কাজলাদিদির চিঠি

 
খবর পেয়ে লাশ-উদ্ধারের জন্য পুলিশের গাড়ি এসে থেমেছে বাড়ির সামনে। বাড়ির সকলের অলক্ষে দাঁড়িয়ে সমাগত লোকজন একজন আর-একজনের সাথে কী সব কানাকানি করছে। তবে বাসার ভেতরে কেউ ঢোকেনি।


ওসি সাহেব তাঁর দলবল নিয়ে বাড়ির তিনতলায় উঠছেন।


তিনরুমের একটা মাঝারি সাইজের বাসা। মাঝখানে খোলা ড্রয়িংরুম। ড্রয়িংরুমের দুইপাশে দুইটা রুম এবং তার দখিনমুখী করে আর-একটা রুম। ড্রইংরুমে বসে মাঝবয়সি দুজন ব্যক্তি এবং অল্পবয়সি দুজন ছেলে-মেয়ে বিলাপ করে কাঁদছে।


যে-রুমে লাশটা আছে, তদন্তের জন্য পুলিশ সে-রুমের দিকে এগোল। ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ। দরজা ভেঙে রুমে ঢুকতে হলো।


তরতাজা টগবগে যুবতী মেয়ে। বয়স ছাব্বিশ কি সাতাশ হবে। বড়শিতে ঝুলে-থাকা মরামাছের মতো নিজের গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ফ্যানের সাথে লটকে আছে। নিথরনিস্তব্ধ হাত পা নিচের দিকে এলানো। নীলরঙের সালোয়ার-কামিজ পরা। মুখ থেকে ফেনা বেরিয়ে ঘাড়-গলা হয়ে ধড়ের ঊর্ধ্বাংশ বেয়ে বুক ভিজে গেছে। চোয়ালের দুইপাটি দাঁত জিহ্বাটাকে একপাশে শক্ত করে কামড়ে ধরে রেখেছে। অসহায়ত্বে-ভরা চোখ দুটো ঈষৎ খোলা।


কোমরসমান লম্বা চুল এলোমেলো হয়ে সাপের মতো জড়িয়ে আছে সারা গায়ে। কৃষ্ণকলির মতো মেঘবর্ণ গায়ের রঙটা নীলচে আভায় ভরে উঠেছে। গায়ের এক-এক জায়গার রং এক-এক রকম। চোখ-মুখ নীলচে, আবার হাত-পা সাদাটে, এই রকম। গোলগাল নিরীহ চেহারাটা মায়ায় ভরা, যেন বাগানে সদ্যপ্রস্ফুটিত কোনও সূর্যমুখী। দেবী সরস্বতীর মতো মূর্তিময় নিপট সৌন্দর্য ছড়ানো শরীরে।


ওসি সাহেব রুমে ঢুকেই রুমটা খেয়াল করলেন খানিক সময় ধরে। দখিনমুখো জানালার পাশে ছোট্ট একটা পড়ার টেবিল। বেশ গোছানো, সেখানে হরেক রকম নামিদামি লেখকের মননশীল বইয়ের সংগ্রহ। শীর্ষেন্দু, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ূন, হেমিংওয়ে, এলিয়ট। বোঝা যায়, সদ্যমৃতা মানুষটি বই ভালোবাসত। টেবিলের এককোণে ফুলের টবে জলে-ভেজানো কিছু শুভ্র রজনিগন্ধা।


রুমের বাঁপাশের দেয়ালটিতে পুরো পরিবারের বড়ো একটা পোট্রেট টাঙানো। চেয়ারে-বসা বাবা-মায়ের পায়ের কাছে মায়ের কোলে হাত রেখে জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিতে বসে আছে মৃতা এবং ছবির পেছনে দাঁড়িয়ে দুজন ছেলে-মেয়ে। জানা গেল, ওরা দুজন মৃতার ছোটো ভাই-বোন এবং মাঝবয়সি দুজন হচ্ছেন বাবা-মা। একজন বাদে ছবির বাকি সবাই-ই ড্রয়িংরুমে আছে, ওরা কাঁদছে।


ওসি সাহেব ডায়েরি হাতে নিলেন। মৃত্যুর কারণ লিখলেন, আত্মহত্যা। বয়স সাতাশ, পেশায় নার্স। কর্মস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।


মৃতার টেবিলে পেপারওয়েটে চাপা একটি চিঠি। ওসি সাহেব চিঠি খুলে পড়ছেন।


প্রিয় মা ও বাবা,
জানি, তোমরা যখন চিঠিটা পড়ছ, তখন আমি আর জেগে নেই। তোমাদের কোলে টুপ্‌ করে ঘুমিয়ে-পড়া ছোট্টবেলার দুষ্টু আমি’টির মতো নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছি।


হয়তো ভাবছ, কেন এমনটা করলাম!


