ক্লান্ত যোদ্ধার গান

 
আমার মাথাটি কুঁকড়ে যাচ্ছিল, আমার পায়ের পচা মাংস দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল।
এতদূর কেন হল? এরপরে কী হবে?
ক্লেদাক্ত, রক্তাক্ত, নোংরা এক রাস্তা হাজার দিক দিয়ে চলে যায়।
কোনদিকে, ঠিক? ডানে না বামে? সামনে না পেছনে?
খুঁজতে থাকুন। দেখবেন, আপনি নিজেকেই আর খুঁজে পাচ্ছেন না।
আপনার প্রতিটি কোষ পৃথকভাবে চিৎকার করতে থাকবে,
আপনার ফুসফুস বিদীর্ণ হয়ে রক্ত বেরোবে, তখন ভাববেন,
গাছ, পাথর আর পাখি, দিনের শেষে এইসব অকেজোই!


রোমশ কুকুরদের কর্তারা যখন
ফিটফাট হয়ে বড় কালো ডানাদুটো যত্নে লুকিয়ে রেখে
সন্ধের লালআলোয় পাঁচতারকা রেস্তোরাঁয়
মানুষ খেতে বসেন,
তখন আয়নায় দেখি,
আমার মন কুঁচকে যাচ্ছে,
আমার হৃদয় গলা ফাটাচ্ছে,
আমি ভয় পাচ্ছি।


ঘরের প্রতিটি কোণে ভয়,
কাঠবেড়ালি বিড়বিড় করে উঁকি দিচ্ছে,
আমার বুকের মধ্যে সংকোচন আর প্রসারণের ছন্দ টের পাচ্ছি,
কিছু ছায়ার দৈত্য সামনের বারান্দায় বসে আছে।
আমার শক্তি আলোতেই, অথচ কোথাও কোনো বাতি নেই……
এমনি করে বসে থাকতেথাকতে আরও কিছু ঘ্যানরঘ্যান হজম করতে হল।


হঠাৎ আমি শিস দিয়ে উঠলাম, তার শব্দ আদালতপাড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল!
প্রতিটি কোণে আজ নব্য আতংকবিরোধীরা বসে আছে।
ওদের রক্তাক্ত চোখ জ্বলজ্বলে, কথাবার্তা ফিটফাট,
ওদের কেউকেউ নাকি একদিন গোলাপগাছের আড়ালে সুখ খুঁজে পেয়েছিল।
ওদের নিরীহ কলমগুলি আদতে বেশ সেয়ানা,
এবং প্রতি রাতেই ওদের সরব হতে দেখা যায়। এইটুকুই ওদের আমলনামা।


আমার মস্তিষ্কের কোষগুলি যখন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিচের দিকে তাকায়,
ওদের মধ্যে তখন উন্মাদনা লক্ষ্য করি, এবং কোনো অনুকম্পা খুঁজে পাই না।
কেবল কখনওকখনও আমার মধ্যে একটি
বিভ্রান্তিকর ছোট্ট প্রার্থনা আসে---
হে ঈশ্বর! কোনওভাবে আমাকে একজোড়া স্বচ্ছ নীল চোখ দাও,
যে চোখ বেদনা গিলতে পারে।


আমার কপালের পেছনের জঙ্গলটায় আগুন জ্বলছে,
উল্কার বজ্রকণ্ঠে সন্ধের আলো এসে পড়ছে,
আমার শিরা দিয়ে সে উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে রক্তের ভেতরে।
কিবোর্ডের গলির মধ্য দিয়ে আমি গতকালকের আগের দিন বলেছিলাম,
কিছু দুঃসহ স্মৃতি সবসময়ই সাহায্যের জন্য চিৎকার করে।
একটি বীভৎস বৃষ্টি আঁকাবাঁকা গাছগুলিকে সরিয়ে দেয়,
চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়, ভীত প্রশ্নচিহ্ন রেখে যায়।
………হায়, আজ কিবোর্ড আছে বলেই বেঁচে আছি!


একটি ভয়ার্ত পুরুষকণ্ঠ চিৎকার করে ওঠে: আগুন হবে?
আমি চোখ বন্ধ করে দ্বিগুণ চিৎকারে জবাব দিলাম,
এই দুঃসময়ে কে আগুন রাখে? নেভাতেই-বা আসে কে?
এক চর্মসার ছেলে ফ্যাকাসে বেগুনি রঙের শার্টের মধ্যে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে।
তাকে দেখে মাথায় এলো, একে তো আমি চিনি!
আমি ওকে চিনলেও ওর অশ্রুটাকে আগে কখনও চিনতাম না।
আমরা যাদের চিনি, তাদের অশ্রুকে আমরা চিনি না।
অতএব, আমি খুশিমনে ধরে নিলাম, সে আগুন চেয়েছিল সিগ্রেট ধরাবে বলে।


সবুজ রাস্তায় চলতেচলতে ক্লান্ত খচ্চরগুলি ঘুমিয়ে পড়েছিল।
সন্ধের বাতাসে কিছু পুরানো বাঁশি গান শোনাচ্ছে,
ছাগলছানা লাফাচ্ছে না, কাঁদছে। কয়েকটি অন্ধকার বছর কেটে গেছে
বেহালায় ভালোবাসার ভুলভাল সুর তুলেতুলে,
গভীর রাত্রে হাঁটার সময় জ্যোৎস্নার প্রশংসা করেকরে,
হৃদয় থেকে বের হয়ে আসা জলপ্রপাতের জলে স্মৃতি ধুয়েধুয়ে।


তারপর, রাতের শরীর থেকে অনেক দূরে, শ্যাওলাগুলির ওপরে, একটি
বদ্ধ উন্মাদ হাস্যকর সব গানে পৃথিবী জয় করতে চেয়েছিল।
তার কণ্ঠস্বর অভিশপ্ত, তার প্রসারিত বাহুতে ক্রমেই উন্মাদনার বান জেগে উঠছিল,
তার বিভ্রান্ত মন সকলের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছিল---
আমিই দেবতা, বাকি সবাই পাগল!
আমি মৃদুভাবে কেবল এইটুকুই বলতে পেরেছি:
হে মহাত্মা! এইসব গান দুর্দান্ত সময়ের গভীরতম সংগীত।


এরপর আমার আঙুলগুলি দিয়াশলাইয়ের কাঠি কাঁপায়,
মোমবাতি জ্বালায়, আমার মৃত পূর্বপুরুষদের মাথার খুলি জড়িয়ে ধরে।
যখন নিজেকে কবর দিই, তখন আমি একজন অপরাধী পুরোহিত হিসেবে স্বীকারোক্তি দিই:
হ্যাঁ, মৃত্যুর শোক আমাকে ঘিরে রেখেছে যদিও নরকের অভিশাপ আমাকে ঘিরে ফেলেছিল।