এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো

 
: আসসালামু আলাইকুম, স্যার।
: ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন?
: স্যার, আমাকে আপনি চেনেন না, আমি আপনাকে জানি, ফেসবুকে দেখি আপনার সম্পর্কে, অনেক কিছু শুনি। একটু সমস্যায় পড়ে আপনাকে রিং দিলাম, স্যার।
: হ্যাঁ, বলুন। কী সমস্যা?
: স্যার, ওই যে আমার ছেলেটার বিসিএস দেওয়ার খুব আগ্রহ। ঢাকা ভার্সিটিতে টিকেছে, ভর্তিও হয়েছে মার্কেটিং-এ। ওটা নিয়ে ও চিন্তা করছে। ভাবছে, আমি তো কমার্স থেকে পাস করে এসেছি খেলাধুলা নিয়ে, এখন কি আমি ওটা পারব? তা ছাড়া ওর দুটো অপশন আছে--রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর আইআর। তো কোনটা নিলে ভালো হয়? বিসিএস দিবে তো, তাই একটু জানতে চাওয়া।
: কী কী বিষয় বললেন?
: রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর আইআর।
: এই দুটোই?
: জ্বি, ঢাকা ভার্সিটিতেই সাবজেক্ট দুটো আছে। এখন ও বলছে, আম্মু, যেভাবেই পার, একটু কষ্ট করে টাকাটা ম্যানেজ করে দাও, সাবজেক্ট চেঞ্জ করি। আর আমরা স্যার অনেক সাধারণ, আমাদের টাকাও বেশি নাই। যা-ই হোক, তার পরও বিসিএস-এর জন্য কোনটা ভালো হয়, এটা জানার জন্য ফোন করেছি।
: টাকা দিলে কি সাবজেক্ট চেঞ্জ করা যায়?
: আবার নতুন করে ভর্তি হবে, স্যার।
: ও কীসে ভর্তি হয়েছে?
: মার্কেটিং-এ, স্যার।
: মার্কেটিং-এ! মানে বিবিএ-তে?
: জ্বি, স্যার। সবাই বলছে, আইআর নাকি বিসিএস ফরেন ক্যাডারের জন্য ভালো। আমি কি ওকে আইআর-এ নিয়ে আসব, স্যার? না কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আনলে ভালো হয়, স্যার? তা হলে ম্যাজিস্ট্রেট হতে সুবিধে হবে।
: মার্কেটিং থেকে কোনওভাবেই অন্য কোনও বিষয়ে আনবেন না। ও কি পাগল নাকি! কী বলছেন আপনি! ঢাকা ভার্সিটির মার্কেটিং বিভাগে একটা ছেলে চান্স পেয়েছে, আর তাকে আপনি আইআর-এ এনে ভর্তি করাবেন! তাও বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য? আইআর থেকে ফরেনে আসা সোজা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে অ্যাডমিনে, এসব অদ্ভুত ধারণা কে দিল আপনাকে? আবার বলছেন, এর জন্য মার্কেটিং চেঞ্জ করে ফেলবেন! এ বুদ্ধি আপনাকে কে দিয়েছে? কী কারণে এইসব করতে চাইছেন, বলুন তো?
: আমি কিছু জানি না, স্যার। আমি তো অত লেখাপড়া করি নাই।
: না না, ঠিক আছে, বুঝতে পারছি। ওকে এই বুদ্ধিটা কে দিয়েছে?
: ওর বন্ধুরা। ওরা ওকে বলেছে ও নাকি মার্কেটিং বুঝবে না, ওটা অনেক কঠিন। তা ছাড়া আইআর বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়লে নাকি বিসিএস ক্যাডার হওয়া সহজ হবে।
: এখনও ক্লাসই শুরু করতে পারল না ঠিকমতো, আর আপনারা ধরে নিচ্ছেন ও পারবে না! আইআর কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করতে হয় না? আর ও বিসিএস দিবে না কী দিবে, এটা নিয়ে এখন কথা বলার কী আছে? জীবনে করার মতো আর কিছু নাই? সামনের চার বছর পর ওর ইচ্ছে, সুযোগ, সামর্থ্য কেমন হবে, এটা নিয়ে আপনারা জানলেন কী করে? চাকরি করতে পারে, ব্যবসা করতে পারে, বাইরে চলেও যেতে পারে। আবার অন্য কিছুও তো হতে পারে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীরা কেউই বিসিএস ক্যাডার নয়। আপনি কি চান না আপনার সন্তান নিজের মতো করে ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠুক? ওর মাথা এই অল্প বয়সেই নষ্ট করে দিচ্ছেন কেন? আর ওর কথা এত শোনার কী আছে? ওর বয়সের একটা ছেলে কী বোঝে? কতটুকুই-বা বোঝে? ওর কথা আমলে নিচ্ছেন কেন? ওকে যারা বোঝাচ্ছে, ওরাও ওরই বয়সি। ওদের মাথায় কী এমন বুদ্ধি আছে? জীবনকে ওরা চেনেই-বা কতটুকু?
