কাব্যলক্ষ্মী, তোমাকে… (প্রথম পর্ব)

 
ভুলেভরা এই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিজের মতো করে কাটাতে পারলেই বরং আত্মগ্লানি থেকে বেঁচে যাওয়া যায়। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখগুলিকে তখন যৌক্তিক মনে হয়। দুঃখগুলি আমাদের একধরনের নতুন রূপের মানুষ হিসেবে তৈরি করে দেয়। তারপর একদিন পেছনে তাকিয়ে হঠাৎ দেখি, আসলে সব কিছু ঠিক জায়গামতোই আছে, কেবল আমিই ভুলোমনা হয়ে অন্য কিছু খুঁজেছি। যা হওয়ার কথা ছিল, তা-ই তো হয়েছে। এত ভাবছিই-বা কেন?


আমাদের জীবনটা খুব ছোট। একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালালে এর বারুদটুকু ফুরোতে যতটা সময় লাগে, ঠিক ততটাই ছোট এই জীবন। কিছু কিছু ঘটনা আমাদের আবার নতুন করে বাঁচতে শেখায়, জীবনে কিছু কিছু মানুষের আগমন আমাদের অভ্যাসগুলি, আমাদের অর্জিত ধারণাগুলি বদলে দেয়, জীবনকে জীবনের মতো করে দেখতে সাহায্য করে। তখন নিজের অনেক কিছুই অচেনা মনে হতে থাকে। নতুন চোখে নতুন দিনের দিকে তাকাতে হয়। হ্যাঁ, তখন নতুন করে কিছু দুঃখ এসেও ভর করে। কখনওবা ওরা আমাদের থমকে দেয়। পরবর্তীতে আমরা কখনও ভাবি, হয়তো এটাই ছিল আমাদের নিয়তি। নিজেকে বড়ো দুঃখী, বড়ো অসহায় মনে হতে থাকে। অথচ এই যে দুঃখগুলি আমাদেরকে আমাদের আজকের জায়গায় এনে দিল, তার জন্য কৃতজ্ঞ হতে ভুলে যাই। এই দুঃখগুলিই আসলে আমাদের ঐশ্বর্য। কেন? কারণ আমরা জন্মগতভাবেই কষ্টসহিষ্ণু। আমাদের জীবনের সবচাইতে বড়ো ঐশ্বর্য যা, তা কেবলই দুঃখের মধ্য দিয়েই আসে। এই দুঃখগুলি আমাদের আনন্দ চিনে নিতে শেখায়, চলার পথে সঠিক পথ খুঁজে নিতে শেখায়। যে কখনও দুঃখ পায়নি, তার চাইতে বড়ো অভাগা আর নেই।


আচ্ছা, আমরা তা হলে আমাদের দুঃখগুলি থেকে পালিয়ে বেড়াই কেন? কারণ আমরা সত্যকে সহজভাবে মেনে নিতে ভয় পাই। অবশেষে যখন আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই, তখন না চাইতেও কখনও কখনও আমাদের সেটা মেনে নিতেই হয়। তার ফল হয়তো সব সময় ঠিক আমাদের মনের মতো হয় না। আমরা যদি আমরা যা চাইছি তা পেতে চাই, তা হলে সবার আগে আমাদেরকে বাস্তবতা এবং পরিস্থিতি দুটোকেই, যেমনই হোক না কেন, মেনে নিতে হবে। তারপর বিষয়গুলি নিয়ে একটু শান্ত মেজাজে ভেবে দেখতে হবে যে, আসলে বিষয়টাকে আমরা যতটা কঠিন অথবা যতটা সহজ করে দেখছি, আদৌ সেটি ততটাই সহজ কিংবা কঠিন কি না। প্রায়ই দেখা যায়, আমরা পরিস্থিতিকে যেমনটা ভাবছি, তেমনটা আসলে নয়। আমরা আমাদের মস্তিষ্কে সেটাকে খুব সহজ বা জটিল করে রাখছি, যার সাথে বাস্তব অবস্থার সংশ্লেষ অল্পই। কিছু বিষয় সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যায়, আবার কিছু বিষয়ের উপর সময় ধীরে ধীরে ধুলোর আস্তরণ জমিয়ে দেয়। ব্যাপারগুলি এমনভাবে ঘটে যে, ঘটনাগুলিকে চাইলেও আমরা আর আগের মতো মস্তিষ্কে ধরে রাখতে পারি না। কিছু কিছু বিষয় সময় যেতে যেতে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হয়। কেন এমন হয়? কারণ আমাদের আবেগ সত্য এবং মিথ্যা, লৌকিক এবং অলৌকিকের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। আমাদের আবেগ এবং আমাদের বুদ্ধিমত্তা কখনও কখনও একত্রে কাজ করতে পারে না। আমাদের আবেগ যখন আমাদের সাথে কথা বলে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক দূরে সরে থাকে। আবার মস্তিষ্ক যখনই কোনও পথ দেখায়, তখন সব সময় সেটি আমাদের আবেগের সঙ্গে মেলে না।