পৃথিবীজুড়ে যে মহামারি শুরু হয়েছে, সেখানে দায়িত্বের খাতিরে বিপন্ন মানুষের সেবায় নিজেকে সমর্পণ করতে হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। নার্স হিসেবে এই সংকটময় মুহূর্তে দেশ ও দশের সেবা করাই তো আমার কর্তব্য, তাই না? এই কর্তব্যের চেয়ে কোনও অংশে কি ছোটো আমার নিজের পরিবারটা? আমার কাছে তো তোমরাই এক-একটা পৃথিবী! আমার কাছে এই জীবনের আর কোনও অর্থ নেই এর বাইরে।


সে-দিন। হাসপাতাল থেকে ফিরে বুঝতে পারলাম, আমিও এই ছোঁয়াচে মরণব্যাধি শরীরে বয়ে ঘরে ঢুকেছি। সন্দেহ যতই বেড়েছে, তোমাদের সাথে দূরত্বও ততই বাড়িয়েছি। তোমরা বোঝোনি হয়তো।


মা,
পৃথিবীর অসুখ মুছতে গিয়ে আমি নিজেই সেই অসুখ বাধিয়ে এসেছিলাম নিজের শরীরে। আলোয় ভরা ছোট্ট পৃথিবীটা আমার, সেখানে হঠাৎ করেই এক অন্ধকারের হানা! আমি চেয়েছি, আমার এই অসুখের ভাগীদার যেন তোমাদের না হতে হয় কোনওমতেই। তোমাদের বাঁচাতে এটুক করা আমার জন্য কঠিন কিছু নয়।


আক্রান্ত হবার পর থেকে যতটা না কষ্টভোগ করেছি, তার শতগুণ বেশি যন্ত্রণায় ভুগেছি এই ভেবে ভেবে, যদি তোমাদের কারও সংক্রমণ হয় আমার কাছ থেকে, তখন? তোমাদের ঘিরেই তো আমার এই বেঁচে-থাকা! আর আমার বেঁচে-থাকাই যখন হঠাৎই তোমাদের বেঁচে-থাকার উপর হুমকি হয়ে দাঁড়াল, তখন আর তা কী করে মানতে পারি, বলো?


এই অসুখ বড়ো ভয়ংকর অসুখ, মা। সারা বিশ্বের কোথাও এর ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। একবার আক্রান্ত হলে বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা বড়োই ক্ষীণ।


আমি সারাক্ষণই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকি, এই বুঝি তোমাদের কারও অসুখটা হয়ে গেল! এই বুঝি তোমরা কেউ আক্রান্ত হচ্ছ! তোমাদের এমন কঠিন অবস্থায় নিজের চোখে দেখব, এমনটা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। এমনটা আমি এই দেহে প্রাণ থাকতে কিছুতেই হতে দিতে পারি না। তাই ভেবে চিন্তে সম্পূর্ণ সুস্থমস্তিষ্কেই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।


মা, মনে করে বাবার চশমার ফ্রেমটা পালটে দিয়ো লকডাউন-শেষে। ফ্রিজে মিষ্টির মজুত রেখো না, বাবা মিষ্টি ভালোবাসে; কিন্তু জানোই তো, বাবার ডায়বেটিস।


আমার আলমারির নিচের তাকে একটা বড়ো নীলখামে আমার সব টাকা রাখা আছে। আগামী বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে তুলিকে ল্যাপটপ কিনে দেবো বলেছিলাম। পাগলিটাকে কিনে দিয়ো একটা ল্যাপটপ।


