খেলা থেকে শেখা

ছোটবেলায় দুপুরে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে চুপি-চুপি অপেক্ষা করে থাকতাম, মা কখন ঘুমিয়ে পড়বে। মা ঘুমিয়ে পড়লে খুবই সন্তর্পণে দরোজার ছিটকিনিটা খুলে পা টিপে-টিপে বেরিয়ে পড়েই সিঁড়ি দিয়ে দুই ধাপ বাদ দিয়ে-দিয়ে লাফাতে-লাফাতে নিচে নেমেই সোজা মাঠের দিকে দৌড়! কারণ, মা বিকেলে ঘুম থেকে যে সময়ে উঠবে, ততক্ষণে অর্ধেক খেলাই হয়ে যাবে। তখন গিয়ে কী লাভ? দুপুরে মাকে বলে বের হওয়াও সম্ভব নয়। মা কিছুতেই যেতে দেবে না। বলবে, “এখন ঘুমা। ঘুম থেকে উঠে বিকেলে মাঠে যাবি।” আমাদের বাসা ছিল চট্টগ্রামের আইস ফ্যাক্টরি রোডে। বাসার কাছেই পিটিআই স্কুলের মাঠ, কলেজিয়েট স্কুলের মাঠ, রেলওয়ে কলোনির মাঠ। খুবই বোকাসোকা গোছের ছিলাম বলে এর চাইতে দূরে যাওয়ার সাহস কখনওই করিনি। তাছাড়া মায়ের মার খাওয়ার ভয় ছিল। ওখানে কত-কত ছেলেরা ফুটবল আর ক্রিকেট খেলত। আমি যেতাম, ওদের সাথে মিশতে চাইতাম, ওরা মারামারি করতো, আমাকেও কখনও-কখনও মারত, আমি মার খেয়ে বলতাম, “আমি মাকে সব বলে দেবো।” এটা শুনে ওরা হাহাহোহো করে হাসত। ওদিকে মাকে বলে দিলে মা আরেক দফায় মারতেন। “তুই ওখানে গেছিস কেন?” ভাববেন না যে বেশ ভাল খেলতাম। বরং খেলাটেলা পারতাম বলে মনে পড়ে না। আমাকে ওরা বলত, “বল নালায় পড়ে গেলে, কিংবা দূরে ময়লার স্তূপের মধ্যে হারিয়ে গেলে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে তোকে খেলায় নেবো।” ওটাই নাকি ফিল্ডারের কাজ। আমি বলতাম, “আরও অনেকেই তো আছে! ওদেরকেও বলো না!” ওরা ধমকে বলত, “বল না নিয়ে আসলে তোকে ব্যাটিংই দিব না।” কিন্তু ব্যাটিং দূরে থাক, একটা বলও ব্যাটসম্যানের দিকে ছুঁড়তে কখনওই দেয়নি আমাকে।

খুব রাগ হতো ওদের উপর। কিন্তু ভয়ে কিছুই বলতাম না। যদি মারে? যদি খেলায় না নেয়? রাগ করে মাঝেমাঝে অন্য কোনও দলের সাথে ফুটবল খেলতে চলে যেতাম। দেখতে খুবই নাদুসনুদুস ছিলাম। মারামারি করতাম না বলে কখনওই বুঝতে পারিনি না যে আমার গায়েও অনেক শক্তি ছিল। চাইলে আমিও দু’ঘা লাগিয়ে দিতে পারতাম। ফুটবল খেলায় আমাকে গোলকিপার রাখত। বল কাটাতে পারতাম না, শুধু ল্যাং খেয়ে-খেয়ে ধপাস করে পড়ে যেতাম। ওরা আমাকে গোলপোস্টেই রাখত, আর বলতো, “বাপ্পি, শোন! বল মারবি পায়ের সাইড দিয়ে। নখ দিয়ে বলে লাথি মারলে নখ উঠে যাবে তো!” আমি সাইড দিয়ে মারতাম না, আঙুলের নখ দিয়েই লাথি মারতাম। মনে হত, ওতে জোর পাওয়া যায় বেশি। গোলকিপিং করতে গিয়েই টের পেতাম, আমার গায়ে অনেক শক্তি। অনেকেই গোলবারের সামনে এসে বলতো, “এই মোটাইয়া, সর সর! নাহলে খেলার পর মাইর খাবি!” আমি কিছুতেই সরতাম না, বরং বলে গায়ের সব শক্তি দিয়ে লাথি মারতাম। পরে বুঝেছি, যারা মারে, ওরা মারবে বলে ভয় দেখায় না, সরাসরি মেরে দেয়। আমার জীবনে ফুটবলে লাথি মারার প্রতিভা ওই পর্যন্তই।

