ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭ (১৯৬২)

আমার রিভিউ পড়তে ভাল লাগে না। আগে থেকেই গল্পটা জেনে ফেলতে বিরক্ত লাগে। এটা অনেকটা সময়ের আগেই বার্থডে কার্ড পাঠিয়ে দেয়ার মতো।……….যে মুভিটার রিভিউ লিখছি, সে মুভির নায়িকা ক্লিও রিভিউ পড়তে পছন্দ করে না। সে অনিন্দ্যসুন্দরী আমার এ রিভিউ পড়বে না, এই স্বস্তিতে লিখছি।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি কারো জন্য না, বরং কোনোকিছুর জন্য অপেক্ষা করে আছো।

কিছু টেস্টের রেজাল্টের জন্য।

ওহ্‌! তুমি স্টুডেন্ট?

না। কিছু মেডিকেল টেস্ট করিয়েছি।

তুমি কি উদ্বিগ্ন এটা নিয়ে?

হ্যাঁ, খুব।

তুমি কী নিয়ে ভয় পাচ্ছ?

আমার ধারণা, আমার ক্যান্সার হয়েছে। সন্ধ্যায় নিশ্চিতভাবে জানতে পারবো।

অন্য কিছুও তো হতে পারে।

আমাকে এক জ্যোতিষী বলেছে, আমার ক্যান্সারই হয়েছে।

তুমি এসবে বিশ্বাস কর?

আমি সবকিছুতেই বিশ্বাস করি, সবকিছুকেই ভয় পাই। পাখি, ঝড়, এলিভেটর, সুঁই। আর এখন ভয় পাচ্ছি মৃত্যুকে। খুব বেশি ভয় পাচ্ছি।

অ্যালজেরিয়ায় থাকার মানেই হচ্ছে, তোমাকে সবসময়ই ভয়ের মধ্যে থাকতে হবে।

কী ভয়াবহ!

আমরা মারা যাচ্ছি। কোনো কারণ ছাড়াই। ভাবলে খুব খারাপ লাগে। এরকম ফালতুভাবে মরার চাইতে বরং একটা মেয়েকে ভালোবেসে মরে যাওয়া ভাল।

ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭, ১৯৬২ সালের। দেড় ঘণ্টার এ মুভিতে গায়িকা ক্লিওর জীবনের ২ ঘণ্টার গল্প বলা হয়েছে। ক্লিও একজন সুন্দরী গায়িকা। বয়স অল্প, নিজের খ্যাতি ও সৌন্দর্যে নিজেই মুগ্ধ। সে স্বার্থপর, অহংকারী। কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, নিজের সম্পর্কে ভালভাল কথা ভাবতে ও শুনতে ভালোবাসে। সে একটা বায়োপসি করিয়েছে, বিকেল ৫টায়। রেজাল্ট পাওয়ার জন্য তাকে ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সে জ্যোতিষীর কাছে যায়। জ্যোতিষী বলে, ক্লিওর জন্য মৃত্যুর মতো কিছু একটা অপেক্ষা করে আছে, তবে এমনও হতে পারে, এ মৃত্যুর অর্থ, ক্লিওর বর্তমান অবস্থার মৃত্যু—পরিবর্তনের দিকে যাত্রা। জ্যোতিষীর কথা শুনে ক্লিও কাঁদতে থাকে। প্রচণ্ড ভয় আর অস্থিরতা নিয়ে সে কীকরে ২ ঘণ্টা কাটাচ্ছে, তা নিয়েই এ মুভি। মাথায় প্রচণ্ড টেনশন ও উদ্বেগ নিয়ে বাঁচা একজন স্বল্পখ্যাত সুন্দরী গায়িকার মনস্তত্ত্ব আর কাজকর্ম কেমন হতে পারে, মুভিতে সেটি দেখানো হয়েছে। ক্লিওর অ্যাপার্টমেন্টে বেড়ালের বাচ্চাগুলির ঝগড়া, রাস্তায় একটা শিশুর ছোট পিয়ানো বাজানো, ক্যাফেতে প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে ঝগড়া। এইসব কিছুও ক্লিওকে স্পর্শ করছে না। তার ধ্যান, ভাবনা সবই টেস্টের রেজাল্ট কী হবে, সেটাকে কেন্দ্র করেই। এ সময়ে ক্লিও একটা টুপির দোকানে যায়। সে বিভিন্ন ডিজাইনের টুপি পরে আয়নায় দেখে নিচ্ছে কোনটাতে তাকে কেমন দেখাচ্ছে। মূলত এ দৃশ্যের মধ্য দিয়ে পরিচালক আগনেস ভার্দা গায়িকা ক্লিওর নানান পারসোনা দেখিয়েছেন। উদ্বেগ ভুলেথাকার জন্য মেয়েরা কত কিছু যে করে! নিজের মনের কাছেই নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা! কেউ রান্না করে, কেউ গান শোনে, কেউ মুভি দেখে, কেউ বেড়াতে যায়, কেউ ফোনে কথা বলে, কেউ ফেসবুকিং করে, কেউ ননস্টপ খাওয়াদাওয়া করে, কেউ বাসায়ই নানান পোশাকে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, কেউ মেকআপ নেয়। ব্যাপারটা হল, ঠিক সে মুহূর্তের মানুষটার কাছ থেকে পালিয়ে অন্য মানুষের কাছে আশ্রয় খুঁজে ফেরা। গল্পের নায়িকা টুপি বদলেবদলে পরছে আর ভাবছে, আমি দেখতে কত সুন্দর! আমাকে যেকোনো টুপিতেই বেশ মানিয়ে যায়! মজার ব্যাপার, এ ফিল্মে পরিচালক ক্লিও চরিত্রকে এমনভাবে আমাদের সামনে তুলে এনেছেন, সিনেমা দেখার সময় আমরা তার চিন্তা আর কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তার মনস্তত্ত্বের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে থাকি, সেখানে তার কুসংস্কার কিংবা সুন্দরীসুলভ আদিখ্যেতা আমাদের মনে প্রশ্রয় পায় না। সে দৃশ্যে আগনেস ভার্দার ক্যামেরা কায়দা করে ক্লিওর চারপাশের পৃথিবীটাকে তুলে এনেছে। জানালার শার্সি দিয়ে দেখা যায় কিছু সৈন্য মার্চ করে চলে যাচ্ছে—অ্যালজেরিয়ার যুদ্ধের পূর্বাভাস। কিছু হ্যাট ক্লিওকে মানায় না, তার মাথায় সেগুলি দেখতে বাজেই দেখায়। ক্লিওর নিজেরও সেগুলি পছন্দ হয় না। হ্যাট পরার আগে হ্যাটটা পরলে কেমন দেখাবে, জানা সম্ভব নয়। ক্লিওর ভাগ্যেও এমন কিছু আছে, যা জানতে পারলে ক্লিও সহজে মেনে নিতে পারবে না। ভাল কথা, ব্যাকগ্রাউন্ডে ক্লিওর অ্যাসিটেন্ট মহিলাটি মন খারাপ করে বসে থাকে, যেমন করে আমরা বসে থাকি শেষ দৃশ্যের সময়টাতে।