: স্যার, আমরা এত বুঝি না তো! এজন্যই তো ওকে সব সময় আপনাকে ফলো করতে বলি।
: আমাকে ফলো করা না করায় কিছু এসে যায় না। জীবনের একটা দর্শন থাকা প্রয়োজন। আবার সে-দর্শন সময়ের সাথে সময়ের দাবিতে বদলে যেতেও পারে। আর আমি বলি কী, বিসিএস-এর চিন্তা আপনি বাদ দিন। সে তো এখনওপড়াশোনা শুরুই করে নাই। ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসই শুরু করে নাই। সে যে বিসিএস ক্যাডারই হবে, সেটা আপনাকে কে বলেছে? বিবিএ কমপ্লিট করার পর উদ্যোক্তাও তো হতে পারে। স্বাধীনভাবে চলবে, সম্মান নিয়ে বাঁচবে। অনেক মানুষের জীবিকার সংস্থান করবে, অনেক পরিবারের বেঁচে-থাকার একটা উপায় করে দেবে।
: আসলে আমাদের আগ্রহ ওটাই, মানে বিসিএস। তার নিজেরও একই আগ্রহ।
: ওর আগ্রহ ওটা? ভালো! শুনুন, এই আগ্রহ পরে চলেও যেতে পারে। আমারও তো আগ্রহ ভিন্ন ছিল। আমি কি পেরেছি সেখানে যেতে? কিংবা পরবর্তীতে চেয়েছি সেখানে যেতে? আপনার ছেলে মার্কেটিং-এ পড়াশোনা করে দেখা যাবে, আপনারা যা ভাবছেন, তার চেয়ে অনেক ভালো কিছু করেছে। বিসিএস ক্যাডারের চাকরি তো একটা সরকারি চাকরি মাত্র। জীবনে বিসিএস ক্যাডার হব--এই লক্ষ্য খুব ছোট একটা লক্ষ্য, তেমন আহামরি কিছু না। এমনও হতে পারে সে সত্যিই উদ্যোক্তা হয়ে গেছে। নিজে চাকরি করছে না, বরং শত শত মানুষকে চাকরি দিচ্ছে। এটা অনেক শান্তির, স্বস্তির, গৌরবের। আপনি নিজের চোখে দেখে আনন্দ পাবেন। কী? হতে পারে না এমন? ও ব্যবসাবাণিজ্যই করবে, তাও তো হতে পারে। ডিপার্টমেন্টে ভালো রেজাল্ট করে শিক্ষকও হয়ে যেতে পারে। দেশের বাইরে যেতে পারে, ওখানে আরও পড়াশোনা বা চাকরি করতে পারে। দেশে বিসিএস ছাড়া আর চাকরি নাই? যারা বিসিএস ক্যাডার না, ওরা ভালো নেই? একটা গোটা জেনারেশন বিসিএস-জ্বরে আক্রান্ত! গবেষণার দিকে ঝোঁক কমছে, অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার কোনও খোঁজ নেই! আর ও এখনও পড়াশোনাই শুরু করতে পারল না, ক্যাম্পাসে একটু হেঁটে বেড়াতেই পারল না, আর এখনই আপনি ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন চাকরির কথা! কোনও মানে হয়? সবচেয়ে বড় কথা,আপনার মাথায় এই ধরনের ধ্বংসাত্মক বুদ্ধি কে দিল যে মার্কেটিং থেকে এনে আইআর বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দিয়ে দেবেন একটা স্টুডেন্টকে!