আবার জীবনের জন্য, জীবনকে পরিচালিত করতে হলে আবেগ মুখ্য একটি বিষয়। কখনও কখনও আমাদের এই আবেগ অতিরিক্ত ভাবের বশবর্তী হয়ে ভাবাবেগের কাজ করে। আমাদের সকলের জীবন সাধারণত দুইটি পক্ষ নিয়ে চালিত হয়, তার একটি হচ্ছে ব্যক্তিজীবন, অন্যটি পারিপার্শ্বিক জীবন। আমাদের পারিপার্শ্বিক জীবন আমাদের ব্যক্তিজীবনে প্রভাব ফেললেও আমরা সেটিকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে চলতে পারি, কিন্তু কখনও কখনও একটা নতুন মানুষের সাথে বিশেষ বন্ধনে আবদ্ধ হবার পর আমাদের ব্যক্তিজীবনের সব কিছুতে অনেক সময়ই কিছুটা ছেদ পড়ে। তখন কখনও কখনও চাইলেও আমরা সেটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে ইচ্ছানুযায়ী পরিচালনা করতে পারি না। জীবনকে তখন আমাদের কাছে বিভীষিকার মতো মনে হয়। পুরনো আমি থেকে নতুন আমি হয়ে উঠতে গেলে আমাদের মন থেকে অনেক কিছুই ঝেড়ে ফেলতে হয়। তেমনি নতুন কোনও জীবনে প্রবেশ করার সাথে সাথে অন্য একজন সম্পূর্ন নতুন মানুষকে নিজের সঙ্গে, নিজের সব কিছুর সঙ্গে এই জীবনের প্রয়োজনেই অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়। এ বড্ড ঝামেলার কাজ। তবু মানুষকে এটা করতে হয়। অনেক নতুন নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়।


সেই মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার সময় ধীরে ধীরে পুরনো ব্যক্তি ‘আমি’র মৃত্যু ঘটে। এই মৃত্যু কখনও অনাকাঙ্ক্ষিত, আবার কখনও স্বেচ্ছায় হয়ে থাকে। এই স্বেচ্ছামৃত্যু মানুষকে যতটা স্বস্তি দেয়, অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ততটাই ভেতরে ভেতরে পোড়াতে থাকে। ক্রমেই ভেতরের সেই অগ্নিশিখা একধরনের দ্রোহের জন্যে তৈরি হতে থাকে। তারপর হঠাৎই প্রকাণ্ড আকারে বিস্ফোরিত হয়ে তার জ্বালামুখ উদ্‌গিরণ করে লাভা নির্গত হতে থাকে। আমরা যখন বুঝতে পারি, আমার ব্যক্তি ‘আমি’র আসলে পুরোপুরি মৃত্যু ঘটেছে, তখন সেটি আমাদের বিবেককে অশান্ত করে তোলে। যে ‘আমি’তে আমার ‘আমি’ নেই, যে ‘আমি’তে সরল ‘আমি’র মৃত্যু ঘটে গেছে অনেক আগেই, সে ‘আমি’কে আমি কী করে সহজভাবে মেনে নিই? অথচ স্বেচ্ছামৃত্যু আমাদের কখনও পোড়ায় না। আমরা জানিই যে একটা পুরনো সত্তাকে ফেলে দিয়ে নতুন সত্তাকে আমরা নিজের জীবনে জড়িয়ে নিচ্ছি, আর এই জড়িয়ে নিতে গিয়ে আমরা নিজেদের এই মৃত্যুকে টেনে আনছি, বরণ করে নিচ্ছি। আমাদের যখন বেড়ে ওঠার সময়, তখন সেই মুহূর্তে নিজেকে পুরোপুরি তৈরি না করেই যদি অন্য কারও সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি, তারপর নিজেকে গড়ার সময়টা আর সেভাবে হয়ে ওঠে না। অনেক মানুষই এভাবে রোজ মরে যায়। হাতে যথেষ্ট সময় না নিয়ে পরিবারের চাপে অনেক মানুষই নতুন এক মানুষের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। সে মানুষটি যদি তার মনের মতো না হয়, কিংবা সে যদি নতুন মানুষের মনের মতো না হয়, এবং এটা থেকে দুজনের কেউই আর বেরিয়ে আসতে না পরে, তখন যে যন্ত্রণা, কষ্ট, দহন, তা কিন্তু পরিবার নেয় না, তা কেবলই ওই দুজন মানুষের ব্যক্তিগত। এসব ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করলে পরে অনেক দুঃখ পেতে হয়। পরিবারের স্বার্থপর ভুমিকার কথা মনে করে তখন কেবলই কষ্ট পাওয়া যায়, পরিবারকে অভিশাপ দেওয়া যায়, কিন্তু কিছুই আর করার থাকে না।


