কান্না

যাকে আমি নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসি---
তার হাতটি ছাড়ার চাইতে অনেক বেশি কঠিন সে মানুষটির হাত ছাড়া---
যে আমাকে তার নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে।


যে আমাকে থেকে যেতে বললে থেকে যেতাম পুরো পৃথিবীকে একপাশে সরিয়ে রেখে হলেও,
তাকে চলে যেতে দেওয়ার চাইতে অনেক অনেক কঠিন সে মানুষটাকে চলে যেতে দেওয়া, যার কাছে পুরো পৃথিবীটার মানে শুধুই আমি।


যার সুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি নিজেই যাকে আমার কাছে থাকতে দিচ্ছি না,
তাকে একটি বারও থেকে যেতে বলতে বুকের মধ্যে অনেক সাহস থাকতে হয়!
বর্তমানের উপর দাঁড়িয়ে, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে,
আমার মতন কাপুরুষ অতটা দুঃসাহস বোধহয় করতে পারে না।


যার সুখের কথা ভেবে ভেবে আজ আমি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত,
তার সুখের আদ্যোপান্ত অর্থ যে এক আমিই,
তা বুঝতে গিয়েও কোথায় যেন বিবেক আটকে যায়!


একদিন আজকের এই বোধটাই কাঁদাবে, জানি।
সময় আসবে। সেদিন চিৎকার করে কাঁদব দরজা বন্ধ করে।
হু হু করে উঠবে বুক, অথচ তখন আর কিছুই করার থাকবে না---
ঠিক যেমনটি আজকেও...নেই!


সেদিন আমার মানুষটা অন্য কারও বুকে মাথা গুঁজে
ঠিকই ব্যস্ত হয়ে থাকবে অনাগত সন্তানের নামটা ঠিক করতে।
আমাদের একটি ফুটফুটে মেয়ে হলে, তার নামটা আমরা দুজন মিলে যা ঠিক করে রেখেছি,
তা সেদিন নিশ্চয়ই বদলে যাবে!
এমনকি, ওরা দুজন মিলে একটি ছেলেই প্রত্যাশা করবে হয়তো, মেয়ে নয়।
মানুষ বদলালে চাওয়াও বদলে যায়।


লোকে বলে, একসাথে থাকতে থাকতেই নাকি ভালোবাসা জন্মায়!
আমি বলি, তা-ই যদি হতো, তবে পৃথিবীর এত মানুষকে অভিনয় করে জীবন পার করতে হতো না!
তা-ও চাই, আমার মানুষটা তার নতুন মানুষকে ভালোবাসতে শিখে যাক।
আমার মানুষটা ভালো থাকুক। নতুন মানুষ তাকে অনেক ভালো রাখুক, ভালোবেসে।


চাইলেই যদি ভালোবাসা যেত, তবে কত কত মানুষই যে সত্যি সত্যি ভালোবেসে দেখাত,
সে হিসেব রাখতেই পৃথিবী ক্লান্ত হয়ে পড়ত!
ভালো আমি বাসতে চাই না, তা নয়।
আসলে, ভালো আমি বাসতে কখনও বাধ্য হইনি।
এমন একটি মানুষও এ জীবনে আসেনি, যাকে ভালো না বেসে বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল কখনও।
...না, ভুল হলো, এসেছে। সে এমন একজন, যাকে আটকে রাখার ক্ষমতা আমার নেই।


আমায় কেউ ভালোবাসে না, আমায় কেউ রাখতে চায় না---এটাও মেনে নেওয়া যায়।
কিন্তু আমায় এমন কেউ ভালোবাসে, যে আমায় রাখতে পুরো পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে প্রস্তুত---তাকে রাখতে না পারার অসহায়ত্ব কীভাবে মেনে নিতে হয়, আমি সত্যিই জানি না।


আমি কেমন আছি, এটা কেউ আর বলে দেবে না। মানুষটা চলে যাচ্ছে।
আমার আর কী কী লাগবে, তা ঠিক করে দেওয়ার মানুষটা হারিয়ে যাচ্ছে।
কীভাবে চললে আমি ভালো থাকব, সেই রাস্তাটা এখন আর কেউই দেখিয়ে দেবে না।
সবচাইতে সুন্দর 'আমি'টা কেমন 'আমি', তা নিয়ে ভাববার মানুষটা আমার চোখের সামনে দিয়ে অন্য ঘরে চলে যাচ্ছে...।
এই জীবনের সবচাইতে বড়ো ধনটি হারাতে চলেছি...এটা ভাবতে গেলেও বুকের মধ্যে ধক্‌ করে উঠছে!


সময় কি সত্যিই সব শোক আর ক্ষত ঠিক শুকিয়ে দেয়?
বুকটাকে শক্ত করতে গেলে বুকের মধ্যে ঠিক কতটা শক্তি লাগে?
আবেগ আর কান্না লুকোতে সবাই-ই কি শিখে নেয় একসময়?


আগের মতো আমাকে কেউ যখন-তখন যা-তা বকাঝকা করে আর মেসেজ পাঠাবে না।
এই পুরো পৃথিবীতে যার শাসন আমি মেনে চলেছি সবসময়ই, সে মানুষটা আমাকে আর শাসন করবে না।
আমি কি সত্যিই ভেঙে যাচ্ছি ক্রমশ?
ভেঙে যেতে কেমন লাগে, আগে কখনও অনুভব করেছিলাম?
এই অনুভবটা গ্রহণ করার মতো সাহসটা আমার আছে কি আদৌ?


এতটা কষ্ট শেষ কবে হচ্ছিল, মনে পড়ছে না!
আমার ডানহাতটা চোখের সামনে ভেঙে যাচ্ছে...
অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না!
চারিদিকে অক্সিজেনের অফুরন্ত স্রোত, অথচ আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
মানুষটাকে চলে যেতে দেখছি বলেই কি আমার এমন কান্না পাচ্ছে?
না কি এই কান্নাটা অনেক আগে থেকেই বুকের মধ্যে আটকে ছিল?