: এই জন্যই স্যার সাহস করে আপনাকে ফোন দিলাম।
: এরকম কিছু করার প্রশ্নই আসে না। আপনাকে পুরো পৃথিবীর যে কেউ যদি এর ব্যতিক্রম কিছু বলে, আমি আপনাকে শতভাগ দায়িত্ব নিয়ে বলছি, উনি না জেনেই কথাটা বলছেন। আপনি মার্কেটিং থেকে আইআর কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টে ছেলেকে শিফট করারপ্রশ্নই আসে না। সত্যি বলছি, একেবারে প্রশ্নই আসে না। ও মার্কেটিং-এ ভর্তি হয়েছে, সুবাহানআল্লাহ্‌! এখানে অনেকে চান্সই পায় না। ঢাকা ভার্সিটির মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট কী, আপনি বোঝেন? কোনওভাবেই আপনি সেখান থেকে ওকে ছাড়িয়ে আনবেন না। আর যদি নিতান্তই বিসিএস দেয় তো দিবে! সমস্যা কোথায়? বিসিএস পরীক্ষার সাথে তো নির্দিষ্ট কোনও সাবজেক্ট বা ভার্সিটির প্রেমও নাই, শত্রুতাও নাই। বিসিএস পরীক্ষা দিতে কেবল একটা গ্রাজুয়েশনের সার্টিফিকেট লাগে, সেটা যে সাবজেক্টেরই হোক, যে প্রতিষ্ঠানেরই হোক। আরও চাকরি আছে, ব্যবসা আছে, অন্যান্য রাস্তা আছে। আচ্ছা, বলেন তো, আপনাকে এ বুদ্ধি কে দিয়েছে? উনার নাম্বারটা দেন! ফোন করে ঝাড়ি দিই একটু! হাহাহা…
: স্যার, আর একটা ব্যাপার। ও বলছে, আব্বুর বেতন কম, প্রাইভেটে দিতে পারবে না। মার্কেটিং-এ পড়ার সময় আমি প্রাইভেট পড়তে পারব না। তা হলে রেজাল্টও ভালো হবে না।
: মার্কেটিং-এ প্রাইভেট পড়তে হয়!! ভার্সিটির একটা ছেলেকে ভালো রেজাল্ট করার জন্য প্রাইভেটে যেতে হয়! আপনারা আসলে কিছুই জানেন না! এ কথাগুলো আপনাদের বা ওকে কে বলেছে? একটা স্টুডেন্টকে যদি ভার্সিটিতে পড়ার জন্য প্রাইভেটে যেতে হয়, তবে সে ভার্সিটিতে চান্স পেল কেমন করে? কীসের জন্য ভার্সিটিতে পড়তে হবে তাকে? যাকে প্রাইভেট পড়ে ভার্সিটিতে পাস করতে হয়, তার ভার্সিটিতে পড়ারই কোনও দরকার নাই। পাবলিক ভার্সিটির কোন ছেলেটা প্রাইভেট পড়ে, দেখান তো? ঢাকা ভার্সিটির মার্কেটিং-এর স্টুডেন্টরা প্রাইভেট পড়ে? আজব! এগুলো আপনাদের কে বলেছে? কার উর্বর মাথা থেকে কথাগুলো বের হলো? বিষয়গুলো না জানলে জেনে নেন। কিন্তু না বুঝে এমন উদ্ভট ধারণা মাথায় নিয়ে বসে থাকবেন না।
: স্যার, আপনি একটু ওকে বুঝিয়ে দেন।
: না, আমি ওর সাথে কথা বলতে পারব না। দেখা যাবে, মাথা গরম করে বেচারাকে বকাঝকা করতে শুরু করে দিয়েছি!আমি আপনাকে বলছি। আপনি ওর মা, আপনি ওকে বললেই এনাফ। সে যদি আপনার কথা না শুনে, তবে আমি কোথাকার কে! আমার কথা কেন শুনবে নিজের গর্ভধারিণী মায়ের কথা না শুনলে! আপনি কী বলেন এগুলো! আমি আপনাকে যেটা বলছি, বুঝেশুনে বলছি, না বুঝে বলছি না। সে মার্কেটিং ছেড়ে আইআর কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আসবে…পাগল নাকি ছেলেটা! ও যদি এটা নিয়ে অন্য কিছু বলে, তবে কিছুতেই আপনারা ওর কোনও কথা শুনবেন না। আর ওর যদি সত্যিই কারও কাছে প্রাইভেট পড়তে হয়, টিউশনি করে প্রাইভেট পড়বে। ও ক্লাসে মন দেয় না, সেটার দায় আপনাদের না, ওর নিজের। তাই সে-দায়িত্ব আপনারা কেন নেবেন? আমি চুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর আজ পর্যন্তবাসা থেকে একটা পয়সাও নিই