দুঃখের কথা তো অনেক হলো, এবার কাব্যলক্ষ্মীর প্রসঙ্গে আসি। একটা সময় আমিও ভাবতাম, কাব্যলক্ষ্মী বলে আসলে কিছুই নেই। যাকে লক্ষ্মীর আসনে অধিষ্ঠান করে কাব্য লিখব, সে লক্ষ্মীই আসলে বাস্তবে নেই। ধীরে ধীরে এটাকে সত্য হিসেবেই মেনে নিতে চাইছিলাম, আর নিজের মাঝে এ সত্যের প্রতিষ্ঠার কাজও চলছিল। তারপর হঠাৎ আমার জীবনে তুমি এলে। একটু একটু করে নিজের অজান্তেই বদলে যেতে লাগলাম আমি। ভাবতেই পারিনি, একজন মানুষ অন্য আর একজন মানুষের প্রভাবে এতটা বদলে যেতে পারে! নিজের পূর্বপ্রতিষ্ঠিত আমিত্বের উপর অগাধবিশ্বাস আর অহংকার ছিল আমার, ভাবতাম, আমাকে কেউ ভাঙতে পারে না, আমাকে আমি না চাইলে আমাকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। সে সাধ্য আমার নিজের ছাড়া আর কারও নেই, অন্য কোনও মানুষের নেই। কিন্তু পরিবর্তন ব্যাপারটা সময় এবং জীবনের একটি অতি প্রয়োজনীয় নীতি এবং এটি যৌক্তিক, এটা মেনে নিতে অনেক সংকোচ ছিল আমার। নিজের মাঝে নিজেকে নিয়ে কোনও ভুলত্রুটি কিচ্ছু দেখতে পেতাম না, এমনকি মানতেও চাইতাম না। মনে হতো, এই ‘আমি’টা কখনও ভুল করতে পারে না। অবশ্য এরও একটা কারণ ছিল, তা হলো, আমি কখনও কোনও কাজই হুটহাট করে ফেলতাম না। যে কোনও কাজকেই খুব গুরুত্ব দিয়ে বিচারবিবেচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতাম। এজন্যই মনে হতো যে আমার কখনও ভুল হতে পারে না। ‘আমার কোনও ভুল নেই’, এমন একটা ধারণা নিজের মধ্যে পুষে রাখার চাইতে বড়ো ভুল আর নেই।


আমার জীবনে কেবল একটাই বড়ো ভুল ছিল আর সে ভুল পরে দুর্ঘটনা বয়ে আনে। তারপর আমি নিজেকে, নিজের সিদ্ধান্তকে পুনরায় বিবেচনা করতে শুরু করি। তুমি আসার পর থেকে পুরনো ‘আমি’টা আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করল, শুরু হলো নতুন করে গড়ে ওঠা। তোমাকে আমার সকল ইচ্ছে কি অনিচ্ছে, সবটাই সব সময়ই ভাবতাম। আসলে সব সময় সব কিছুতেই তোমাকে দেখতে পেতাম। সব কল্পনায়, সব অনুভূতিতে নিজের অজান্তেই তুমি চলে আসতে। সেই থেকেই শুরু। আমি কখনও কারও জন্যে কোনও অনুভূতি কবিতায় প্রকাশ করিনি। সেটা কখনও আসেনি বলেই করিনি। যখন তোমাকে প্রথম কিছু লিখতে শুরু করি, মনে আছে, তখন এই অযাচিত, তুচ্ছ অনুভূতিগুলি আমাকে ঘুমুতে দিত না। রাতভর জেগে জেগে কী সব আজগুবি কথা ভাবতাম, সেগুলির না থাকত কোনও গন্তব্য, না কোনও অর্থ। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে ঘুম থেকে জেগে যখন স্বাভাবিক বোধ ফিরে আসত, তখনই প্রথমেই তোমাকে মনে পড়ত। আসলে যার মনে পড়ার মতো বিশেষ কেউ নেই, সে হয়তো বুঝবে, ঠিক কতটা অসহায় সে। ঠিক যেন টেনেহিঁচড়ে জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যার উঠোনে কখনও পূর্ণিমার আলো ও অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার আসেনি, সে এই পার্থক্যগুলি বুঝতে পারবে না। যেদিন প্রথম তোমাকে কিছু লিখেছিলাম, অনেক ভয়ে ভয়ে লিখেছিলাম। জানতাম, ভুল হবে, কিন্তু আমার ভুলগুলিকে তুমি কোন চোখে দেখবে, সেটাই ছিল ভয়ের মূল কারণ। জোছনার আলো গায়ে মাখতে অভ্যস্ত আমি, সেখানে, অমাবস্যার অন্ধকার গায়ে মাখতে যদি হয়, এমন একটা ভয় তো থেকেই যায়।