আমার এক পরিচিত জামিল ভাইয়াকে রোহানের কথা বলে রেখেছি, লকডাউন শেষ হলেই যেন তাকে একটা ছোটোখাটো চাকরি ধরিয়ে দেয়। একটুও চিন্তা কোরো না, মা, রোহানের চাকরির ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে।


বাবা,
পুরো পৃথিবী উলটে দিয়ে অমন কিশোরী-বয়সে তোমাকে ভালোবেসে মা তোমার হাত ধরে বাসা থেকে পালিয়ে গাঁটছড়া বেঁধেছিল তোমার অভাবের ঘরটাতে। সব সময়ই দেখে এসেছি, মা তোমার উপর রাগারাগি করে, ঝগড়াঝাঁটি করে জীবনটা পার করে দিয়েছে। অথচ, তোমার ঘরে ফিরতে দুমিনিট দেরি হলেও মা অস্থির হয়ে উঠত, তোমার সামান্য কাশি হলেও মা উদ্‌বিগ্ন হয়ে উঠত, তোমার সামান্য জ্বরেও মা রাত জেগে তোমার কপালে জলপট্টি দিয়ে দিয়ে রাত কাটিয়ে দিত। সারাক্ষণই তোমার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করত আল্লাহ্‌র কাছে। তোমার যত পছন্দ অপছন্দ, তার সবকিছুই মায়ের আগাগোড়া মুখস্থ।


ওই যে সে-বার স্ট্রোক করে হাসপাতালে তিন দিন ছিলে, মনে আছে? জানো বাবা, মা সে তিন দিন ঠিকমতো খায়নি, ঘুমায়নি, আমাদের সাথেও কথা বলেনি। অমাবস্যার ঘুটঘুটে আঁধারের মতো মুখটাকে আঁচলে গুঁজে রাখত সারা দিন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রুমের দরজা বন্ধ করে রাখত। বের হলে খেয়াল করতাম, মায়ের চোখ দুটো টম্যাটোর মতো টকটকে লাল হয়ে ফুলে আছে।


তোমাকে ছাড়া মা বাঁচবেই না, বাবা। কখনওই ‘ভালোবাসি’ বলতে-না-পারা এই মানুষটার প্রাণ আটকে আছে শুধুই তোমার নিঃশ্বাসের সাথে। ও বাবা, আমার লক্ষ্মীসোনা বাবাটা, তুমি সুস্থ থেকো মায়ের জন্য, নিজেকে বাঁচিয়ে রেখো মায়ের জন্য। খেয়াল রেখো নিজের শরীরের দিকে। বয়সটা তো হচ্ছে, একটু সাবধানী হও, বাবা।


প্রিয় তুলি,
আমরা তিন ভাই-বোনের মধ্যে তুই সবার ছোটো। আজ থেকে আঠারো-উনিশ বছর আগে তুই যেদিন দুনিয়ায় এলি, সেদিন আমাদের ছোট্ট পৃথিবীটাতে আরও একছটা রঙের তুলি যুক্ত হলো। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, বেড়ালছানার মতো ছোটো ছোটো হাত-পা আর পিটপিট-করা দুটো চোখ, কেমন একটা আশ্চর্য সৌন্দর্যে ভরা মায়াবী মুখ। তোকে কোলে করে বাবা যখন খুশি খুশি মুখ নিয়ে বাসায় ঢুকল, আমি আর রোহান তো রীতিমতো মারামারি শুরু করে দিয়েছি কে তোকে আগে কোলে নেবে, এইজন্য!


এখন তুই কত্ত বড়ো হয়ে গেছিস, বোন! আমাদের সবার বড়ো আদরের ছোট্ট পরী তুই। ঠিক এই মুহূর্তে তোকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেতে খুব ইচ্ছে করছে রে…! হায়, আমার ভাগ্যে নেই!