আরেকটা সহজ খেলা ছিল ক্যাচ-ক্যাচ খেলা। ২ জন কিংবা ৪ জন মিলে চলত খেলাটি। টেনিস বলকে ছুঁড়ে দিয়ে আরেকজনকে ধরতে বলতাম। যতটা কঠিনভাবে সম্ভব, ততটা কঠিনভাবে ক্যাচ ছুঁড়ে দিয়ে ধরতে বলতাম, বলত। মাঝে-মাঝে গায়ের সব শক্তি দিয়ে বল শূন্যে ছুঁড়ে মারতাম। বলটা অনেক অনেক উঁচুতে উঠে যেত। নামার সময় দৌড়ে গিয়ে যার আগে যে ওটা ধরতে পারে। এই খেলা নাকি ক্রিকেট খেলায় লাগে। ক্রিকেট খেলতে হলে আর ‘ক্যাচ ধরা’ শিখতে হবে। হায়, আমি সারাজীবন ক্যাচ ধরা শিখেই গেলাম, ক্রিকেট আর খেলতে পারলাম না। কখনও-কখনও প্র্যাকটিস করতে করতেই শিখতে হয়। শুধু গ্রামারই শিখলাম, আর প্র্যাকটিস করলাম না, ওতে প্রায়ই আর সময় পাওয়া যায় না, ফলে বেসিকটা দুর্বলই থেকে যায়। অনেক ভাল গ্রামার জানি, কিন্তু সেটাকে ব্যবহার করতে জানি না, তাহলে অমন জানার কোনো দামই নেই। লোকে বেশি-বেশি গ্রামার পড়তে থাকে, কারণ ওতে কষ্ট হয় কম, নিজের মাথা খাটাতে হয় না, আরেকজনের মাথায় চড়ে পড়াশোনা করা যায়, ফাঁকিবাজির অনেক বুদ্ধির মধ্যে এটি একটি। পড়াশোনার একমাত্র মূলমন্ত্র: খাইট্টা খা!!

সাতচাড়া খেলায় সাতটি সিমেন্টের/ কাঠের/ মাটির ঢেলাকে (ওইগুলির নাম ‘চাড়া’) পরপর সাজিয়ে রাখা হত। ওই সজ্জাকে মাঝখানে রেখে দুইদিকে দুইটি দল টেনিস বল ছুঁড়ে-ছুঁড়ে সেটিকে কীভাবে যেন ভাঙার চেষ্টা করে যেত। পুরোটা ভেঙে গেলে এরপর সেই বলটি প্লেয়ারদের গায়ের উপর ছুঁড়ে মারা হত। যার গায়ে বল লেগে যাবে, সে আউট! এরকমই কিছু একটা ছিল বোধ হয় খেলাটি। ওটার আরেকটা ভার্সনের নাম ছিল বোমফাইট। সেখানে কখনও-কখনও মারামারিও বেধে যেত। এখনও মনে আছে, বলটা গায়ের উপর মারার সময় সবাই ভীষণ নির্দয়ভাবে মারত। অনেক ব্যথা লাগত গায়ে। শীতকাল হলে সে ব্যথা দূর করতে বাসায় ফিরে মায়ের চোখ লুকিয়ে বাম মালিশ করতে হত। অবশ্য মা কীভাবে-কীভাবে যেন জেনেই যেতেন। আরেক দফায় মার খেতাম। ছোটবেলার মায়েরা ভীষণ নিষ্ঠুর হয়। জীবনটাও সাতচাড়ার মতন, যাকে সুবিধে তাকে মনের খুশিমতো মেরে নিয়ে যত অসুস্থ সুখ পেয়ে নেয়া যায় আরকি! No justice!