আমি যা কিছু লিখেছি, তার সব কিছু তোমাকে লক্ষ্মী করেই। কিন্তু তখনও কাব্যলক্ষ্মী কী, এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। তোমার কাছ থেকেই শিখেছি কাব্যলক্ষ্মী কী। আসলেই মাথার মধ্যে একটা কাব্যলক্ষ্মী সেট করে ফেললে অনেক সুবিধা হয়। যেমন ধরো, তুমি যদি কোনও কাব্য অথবা গদ্য কিছু একটা লিখ, তখন মনে মনে যদি আমাকে সেই লেখার কোনও একটা জায়গায় বা পুরোটা জায়গায় কল্পনা করে লিখ, তখন আমিই হচ্ছি তোমার কাব্যলক্ষ্মী। আমাকে কল্পনা করে, আমার নানান আচরণ, কথাবার্তা, ভাবনা ইত্যাদিকে পুঁজি করে তুমি অনেক কিছুই লিখে ফেলতে পারবে। এমনকি, আমার উপর যদি তোমার রাগ হয়, কখনও ঘৃণাই জন্মে, তা-ও তখন আমার বাজে দিকগুলি নিয়েও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে ফেলতে পারবে যদি আমাকে রেখে দাও। এই কাজটা তোমার কাজকে অনেক সহজ করে দেবে। তোমাকে আমার কাব্যলক্ষ্মী হিসেবে সেট করতে হয় না, হয়নি কখনও। আমি যা-কিছু ভাবি, যা-কিছুই লিখি, সবই তোমাকে ঘিরে। তুমি আমার ভালোবাসার মানুষ বলে এটা আপনাআপনিই সেট হয়ে যায়। ভালোবাসার, ভালোলাগার যত অনুভূতি, যত কথা সব তখন তোমাকে ঘিরেই হয়। সেদিন মৃত্যু নিয়ে একটা লেখা যে লিখলে, ওখানে ওই যে সেই গরীব মানুষটিকে নিয়ে লিখলে, যার রিকশাচালক স্বামীটি মারা গেছেন, মনে আছে? তুমি যে জায়গার বর্ণনা দিয়েছিলে, সিআরবি মনে হয়, ওখানে গিয়েই তো অমন একটা দৃশ্য দেখার পর তা লিখেছিলে, তাই না? ওখানে একটা ছেলেকে নিয়ে যে লিখেছিলে, ওই যে যার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুখের যে বর্ণনা দিয়েছিলে, যে কিনা কারও কাছেই হাত পাততে শেখেনি, এমনকি কেউ তার কাজে খুশি হয়ে, তার সততা দেখে, তার ব্যক্তিত্ব দেখে খুশি হয়ে স্বেচ্ছায় তিন টাকার জায়গায় পাঁচ টাকা দিলেও সে নেয় না! সে ছেলেটাই তখন তোমার ওই লেখার কাব্যলক্ষ্মী ছিল, তাই না?


মাথায় একজন কাব্যলক্ষ্মী সেট করে লিখলে যাকে লক্ষ্মী করে লেখা হয়, তখন আসলে তার সাথে সাথে ওই একই রকমের গুণাবলিসম্পন্ন সব লোকের মৌলিক দিকগুলিই সেই লেখার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে, ফুটে ওঠে। সেই একজনের মধ্য দিয়ে হাজারো অমন মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। আমি যখন তোমাকে লক্ষ্মী করে কোনও ভালোবাসার কবিতা লিখি, তখন তার মধ্য দিয়ে সব রাগ - অভিমান - অভিযোগ ফুটে ওঠে। আসলে যারাই ভালোবাসে, তাদের অনুভূতিগুলি কিন্তু ঠিক অমনই। ওরকম করেই কিন্তু সবাই তাদের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ভাবে। এ বিষয়গুলি আসলে চিরন্তন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই যে একটা কবিতা আছে না…ওই যে, ‘তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি…’ কবিতাটি কিন্তু অনেক আগের লেখা, অথচ দেখো, আজও কবিতাটি কত প্রাসঙ্গিক। আবার আজ থেকে একশোবছর পরেও কিন্তু তেমনই প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে। এগুলি চিরন্তন, এগুলি কখনও বদলায় না। এই যে মানুষ দুঃখ নিয়ে এত বেশি কথা বলে, কবিতা লেখে, গদ্য লেখে, এগুলি সবই প্রাসঙ্গিক। সেদিন তোমার ওয়ালে তোমাকে একজন লিখল, তুমি নাকি প্রতিবন্ধী। এমনিই লিখেছে, কোনও গ্রহণযোগ্য কারণ নেই। হয়তো সে তোমাকে সহ্য করতে পারে না, হয়তো সে তোমার মতো হতে চেয়েও হতে পারেনি, কিংবা অন্য কোনও দুঃখ থেকেও লিখতে পারে। অনেকেই আছে, যাদের দুর্ব্যবহার করতে কোনও কারণ লাগে না। ওরা ওটাতেই অভ্যস্ত, ওদের বেয়াদবি করতে না দিলে ওরা দম আটকে মরে যাবে। তখন তুমি ভীষণ রাগ করে একটা কবিতা লিখেছিলে। তোমার ঝরনা হবার প্রতীক্ষায়। সেখানে ছিল,
আমি চলে যাবার পর কিছু অক্ষর আমার জন্মের সাক্ষ্য দেবে।
ওরা চলে যাবার পর ওদের জন্মের সাক্ষ্য দেবে কেবলই সেপটিক-ট্যাংক।
…তুমিই বলো, ওই ছেলেটি কি তোমার এই কবিতার পেছনের কাব্যলক্ষ্মী নয়? সে কি একটা ধন্যবাদের দাবি রাখে না? এমনি করেই, যারা আমাদের দুঃখ দেয়, হোক তা কারণে বা অকারণে, তাদের কাছেও আমাদের কিছু ঋণ কিন্তু থেকে যাচ্ছে।