রহিমচাচার ছেলে ফয়সাল তোকে খুব ডিস্টার্ব করে কলেজে যেতে আসতে। আমি ওকে বুঝিয়েছি অনেক। সে আর তোকে বিরক্ত করবে না।


হিরণ এখন কী করে রে? চাকরি-টাকরি পেয়েছে? কী, অবাক হলি? হিরণের কথা আমি কী করে জানলাম, ভাবছিস? শোন পাগলি, সেদিন তুই কলেজে চলে যাবার পর তোর ঘরটা গোছাতে গিয়ে তোর বইপত্র ভাঁজ করছিলাম। বইয়ের ভেতর থেকে টুপুস্‌ করে একটা চিঠি বেরিয়ে পড়ল মেঝেতে। খুলে দেখতেই দেখি, আহা, সে কী প্রেম! ওকে খুব ভালোবাসিস, তাই না রে, পাগলি?


হিরণের কথা আমি বাবাকে বলে রেখেছি আগেই। সময় হলে সবই হবে। মন দিয়ে পড়। ভার্সিটিতে ভর্তি হলে তোর আবদারের ল্যাপটপটা পেয়ে যাবি। দেখলি তো, তোর ভুলোমন আপু এটা ঠিকই মনে রেখেছে!


আর শোন, আমার যত জামা আছে, সব তোকে দিয়ে দিলাম। ড্রেসিং-টেবিলের সাজগোজের সব জিনিস এখন থেকে তোর। আমার সমস্ত অর্নামেন্টও আজকে থেকে তোর একার। তুই তো কাজল খুব পছন্দ করিস রে, আমার এগারোটা কাজলই এবার থেকে তোর। তুই ছোটোবেলায় খুব বলতিস, আমাদের দাদি মরে গিয়ে তারা হয়ে গেছে! তোর কথাই ঠিক! আমিও তারা হচ্ছি রে! সন্ধের আকাশে তোর আদরের কাজলাদিদি সন্ধ্যাতারা হয়ে উঁকি মেরে রোজই দেখতে আসবে তোকে। সময় পেলে আকাশ দেখিস, কেমন?


প্রিয় রোহান,
জন্মের পর থেকে আমরা পিঠাপিঠি দুই ভাই-বোন প্রতিদিনই ঘরে তৃতীয় মহাযুদ্ধ চালিয়েছি। কারণে অকারণে তোকে ইচ্ছেমতো কিল ঘুসিতে ব্যস্ত করে রেখেছি। একজন আর-একজনকে খ্যাপানোর চিরায়ত অঘোষিত বাধ্যতা আর অধিকার নিয়েই যেন আমাদের দুইজনের জন্ম! আমরা ছিলাম একই ঘরে দুই স্বৈরাচারী হিটলার! হা হা হা…!


হাসপাতালে যাবার পথে রূপক আমাকে খুব বিরক্ত করত। প্রতিদিনই টিজ করত সে। একদিন হঠাৎই দেখি, তার কোনও খোঁজ নেই। সে আর বিরক্ত করে না আমাকে। শুনলাম, তাকে কে জানি পিটিয়ে জখম করে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। পরে জানলাম, কাজটা তুই-ই করেছিলি!


পাগলা ভাইটা আমার, খুব বড়ো হয়ে গেছিস, না রে? সারা দিন আমার সাথে ঝগড়া করলেও ঠিকই তো আমার খবর রাখতিস। খোঁজ রাখতিস সবই, কোথাও আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, আমার কিছু লাগবে কি না। এত যে ভালোবাসিস, এই কথাটা মুখে কখনও বললি না কেন রে, পাগল?


আমার ডেস্কটপটা তোর জন্য রেখে গেলাম। টিভির রিমোর্টটা এখন থেকে তোরই। টিয়াপাখিটার দিকে খেয়াল রাখিস। পারলে ওকে খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিস, ভাই।


সামনেই তো তোর জন্মদিন। তোর জন্মদিনে দেবো বলে তোর পছন্দের লেদারবেল্টের একটা ঘড়ি কিনে রেখেছিলাম। টেবিলের ড্রয়ারে আছে। অত দামি না রে, আপু এর বেশি পারিনি। ওটা নিয়ে নিস মনে করে।


ভালো কথা, শুনেছি, তুই নাকি পূজা নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিস? পূজাও নাকি তোকে ভালোবাসে? ইসসস্‌, পূজার পছন্দ এত বিচ্ছিরি যে তোর মতো একটা গর্দভকেই কিনা ভালোবাসল শেষমেশ? হা হা হা!