নাই। নিজের খরচ, এমনকি পরিবারের প্রায় সবার খরচও নিজে বহন করেছি, আজও করছি, সব সময়ই করে যাব। এটার মধ্যে আত্মসম্মান আছে, আনন্দ আছে। সে মার্কেটিং-এ ভর্তি হওয়ার পর আপনারা বাসা থেকে ওকে একটা পয়সাও পাঠাবেন না। ওকে বলবেন, “তুই টিউশনি করে পড়াশোনা করবি। নিজের খরচ নিজেই চালাবি।” টিউশনি করলে মান যায় না, হাত পাতলে মান যায়--সেটা যদি নিজের বাবার কাছেও হয়, তাও। আপনারা বড়জোর প্রথম ৬ মাস টাকা পাঠাবেন। ৬ মাস পর থেকে একটা পয়সাও আরপাঠাবেন না। ওকে পৃথিবীর পথে হাঁটতে দিন। হোঁচট খেয়ে খেয়ে জীবনটাকে চিনুক। না হলে পরবর্তীতে পঙ্গু হয়েই জীবন কাটাবে। কারও উপর নির্ভর করে চলাটা এক ধরনের বদভ্যাস। এরকম অনেককেই দেখেছি, যাদের মধ্যে ন্যূনতম আত্মমর্যাদাবোধ নেই, লজ্জা নেই, অন্যের কাঁধের বোঝা হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এই শিক্ষাটা অনার্স ফার্স্ট ইয়ার থেকেই ওর মধ্যে ঢুকিয়ে দিন, ও মানুষ হয়ে উঠুক। আর আপনার পরিবারের আর্থিক অবস্থা যেহেতু খারাপ, সেহেতু তার দায়িত্ব, টিউশনি করে পড়াশোনা করা, নিজের খরচ নিজেই চালানো। ওকে ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন, কয় জন বাবা-মা পারেন এটা করতে? আর কত করবেন? কেন করবেন? ওকে পঙ্গু করে রাখবেন না। ওর এইসব কথাকে আপনি প্রশ্রয় দিবেন না। ও মার্কেটিং-এ ভর্তি হয়েছে, ওখানেই পড়তে দেন। ওকে ওখানেই পড়তে হবে। আমি তার সাথে কথা বলব না। কারণ, তার কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। আমি তো প্রথমে আপনার কথা বুঝি নাই। অন্যমনস্ক ছিলাম, আমি ভেবেছি, আইআর ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান, এই দুইটার মধ্যে কোনটাতে ভর্তি হবে, আপনি আমাকে তা জিজ্ঞেস করছেন। সে মার্কেটিং ছেড়ে এই দুই সাবজেক্টের কথা ভাবছে…পাগল নাকি! মার্কেটিং অনেক ভালো সাবজেক্ট। ওই দুই সাবজেক্ট খারাপ না, তবে মার্কেটিং ছেড়ে ওগুলিতে যাওয়ার কোনও কারণ দেখি না। আর বর্তমানে কে কোন সাবজেক্টে পড়ল, তার সাথে ক্যারিয়ারের তেমন কোনও মিলই থাকবে না। সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করে তুখোড় কাস্টমস কর্মকর্তা--আমার এমন একজন কলিগ আছেন। সে ডাক্তারি করতে পারবে না, ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করতে পারবে না। ওগুলো তো প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল জিনিস। ওর করার মতো অনেক কিছুই আছে। কেউ বাংলায় পড়েও ব্যাংকে চাকরি করে, কেউ ফাইন্যান্সে পড়েও ব্যাংকে একই পোস্টেই চাকরি করে। দুইজনের ক্যারিয়ার কিন্তু একই রকমের। সাবজেক্ট বা ভার্সিটি নিয়ে এত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আসল কাজ, নিজেকে জব মার্কেটের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলা।
: সেটাই, স্যার। আমি বলেছি, তোকে যদি হেল্প করতে হয়, আমি করব। তোকে আমি সাপোর্ট দিব। ৫ বছর আমি তোকে দিব। তুই পড়।