মার্বেল খেলা ছিল আমার আরেকটা প্রিয় খেলা। এক বিঘৎ পরিমাণ জায়গার দূরত্বে বৃদ্ধাঙ্গুলিকে রেখে বাকি আঙুলগুলির যেকোনোটিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষের মার্বেলটিকে নিজের মার্বেল দিয়ে আঘাত করতে হয়। অনেক পাকা খেলোয়াড় আরও দূর থেকেও কাজটি করতে পারত। মার্বেলে লাগাতে পারলেই ওর কাছ থেকে আরেকটা মার্বেল পাওয়া যেত। মার্বেলের হরেক রকমের বৈচিত্র্য ছিল। মার্বেলের ভেতরের কারুকাজের উপরে ভিত্তি করে মার্বেলের দামের ভিন্নতা হতো। কারুকাজ করা মার্বেলকে বলতাম, ডাজ্ঞি মার্বেল। (কথাটা হয়তো ‘দাগ’ থেকে আসতে পারে।) প্রতিপক্ষের কাছ থেকে নিজের নৈপুণ্যে মার্বেল লাভ করা ছিল অনেক প্রেস্টিজের একটা ব্যাপার! অনেকেই সব মার্বেল হারিয়ে ‘ফতুর’ হয়ে যেত। তখন আবার ধার করে খেলা যেত। আরেকটা খেলা ছিল যেটাতে সবাই সমান সংখ্যক মার্বেল দিত আর সেগুলি একসাথে এক হাতে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে ছুঁড়ে মারতে হত। আরেকটা মার্বেল দিয়ে সেগুলির যেকোনোটিকে ঠেকাতে পারলেই মার্বেলগুলি সব একসাথে পাওয়া যেত! তবে একটার চাইতে বেশি মার্বেলে লেগে গেলেই ওই ‘দান’এ কিছুই পাওয়া যাবে না। কাজটিকে খুব সহজ মনে হলেও নাবালকদের পক্ষে এটা খুব একটা সহজ নয়। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে এরপর বিশেষ কায়দায় আঙুলের জোরে মার্বেলকে সেই গর্তে ফেলতে পারলেও মার্বেল লাভ করা যেত। মার্বেল খেলায় সবার টার্গেটই থাকত, যে যত আরেকজনের মার্বেল নিজের পকেটে খেলে জিততে পারে। বড়বেলায়ও তো দেখি সেই একই নিয়ম! যে যত বুদ্ধি করে আরেকজনের পকেটের টাকা নিজের পকেটে পুরতে পারে!

লাট্টু বা লাটিম ঘোরানো শেখাটাও একটা ভীষণ কঠিন ব্যাপার। একটা বিশেষ ধরনের দড়িতে লাটিমটাকে পুরোপুরি পেঁচিয়ে হাতের আঙুলের জোরটা ওপরের দিকে একটা হ্যাঁচকা টানে দিয়ে লাটিমটাকে মাটিতে ফেললে ওটা ঘুরতে শুরু করে। বিশেষ কায়দায় ওটাকে দুই আঙুলের ফাঁকে হাতের তালুতে নেয়া যায়। হাতটাকে এদিকওদিক হেলিয়ে লাট্টুটাকে সোজা করে ঘুরতে দিতে হয়। প্রথম-প্রথম লাট্টুর ঘূর্ণায়মান পেরেকে হাতের তালুতে ভীষণ সুড়সুড়ি লাগে। পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। দড়ির প্যাঁচ খুলে মাটিতে পড়ার আগেই বিশেষ কায়দায় লাটিমকে হাতের তালুতে নিয়ে আসা যায়। লাট্টুকে যে যত ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, লাট্টু তার হাতের তালুতে তত সুন্দরভাবে ঘোরে। জীবনটা লাট্টুর মতন। আপনি জীবনকে যত সুন্দরভাবে চালাবেন, জীবনও আপনাকে তত সুন্দরভাবে চালাবে।

