কখনও বলা হয়নি

 
আপনি চলে যাবার পর চায়ের যে কাপটা রেখে যান, ওটা আমি কখনও হুট্‌ করে ধুয়ে ফেলি না। যে পাশটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে চুমুকে চুমুকে চা খান, ওই চুমুকের জায়গাটায় দীর্ঘ সময় ধরে চুমু বসিয়ে, কাপের তলানিতে পড়ে-থাকা শেষ দুইবিন্দু চায়ের ফোঁটা আমি আধাঘণ্টা সময় নিয়ে খাই---একথা আপনাকে কখনও বলা হয়নি।
আপনি চলে গেলে বাটিতে যে শেষঝোলের ফোঁটাগুলি থেকে যায়, মাংসের হাড়ের যে অংশগুলি অর্ধেকটা না-চিবানো অবস্থায় ফেলে রেখে যান বাটির মাঝ বরাবর, ভারি আদর করে ওই অর্ধ-চিবানো হাড়গুলি আমি একঘণ্টা সময় নিয়ে টুংটাং, কট্‌কট্‌ করে চিবিয়ে খাই---একথা আপনাকে কখনও বলা হয়নি।
আপনি ভাত খাবার পর প্লেটে যে কয়েকটা ভাত পড়ে থাকে, আপনার চিবানো-হাড়, মরিচের ঊর্ধ্বভাগ, ব্যবহৃত টিস্যু, চায়ের মধ্য থেকে সরিয়ে-রাখা এলাচি…এসব সরিয়ে সরিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে সবকটা ভাতই আমি গুনেগুনে বড় তৃপ্তি নিয়ে গপাগপ খেয়ে ফেলি। কখনও কখনও প্লেটে হাত ধুয়ে হালকা পানি ঢেলে দিয়ে যে কয়েকটা ভাতের দানা খাবার অযোগ্য করে তুলেন, আমি সেগুলিও পানি ঝেড়ে ঝেড়ে খেয়ে ফেলি---একথা আপনাকে কখনও বলা হয়নি।
স্নানসেরে নীল যে তোয়ালেটায় গা মুছেন, ওই ভেজা-তোয়ালে আমি অনেকক্ষণ ধরে নিবিড় মমতায় গায়ে জড়িয়ে রাখি আপনি চলে যাবার পর---একথা আপনাকে কখনও বলা হয়নি।
যাবার বেলায় যে চিরুনিটায় চুল আঁচড়ান, ওই চিরুনিটায় আমি আবার চুল আঁচড়াই আপনি চলে গেলে---একথা আপনাকে কখনও বলা হয়নি।
যে চেয়ারের গায়ে আপনার জামাগুলি রাখেন, আপনি চলে যাবার পর ওই চেয়ারের গা-টা বারবার শুঁকে শুঁকে ওই জামাগুলিতে লেগে-থাকা আপনার গায়ের যত ঘ্রাণ চেয়ারটার গায়ে লেপটে থাকে, তার সবটা শুষে নিয়ে ফেলি---একথা আপনাকে কখনও বলা হয়নি।
খাটের যে পাশটায় আপনি শুয়ে থাকেন, আপনি চলে যাবার পর ওই পাশটাতে আমি ঠায় কয়েক ঘণ্টা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি---একথা আপনাকে কখনও বলা হয়নি।
প্রতিবার আপনি চলে যাবার পর আমি পরের দিন রাত অবধি স্নানে যাই না। আপনার গায়ের যে ঘ্রাণটা আমার সারাগায়ে লেপটে থাকে, ওটা বারবারই শুঁকে শুঁকে দেখি। দেখি, আপনি আমার সমস্ত শরীরটা জুড়ে থেকেই গেছেন চলে গিয়েও---একথাটাই শুধু একবার বলেছিলাম আপনাকে। আপনার মনে আছে?


আপনাকে বলা হয়নি, আপনি চলে যাবার পরও আপনার পুরোটা থেকে যায় আপনার ফেলে-যাওয়া সবকটা ব্যবহৃত জিনিসপত্রে।
আপনি চলে যাবার পর আপনার সব না-থাকা জুড়ে আপনার বড় বেশিই থেকে-যাওয়া হয়। আপনার সকল প্রস্থান থেকে আপনাকে খুঁজে খুঁজে, খুঁড়ে খুঁড়ে, তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে নিয়ে আসি। এটা আমার নিত্য-অভ্যেস।
আপনি চলে যাবার পরও আপনাকে খুঁজে পাই ওই চায়ের মগটায়, ঝোলের বাটিটায়, চিবানো-হাড়গুলিতে, খাটের ওই পাশটায়, আর ওই নীল তোয়ালেটাতে।
…এই এত কিছু জুড়ে আপনি থেকেই যখন যান, তবে আপনি আর চলে গেলেনটা কই?
আপনিই বলুন, আপনাকে নিয়ে এত এত ব্যস্ততাঠেলে পড়ার সময়ই-বা আমার কই?
পড়তে আমার একটু করেও মন চায় না। আমার আপনাকে নিয়ে পড়ে থাকতেই ভালো লাগে খুউব।


