কিঁচনি ভূত

ভূত ব্যাপারটা পুংলিঙ্গ নাকি স্ত্রীলিঙ্গ, সেটা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। এটা নিয়ে অল্পবিস্তর গবেষণা হয়েছে। তবে এইটুকু জানা গেছে, যেকোনও ভূত প্রয়োজন বুঝে ছেলেভূত কিংবা মেয়েভূত হয়ে যেতে পারে। বিভূতিভূষণ কিংবা হালের শীর্ষেন্দু থেকে শুরু করে অনেক নামিদামি প্ল্যানচ্যাট কর্তারাই ইঁনাদের যথেষ্ট সম্মানের সাথে স্মরণ করেছেন।
গল্পের নায়ক কিংবা নায়িকা না বানিয়ে বরং নায়কনায়িকাদের ভয় দেখাতেই ভূত মহোদয় কিংবা মহোদয়াদের ডাকা হয় বলে ওরা সিরিয়াসলি মাইন্ড করেছে এবং গত ভূতদিবসে অনুষ্ঠিত ভূতদের বিশ্ব মহাসম্মেলনে ওরা এই নীতিগত সিদ্ধান্তে এসেছে যে ওরা আস্তেআস্তে গল্পের প্লট থেকে পাবলিকের রিয়েল লাইফেও এসে যাবে, যাতে ভূতের সাথে এরকম মস্করা করার সাহস কোনও লেখকেরই আর কখনও না হয়। পাবলিক না চাইলে লেখকরা লিখবে কোন সাহসে? লেখকদের সরাসরি আক্রমণ না করে পাঠকদের আক্রমণ করার স্ট্র্যাটেজিটা ওদের ডিপ্লোম্যাটিক বুদ্ধিরই পরিচয় দেয়। (অবশ্য ওরা লেখকদের আক্রমণ করবে না ঠিক করেছিল এইজন্য যে, ওরা বুঝেছে, যারা ভূত নিয়ে মস্করা করার মতো দুঃসাহস দেখায়, তাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা না করাই নিরাপদ।)
শুকনো কাঠে আগুন ধরাতে না ধরাতেই সেই কাঠেই ঘি ঢালার মতো একটা ব্যাপার বেশ কিছুদিন আগে ঘটে গেল। একটা নিষ্পাপ মাসুম ভূতের ছানা টূতকে এক নির্বোধ লোক ভূতের বাচ্চা বলে গালি দেয়াতে চতুর্থ প্রজন্মের কিছু ভূত হাই ভূতকমান্ড থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে ওই গ্রামে হানা দেয়। ওই গ্রাম মানে, ওই লোকটা যে গ্রামে থাকে। গ্রামের নাম মধ্যম মুরাদপুর; চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার একটা গ্রাম। সেই গ্রামে কখনওই ভূতদের ভোটার হওয়ার সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হয়নি; অথচ এটাতেও ভূতরা কেউই কিছু মনে করতো না। ওরা ছিল এতোটাই উদার মানসিকতাসম্পন্ন। কিন্তু আজেবাজে গালিগালাজ করার কারণে ওদের সহজসরল কোমল ভৌতিক মন আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং ওরা একটা সভা করে সবাই এটা মেনে নেয় যে, প্রেমের মড়া যেমন জলে ডোবে না তেমনি ইজ্জতের ফালুদা টেস্টি লাগে না। ওদের মধ্যে সিনিয়রমোস্ট ভূত, যাকে সবাই সম্মান করে অক্ষয়বটভূতজি নামে ডাকে এবং যার সব কথাই সবাই নতশিরে মেনে নেয়, তিনি বললেন, মানুষের সাথে সরাসরি যুদ্ধে নামলে শুধু যে ইজ্জত যাবে তা-ই না, নিজেরাই ফালুদা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। তিনি আরও অভিমত প্রকাশ করেন, মানুষের হাতে রামধোলাই খেয়ে ওদের মধ্যে কেউ-কেউ নগদে তক্তা হয়ে যেতে পারে; আর যদি