: কীসের সাপোর্ট? কী বলছেন আপনি! ও টিউশনি করবে। কষ্ট করে মানুষ হবে। আপনি টিউশনি করতে না দিলে, আপনার ধারণা, সে রাতদিন পড়াশোনা করবে? মোটেও না! ঘুরে বেড়াবে, আড্ডা মারবে, আপনার টাকায় নির্লজ্জের মতো প্রেম করে বেড়াবে। এমনকি সঙ্গদোষে নেশাকরাও শুরু করে দিতে পারে। ওর মাথায় এমনিতেও তো বুদ্ধি কম, ওর কথাবার্তা শুনে বুঝেন না? মার্কেটিং-এ ভর্তি হওয়ার পর থেকে সে টিউশনি করবে। এই কয়েক দিন ওকে সাপোর্ট দেন, সামনে যখন হলে সিট পাবে, তখন আপনাদের আর প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা পাঠানো লাগবে না। প্রতিমাসে ওটা বেঁচে যাবে, ওটা অন্য কাজে লাগাবেন। আর ওকে টিউশনি করতে বলবেন। টিউশনি করে পড়াশোনা চালাতে বলবেন। ধাক্কা খেয়ে শিখতে বলেন। পৃথিবীর পথে হাঁটতে বলেন। ধাক্কা না খেলে, কষ্ট না করলে জীবনে মানুষ হবে না। তা ছাড়া টিউশনি করলে ওর মন ও মস্তিষ্কের সুস্থ চর্চাটাও বজায় থাকবে।
: আমি তা হলে ওকে আর হেল্প করব না। দরকার নাই। সাবজেক্টও চেঞ্জ করিয়ে দেবো না। ও ওটা নিয়েই পড়ুক। যা হয় হোক। লাথি খেয়ে মানুষ হোক।
: আপনি হেল্প করবেন প্রথম ৬ মাস। ও তো এখন হলে সিট পায় নাই, মেসে থাকে, সে-খরচটা আপাতত দেন। হলে উঠে যেতে বলেন, একটা টিউশনি ম্যানেজ করতে বলেন, কোথাও ক্লাস নিতে বলেন। পাখির বাচ্চা যখন ছোট থাকে, তখন তো মুখে তুলে খাওয়ায়ে দিতে হয়। এর পর সে নিজে খেতে পারে, নিজেই উড়তে পারে, তাই না? আপনি তাকে ৬ মাস হেল্প করবেন আর্থিকভাবে। এর পর বলবেন, বাবা, তোর বাবা তোআর্থিকভাবে খুব একটা স্ট্রং না, তুই দুই-একটা টিউশনি করে পড়াশোনা কর। টিউশনি করলে ওর বেসিকও স্ট্রং হবে। ওর এখন বয়সই-বা কত, বুঝেই-বা কতটুকু, বলেন! আমরা টিউশনি করেছি বিধায় আমাদের বেসিকটা স্ট্রং হয়েছে। টিউশনি না-করলে ম্যাট্রিক-ইন্টারের পড়া সব ভুলে যাবে। চাকরির পরীক্ষায় ওই পড়াটাই বেশি কাজে লাগে। চর্চা না-করলে বেসিকে মরিচা পড়ে যায়। ওকে টিউশনি করতে বলেন, ভালো করে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা করতে বলেন, ইউনিভার্সিটি লাইফটাকে এনজয় করতে বলেন। ওর বান্ধবীকে বাদাম খাওয়াতে মন চাইলে সেই বাদাম-কেনার পয়সাটা আগে কামাতে বলেন। নিজের টাকায় সুখ পাওয়া ভালো, এমনকি নিজের টাকায় দুঃখ পাওয়াও ভালো। যাকে পানির বালতিটা নিজের হাতে বহন করে আনতে হয়, সে কখনও পানি নষ্ট করার কথাও মাথায় আনে না। নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। পুরুষমানুষের দর্শন হবে এরকম--আগে ইনকাম, এর পর খরচ। জীবনটাকে ঠিকভাবে কাটাতে বলেন, বাকিটা এমনিই হবে, আপনাআপনিই হবে। ক্যারিয়ারের জন্য এখন ভাববার কিছু নাই, ওই ভাবনা সময় হলে এসে যাবে। জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বিসিএস ক্যাডার হওয়া খুবই ক্ষুদ্র একটা লক্ষ্য। ওর স্বপ্নটাকে এতটা সীমিত গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলতে নিষেধ করুন। অন্য দশজনের শেষ হয় আকাশে গিয়ে, ওর শুরুটাই হোক আকাশ থেকে। চোখকান খোলা রাখতে বলেন, অনার্স-লাইফটা ফাজলামো করে কাটিয়ে দেওয়ার জিনিস না। ওকে এমন করেই ভাবতে শেখান, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রাখতে শেখান। আপনি শুনবেন না তো ওর এসব কথা, কেমন?