আমার কাছে লেখালেখির জন্য সবচাইতে পছন্দের উপাদান হচ্ছে দুঃখ। আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি আর দুঃখ নিয়েই লিখতে ভালোবাসি। তুমি দেখবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচাইতে ভালো ভালো যে সাহিত্যকর্মগুলি, যেমন কবিতা, গান, গদ্য, কথাসাহিত্য, সিনেমাস্ক্রিপ্ট, যা-ই বলো না কেন, সবগুলিই কিন্তু দুঃখ নিয়ে লেখা। তোমার একটা অনেক আগের একটা লেখা ‘রমণীয় সুরবিষাদ’, ওই লেখাটাতেই ব্যাখ্যা করেছিলে দুঃখ নিয়ে। ওই লেখাটি থেকেই জেনেছিলাম, কেন মানুষের দুঃখগুলিই জীবনে শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করে আছে, কেন মানুষের দুঃখভিত্তিক সৃষ্টিগুলিই পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। এই অনুভূতিগুলির সবই চিরন্তন। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আগেও সকলে যেভাবে গেছে, এখনও এভাবেই যায়, আবার ভবিষ্যতেও সেভাবেই যাবে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা সৃজনশীল মানুষ হচ্ছেন দুঃখী। পৃথিবীর প্রত্যেকটা সৃজনশীল মানুষ হচ্ছেন ডিপ্রেশড, ফ্রাস্ট্রেটেড। আমি কখনও সুখী, একইসাথে সৃজনশীল, এমন কোনও মানুষ দেখিনি। সুখী এবং সৃজনশীল, এমন কখনও হয় না। পৃথিবীর প্রত্যেকটা সৃজনশীল মানুষ অসুখী। কেন? কারণ হ্যাপিনেস বা সুখ থেকে কখনও কোনও মহৎসৃষ্টি হয় না। প্রতিটি মহৎসৃষ্টির মধ্যে একধরনের বিষাদ বা নৈরাশ্য থাকবেই। সুখী হতে চাইলে কখনও সৃজনশীল মানুষের কাছে যাওয়া যাবে না। তাদের সৃষ্টি নিয়ে সুখী হওয়া যায় হয়তো, তবে তাদের জীবনের কাছে যেতে নেই। সৃষ্টিশীল মানুষকে ভালোবাসলেও দুঃখ পেতে হয়। ওদের কোনও ব্যাকরণ নেই। প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের এক এক করে ব্যক্তিগত ব্যাকরণ আছে। আমাদের মাথায় যতটা বুদ্ধি আছে, যতটা ধারণা আমাদের মাথা রাখতে পারে, যতটা আমরা বুঝতে পারি, ততটাকে পুঁজি করে সৃষ্টিশীল মানুষকে বোঝা যাবে না।


আমার কথাগুলিকে এলোমেলো মনে হলে তুমি চাইলে মহৎব্যক্তিদের জীবনীগুলি পড়ে দেখতে পার। দেখবে, তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন দুঃখী। সুখ নিয়ে তুমি কী-ইবা লিখবে, বলতে পার? খুব বেশি হলে দুই-তিন পৃষ্ঠা লেখা যায় সুখ নিয়ে। হয়তো লিখবে, খুব ভালো লাগছে, সিনেমা দেখলাম, মজা করে ফুচকা খেলাম, ঘুরতে গেলাম, রোদ দেখলাম, বৃষ্টি দেখলাম, খুব যদি ইচ্ছে করে যে কিছু আধুনিকতা মিশিয়ে দেবে লেখায়, তা হলে লিখবে, ড্রিংক করলাম, কিছু ফুর্তি হলো, এটা করলাম, সেটা করলাম…এসব ছাড়া আর কী লিখবে সুখ নিয়ে? কিন্তু দুঃখ নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে ফেলা যায়। কারণ পৃথিবীটাকে যখন আমরা আমাদের ষষ্ঠইন্দ্রিয় দিয়ে দেখতে পাই, আমাদের ত্রিনয়ন দিয়ে দেখতে পাই, তখন নিজেকে শান্ত সমাহিত করে ফেলতে হবে। মানুষ কবরে ঠিক যেমন থাকে, তেমন। তখন পৃথিবীটাকে তোমার ভেতরের অন্তর, তোমার ভেতরের হৃদয় দিতে দেখতে হবে। তোমার ভেতরের ‘তুমি’র সাথে একটা যোগাযোগ তখন স্থাপিত হবে। এই যোগাযোগটাকেই ইবাদত বলা হয়। তুমি যখন সৃষ্টিকর্তাকে ডাকো একমনে, তখন আসলে তুমি তোমার ভেতরের মানুষটাকেই ডাকো। যখন মুখে বল, ইনশাআল্লাহ্‌ কিংবা ভগবানের ইচ্ছায় কিংবা এমন কিছু, তখন প্রকৃতপক্ষে তুমি তোমার আত্মাকে বল, হ্যাঁ, কাজটা হবে! ফলে তোমার মধ্যে একটা শক্তি তো তৈরি হয়ই! সেই শক্তিই তোমাকে এগিয়ে নেয়। স্রষ্টা বাইরে কোথাও থাকেন না, তোমার হৃদয়ের মধ্যেই থাকেন। তুমি নিজেই ঈশ্বর, যদি ভেতর থেকে জেগে উঠতে পারো।