শোন ভাই, ভালোবাসা কোনও জাতকুল ধর্ম মানে না রে! ধর্মের দোহাই দিয়ে কখনও ওকে ফিরিয়ে দিস না। তোর চাকরির ব্যবস্থা করে রেখেছি। চাকরিটা হয়ে গেলে ওকে ঘরে তুলিস।


বাবা, মা আর তুলির দিকে খেয়াল রাখিস। পরিবারে বড়োদের দায়িত্বগুলি পুরো পৃথিবীর চেয়েও বড়ো হয়। কর্তব্যের ওজন গোটা একটা মহবিশ্বের চেয়েও ভারী! এখন থেকে সব দায়িত্ব তোর কাঁধে বর্তাল। বাবা-মায়ের বয়স হচ্ছে, তুলিটা অনেক কিছুই এখনও বোঝে না। তুলিকে বকিস না, মুরগির রানের মাংসটা ওর পাতে দিস, ও তো এখনও ছোটো! ওদের দেখেশুনে রাখিস, ভাই। ওদের ভালো রাখিস। তোর কষ্টটা একটু বেড়ে গেল, আমাকে ক্ষমা করিস।


কখনও মুখে তোকে বলা হয়নি---ভালোবাসি! আজ মনে হচ্ছে, বড্ড ভুল করে ফেলেছি! একবার অন্তত বলতে পারতাম! ভাই, মুখে না বললেও তোকে অদ্ভুত রকমের ভালোবাসি রে! তুই সামান্য চোখের আড়াল হলেও বড্ড অসুখ অসুখ লাগত মনের মধ্যে, তোকে একদিন না দেখলেও খুব যন্ত্রণা হতো বুকে। জীবনের এই শেষস্টেশনে এসে তোকে বলে গেলাম---অনেক ভালোবাসি, ভাই আমার!


আমার জন্য একদমই কাঁদিস না! মেঘের আড়ালেও একটা সূর্য থাকে। রাত্রিশেষে ভোরের আলোয় পৃথিবী আবার ঝলসে উঠবে। ধৈর্য রাখ, অপেক্ষা কর, ভাই। তোর মুখের দিকেই সবাই তাকিয়ে আছে, এটা সব সময়ই মাথায় রাখিস।


কখনও ভাবিনি, পৃথিবী এমন রং পালটাবে। পৃথিবীর এই পালটে-যাওয়া রঙে ধুয়েমুছে ধূসর রংহীন হয়ে গেছে আমার কয়েক হাজার স্বপ্নের সমস্ত নীলবেগুনি ডানা।


মা, তুমি তো জানো, কত কত বাধার দেয়াল ডিঙিয়ে হাজারো স্বপ্নসারথির কষ্ট-কাজল লেপটে বড়ো আদরে-যতনে তিল তিল করে গড়ে-ওঠা আমাদের ঘরটা। সুখের রংতুলিতে সদ্যোজাত আমার ফুলের বাগানটায় আচমকাই এল একি কালবৈশাখী ঝড়!


এমন তো হবার কথা ছিল না! ও মা, তবে এমন হলো কেন? মা, কথা তো ছিল, আমার নিজেরও একটা সংসার হবে, আমার সাজানো ছোটো বাগানটাতেও একদিন ফুলে ফুলে বসন্ত নামবে।


না মা, তার কিছুই হয়নি! বিধিলিপির কোনও অক্ষরই তো খণ্ডানো যায় না। হয়তো আমার লিপিতেই ওরকম কিছু না-হওয়ার বিধানই রক্ষিত ছিল!


আজ বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে, একবার বাঁচি! সুতীব্র কণ্ঠে আর-একবার গেয়ে উঠি জীবনের গান। আর-একবার তোমাদের এই বুকের মধ্যে জোরে চেপে ধরে উঠে দাঁড়াই এই পৃথিবীর সমস্ত জরা আর বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে! আমার বাঁচতে খুব ইচ্ছে করছে, মা…খুউব!


কিন্তু হায়! আজ জীবনের সীমান্তে সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছে ঘোর তারকাঁটার সীমানা। মৃত্যুর রং এই অঙ্গে মেখে ওই সীমান্তটা পাড়ি দিতে হবে। আমি তাই সারা গায়ে মেখে নিয়েছি মৃত্যুর রং। আমার এপারে ফেরার সকল পথই বন্ধ!