তা-ই হয়, তবে এতে অন্যান্য ভূতসেনারা ভয় পাবে। ভূতের ভয়ের চাইতে মানুষের ভয় অনেকবেশি ভয়ংকর। সবাই যখন ভাবছেই তো ভাবছে, কী করা যায়, কী করা যায়, তখন সবচেয়ে অল্পবয়েসি ভূত, যাকে সবাই আদর করে মিঁনকা বলে ডাকে, সে একটা বুদ্ধি দিল। মানুষ যেহেতু ভূতের ভয় পেতে একই সাথে ভালোবাসে এবং ভয় পায়, সেহেতু মানুষকে ভালোবেসে ভয় দেখাতে হবে। তাদের কোনও ক্ষতি করা যাবে না, তবে ইচ্ছামতো উপদ্রব করা যাবে। এই বুদ্ধিটা সবার মনে ধরলো। ভূতদের হেডকোয়ার্টার্সে ওই সভার মিনিটস লিখে তখনই ফ্যাক্স করা হল। মিনিটসের ফুটনোটে অতি জরুরি ভিত্তিতে কিছু ফোর্থ জেনারেশন ভূত চাওয়াও হল।
এর দুইদিনের মধ্যেই অনেক ভেবেচিন্তে কমপক্ষে ৫-৭ জনের আলাদা-আলাদা দল ঠিক করে দিয়ে প্রায় শ’ দেড়েক ভূতকে ভয় দেখানোর অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে বিশেষ কয়েকটা অদৃশ্য ভূতোকপ্টারে সে গ্রামে পাঠানো হল। ওদের প্রত্যেকেরই উচ্চতা দুই থেকে আড়াই ফিট। পোশাক হিসেবে ওরা বোরকা (ছেলেদেরকে ভয় দেখানোর সময়) কিংবা আলখাল্লা (মেয়েদেরকে ভয় দেখানোর সময়) টাইপের জামা পরে। ওদের পছন্দের রঙ সাদা। পছন্দের খাবার ম্যাপ্‌ল ওয়ালনাট ফ্লেভারের মোভেনপিক আইসক্রিম। ওরা লম্বা-লম্বা গাছের ডালে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। ওরা অবসরে উচ্চাঙ্গ সংগীত এবং গজলচর্চা করে। ওরা যখন মাথা দোলায়, তখন সাধারণত পুরো শরীরটাই দুলতে থাকে। ওরা নাচতেও জানে। ভূতদের সংবিধানে সাম্বা ডান্স ছাড়া অন্য সবধরনের ডান্সই অনুমোদিত। ওদের জেনেরিক নেম কিঁচনি। ওরা ভদ্র এবং ভৌতিক। ওরা নির্দিষ্ট কোনও ধর্ম পালন না করলেও কখনওই অনেক ধর্ম পালন করা মানুষের মতো অধর্ম পালন করে না। ওরা ভাল ভূত হিসেবে পরিচিত এইজন্যে যে ওরা কাউকে অযথা বিরক্ত করে না, কারওর কাছ থেকে খাবার কেড়ে খায় না; প্রয়োজনে মানুষের বাসা থেকে না বলে খাবার নিয়ে আসে। ওদের সমাজে চুরি করা অমার্জনীয় গর্হিত অপরাধ, তবে না বলে নিয়া আসাটা কোনও অপরাধের মধ্যে পড়ে না। ওরা কারওর উপকার করে না, এটা কোনও কথা না। বরং কথা এই যে, ওরা কারওর কোনও ক্ষতি করে না। এটাই সবচেয়ে বড় উপকার যা মানুষ করতে পারে না, কিন্তু ওরা পারে। ওরা চুপচাপ ঘাপটি মেরে থাকতেই ভালোবাসে। পৃথিবীতে নোবডি হয়ে থাকাটা সুখকর না হলেও ওদের পৃথিবীতে নোবডি হয়ে থাকাটা বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হয়। ওদের ট্যাগলাইন---নেই কোনও দ্রিমদ্রিম, খায় শুধু আইসক্রিম। ওরা মানুষ দেখলেই খুশি হয়ে ওঠে, গাছের ডালেডালে লাফাতে-লাফাতে নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করার সময় ওরা আদর করে নিচের লোকজনের গায়ে থুতু ছিটাতে থাকে। যখন লোকে ওদের