যখন সেই ভেতরের ‘তুমি’টা কথা বলতে শুরু করে, তখন নিজেকে আলোকিত করতে কোনও ধর্মগ্রন্থের প্রয়োজন হয় না। ওই ভেতরের ‘তুমি’টাই হচ্ছে স্রষ্টা। সেটাকে কথা বলাতে জানতে হয়। সবার ভেতরের ‘তুমি’টা কথা বলে না কিন্তু। কথা বললেও সব সময় বলে না। ভেতরের ‘তুমি’টার সাথে কথা বলতে পারাটা একটা দীর্ঘসাধনার ব্যাপার। এটার জন্য কোনও ধরনের আচার-রীতির প্রয়োজন পড়ে না, কোনও পবিত্রগ্রন্থের দরকার হয় না। এটার জন্যে কেবল দুঃখ দরকার, ঠান্ডা মস্তিষ্ক দরকার, নৈরাশ্য দরকার, স্থিরহওয়া দরকার। এটার জন্যে ভেতরের ‘তুমি’টার সাথে কথা বলতে জানা দরকার। তবে হ্যাঁ, একজন মানুষ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা থেকে যদি অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে কোনও ধর্মালয়, ধর্মগ্রন্থ, ধর্মাচরণ ইত্যাদির সাহায্যে প্রার্থনা বা ইবাদত করেন, তা-ও তাঁর বিশ্বাস তাঁর ভেতরটাকে জাগায়, ফলে তিনিও একধরনের শান্তি, স্বস্তি, সুখ লাভ করেন। এটা যার যার অভ্যাস, বিশ্বাস, অভিজ্ঞতার ব্যাপার। আর মানুষ এই প্রার্থনার প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত সহায়ক উপাদানের সাহায্য নেয়, তার প্রত্যেকটিই এক এক মানুষের বেলায় এক এক রকমের। কোনওটিই শ্রেষ্ঠ নয়, কোনওটিই নিকৃষ্ট নয়। প্রত্যেকটিই জরুরি, প্রত্যেকটিই অপরিহার্য, কেননা ওসব নিয়েই অনেক মানুষ বেঁচে আছে। একজনের বেঁচে থাকার উপায় বা অনুষঙ্গের উপর অন্যজনের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা থাকতে হবে। নইলে এ পৃথিবীটাকে বড়োই ধূসর মনে হয়। যে যেভাবে ভালো থাকে, তাকে সেভাবেই ভালো থাকতে দিতে হবে। একমাত্র নির্বোধরাই জোর করে নিজের বিশ্বাস, রীতি, পদ্ধতি অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। যে যেভাবেই ধর্মাচরণ বা প্রার্থনা করুক না কেন, সবারই মূল উদ্দেশ্য একটা---নিজের ভেতরের ‘আমি’টাকে জাগানো, আর কিছুই নয়। এই পৃথিবীর কারও কোনও ক্ষতি না করে নিজেকে জাগিয়ে তোলার জন্য যে যেভাবে থাকতে চায়, তাকে সেভাবেই থাকতে দেওয়া ভালো। নিজে বাঁচো ও অন্যকে বাঁচতে দাও---এর চাইতে বড়ো ধর্ম এ পৃথিবীতে আর নেই।


তো যেখানে ছিলাম! সুখের শক্তি আসলে ক্ষণস্থায়ী। দুঃখের শক্তি অসীম। এগুলি নিয়ে ভাবতে বসলে আসলেই অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়। তোমার সাথে এই যে আমার চিন্তাগুলির এত মিল, মাঝে মাঝে কী ভাবি, জানো? ভাবি, যদি কখনও এই ‘আমি’টা হঠাৎ করেই কোনও কারণে বদলে যাই, তখন কি আর আমাকে এখন যতটা ভালোবাসো, ততটা আর ভালোবাসবে না সেদিন? যদিও আমার মনে হয়, আমার ভেতরের এই অনুভূতিগুলি কখনও বদলাবে না, ঠিক যেমন করে তুমি বলো, তোমার ভেতরটা কখনও পরিবর্তন হবে না, কারণ তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে সব কিছু খুব ভালোভাবে জানো, নিজেকে খুব ভালো চেনো তুমি। হয়তো তুমি মাঝে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর রাগ অভিমান যা থেকেই বলো, যে কারণেই হোক, অনেক দিন চুপ করে ছিলে, কিছুই লিখোনি অনেক দিন। কিন্তু আবার তুমিই তো বলো, এই লেখালেখির রাজ্যটা এক অদ্ভুত রাজ্য। এটা এমনই একটা রাজ্য, যে রাজ্যে বসবাসের নিয়মকানুন শেখার কোনও ট্রেনিংস্কুল হয় না, যে রাজ্যে কীভাবে ঢুকতে হয়, তার কোনও দিকনির্দেশনা নেই, যে রাজ্যে ঢোকার পর কীভাবে হাঁটতে হয়, তার কোনও দিক নির্দেশনা নেই, যে রাজ্য ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে কী করতে হয়, তারও কোনও দিকনির্দেশনা নেই। কিছুই নেই একেবারে। আর এজন্যেই হয়তো আমরা আলাদা নই, আমরা আলাদা হতেও পারব না। দুজন মানুষ একসাথে থাকতে হলে, তাদের দুজনের ভাবনা মিলুক বা না মিলুক, সে ভাবনাগুলির প্রতি পারস্পরিক সহনশীলতা ও মান্যতা থাকতে হয়। ওটা যতদিন আমাদের মধ্যে আছে, ততদিন একসাথে থাকা না থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হলেও চলবে।