আমাকে ক্ষমা কোরো তোমরা। আমার লাশের আশেপাশে এসো না। পৃথিবী সেরে উঠলে কবরে দেখতে যেয়ো একবার। কখনও ভেবো না, আমি নেই। তোমাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে কোষে আমার স্বচ্ছন্দ বিচরণ থাকবে। তোমাদের নিউরনে নিউরনে আমি বেঁচে থাকব যুগ যুগ ধরে। তোমাদের স্মৃতিতে, তোমাদের প্রতিটি মোনাজাতে আমি ফিরে ফিরে আসব এক অশরীরী দুর্বার ভালোবাসা নিয়ে। এই ভালোবাসার যে কখনও বিনাশ নেই!


রাত্রিশেষে পুবের আকাশে শুকতারাটি হয়ে তোমাদের পাহারায় রাখব। সময় করে মাঝেমধ্যে বারান্দায় এসো!


বেলাশেষে আবার আমাদের দেখা হবে। সে-বার একসাথে বাঁচব কয়েকশো বছর, কথা দিচ্ছি!


তোমাদের জন্য আমার এই প্রাণ, এই স্বপ্ন, এই নিঃশ্বাস উৎসর্গ করে দিলাম! এবার তবে আসি…আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতিটুকু রেখে গেলাম…।


বিদায়...


চিঠি পড়াশেষে ওসি সাহেব পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ-নাক মুছছেন। দায়িত্বের কাছে আবেগের কোনও স্থান নেই। তাই তিনি অশ্রু লুকাতে চাইছেন বার বার। না, কিছুতেই পারছেন না তিনি! তাঁর দুচোখ ফেটে গলগল করে নেমে-আসা জলের ফোয়ারা বাড়ছে তো বাড়ছেই…। ওসি সাহেব মাথানিচু রেখে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সংবরণ করার ব্যর্থচেষ্টা করে যাচ্ছেন। বহু দিন পর তিনি ভীষণ অসহায়বোধ করছেন।


তাঁকে দেখে অন্য পুলিশ-সদস্যদের চোখেও জল টলমল করছে।


এই পৃথিবীতে, মানুষ বড়োই বিচিত্র প্রাণী। নিজের পরিবারকে সম্ভাব্য সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে জলজ্যান্ত একটা প্রাণ নিজের হাতেই টেনে হিঁচড়ে বের করে নিল মেয়েটা! ভালোবাসার শক্তি বড়ো আশ্চর্য শক্তি, সে-শক্তির কাছে নিজের প্রাণও খুব তুচ্ছ!


লাশ গাড়িতে তোলা হচ্ছে।


যে মানুষটি নিজের পরিবার-পরিজনকে বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে এসেছে এতকাল, তার শেষযাত্রায় মাথায় হাত দিয়ে একটুখানি আদর মেখে দেবার উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে আছে সবার প্রতি! যে মানুষটি পুরো একটা পরিবারের ভার নিজের কাঁধে বহন করে এসেছে এই এতদিন, সেই মানুষটিরই, লাশ হবার পর, কারও কাঁধে ঠাঁই মিলেনি এতটুকুও!


পৃথিবীর সমস্ত আলো এক এক করে নিভে যাচ্ছে। বিগত আলোর সকল ছটা নিজের বুকে লুকিয়ে ফেলে সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে পশ্চিমকোণে। আজ সারা আকাশভর্তি পাখি! আকাশের গায়ে আঁকাবাঁকা রেখায় ওরা ফিরছে নিজ নিজ নীড়ে। ঠিক এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোথাও-না-কোথাও জন্ম নিচ্ছে নতুন কিছু কুঁড়ি। আবার কেউ-না-কেউ হেঁটে চলেছে এক অনন্ত অন্ধকারখচিত অসীমের পথে…এই যাত্রাপথ শাশ্বত, ধ্রুব, অনিবার্য!


সময় যতই কাটে, সময় ততই ফুরোয়।
সামনে যতই হাঁটি, পেছনে ততই ফিরি।
…পথ একটাই---কিছু আগে বা কিছু পরে।