এই ভালোবাসা নিয়ে মাইন্ড করে কিংবা কটূক্তি করে, তখন ওরা ওদের হৃদয়ের নিখাদ ভালোবাসার কথা সামনাসামনি জানাতে গাছের উঁচু-উঁচু ডাল থেকে লোকের ঠিক সামনেই ঝুপঝুপ শব্দে লাফিয়ে পড়ে। ওদের এই লাফ মারাতেই আনন্দ। এরপর ওরা ওদের ঝকঝকে সফেদ দাঁতগুলো বের করে ওই লোককে হাসিমুখে সম্বোধন জানায়। ওদের হাসিতে মেয়েদের হাসির মতো হিহি শব্দ হয় না; ওদের হাসির শব্দ হিঁহিঁ, একটু জুনিয়র ভূতদের হাসি চিঁচিঁ। এই হাসি ভূতের হাসি হলেও ভৌতিক নয় মোটেও। ওদের যে হাসিতে ভূতের ভালোবাসা, সেই হাসিতেই মানুষের ভয়।
ওরা সত্যিই খুব কষ্ট পায় যখন কেউ ওদের অতি আদরে অজ্ঞান হয়ে যায়। একবার এক সফটহার্টেড মেয়েভূত এক সুদর্শন যুবককে চুমু খেতে গেলে সেই যুবক ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। এতে সেই কোমলমতি মেয়েভূতটা অভিমান করে ৭ দিন আইসক্রিম খায়নি। পরে ওই মেয়েভূতটা সেই যুবকের বিয়ের বাসরঘরে গিয়ে হাজির হয়ে যুবকের চিবুকে আলতো করে চুমু খেয়ে আসে। ব্যাপারটাতে নববধূ ভয় পেয়ে চিৎকার করতে-করতে অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর তার অভিমান ভাঙে। পরবর্তীতে এটা প্রমাণিত হয় যে, ওর অভিমান ভাঙার পেছনে ওই মিষ্টি করে চুমু খাওয়া নয়, বরং ওই নববধূর অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এতে স্পষ্টতই তার ঈর্ষা প্রকাশ পায়। ভূতদের সংবিধানে পরশ্রীকাতরতার কোনও নিয়ম নেই বলে ওর শাস্তি হিসেবে ওর উপর গ্রামের কোনও হ্যান্ডসাম পুরুষকে উত্যক্ত করার ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। ওর জন্য অ্যাডাম-চেজিং চিরতরে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ওকে দেখে শিক্ষা নিয়ে আর কখনওই কোনও মেয়েভূত মেয়েমানুষের মতো ঈর্ষান্বিত হওয়ার ছেলেমানুষি করার সাহসই করেনি। একটা মেয়েভূতের কাছে একটা হ্যান্ডসাম ছেলেকে জ্বালাতে না পারার চাইতে বড় শাস্তি আর নেই।
আপনারা যারা ভাবছেন, আমি স্রেফ মজা করছি, তাদেরকে আমি পরামর্শ দেবো, বিশ্বাস না হয় তো সেই গ্রামে গিয়ে দেখে আসুন। (গাড়িভাড়া না হয় আমিই দেবো।) ভূত নিয়ে মজা করার মতো অতোটা মজার মানুষ আমি কোনওভাবেই নই। আমি নিজে ভূতের খোঁজে সেই গ্রামে গেছি। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবক’টা বড়-বড় গাছের নিচে ঘুরেছি। ভূতদের সিক্সথ সেন্স খুবই প্রখর হয়। ওরা হয়তোবা কোনও না কোনওভাবে বুঝে গিয়েছিল, আমি ওদের নিয়ে ফেসবুকে লিখবো। তাই ওরা আমাকে ভালোবাসা দেখাতে সামনাসামনি আসেনি; মনের ভালোবাসা মনেই রেখে দিয়েছে। ওরা না এসে প্রমাণ করলো, ওরা আছে। ভূতের অনস্তিত্বই তো ভূতের অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এতে আমি ওই ভূতদের ভূতত্ব