আমি এও জানি, এই গোটা পৃথিবীতে তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস তোমার লেখালেখি, আর সেই লেখালেখি, সেই ভাবনার জগত তুমি যা শেয়ার কর প্রতিনিয়ত, সেই তোমার কাছে, সে-ই মানুষটাই সবচাইতে প্রিয় মানুষ হবে, যে লিখতে জানে কিংবা তোমায় লেখাতে জানে, এটা কে না বুঝবে! এজন্যই হয়তো তোমার কাছে-আসাটা আমার জন্যে অনেক সহজ হয়েছে, তোমার ভালোবাসা পাওয়া, তোমাকে পাওয়া, এই সবই ওই একটা জিনিসেরই হাত ধরে। আর সেজন্যেই সব সময় তোমার মাথায় চেপে বসে থাকি, তোমাকে অনবরত জ্বালাতে থাকি, অথচ আমার সব কিছু তুমি চুপ করে সহ্য করে যাও। অবশ্য ভালোবাসার মানুষ হিসেবে তোমাকে জ্বালানোটাও আমার একটা অলিখিত অধিকার। আমার ভালোবাসার মানুষকে আমি জ্বালাব, এটাই স্বাভাবিক। আমি তোমাকে জ্বালাব না তো কি আমার বান্ধবীর মানুষটাকে জ্বালাব?


তুমি যেদিন আমাকে চাঁদের সাথে তুলনা করেছিলে, বলেছিলে, আমি তোমার মাঝে জোয়ার-ভাটা আনি, সে জোয়ার-ভাটা শক্তি যে কী, তা সম্পর্কে আমি নিজেই হয়তো জানি না, তখন আমার যে নিজের কাছে কতটা ভালো লেগেছিল, সে কথা বলে বোঝানো যাবে না। তুমি বলেছিলে, চাঁদ যে সমুদ্রের বুকে জোয়ার-ভাটা আনে, তা সে নিজেই জানে না। আমি যে তোমার সেই চাঁদটা হতে পেরেছি, তোমার মতো একজন বড়োমনের শিল্পীর কাছে আমি যে নিজের একটা বিশেষ জায়গা নিয়ে আছি, সে পাওয়া আমাকে ভেতর থেকে নিজেকে আরও শুদ্ধ হতে তাগিদ দেয়। সেদিন তোমার সেই কয়েকটা কথা শোনার পরই মনে হয়েছিল, নিজেকে আরও অনেক পরিশুদ্ধ করতে হবে। যে হিরে যতটা পরিশুদ্ধ, সে ততটাই জ্বলজ্বল করে বলেই জানি। মনে হয়েছিল, ইস্‌, নিজেকে গড়ে তোলার আরও অনেক বাকি! যখন কারণটা তুমি, তখন সেই তাড়াটা ভেতর থেকে আসে। যে মানুষটা কেবল তোমাকে ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসে, তার কথার মূল্য তোমার কাছে কেমন, সে তুমি আমার চাইতে ভালো জানো। তুমি প্রথমে আমার ভালোবাসার মানুষ এবং পরে আমার কাছে একজন শিল্পী, আর কাউকে ভালোবাসতে পারা একটা মানুষের শিল্পীসত্তারই আর এক রূপ। যে ভালোবাসতে জানে না আর ভালোবাসা গ্রহণ করতে জানে না, তার পক্ষে শিল্পী হয়ে ওঠা অসম্ভব।


আমার সব বাহানা তুমি, আমার সব কলরব কেবলই তুমি, এই যে আমাকে এখন যেমন দেখ, এর সবটাই আসলে তোমার তৈরি। ওই যে আকাশের চাঁদটা দেখ, ওকে নিয়ে আমার ভীষণ মাতামাতি। মনে আছে, যেদিন প্রথম তোমাকে কবিতা লিখেছিলাম, সেদিনটার কথা? ওদিন আমি সন্ধ্যারাতে ছাদের কোণে চাঁদের সাথে কথা বলছিলাম। আমার আকাশের চাঁদ যে তুমি, সেজন্য সেই চাঁদের কানেই তোমার যত কথা, তোমাকে না বলা যত কথা, যত অভিযোগ, সবই নালিশ দেওয়ার কথা মনে এসেছিল। এই যে তোমাকে নিয়ে এত এত অভিযোগ করি চাঁদের কাছে, এগুলি কেন করি? আমার তো এই ভেবে খুশি থাকা দরকার যে তুমি যেখানেই থাকো, যেভাবেই থাকো,…ভালো আছ, বেঁচে আছ। আমার ভালোবাসার মানুষটি হয়তো জানে না, আমি তাকে কতটা ভালোবাসি অথবা কতটা অনুভবে জড়াই। তারপরও সে তো অন্তত এই পৃথিবীতেই আছে, চাইলেই আমি তাকে আর যা-ই হোক, দূর থেকে হলেও দেখতে তো পারছি। ভালোবাসার মানুষ যেখানে যেভাবেই থাকুক না কেন, তার ভালোথাকাটাই তো সবার কাম্য। এবং এটাই শেষকথা।


