ক্যারিয়ার আড্ডা @ কে স্কয়ার

 
গতকালকের ক্যারিয়ার আড্ডার মূল বক্তা সুফি মিজানুর রহমান অনেকগুলো লাইফ সিক্রেট শেয়ার করেছেন। উনি মাসিক ১০০ টাকা বেতনে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরু করে আজকের অবস্থানে এসেছেন সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায়। এখন তিনি প্রতিমাসে ৬ কোটি টাকা ট্যাক্স দেন। উনার কথা বলার দৃঢ়তা, দীপ্তি, কর্মস্পৃহা দেখলে বুঝে নেয়াটা সহজ নয় যে এই মানুষটির বয়স ৭৩। চমৎকার গানও করেন। গতসন্ধ্যায় সবার মাঝে যে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কিছু কথা মনে গেঁথে রাখার মত। একটি বলছি। আপনি অন্যদের তুলনায় কতোটুকু বেশি পরিশ্রম করছেন, সেটাই নির্ধারণ করে দেবে, আপনি অন্যদের তুলনায় কতোটুকু বেশি দূর যাবেন। আপনার চাকরিতে যতটুকু করা যদি শুধু ততটুকুই করেন, তবে আপনি চাকরি থেকে যতটুকু আপনার পাওয়ার কথা শুধু ততটুকুই পাবেন। উনি এই বয়সেও দিনে ২০ ঘণ্টা কাজ করেন। উনার নিজের লাইফ সিক্রেটগুলোকে উনি বলেছেন বড় হওয়ার ‘ট্যাবলেট’। এরকম অনেক ট্যাবলেটের খোঁজ উনি গল্পের মাধ্যমে গতকাল দিয়ে গেছেন।
যেটি দেননি, কারণ তা সম্পর্কে হয়তো উনি নিজেও কখনও আলাদা করে কিছু ভাবেননি, ব্যাপারটা তাঁর সহজাত, সেটি হল, মানুষকে প্রচণ্ড সম্মান দিয়ে কথা বলা। উনি এত বড় মানুষ হয়েও সবাইকে খুব সম্মান দিয়ে কথা বলেন। ফলের ভারে গাছ নত হয়। এ আর রাহমানের একটা কথা আছে: “কোনও কাজে সফল হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম আমাদের বিনয়ী হওয়া প্রয়োজন।” অনেক বড় মানুষের কথা। বড় মানুষের কথা শুনতে হয়। একজন এ আর রাহমান পেতে কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়। তাই উনারা যা বলেন, সেটি মানতে হয়, নিজের জন্যই। আমি আপনি কয়েক যুগ সাধনা করলেও কি উনার একটা কম্পোজিশন সৃষ্টি করতে পারব? বলতে পারেন, কী দরকার? করতেই হবে কেন? আমি বলি, আমি আপনি এমন কী করেছি যেটা পৃথিবীর মানুষকে আনন্দ দিচ্ছে? আমি আপনি এ পৃথিবীতে না আসলেই বা এমন কী ক্ষতি হতো? আরেকজনকে সম্মান করলে নিজের সম্মানও বাড়ে। বাবাকে কোনওদিন কারওর সাথে দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি। উনি বলেন, “কারওর সাথে দুর্ব্যবহার করলে তুই কোনদিনও জানতে পারবি না, তুই জীবনে এমনকিছু হারাচ্ছিস যেটার জন্য সে দুর্ব্যবহারটা দায়ী। কখনও কারওর মনে কষ্ট দিস না।” ধরুন, আপনি কারওর সাথে দুর্ব্যবহার করলেন। পরবর্তীতে আপনার কোন এক কাজে কারওর হেল্প দরকার। সেই ব্যক্তি আবার আপনি যার সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন, তার পরিচিত। যদি উনি আপনার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে দেন, তবে আপনি সে হেল্পটা নাও পেতে পারেন। মানুষকে ‘না’ বলতে হয় হাসিমুখে।