: আচ্ছা, স্যার।
: ঠিক আছে। ভালো থাকবেন।
: স্যার, আর একটু সময় নেব। আমার পরিচয়টা দিই। আপনি কুড়িগ্রামে ছিলেন, স্যার। আপনার কথা সব সময় শুনি।
: হ্যাঁ, আমি কুড়িগ্রামে ছিলাম। লালমনিরহাটের দায়িত্বেও ছিলাম। খুবই সুন্দর জায়গা!
: লালমনিরহাটেও ছিলেন!
: জ্বি, আমি লালমনিরহাটেও অফিস করতাম।
: আমি কুড়িগ্রামে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে মাস্টাররোলে চাকরি করি, স্যার।
: আচ্ছা আচ্ছা, ভালো।
: খেতে গেলে আপনার কথা বলে সবাই। আপনারা অফিসের সবাই একটা পরিবারের মতো ছিলেন। সবাই আপনার বিভিন্ন গল্প করে।আমি এজন্য আপনাকে জানি, নাম্বারটাও পেয়েছি।
: না না, ঠিক আছে।
: সেজন্যই আপনাকে ফোন দিলাম। কিছু মনে করবেন না, স্যার। ছেলের জন্য ফোন দিতে হলো।
: না না, এগুলো ও না বুঝে বলছে। ছোট মানুষ, ঠিক হয়ে যাবে। তবে কখনও প্রশ্রয় দেবেন না। এই বয়সের অনেকেই না বুঝেই খুব কনফিডেন্টলি ভুলভাল কথা বলে।
: না স্যার, আমার ছেলে ভালো ছেলে। আমি ওকে বুঝাই, ওকে বুঝালে কিন্তু ও বুঝে।
: আপনারা ওকে বলেন, যা সাপোর্ট দিতে হয়, দেবো। কোনওসমস্যা নাই। তুমি পড়াশোনা করো, আর পাশাপাশি দুই-তিনটাটিউশনি করো। নিজের খরচটা নিজে চালাও। আত্মসম্মানবোধ তৈরি করতে শিখো। নিজের খরচ নিজে চালালে তোমার নিজের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা বাড়বে, দায়িত্ববোধ বাড়বে। পরনির্ভরশীল হয়ে যারা বাঁচে, সারাজীবনেও ওদের মেরুদণ্ড সোজা হয় না। ওদের লজ্জাশরম একসময় চলে যায়, আরও পরে গিয়ে ওরা অথর্ব হয়ে যায়। নিজের অবস্থার জন্য পুরো পৃথিবীর উপর দোষ চাপায়। অবশ্য, যদি আপনাদের অঢেল সম্পদ থাকত, তা হলে ভিন্ন ব্যাপার ছিল। ধনী মানুষের সন্তানের এত কিছু না-করলেও চলে! হাহাহা…যা-ই হোক, আপনি এগুলো ওকে বোঝাবেন। বোঝালে দেখবেন, একদিন সে জীবনে অনেক ভালো কিছুকরবে। আপনাদের খুশি করবে। আর বিসিএস ক্যাডার হবে, না অন্য চাকরি করবে, না গবেষণা করবে, না ব্যবসা করবে, না দেশের বাইরে চলে যাবে, এইসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। বিসিএস বিসিএস করে ওর মাথাটা নষ্ট করে দেবেন না। অনার্সের সাবজেক্টের সাথে মানুষের জীবনের সমৃদ্ধি কোনওভাবেই সম্পর্কিত নয়। আপনার ছেলেকে বলেন নিয়ত ঠিক রাখতে, যদি রাখতে পারে, নিয়তি ওকে ঠিক পথেই রাখবে।
: বলব, স্যার। আমি তো ওকে ছোটবেলা থেকে বিকেএসপি’তে পড়িয়েছি। ওখান থেকে বের হয়ে এসে সব ভার্সিটিতে টিকেছে।