তবুও জোছনাস্রোতে অস্থির আর আবেগাপ্লুত হয়ে নিজেকে আর কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিলাম না আমি। চোখ ভিজে আসছিল বারেবার। ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, মানুষটাকে পাই অথবা না পাই, মানুষটার দেওয়া ঘৃণা - লজ্জা - অবহেলা যা-কিছুই পাই না কেন, আমি অন্তত আমার ভাবনাগুলি তাকে জানাবই। ভালোবাসা যখন এভাবে ভেঙেচুরে আসে, তখন সে স্রোত নিজেকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তা আমার জানা ছিল না। আমি সব ক্ষতি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলাম বলেই হয়তো আজ তোমাকে এভাবে এতটা নিজের করে পেয়েছি। তুমি বল, ভালোবাসা ব্যাপারটা বলে বলে বোঝাবার কিছু নেই, এটা অনুভব করে নিতে হয়, আমিও সেটাই বুঝি, কিন্তু যখন তুমি ব্যাপারটাকে আর নিজের মাঝে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছ না, তখনই এটাকে তার নিজের গতিতে ছেড়ে দেওয়াই কি যাথার্থ নয়? আমি সেটাকেই মুখ্য ভেবেছি, যা আমার হৃদয় ধারণ করে। ভালোবাসাটা আমার কাছে ইবাদতের মতোই পবিত্র কিছু, কেননা সেটা দিনের শেষে হৃদয়ের মধ্যে গিয়েই মেশে। যা-কিছু আমার হৃদয় ধারণ করতে পারে,---সেখানেই তার বিকাশ, সেখানেই তার অন্তিমআশ্রয়,---তা-কিছুকে আমি প্রার্থনার স্থানে রাখি। এই যে যখন একমনে লিখি, একমনে মানুষের কথা ভাবি, একমনে কাঁদি, একমনে স্বস্তি অনুভব করি, একমনে গান শুনি, একমনে জ্যোৎস্না দেখি, একমনে ভালোবাসি, এরকম আরও অনেক কিছুই, যেখানে কোনও কালিমা নেই, যেখানে কোনও ফাঁকি নেই, যেখানে কোনও অনিষ্টভাবনা নেই, যেখানে কোনও অসহিষ্ণুতা নেই,---যেখানে কেবলই শান্তি, সুখ, স্বস্তি,---যেখানে পৌঁছে যেতে হলে অনেক কষ্ট, গ্লানি, দুঃখকে মেনে নিতে যাত্রায় নিজেকে নিবেদন করতে হয়,---তার সব কিছুই আমার কাছে প্রার্থনা, ইবাদত, ধর্মাচরণ। ধর্ম তো সেটাই যা আমাদের ধারণ করে,---আমাকে যে এসবই ধারণ করে রাখছে দিনের পর দিন।


ভালোবাসার ভাষাগুলি আসলেই অন্যরকম, কখনও বলে বোঝাতে হয় তো কখনও মৌনে। আমি জানি কখন তুমি আমাকে মৌনে বাঁধো। আমি যদি সেদিনও চুপ করেই থাকতাম, নিজেকে মৌনে বেঁধে তোমার থেকে লুকিয়ে রাখতাম, তবে আজ এভাবে করে তোমাকে কতটা পেতাম? তোমার কাছে এভাবে এতটা আশ্রয়, এতটা যত্ন, এতটা ভালোবাসা আজ আমাকে ওই দূরআকাশের চাঁদটাই এনে দিয়েছে। সেই চাঁদের সাথেই তুমি যখন আমার তুলনা কর, তখন নিজেকে তোমার আকাশের কোথায় লুকোই, বলো? তুমিও কি কখনও জানতে, আমি তোমার আকাশের চাঁদ হয়েই এভাবে ধরা দেবো? আর আমিই-বা কতটা জানতাম আমার ভেতরের কথা, যা আজকাল তোমাকে বলি? আমি খুব মুখচোরা মানুষ, জানো? কাউকে কখনও কিছু বলতে পারতাম না, এমনকি সামান্য একটা প্রতিবাদের ভাষাও আমার জানা ছিল না। আমার ভেতরের এই যে মানুষটা, যে তোমার সাথে এত এত কথা বলে, আমার জানাই ছিল না, এমন একটা মানুষ আমার ভেতরে লুকিয়ে আছে, যে কিনা মন খুলে কথাও বলতে পারে। এ আমার প্রার্থনার ফসল, এ আমার নিজেকে জাগাতে পারার পুরস্কার।


(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য…)