ছোটবেলায় ব্যাডমিন্টন খেলাকে বলতাম ককখেলা। শাটলককের সংক্ষিপ্ত রূপ হল কক। (ককের মোরগ ছাড়া আর কোনো অর্থ তখন জানতাম না বলেই অবলীলায় বলে ফেলতাম, চল, কক খেলি! হাহাহাহা…) গায়ের জোরে র‍্যাকেট দিয়ে ককটাকে যত দূরে পাঠানো যায়, এটাই ছিল আমার নীতি। খেলার কিছুই বুঝতাম না। শুধুই গায়ের জোরে খেলতাম। প্রায়ই আমাকে ওরা খেলায় নিত না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম এই আশায় যদি ৫ মিনিটের জন্য হলেও র‍্যাকেটটা একটু দেয়! জীবনেও তা-ই। এখানে যার নৈপুণ্য যত কম, সুযোগের জন্য তাকে তত বেশি অপেক্ষা করে থাকতে হয়।

খেলার নাম মনে নেই। দুইজন মাটির উপরে মুখোমুখি হয়ে বসত। এরপর এক পা সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে দুইজনের পায়ের পাতা একসাথে বিপরীত দিক থেকে এমনভাবে ঠেকিয়ে ছুঁইয়ে রাখা হত যাতে পায়ের পাঁচটি আঙুল পরস্পরের সাথে শক্ত করে বিপরীত দিক হতে লেগে থাকে। এরপর একজনের যেকোনো একটি হাতের পাঞ্জা টানটান করে দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে কনিষ্ঠাকে পায়ের দুই সংযুক্ত বৃদ্ধাঙ্গুলির ওপরে রেখে আরেকজন একইভাবে ওর বৃদ্ধাঙ্গুলির ওপর কনিষ্ঠা রেখে ওর এক হাতের পাঞ্জাকে উলম্বভাবে ছড়িয়ে দিত। এভাবে চার হাতের পাঞ্জা পরপর সাজিয়ে একটা দেয়াল তৈরি হতো। বাকিদেরকে দূর থেকে দৌড়ে এসে লাফ দিয়ে সে দেয়ালের উপর দিয়ে পার হতে হত। যদি কারও শরীরের কোনও অংশ দেয়ালে লেগে যায়, তাহলে সে আউট। এই খেলায় কারচুপি ছিল এই যে, যে দুইজন বসে থাকত, ওরা কখনও-কখনও হাতটা একটু উপরে উঠিয়ে ওকে আউট করে দিত। জীবনের দেয়ালগুলিও পার হওয়ার সময়ে যাতে দেয়ালই আমাকে ভেঙে না দেয়, সেদিকে খেয়াল করে পার হতে হয়! যে যত বেশি উঁচুতে লাফাতে পারে, সে তত সহজে বাধাকে অতিক্রম করতে পারে। বাধা টপকাতে উঁচুতে উঠতে শেখাটাই বড় কথা।

