এখনো ফানুস ওড়ে

 
খাঁটি দর্শন বলে, বসন্তের রহস্য মিথ্যে।
বোকা, দুর্দান্ত, অচেতন সময়ে, এমন-কী,
যখন সূর্যের মানসপুত্র পৃথিবী ঝড়ের কিংবা উপচেপড়া বর্ষার
নিষ্ঠুর সময়ে প্রেমের স্তোমে ব্যস্ত, তখন বছরের পর বছর ধরে
এক আলাদা রকমের ভালোবাসার জন্ম হয়।
সে ভালোবাসা পরিপক্ব এবং তাকে বিবর্ণ করে দেয়,
এমন সমস্ত ক্ষতির ব্যাপারে সচেতন।


যে তাপ সমস্ত কিছুকে জড়িয়ে ধরেছিল নীরবতার আড়াআড়িতে
এবং সবুজের পূর্ণতায়, তা হতাশ ও ক্লান্ত ঝাঁককে বাঁকের স্বস্তি দেয়।
প্রশস্ত হাসিতে পাথুরে ধার্মিকতার স্নিগ্ধ রূপটি, যা সংক্ষেপে এবং সূক্ষ্মভাবে,
যে ভাল, সে সর্বদাই বোন, ভাই, বাবা কিংবা মা---এরকম কথাই বলে……
অবশ্য তেমন সান্ত্বনায় অতৃপ্ত প্রেমিকের দল কখনো গান থামিয়ে বসে থাকে না।


আপনাদের মধ্যে কে বুকে হাত রেখে বলতে পারেন,
প্রেম ভাল কিছু নয়?
যখন আহত হওয়াই নিয়তি কেবল, এমন-কী, আহত হয়েও ফিরে আসে আগের পথে,
ব্যথার মুকুট চড়ায় মাথায়, পেছনে ফিরে তাকিয়ে হাসে---অবোধ প্রেমিক,
তার পায়ে রক্ত, কপালে রক্ত, আত্মার ফোটে হিজলের ফুল,
চোখে আর ঠোঁটে সুরের প্রবোধ, রক্তের স্রোত আগুনে ঢোকে, তখন
প্রাণ যায় যাক, ভালোবাসা-বোধেই শ্বাসটা চলে শেষ অবধি!


কে এখনো রায় দিতে চান, প্রেম মন্দ?
প্রেম---সে ধ্রুব সত্যকে কোনো অসত্যের রঙচটা মোড়কে জানতে চাই না, জানাতে চাই না।
আমরা বরং চলে যাবো সেই গানের সাথে, সুর আছে যার সবার প্রাণে, একই টানে।
একাকী রাত কাটছে, কাটুক---প্রেম-ফানুসে, হৃদয়-সুখে। বিশ্বাসখেকোরা, আজও,
ফানুস উড়ে যেতে দেখলে আলোর প্রেমে পড়ে যায়।


কোন আবেগে হৃদয়ে জাগে এমন দারুণ স্তব্ধ ব্যথা?
শোক-শ্মশানে দাঁড়িয়ে থাকে অচল পাহাড়?
চিরসবুজে দূর-অবুঝে বনের বাহার?
এক ঘণ্টা আরেকটাতে কোন ধ্বনিতে সাগর ভাসায়, পাহাড় কাঁদায়?
এমন ক্ষণে নিসর্গটা কোথায়, বলো? কোন সে নদীর উপত্যকায়?
অন্য ছবি? হোক না হলে! চারপাশটা ঘিরছে যখন রঙের নাচন,
থাকলে থাকুক গোটা কয়েক কষ্ট গোপন!
প্রেম কাঁপালে শব্দ ভীষণ বোকার মতন যত্নে দারুণ নষ্ট হতে আত্মা হতে কাগজে ছোটে!


