকবে, আপনার কথা তার মনে থাকবে। একজন যৌনকর্মী প্রতিদিন আপনাকে মনে করবে, আপনার জন্য দুইহাত তুলে দোয়া করবে।’


সে খাট থেকে নেমে কার্পেট থেকে চকলেট আর দুমড়েমুচড়ে-যাওয়া একহাজার টাকার নোটটা নিল। এর পর আমার চোখের দিকে তার স্নিগ্ধ চোখজোড়া রেখে বলল, ভাইয়া, এই টাকাটা আমি কখনও খরচ করব না, ল্যামিনেটিং করে রেখে দেবো। এই টাকাটা আমাকে আমার কাস্টমার দেয়নি, আমার ভাইয়া দিয়েছে। একজন পুরুষমানুষ আমায় ভালোবেসে বোন ভেবে দিয়েছে। ভাইয়া, একদিন আমারও একটা সংসার হবে। আমারও একদিন সন্তান হবে। আমি ওকে এই নোটটা দেখিয়ে বলব, দ্যাখ, এই টাকাটা তোর মামা আমাকে দিয়েছে ভালোবেসে। ভাইয়া, আর এই যে স্নিকারস চকলেটটা, এটাও আমার কাছে থেকে যাবে। একদিন এই চকলেটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে, আরও পরে একসময় এটা খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে যাবে, তবু আমি কখনওই এর মোড়কটা খুলব না। এটা আমার কাছে সারাজীবনই থেকে যাবে আমার ভাইয়ার স্মৃতি হিসেবে।


…এসব কথা বলতে বলতে হাতে নোটটা আর চকলেট নিয়ে আমার হাতের উপর মাথা উবু করে রেখে দিনা আবারও হু হু করে কেঁদে উঠল। কিছু সময় কাটল নীরবতায়। এর পর চোখ মুছতে মুছতে আমার ডান হাতটা দিনা তার মাথার উপর রেখে অনেকটা অধিকার-খাটানোর সুরে বলল, ‘ভাইয়া, বোনের কাছে শপথ করো, তুমি এইসব জায়গায় আর কখনওই আসবে না! এটা আমার দাবি। একজন ভাইয়ের কাছে একজন বোনের দাবি।’


বুঝলাম, সে খুবই ইমোশনাল হয়ে পড়েছে। আমি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়ে দিনার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করলাম। ডানহাতের তর্জনী ভাঁজ করে ওর চিবুকটা ধরে মুখটা উপর করে তুলে বাঁহাতের উল্টোপিঠে ওর চোখের জল মুছে দিচ্ছি। দেখলাম, দিনা কেমন একটা স্নেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে, সব পুরুষই কাস্টমার হয় না, কেউ কেউ ভাইও হয়। সব পুরুষেরই ছোঁয়ায় কামনা থাকে না, কিছু কিছু পুরুষের ছোঁয়ায় মমতাও থাকে। সব পুরুষই পলিদের শরীর ছোঁয় না, কিছু কিছু পুরুষ পলিদের হৃদয়টাও ছোঁয়। সব পুরুষই কেবলই পুরুষ হয় না, কিছু কিছু পুরুষ মানুষও হয়।


দিনা আমার নাম্বারটা চাইল। দিলাম। মিসড কল দিতে বললাম, দিল না। বলল, ভাইয়া, আমি একদিন হয়তো তোমাকে ফোন করব। তবে কোনও প্রয়োজনে ফোন করব না। তোমার খোঁজ নিতেই ফোন করব। রাস্তাঘাটে যদি আমার সাথে দেখা হয়ে যায় কখনও, চিনতে পারবে? আমি ‘ভাইয়া’ বলে চিৎকার করে ডেকে সামনে এসে দাঁড়ালে না চেনার ভান করে সরে যাবে না তো? আমার নামটা মনে থাকবে তোমার?


পলি বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এল। পলিদের ফ্রেশ থাকতে হয়। দুজনের এমন অনেক কথাশেষে পলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আর হ্যাঁ, প্যাকেট দুটো জিনসের প্যান্টের লেফটসাইডের ব্যাকপকেটেই ছিল।


বেরিয়ে এসে রুমের দরজার একপাশে রবিন ভাই আর জয়ন্তকে দেখলাম। ওরা মোর ব্র্যান্ডের সিগারেট ফুঁকছে আর গল্প করছে। আমাকে দেখেই জয়ন্ত বলে উঠল, ‘মামা, তুমি তো ফাটায়ে দিলা! পৌনে তিন ঘণ্টা! কয়বার খেললা? তোমাকে দিয়ে হবে হবে! তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ! বেস্ট অব লাক!’ আমি কিছুই বললাম না, চোখেমুখে একটা রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে রাখলাম। রবিন ভাই আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কংগ্রাচুলেশনস! ওয়েল ডান, ভাই! সার্ভিস ঠিক ছিল তো? কোনও ঝামেলা হয়নি তো?’ মৃদুহেসে বললাম, ‘ভাই, এভ্রিথিং ওয়জ পারফেক্ট! নো প্রবলেম!’ জয়ন্ত কানে কানে বলল, ‘দুই শট খেলেছিস না? চার চার করে আট দিয়ে দে, আমারটা আমি দিয়ে দিয়েছি।’ আমি রবিন ভাইকে দুইটা ‘প্রোগ্রাম’-এর জন্য আটহাজার টাকা দিলে উনি সেখান থেকে আমাকে একহাজার টাকা ফেরত দিয়ে বললেন, ‘ভাই, এটা আপনার জন্য স্পেশাল ডিসকাউন্ট। আজকেই প্রথম এলেন…আমার নাম্বারটা নিয়ে রাখেন, একটা মিসডকল দেন। নামটা রকিব তো, না? আমি রকিব জয়ন্ত নামে সেভ করে রাখছি মনেরাখার সুবিধার্থে। নাম্বারটা ডায়াল করেন…জিরো ওয়ান এইট ওয়ান ফোর…’ এদিকে আমার মাথায় বারবারই একটা প্রশ্ন এসে এসে ধাক্কা খাচ্ছে: এই একহাজার টাকাটা ডিসকাউন্ট? না কি তাৎক্ষণিক-প্রত্যর্পণ?