আরেকটা বলি। কারওর কথার মাঝখানে কথা না বলা। জীবনটা টকশো নয়। আপনার কথা বলাটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, আরেকজনের কথা বলাটা ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যখন আপনি কারওর হেল্প চাচ্ছেন, তখন তাকে অবশ্যই এমন কিছু কথাও বলতে দিতে হবে, যেগুলো আপনার কাজে লাগবে না, কিন্তু সেগুলো বলতে না দিলে উনার আপনাকে হেল্প করার ইচ্ছেটুকু পুরোপুরি চলে না গেলেও কমে যাবে। কারওর কাছ থেকে হেল্প চাওয়ার নিয়ম হচ্ছে, এটা মাথায় রাখা, কেউ আপনাকে হেল্প করতে বাধ্য না। এই যেমন, গতকাল সুফি মিজানুর রহমান যখন বলছিলেন উনার অসুস্থ স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য একাএকা ব্যাংকক পাঠিয়ে উনি আমাদের আলো ছড়াতে মাঝে এসেছেন স্রেফ ভাললাগা আর দায়িত্ববোধ থেকে, তখন আমার আপনার মনে হতেই পারে, “উনার স্ত্রী অসুস্থ, এতে আমার কী? ওই ভদ্রমহিলা তো আমার আমার কেউ নন। আমি কেন এসব কথা শুনব?” ধরুন, আমি উনাকে থামিয়ে আমার যা দরকার সে প্রসঙ্গে চলে গেলাম। একটু ভাবুন তো, আমি যদি উনার অনুভূতিকে শ্রদ্ধা না করি, তবে উনি কেন আমার জন্য কথা বলবেন? কী দায় উনার? এ পৃথিবীতে সফল তো অনেকেই হয়, কিন্তু নিজের সফলতার সিক্রেটগুলো শেয়ার করতে দেখেছেন কয়জনকে? নিজের কথাই বলি। এই কয়েকদিন হল, আমার বাবা স্ট্রোক করেছেন। বাবা-মা অসুস্থ হলে কেমন লাগে, সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। নিজে অসুস্থ হলেও অতোটা কষ্ট হয় না। আমি অসুস্থ বাবাকে রেখে ক্যারিয়ার আড্ডায় গেছি শুধু এক ধরনের তাগিদ থেকে, মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়ার তাগিদ। সবাই কত কষ্ট করে আমার কথা শুনতে এসেছেন, আমি না গেলে কীভাবে হয়? দাউদ স্যারও বিশেষভাবে আসতে বলেছেন। না গেলে কী হতো? সুফি মিজানুর রহমান কালকে ক্যারিয়ার আড্ডায় না এলে উনার কী এসে যেত? আমি আজকের অবস্থানে যে মানুষটির জন্য এসেছি, যে মানুষটি আছেন বলেই সবার মাঝেই আলো ছড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছি, সে মানুষটিকে নিয়ে দুএক মিনিট বললে যদি আপনার খুবই বিরক্ত লাগে, সময় নষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয়, অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছি বলে মনে হয়, তবে আমি আপনাকে বিনীতভাবে বলব, দয়া করে আপনি আমার ধারেকাছে আসবেন না। আমার আবেগকে যে সম্মান করবে না, তাকে হেল্প করার কোন দায় নেই আমার। কাউকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করতে গেলে উনি যদি আপনার সাথে এমন আচরণ করতেন, তাহলে আপনার কতটা মন খারাপ হতো, ভাবতে পারেন? কারওর কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার বুদ্ধি হল, আপনার যা দরকার, তা নয়, বরং উনি যা বলতে ভালোবাসেন, সেটা উনাকে বলতে দেয়া। বাজি ধরে বলতে পারি, আপনি যতটুকু সাহায্য চাচ্ছেন, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি পাবেন। অপেক্ষা করুন, ধৈর্য ধরুন, আপনি যা চাচ্ছেন তা নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন।