আপনার রেখে-যাওয়া শূন্যতার বুকফুঁড়ে আপাদমস্তক আপনার যে জলছবি আমার একান্ত সংসারটায় আটকে থেকে যায়, সেই ঘরে…কে বলে আপনি নেই?
ওই দেয়ালের সাদাটে রংটায় আপনি, টেবিলের ফুলদানিটাতে আপনি, ওয়াশরুমের অ্যাপেক্সের প্লাস্টিকের দরজায় আপনি, জানালার খয়েরিরঙের পর্দাতেও আপনিই তো থাকেন!
সাধ্য থাকে তো আমার এই সংসারটার আনাচকানাচ থেকে আপনি আপনাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যান!


সত্যিই আমার পড়তে কখনও মন চায় না।
পড়তে বসলেই মনে এসে যায়, এই বুঝি চাকরিটা আমার হয়েই যাবে! এই বুঝি সকাল থেকে সন্ধে হয়ে রাত…সবটাই, অন্য কারও অধীন হয়ে, চলেই যাবে!
এই বুঝি আমার সংসারটা আর করা হবে না!
আমি চাকরি চাই না, আমি শুধু আপনাকে ভালোবাসার সময় চাই। আপনাকে ভেবে ভেবে এই ছোট্ট একটা জীবন অফুরন্ত অবসরে কাটিয়ে দিতে চাই।


সকালে ওঠো, রেডি হয়ে যাও, অফিসে গিয়ে প্রতিদিন একই নিয়মে কাজ করো, মাসশেষে ভূরি ভূরি টাকা কামাও…মরো---চাকরি হলে এ-ই তো জীবন! তাই না, বলুন?
ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে দেখব তখন, আপনার জন্য আমার সময়ই তো নেই! ঠিকঠাক সব কুলিয়ে উঠতে আমি পারছিই না আর!
অফিসের নতুন বস, সুদর্শন কলিগ বা নতুন-পুরান মুখের ভিড়ে আপনার মুখটি তখন মলিন হয়ে যাবে না…একটু হলেও?
জীবনে নতুন কারও কারও হঠাৎ আসায় মনটা যদি অন্য কারও মায়ায় পড়ে, তখন উপায়?
হয় না এমন? বলুন…হয় না এমন?
হয় হয়, হয় তো দেখি অনেক কিছুই!
আপনাকে বলা হয়নি, আমি আর চাকরি খুঁজছি না, আমি কেবলই আপনাকে খুঁজছি।


আমি আরও কয়েক বছর হেলা-অবহেলায়, না পড়েটড়ে, কিছু না করে আপনারই সাথে বেনামি এই সংসারে পড়ে থাকতে চাই!
আমি আপনার প্রতীক্ষাতে আরও কয়টা বছর থেকে গিয়ে এই সংসারের সুখ পেতে চাই।
কে জানে কখন, কোন সময়ে, কোন অকারণে অন্য কী মুখ এই গোটা সংসারটাকেই নিয়ে নেবে দখলে!
এমনও তো হতে পারে, সমাজের অবধারিত রীতির লাইনে দাঁড়িয়ে যেতে আপনি বাধ্য হলেন! আপনি তখন চলেই যাবেন ওই নিয়মের পথটা ধরে…আমার ঘর-সংসার পেছনে ফেলে, আমার সবটা একাই ভেঙেচুরে দিয়ে!
হয় না এমন? হয় তো প্রায়ই!
আমাদের বেলায় হয়তো অমনই কিছু হবে!
আমি একটা জীবন বিলিয়ে দেবো, তখন একটা প্রেমের গল্প তৈরি হবে! আমার ইচ্ছেই এমন!
আমি ক্যারিয়ারই দেবো বরবাদ করে একটা বেনামি, অলিখিত, ভাঙাচোরা ঘরের ছাদ বানাতে!


আজ মনে হচ্ছে, আপনাকে অনেক কথাই বলা হয়নি। মনে হচ্ছে, আজ অনেক কথাই বলে ফেলি!
মনে হচ্ছে, যদি আর সময় না পাই? বলার সুযোগই যদি আর না মিলে? কী হবে তখন?
আমার অনেক কথাই আপনাকে হয়নি বলা! বলা হয়ে ওঠেনি কখনও…অনেক অনেক অনেক কথা!
একটা ছাদহীন ঘরের কথা, একটা নামহীন সংসারের কথা, একটা নিষিদ্ধ ভালোবাসার গল্পের কথা।
অন্তত আজকে আপনার সময় হবে আমার জন্য…একটু করে?