কখনও অতীত

বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছে রেশমি। ছেলেটা স্কুলে, এই বছরই ভর্তি করানো হলো। বর অফিসে। চেয়ারে বসে বসে সে তার ভেতরে নতুন সত্তার হৃৎস্পন্দন অনুভব করছে।


বারান্দা থেকে দেখছে ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ততা। সেও একদিন এমন ব্যস্ত ছিল। কখন যে ওইসব সোনালি-রুপালি দিনগুলো ফুরিয়ে পালিয়ে গেল, বুঝতেই পারল না সে। অবশ্য, সুন্দর সময়গুলো নাকি এরকমই দ্রুতই কেটে যায়। এটা সেটা ভাবতে ভাবতে রেশমি কলেজলাইফের দিনগুলোতে ফিরে গেল। মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। অথচ হিসেবে তো দশ বছর আগের কথা!


কলেজ লাইফে সে উড়ে বেড়াত এ ডাল থেকে সে ডালে। কত বন্ধুবান্ধব ছিল, সবাই মিলে কত ঘোরাঘুরি করত। পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল বলে তাকে নিয়ে বাড়িতে আহ্লাদেরও সীমা ছিল না, আর সেজন্যই ওর অতসব দুষ্টুমিকে সবাই সহজভাবেই গ্রহণ করত। কেউ ওকে কখনওই কিছু বলত না। মেয়েরা সাধারণত যেরকম কড়া শাসনে বড়ো হয়, রেশমি সেসবের কিছুই দেখেনি। ভারি সুন্দর আর সাজানো-গোছানো ছিল দিনগুলি।


সে যে এত ভালো সংসারী হয়ে উঠবে, এটা সে ভাবেইনি কোনও দিন। তার এখন বেশ ভালোই লাগে কোমরে চাবি ঝুলিয়ে হাঁটতে। রেশমি উপভোগ করে নিজের এই গিন্নিপনা।


বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গলে গলে হালকা রোদ আসছে। হঠাৎ ওর মনে পড়তে লাগল একটা ভারী কণ্ঠস্বর।


‘রেশমি, তোমাকে রেশমি চুড়ি কিনে দেবো। পরবে? তুমিও ঠিক রেশমি চুড়ির মতন, শুধুই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।’
‘দেখো, একদিন তোমার আর আমার আলাদা আলাদা ঘরে ফিরতে হবে না, কয়েক বছর পরে আমরা একসাথে একই ঘরে ফিরব।’
‘চলো, আজ আমরা সংসদভবনের ওখানে যাব, তোমায় আমি কৃষ্ণচূড়া ফুল এনে দেবো।’
‘আমরা আজকে ক্লাস ফাঁকি দেবো, বই-খাতাগুলোকে আজ আম-কাঁঠালের ছুটি দিলাম!’


রেশমি মনে মনে ভাবে, আচ্ছা ‘সে’ কেমন আছে? তার নামটা…না না, বলা যাবে না, দেয়ালেরও তো কান থাকে, আরাফ যদি শুনে ফেলে? রেশমির মাথায় কত কী যে আসছে এক এক করে!


আচ্ছা, হঠাৎ ওর কথাই কেন মনে পড়ল? আমি তো ওর কথা ভাবতে বসিনি। আমি আর কেন কিছুই মনে করতে পারছি না? শুধুই ওর গলার আওয়াজ আর ওর মুখটাই আমার এখন মনে পড়ছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যেন সবই! গভীর চোখগুলো, কী ভীষণ স্নিগ্ধতায় ভরা মুখটি!


সেই কত বছর আগের অতীত আমার, এসব কেন মনে পড়ে যাচ্ছে এতটা! সব তো ঠিকই ছিল, হুট করে কেন এসব আবার নতুন করে…! অতীত হয়তো বন্ধু হয় না কারও, শুধু বন্ধু বন্ধু ভাব করে দূর থেকে হাত নাড়ে, আর হুট করে অনেক পেছনে টেনে নিয়ে যায়…!