ওই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আমি আর জয়ন্ত দুজন মিলে পিচঢালা রাস্তাধরে হেঁটে চলেছি। জয়ন্ত শিস বাজাচ্ছে…হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা…রাস্তার দুইধারে সারি সারি আবছাআলোর নিয়নবাতি। এক 'ঝলমলে অন্ধকার' জগতের গলি থেকে বেরিয়ে আমি প্রতিদিনের পরিচিত জীবনে ফিরে যাচ্ছি। আমার পেছন পেছন আসছে আমার লম্বা লম্বা ফেলেআসা ছায়া। নিয়নআলো আমার চোখ ধাঁধাচ্ছে না, আমার চোখ ধাঁধাচ্ছে একজন পলির জীবনের আলো। আমার মাথা নত করে দিচ্ছে সংগ্রামী, পরিশ্রমী, সৎসাহসী, আত্মনির্ভরশীল একজন পরিপূর্ণ মানুষ। পলিকে সমাজ বেশ্যা বলে, আর আমি বলছি, কোনও মহৎ-উপন্যাসের গল্পের নায়িকা সে। ওর সাথে পরিচয় হয়েছে বলেই আমি আজকে বুঝেছি, এই পৃথিবীর অলিতে-গলিতে কত জানা-অজানা গল্প থেকে যায়। এক একটা মানুষ যেন এক একটা মহাগল্প। সমরেশের দীপাবলি আমাকে যতটা টেনেছে, আজ একজন পলি টানছে তারও শতগুণ! এই টান কামনার নয়, শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার।


বন্ধু জয়ন্ত এবার চোখে কৌতুক মিশিয়ে বামচোখ টিপে আমার চলমান ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে কামার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কীরে গুরু, কেমন খেলি মালটা? বেশি জোশ না? সেইরকম প্লেয়ার কিন্তু! কয় স্টাইলে খেললি? ভালোই হয়েছে! তুই তো শালা এখন আর নিজেকে ভার্জিন দাবি করতে পারবি না! পলি তো তোকে খেয়ে দিল, মামা!’ বলেই হো হো করে হেসে উঠল। আমি মুখে শুধু ‘সেটাই সেটাই!’ ‘একদম একদম!’ জাতীয় কথাবার্তা বলে বলে ওর উৎসাহ উপভোগ করে যাচ্ছিলাম। আমার মাথায় তখনও ভাসছে আপাদমস্তক একজন সংগ্রামী নারীর ছবি। মন বারবারই বলে উঠছে, ‘তুই ভালো থাকিস রে, বোন!’


রবিন সাহেবের দেওয়া দুটো ‘প্যাকেট’ আমার পকেট থেকে বের করে জয়ন্তর হাতে ধরিয়ে দিলাম। এবার বন্ধু আমার যেন আকাশ থেকে পড়ল। মুখ হাঁ করে জিজ্ঞেস করল, ‘সরাসরি করেছিস? প্রটেকশন নিস নাই? রিস্কি হয়ে গেল না, গুরু?’
‘আরে, ব্যাপার না! সরাসরিই মজা!’
‘তা অবশ্য ঠিক। আর পলি মালটা ফ্রেশ, সমস্যা হবে না। ভালোই হলো, আমার কাজে লাগবে! দোকানে গিয়ে এই জিনিস চাওয়াটা কী যে বিরক্তিকর! থ্যাংকস রে, দোস্ত!’


আমরা হাঁটছি। এবার আমি শিস বাজাচ্ছি…চলো একবার ফির সে আজনাবি বান জায়ে হাম দোনো… নিয়নআলোর হলদেবৃষ্টিতে চোখ ভেজাচ্ছি। একইসাথে বিষণ্ণ ও উদাস অনুভব করছি। মনে হচ্ছে, আমি কাকে যেন কোথায় ফেলে এসেছি…কে যেন নেই কে যেন নেই! বুকের মধ্যে একধরনের শূন্যতা টের পেলাম। ভাবছি, এমন কি হওয়ার কথা ছিল?


আজ অনেকগুলি বছর পেরিয়ে গেছে। দিনার খোঁজ আমার আর নেওয়া হয়নি। সেও কখনওই আমাকে ফোন করেনি। কিছু সম্পর্ক শেষপর্যন্ত থেকে যায়---সকল যোগাযোগের ঊর্ধ্বে, সকল যুক্তিকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে। দিনা কেমন আছে, আমি জানি না, কখনও জানাও হবে না হয়তো; তবে, তাকে দেওয়া কথাটি আমি আজও রেখে চলেছি…আমৃত্যু রেখে যাব। কেন যাব? জানি না। আমি সত্যিই জানি না। তবে রেখে যাব, এটাই সত্য, এটাই আমার নিজের কাছে করা ধনুর্ভঙ্গ পণ!