আয়ান আর নিক্সনের কথা শুনলাম। ওরা বরাবরই খুব ভাল বলে। গতকাল ছিল আয়ানের জন্মদিন। আমি সবাইকে অনুরোধ করলাম, সবাই মিলে যেন বলে, শুভ জন্মদিন! সবাই বলল। আমরা সবাই মিলে কেক কাটলাম। খুব মন ভাল করে দেয়া একটা দৃশ্য! কাউকে খুশি করতে পারলে অনেক অনেকবেশি ভাল লাগে। মানুষ সবচাইতে বেশি সম্মানিত হয় ৩টা সময়ে---জন্মদিনে, বিয়ের দিনে, মৃত্যুর দিনে। (কেউ যদি ভাবেন, উনার জন্মদিন, আমার কী? এটা আমার বিসিএস-এ কী কাজে লাগবে? তবে আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করব, আপনি ক্যারিয়ার আড্ডায় আসবেন না। আমি এখানে স্বপ্ন দেখতে শেখাই, নিজের এবং অন্যের আবেগকে শ্রদ্ধা করতে শেখাই, দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে শেখাই। বিসিএস ক্যাডার গড়া আমার উদ্দেশ্য নয়।) নিক্সন আমার সম্পর্কে বলল, কীভাবে আমার কথায় ওর দুলাভাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, উনার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া সন্তানকে দেশের কাজে লাগাবেন। এর আগে উনার ইচ্ছেই ছিল ওকে এ লেভেল পাস করানোর পর ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন। ভদ্রলোক আমাদের ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন, ট্রেনিং একাডেমীতে উনাদের একটা ক্লাস নেয়ার সুযোগ হয়েছিল। আবু দাউদ স্যারের কথা বলাই বাহুল্য। উনাকে দেখি আর মনে পড়ে যায় লিও টলস্টয়ের সেই অমোঘ প্রশ্নটি---What do men live by? স্যারকে অনুরোধ করব যেন উনি সবসময়ই এভাবে করে আমার পাশে থাকেন। এই সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি আমাদের অনেক দায়বদ্ধতা আছে। অল্প ক’দিন বাঁচি, সমস্যা নেই। কিন্তু যতদিন বাঁচব, একাএকা বাঁচব না। সবাইকে বাঁচতে শেখাবো, সবাইকে নিয়েই বাঁচব। ভাবিকেও ধন্যবাদ আমাদের পাশে থেকে সাহস যোগানোর জন্য। শামীনা ম্যাডামকে ধন্যবাদ সবসময়ই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য। রোটারি ক্লাব অব খুলশী প্রতিবারের মত এই অনুষ্ঠান আয়োজনের পেছনে থেকে আমাদের কৃতজ্ঞ করেছেন। এবার আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন ফিনলে প্রোপার্টি আর টি কে গ্রুপ। তাদেরকে ধন্যবাদ। দুচোখে স্বপ্নমাখা একঝাঁক তরুণ এই অনুষ্ঠানকে সফল করতে সবধরনের সাহায্য করেছেন। কালকের খবরটি আজকে অনেক মিডিয়াতে এসেছে। তাদেরকে ধন্যবাদ।
গতকালকের আড্ডাটা আমার সাথে আড্ডা ছিল না, তবুও বলেছি---একটু কম। অন্যান্য আড্ডায় বলি ৫-৬ ঘণ্টা, কালকে বলেছি পৌনে ১ ঘণ্টার মত। জানি না কতোটুকু কী দিতে পেরেছি। প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে বেশিটুকু দেয়া যায় না। সবার সাথে অনেক ছবি তুলেছি, সেগুলোর বেশিরভাগেই ম্লান মুখে পোজ দেয়া। আমার এই অক্ষমতাটুকুকে ক্ষমা করবেন আর আমার বাবার জন্য প্রার্থনা করবেন। যদি আমি কোনওদিন আপনাকে খুব সামান্যটুকুও দিতে পারি, তবে আপনার কাছে অনুরোধ করছি, আমার বাবা-মা’র জন্য প্রার্থনা করবেন। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, মানুষের প্রার্থনা কাজে লাগে। ঈশ্বরের কাছে মন থেকে প্রার্থনা করি, “হে ঈশ্বর! আমার আয়ু থেকে কিছুটা আয়ু আমার বাবা-মা’কে দিয়ে দাও।” আমার ছোটভাইয়ের জন্যও প্রার্থনা করবেন। বেচারাকে একা হাতে আমাদের বাসার সবকিছু সামলে রাখতে হয়। গতকাল সন্ধ্যায় একটা ব্যাপারে আমি কিছুটা এমনভাবে রিঅ্যাক্ট করেছি, যেটা করাটা আমার ঠিক হয়নি। আমি ভুল করেছি। কালকে থেকে এটা মনে করে খুব কষ্ট পাচ্ছি। কেউ যদি আমার কোন কথায় ব্যথা পান, তবে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি লজ্জিত এবং অনুতপ্ত।