শোক তো আসেই, যখন দেখি---
উঁচুউঁচু পাহাড় যতো, বাসে না ভালো আগের মতো। বাবুমশাই বলছে রোষে,
কাঠটা কেন কয়লা হল, সেই দায়েতে কাঠকে ধরে ফাঁসিতে ঝোলাও!
আঁধার এলো……কেন সে এলো? প্রেম অহেতুক হাজির হলো অসংকোচে কোন সাহসে?
এসব দেখে, প্রতিধ্বনির প্রতিক্রিয়া দূরে কোথাও দৌড়ে পালায়, মঞ্চে একা রাজাই নাচে!
অরণ্য আর জলজঙ্গল, নগর এসে হাওয়া করে দেয় এক পলকেই! আমি তবু
দেশ বুঝি না, আবেগ বুঝি, মৃত্যু এলে কবর খুঁজি---ভালোবাসায়, এই মাটিতেই!


যা-ই হোক, আজ তেতো স্বপ্ন, প্রতিবিম্ব……আয়নায় সব পিছলে বাঁচে।
চলছে হৃদয় অবাধ পায়ে, তখন দেখি, ভয়ের নাটাই ওড়ায় ঘুড়ি আপত্তিতে।
দরোজাটা বন্ধ করে, সম্ভবত, একটু হাসি।
একটাসময়, ইন্দ্রিয় ছয়অন্ধকারে ডুবতে দেখি……
প্রিয়ার চলমান চুলের স্রোতের মধ্যে জপমালার একটি বিচক্ষণ ঝলক ফুঁকছে, দেখেছি।
সেই রাতে আমার ঘরে উষ্ণ কিছু ভুল ক্রমাগত প্রহর গুনছিল মুক্তির লোভে।
আমি জানি না কী হচ্ছিল, তবে আমি হৃদয়কে কাঁপতে শুনেছি, আবেগকে দ্রোহ করতে দেখেছি।
আমার জীবনে কোনোকিছুই যথেষ্ট ছিল না, এবং এমন কিছু হচ্ছিল,
যা হওয়ার কথা ছিল না। তবু ভয় পাইনি, ঈশ্বরের হেঁয়ালিপনা আমার পূর্বপরিচিত, পূর্বঅনুমিত।


সময় এগোয়, একসময়। ভালোবাসাকে প্রেম আর আগলে রাখতে পারে না।
শুরু হয় যন্ত্রণার দ্বিতীয় যাত্রা---অন্ধকার, নিরুদ্দেশ।
চারণভূমি যতো, আগেই শুকিয়ে গেছে, দেখা যায়,
জলের শরীরে হাজারো হলদে খাঁজ জ্বলছে……পাখিরা তাতে স্নান করে।
গোছানো শারদদুপুরে, রৌদ্র গাছের কাণ্ড পোড়ায়,
জীবন এবং মৃত্যুর মন্ত্রবদ্ধ আঙিনা আমাদের ধ্যানের মধ্যে আরও একবার বাঁধা পড়ে।
কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি শেষে বাগানের বাসিন্দারা শান্ত হয়ে বসে,
পাখিটি তখনও কেবল গান গাইতে চায়……সে গানের ভাষা খোলাখুলি বলে,
সূর্য চলে গেছে, আমরা পাহাড় এবং নদী পেরিয়ে কোথাও যেতে চাই,
আমরা লুকিয়ে আছি, শতশত কৌতূহলী মানুষ আমাদের খুঁজে পেয়েছে……


সমুদ্রের উষ্ণ নীলজল গাছগুলিকে ভয় দেখায়, পায়ের নিচে হলুদ পাতার রাজ্য বাধে,
বোঝাবুঝির তেমন কিছু আর বাকি থাকে না, যখন বিশ্বস্ত সুখ শোককে পরাজিত করে।
আমরা সবাই মিলে দিনের আলোয় জ্বলতেথাকা দুঃখকণার দিকে তাকাই,
এবং এককণ্ঠে চিৎকার করে বলি, হাসতে পারাই জীবনের শেষকথা নয়!