সিনেমায় শুরু থেকেই আমরা পরিচালকের হাত ধরে ক্লিওর পৃথিবীতে ঢুকে পড়ি। ক্লিও একটা মেয়ে, যাকে তার চারপাশের কেউ বোঝে না। সে সুন্দরী, স্বল্পখ্যাত, আত্মমুগ্ধ। তার চিন্তাভাবনা অন্য দশটা সুন্দরীর মতোই—অগভীর, অপরিপক্ব। সবাই তার প্রতি মনোযোগী, সেও তা চায়, কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাকে তার মতো করে কেউ বুঝতে পারে না। তার সহকর্মীরা তার অসুখের ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায় না, তারা কেবল নতুন গানটা কেমন হবে, ক্লিও সেটা কীভাবে গাইবে, এইসব নিয়ে উদ্বিগ্ন। তার প্রেমিক মুখে অনেক সহানুভূতি দেখালেও প্রকৃতপক্ষে ক্লিওর জীবন নিয়ে অতোটা ভাবে না, ফিল্ম দেখলে বোঝা যায়। ক্লিও নিজেও এটা বোঝে, কিন্তু তার একাকীত্বের একজন সঙ্গী দরকার বলে মুখে কিছু বলে না। তার বেস্ট ফ্রেন্ড তাকে পছন্দ করে ঠিকই, কিন্তু সেও নিজের কাজ ও জীবন নিয়ে ব্যস্ত। ক্লিওর মানসিক অবস্থা কিংবা রোগ নিয়ে কেউই কোনো আগ্রহ দেখায় না। এটা উদাসীনতা নয়, এটাই বাস্তবতা। ক্লিও বেঁচে থাকবে কি মরে যাবে, এটা নিয়ে ভাববার গরজটাই-বা কারো মধ্যে কেন আসবে? অন্য কারো জন্য তারও কি আসে অমন গরজ? এ অবস্থায় ওই দুই ঘণ্টায়ই ক্লিওর সাথে পার্কে এক সৈনিকের দেখা হয়। তার নাম অ্যান্টোইনি। সে ক্লিওর ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়, ক্লিওর মন ভাল করে দিয়ে তার সব উদ্বেগ দূর করার চেষ্টা করে যায়, এবং টেস্টের রেজাল্ট জানার পরও ক্লিওকে আন্তরিকভাবে সময় দেয়। এমন কেয়ারিং কারো প্রতি ক্লিওর ভালোবাসা জন্মাবে, স্বাভাবিক। জন্মেছেও। ক্লিওর মুখ থেকে শোনা যাক: আমার মনে হয়, আমার আর ভয় লাগছে না। আমি এখন সুখী।

জীবনটা ছোট, সাথে অনিশ্চিতও। তাই জীবনের প্রতিটি অনুভূতিই গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসার মানুষগুলির সাথে, বন্ধুদের সাথে, সহকর্মীদের সাথে, এবং নিজের সাথে সুন্দর সময় কাটানোর নামই জীবন। বাঁচার অর্থই হল সময় কাটানো। এ সময় আমরা নতুন কোথাও বেড়াতে যেতে পারি, নতুন কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি, নতুন কিছু করে দেখতে পারি, এমন-কী নতুন কারো প্রেমেও পড়তে পারি। জীবনে উচিত অনুচিত বলে কিছু নেই, বরং মৃত্যুর সময়ে ‘অমুক কাজটা করে দেখতে পারলাম না’, এমন আফসোস নিয়ে মরার চাইতে সাধ্যের মধ্যে সাধ মিটিয়ে নেয়াই ভাল। কখন যে সময় শেষ হয়ে যায়, কে বলতে পারে! যেন মাত্র দুই ঘণ্টা আয়ু হাতে আছে, এমন ভাবনামগ্ন থেকে জীবনটাকে একজন সাধারণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ক্লিও মাথায় সারাক্ষণই মৃত্যুভয় নিয়ে কীভাবে কাটাচ্ছে, সেটা উপভোগ করার মতো। দুর্ঘটনার চাইতে দুর্ঘটনার ভয় আমাদের বেশি টেনশনে রাখে। ক্লিওর মতো আধুনিক ও অভিজাত একটা মেয়েকেও মৃত্যুচিন্তা কতটা ভীতবিহ্বল করে রাখতে পারে, রেখে আত্মঅনুসন্ধানের পথে নামিয়ে দেয়, তা দেখি, তার অসহায়ত্ব আমাদেরও স্পর্শ করে। ক্লিওর জার্নিটাও চমৎকার। প্রথম দৃশ্যে ক্লিওকে দেখি এক জ্যোতিষীর বাসায়, নিজের ভাগ্য জানতে উদগ্রীব এক তরুণী। শেষ দৃশ্যে ক্লিও নিজের নিয়তিকে মেনে নিয়ে পথচলতে সম্মত ও সমর্থ এক নারী। তার এই মানসিক পরিবর্তন হয়েছে এক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে, যা তার সকল দম্ভ, আত্মবিশ্বাস, স্বার্থপরতা, খ্যাতি সবকিছুর চাইতেও ক্ষমতাধর। বিপর্যয় মানুষকে বদলে অন্য মানুষে পরিণত করে।