পাঞ্জা লড়ার খেলায় শুধু শক্তিতেই হয় না, এটা কখনওই বুঝিনি। স্রেফ গায়ের জোরেই জিতেছি যে কয়েকবার জিতেছি। বেকুব টাইপের ছিলাম বলে যখনই প্রতিপক্ষের হাতটিকে প্রায় কাত করে ফেলতাম, তখনই কেউ একজন সুড়সুড়ি দিয়ে আমার হাতের জোরটি ছাড়িয়ে নিত আর আমি হেরে যেতাম। যে আমাকে জিততে দিল না, তাকে কখনওই একটা বকাও দিতে পারিনি। তখন থেকেই এটা মাথায় কাজ করতো, মুখে নয়, মাথায় জেতা শিখতে হবে। খেলাটা কীভাবে হল, সেটা কারও মাথায় থাকত না, শুধু এটাই মাথায় রাখত সবাই, বাপ্পি হেরে গেছে! জীবনটাও এরকমই! নচিকেতার গানেও পাই: কেন পথ নিয়ে মাথাব্যথা? জেতাটাই বড় কথা, হেরে গেলে শেইম শেইম! ইটস্‌ অ্যা গেইম!

শক্তির আরেকটা খেলা ছিল দড়ি টানাটানি খেলা। একটা দড়ির দুই মাথা ধরে দুটো দল দুইদিক থেকে টানত। সে খেলায় জেতার একটা বুদ্ধি ছিল, প্রতিপক্ষকে একটু ছাড় দিয়ে, মানে, দড়িটা একটু ওদের দিকে হেলিয়ে দিয়ে যখনই ওরা জিতে যাচ্ছে ভেবে একটু অসতর্ক হবে, তখনই এক হ্যাঁচকা টানে দড়িটা নিজেদের দিকে টেনে নেয়া। এটা ভীষণ মজার একটা টেকনিক। প্রতিদ্বন্দ্বীকে এটা বিশ্বাস করাতে হবে যে, আপনি বোধ হয় হেরে যাচ্ছেন, আর পারছেন না, তাই ছেড়ে দিচ্ছেন। তখন ও আপনাকে সহজ টার্গেট ভাববে এবং নিজের চেষ্টা একটু কমিয়ে দেবে। ঠিক তখনই ওকে বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে মোক্ষম আঘাতটা করতে হবে নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে। লড়াইয়ের সময় নিজের শক্তিপ্রদর্শনই শেষ কথা নয়, এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন প্রতিদ্বন্দ্বী নিজের শক্তিপ্রদর্শন কিছু সময়ের জন্য হলেও বন্ধ রাখলেও জিতে যাবে, এরকমটা ভেবে নেয়।

হাডুডু খেলতাম। একটা দাগের দুইদিকে দুইটি দল ভাগ হয়ে যেত। একটি দলের একজন দম আটকে রেখে হাডুডুডুউউউউ… হাডুডু লক্ষণ, তোরে ধরতে কতক্ষণ… বলতে-বলতে অন্যদলের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওদের কাউকে ছুঁয়েই দম আটকানো অবস্থাতেই নিজের দলের দিকে চলে আসার চেষ্টা করত। কাজটি ঠিকভাবে করতে পারলে যাকে ছুঁয়ে দিয়েছে, সে আউট। এর আগেই দম ফেলে দিলে কিংবা ওকে ওরা ধরে আটকে রেখে দিতে পারলে, ও নিজেই আউট। যদি একবার দম আটকে দাগের ওপারে নিজেদের জায়গায় চলে আসতে পারে, তবে আর ভয় নেই। কাজ ফুরোনোর আগেই শান্তিতে দম নিলে অনেক কাজই আর করা হয়ে ওঠে না। কিছু-কিছু কাজ করতে হয় একদমে!

ডাংগুলি খেলায় গাছের ডালের একটা খুব ছোট অংশকে আরেকটা বড় অংশ দিয়ে পিটিয়ে অনেকদূরে পাঠাতে হত। প্রয়োজনে একাধিকবার পিটানো যাবে। এটি ছিল গলফ খেলার বালক সংস্করণ, শুধু বলের পরিবর্তে ছোট মড়া ডাল। এ খেলায় অনেকসময়ই ছোট ডালটি গিয়ে খুদে খেলোয়াড়দের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করে বসত। এ খেলায় মায়ের হাতের মার খাওয়ার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি ছিল। জীবনটাও ডাংগুলি খেলার মতন, একে যে যত বেশি আঘাত করে যত দূরে নিয়ে ফেলতে পারে! প্রবল আঘাত করা ছাড়া জীবনটাকে ছোটানো অসম্ভব ব্যাপার।