নিয়ে যা-ও আগে একটুখানি সন্দিহান ছিলাম, ওটাও কেটে যায়। ওদের অনুপস্থিতিই ওদের অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ওরা আসেনি বলেই আমি সন্ধ্যার পর আর ছিলাম না। কারণ, আমি আধুনিক মানুষ হওয়ার ভাবটাব যতোই নিই না কেন, আমি অতোটা সাহসী হই যে ভর সন্ধেবেলাতেও মাঠেজঙ্গলের মধ্যে গিয়ে গা ছমছম করা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কিঁচনিদের প্রতি আমার সামনে এসে লম্ফননৃত্য প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবো। হোক ২ ফিটের ভূত! ভূত তো! ২০-২৫টা একসাথে এসে লাফিয়ে-লাফিয়ে কামড়াতে শুরু করে যদি? ওদের মাথায় কী আছে, আমি কি জানি? ও বাবা! সেকথা ভাবলেও ভয়ে আমার গায়ে এখনও কাঁটা দিয়ে ওঠে, গায়ের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সবক’টা লোমই খাড়া হয়ে যায়!
পুরো ব্যাপারটার আরও বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যার জন্য আমি আমার বাল্যবন্ধু মিসির আলির সাথে ফোনে কথা বলেছি। ওর মতে, ঐ কিঁচনিরা আসলে একেকটা বড়সড় আকারের প্যাঁচা। বাকি গল্পগুলো লোকের মুখেমুখেই বানানো এবং ছড়ানো। তবে, মিসির আলির এই কথাটা আমার কোনওভাবেই বিশ্বাস হয় না। আমি জানি এবং মানি, ওরা অবশ্যই কিঁচনি নামের কিউট-কিউট সাদা ভূত। কেন? ৩টা কারণে। এক। প্যাঁচা কি কখনও বড়বড় সাদা দাঁত বের করে হাসে? উত্তর হল, না, হাসে না। দুই। মেয়ে প্যাঁচারা কি সুদর্শন পুরুষদের প্রতি বেশি আগ্রহী? না, কোনওভাবেই না। তিন। সবচেয়ে বড় কারণ হল, ওদের সিক্সথ সেন্স ওদেরকে আমার সামনে আসতেই দেয়নি। ওরা যদি না-ই থাকবে, তবে এই না-আসার বুদ্ধিটা আসার জন্য ওদের মাথাগুলোই বা কীভাবে এল?
অতএব, ওরা আছে। ওরা কিঁচনি ভূত। (নাকি, ভূতনি? কে জানে!)
শেষকথা। যদি কখনও একটা তেলাপোকাও মারেন, তবে মারার আগে অন্তত একশ’বার ভেবে নেবেন, যদি ওর মৃত্যুর পর ওর বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, (ফেসবুক রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সিঙ্গেল না হলে) ওর গার্লফ্রেন্ড কিংবা বয়ফ্রেন্ড, (ম্যারিড হলে) ওর শ্বশুরের ফ্যামিলির তেলাপোকাগুষ্ঠি, (আমার মতো নিঃসঙ্গ থাকতে পছন্দ না করলে) ওর বন্ধুবান্ধব সবাই এসে যদি আপনার উপর প্রতিশোধ নেয়, আপনি বাথরুমে যাওয়ার দুইটা মাত্র স্পঞ্জের স্যান্ডেল দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে নামতে পারবেন কি? খুবই ভাল হয় যদি আগেভাগেই ওর টাইমলাইনে গিয়ে চেক করে দেখে নেন, ও মৃত্যু নিয়ে রিসেন্টলি কোনও স্ট্যাটাস দিয়েছে কি না।
ভূত ও ভগবান---ইনাদের কেউই অবিশ্বাসীদের কোনও ডিস্টার্ব দেন না, ঘাঁটান না। অতএব, আপনাদের পিলিজ লাগে, ভূতে বিশ্বাস করুন, ভয়ে মরুন।