: আপনার ছেলে তো সত্যিই ভালো ছেলে। আর ঢাকা ভার্সিটির মার্কেটিং-এ চান্স পাওয়াটাই তো কঠিন ব্যাপার। ওখানে চান্স পেয়েছে, তার মানে সে স্টুডেন্ট হিসেবে ভালো, সেটা আমি বুঝতে পারছি।…তো ঠিক আছে, আপনি তা হলে ওকে ওভাবে করে গাইডলাইন দেন, কেমন? আর, আপনার ইমেইল অ্যাড্রেসটা আমাকে দিয়ে রাখেন, আমি আমার বিসিএস সংক্রান্তলেখাগুলি একটা পিডিএফ করে আপনাকে দিয়ে দেবো, মাঝেমধ্যে সেগুলো তাকে পড়তে বলবেন। তা হলে সে কিছুটা গাইডলাইন পাবে। তবে ওর যে লাইনে যেতে ইচ্ছে করে, ওকে সে লাইনেই যেতে দেবেন, নিজের ইচ্ছেটা ওর উপর চাপিয়ে দেবেন না। আমার ওয়েবসাইটে ঢুকে আমার কিছু লেখা পড়তে বলতে পারেন, কাজে লাগবে। www.sushantapaul.com ঠিকানায় আমার লেখা ও বক্তৃতাগুলি পাবেন। সবচাইতে বড় কথা, ওকে ওর পড়াশোনাটা ঠিক করে করতে বলবেন। দেখবেন, ও ডিপার্টমেন্টে প্লেস করে বসে আছে। যে বন্ধুরা ওকে বলেছে, ও মার্কেটিং নিয়ে পড়তে পারবে না, মার্কেটিং অনেক কঠিন সাবজেক্ট, ও যেন ওদের সাথে আর কখনও না মেশে। ওকে বলেন রেজাল্টের মাধ্যমে ওদের কথার জবাবটা দিয়ে দিতে। ও আপনাদের যা বলছে, তা না বুঝেই বলছে এবং সে এখনও ছোট বলেই বলছে। তার বুদ্ধিসুদ্ধি হলে সে এটা কখনওই বলত না।
: আসলে স্যার আমরাও তো আর অত বুঝি না। কেউ কখনও এভাবে করে কিছু বলেও না।
: ওই পোলাপান বলছে, তুই রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা আইআর-এ পড়। এগুলো পড়লে বিসিএস ক্যাডার হওয়া সোজা হবে। ওরাদুনিয়াটা চিনে কতটুকু, বলেন! এই রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা আইআর-এ পড়লে দেখা যাবে, তার মধ্যে কোনও কম্পিটিশন-সেন্সই গ্রো করবে না। মার্কেটিং-এ তো একটু খাটতে হয়, পড়াশোনা করতে হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা আইআর-এ কি আর অত চাপ আছে? দেখবেন, সারাদিন প্রেম করে বেড়াবে, এর পর পরীক্ষার সময় এলে পড়াশোনা করবে। আরে বাবা, ভালো একটা টিউশনিও তো পাবে না! মার্কেটিং-এ পড়লে অন্তত কিছু টিউশনি পাবে, কোচিং-এ ক্লাস নিতে পারবে। তবে সব কিছুরই ব্যতিক্রম কাহিনিও আছে। একেক মানুষ একেক রকমের। আপনার ছেলে ওরকম ব্যতিক্রম কিছু তো নাও হতে পারে, তাই না? বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য মার্কেটিং ছেড়ে আইআর পড়বে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়বে! আইআর-এ পড়লে ফরেন ক্যাডার হওয়া সোজা, আর অ্যাডমিনের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান! কী সব অদ্ভুত বাজে কথাবার্তা মেনে নেন আপনারা! আপনারা এগুলো আর কখনও শুনবেন না, কেমন?