শেষটাতে এসে ক্লিওর পরিবর্তনটা দেখতে খুব ভাল লাগে। সৈনিক অ্যান্টোইনি ক্লিওকে জীবনে প্রথমবারের মতো দেখিয়েছে, কীকরে নিয়তিকে মেনে নিয়ে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। ক্লিওর প্রতি তার আচরণটা শুরু থেকেই তেমনই ছিল, একজন ভদ্রমহিলার প্রতি একজন ভদ্রলোকের আচরণ যেমন হওয়া উচিত। পার্কের মধ্য দিয়ে ওরা দুজন যখন হেঁটে যাচ্ছিল কিংবা বাসে ভ্রমণের সময়টাতে, তার কথাবার্তা শুনে ক্লিওর যেন মাথায় এল: ‘জীবনে যা-ই আসুক না কেন, সেটিকে সহজে গ্রহণ করতে শেখো’। ততক্ষণে ক্লিও একজন ধীর, দায়িত্বশীল, পরিপূর্ণ নারী। এরপর যখন ক্লিও জানতে পারল, জ্যোতিষীর কথাই ঠিক, তার ক্যান্সার হয়েছে, দুইমাসের কেমো নিতে হবে, তখন তার সমস্ত আত্মগরিমা, আত্মমগ্নতা উবে যায়, সে ছেলেমানুষ থেকে মানুষ হয়ে ওঠে, তার ভেতরের প্রকৃত মানুষটা বেরিয়ে আসে যেন! আমরা বিশ্বাস করে ফেলি, এতক্ষণ ধরে আমরা তার যে পারসোনাটা দেখছিলাম, তা ছিল আসলে খুব চাপ আর টেনশনে থাকলে একজন মানুষ যেরকম আচরণ করে, তারই একটা প্রতিফলন, সেখানে ক্লিওর কোনো খুঁত বা ঘাটতি নেই, ক্লিও স্রেফ পরিস্থিতির শিকার। আচ্ছা, ক্লিও এবং অ্যান্টোইনিকে কোন ব্যাপারটা কাছে এনেছিল? অসুখ কিংবা অসুখের চিন্তা মানুষকে একা করে দেয়। মানসিক সংকটমুহূর্তে ক্লিওর এমন একজনকে দরকার ছিল, যে তার পাশে থেকে তার সব কষ্টের কথা শুনবে, যার মধ্যে সে তার আস্থার জায়গাটা খুঁজে পাবে, অ্যান্টোইনি ছিল ওরকমই কেউ, এই ব্যাপারটা? নাকি, কাছে এনেছে………ক্লিওর ক্যান্সার ধরা পড়লে, সে তো আর বেশিদিন বাঁচবে না, ওদিকে সৈনিক অ্যান্টোইনিও যেকোনো সময়ই যুদ্ধে প্রাণ হারাতে পারে, দুই জীবনেরই এমন অনিশ্চয়তা?

আপনি যদি বিকেল ৫টায় মুভিটি দেখতে বসেন, তবে মুভিটি শেষ হবার কথা সন্ধে ৭টায়, অথচ শেষ হয়ে যায় আধাঘণ্টা আগেই। প্রশ্ন হল, মুভির নামের প্রতি সুবিচার আর হল কই? তা জানতে মুভিটি দেখুন, উত্তরটা আবিষ্কার করতে ভাল লাগবে।