: না না, ঠিক আছে, স্যার। আমি তো বুঝতেই পারিনি। এই মুহূর্তে নতুন ভর্তির ১২ হাজার টাকা ম্যানেজ করতে কত জনকে যে ফোন দিতে হচ্ছে আমাকে! অথচ, না হলে আমার বাড়তি কোনও ঝামেলাই করা লাগে না। ও তো ভর্তি হয়েই গেছে একটা সাবজেক্টে! ও সেটা নিয়েই ওর বাবার টাকা দিয়ে পড়াশোনা করতে পারছে।
: সেটাই! যেটাতে ভর্তি হয়েছে, সেটাতেই পড়তে বলেন। বাকি চিন্তা বাদ! ওর বয়সে ছেলেমেয়েরা অনেক টাইপের চিন্তা করে, যেগুলির বেশিরভাগই ভ্রান্ত। আগে বুঝে না, পরে লাথি খেয়ে বুঝতে পারে।
: স্যার, লালমনিরহাট আসা হয় না আর? আমার বাসা লালমনিরহাট শহরেই।
: না। ওই দিকে আসা হয় না। এটা তো আসলে চট্টগ্রাম থেকে অনেক দূরে!
: খালা আছে, আপনার মা। সারাক্ষণই আপনার কথা বলেন, একদম সারাক্ষণ বলেন।
: কোন খালা?
: খালা, রান্না করে খাওয়ান যিনি।
: আপনি উনাকে চিনেন কীভাবে?
: স্যার, আমি তো বললাম, আমি ওখানে কাজ করি।
: আচ্ছা। আপনি কোথায় কাজ করেন? লালমনিরহাটে?
: না না, আমি কুড়িগ্রামে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে মাস্টাররোলে আছি, স্যার।
: আমি থাকাকালীন ছিলেন না বোধহয়।
: না, স্যার। আপনি চলে আসার পর জয়েন করেছি।
: ও আচ্ছা, আপনি আমাদের অফিসে কাজ করেন?
: জ্বি জ্বি।
: খালা তো আমার মায়ের মতো। খালার মতো ভালো মানুষ হয় না। সত্যিই অসাধারণ মানুষ। এরকম স্নেহশীল ও আন্তরিক মানুষ বেশি দেখি নাই। একেবারে মায়ের মতন মন নিয়ে মানুষকে ভালোবাসতে পারেন উনি। এরকম মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।
: খালার মুখে প্রতিদিন শুনতে শুনতে আপনি আমার পরিচিত হয়ে গেছেন। আমি এজন্যই আপনার নাম্বারও সেভ করে রেখেছি।
: না, ঠিক আছে। আমি দোয়া করি, আপনার ছেলে ভালো কিছু করবে। আমি চাই, সে জীবনে একজন ভালো মানুষ হোক। ওর রিজিক যেখানে ঠিক করা আছে, সেখানে ও যাবেই। পুরো পৃথিবী মিলে না-চাইলেও যাবে। আমি এটা বিশ্বাস করি। আর যদি কখনও মনে হয়, আমার পক্ষ থেকে সহযোগিতা দরকার, আপনি নির্দ্বিধায় ফোন করবেন। আমি তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করব। কিন্তু ওই যে বললাম…তাকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে বলেন, যেটা আপনাদের খুশি করবে। সে যদি নিজ পায়ে দাঁড়ায়, সবাই ওকে সম্মান করে, পরিবারের ও সমাজের মানুষের জন্য ও কিছু করতে পারে, তখন এসব দেখে আপনাদের অনেক শান্তি লাগবে। বুঝেছেন? ঠিক আছে, ভালো থাকবেন।
: সময় পেলে আসবেন স্যার আমাদের এদিকে।
: আসব, ইনশাআল্লাহ্‌।
: কিছু মনে করবেন না, স্যার। আমি অনেক সাহস করে ফোন দিয়ে দিয়েছি, স্যার।
: না না, ঠিক আছে। ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম।
: অনেক ধন্যবাদ। ওয়ালাইকুম আসসালাম, স্যার।