বাসার ভেতরেও কিছু খেলা হতো। এই যেমন, কানামাছি। একজনের চোখ কাপড় কিংবা গামছা দিয়ে বেঁধে দেয়া হতো, সে কানামাছি। ওর কাজ আমাদের যে কাউকে হাতড়ে-হাতড়ে ধরে ফেলা। যে ধরা পড়বে, সেই পরবর্তী কানামাছি। সবাই বলত, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছোঁ! অনেকেই কানামাছির গালে, মাথায়, পিঠে থাপ্পড় মারত। তখন কায়দা করে ওকে ছুঁয়ে দিতে পারলেই ও নেক্সট কানামাছি। জীবনে আমরা যখন অসহায় হয়ে থাকি, তখন সবাই শুধু আঘাত করে। এমনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, যেটা সেই আঘাতকারীকেই অসহায় অবস্থায় ফেলে দেয়। কাপড় কিংবা গামছা বাঁধারও কিছু কূটকৌশল ছিল। চোরাবুদ্ধি অ্যাপ্লাই করে বাঁধতে পারলে চোখটা কায়দা করে উপরেনিচে ওঠানামা করলেই বাঁধনটা আলগা হয়ে একটু একটু দেখাও যেত। এরকম দেখলে আমরা সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠতাম, ও চোরামি করছে! ও চোরামি করছে!! হবে না! হবে না! খেলবো না!!

আরেকটা খেলা অসম্ভব ভাল লাগত। পেনফাইট বা কলমযুদ্ধ। নিজের কলমটাতে বিশেষ কায়দায় জোরে টোকা দিয়ে প্রতিপক্ষের কলমকে ধাক্কা দিয়ে টেবিল থেকে ফেলে দিতে হবে। বাসায় কিংবা ক্লাসে এই খেলায় কতকত ভাল কলম যে নষ্ট করেছি, তার কোন হিসেব নেই। মোটা আর ভারি কলম দিয়ে খেললে যে সুবিধা পাওয়া যেত, তা হল, সেটিকে অন্য কলমগুলো ফেলে দিতে পারত না। কলমখেলায় হেরে গিয়ে কত বন্ধুর সাথেই দুই-তিনদিন কথা বলিনি! কলমের আসল জোর যে মাথা থেকে আসে, সেটা বোঝার বয়স যতদিন হয়নি, ততদিনই এই খেলাটি চালিয়ে গেছি।

লুকোচুরি ছিল বেশ মজার একটা খেলা। একজন হতো চোর। ও চোখ বন্ধ করে এক জায়গায় বসে থাকত আর বাকিরা যে যার মতো করে লুকিয়ে পড়ত। কে যে কোথায় লুকাত, তার কোনো ঠিকঠিকানা থাকত না। খুব কঠিন-কঠিন জায়গাতেও লুকিয়ে যেত অনেকেই। যে লুকিয়ে যায়, সে-ই ভাবে, সে বুঝি আর কোনোদিনও ধরা পড়বে না। লুকিয়েই বলত, কুলুক!! ওর কাজ, যেকোনো একজনকে লুকানো স্থান থেকে খুঁজে বের করা। যে ধরা পড়বে, সেই পরবর্তী চোর। এই খেলায় সূক্ষ্ম কারচুপি চলত। কেউ কেউ আরেকজনকে ধরিয়ে দিত। এমনকি লুকিয়ে থাকার জন্যও দুনিয়াটা ফেয়ার না! এ দুনিয়ায় লুকিয়েও শান্তি নাই!

লুডুখেলা ভীষণ ভাল লাগত। বিশেষ করে সাপলুডু। লুডুর আরও একটা খেলা আছে যেখানে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়, প্রতিপক্ষ চাইলে এর আগেই আপনার গুটিটি কেটে দিতে পারেন। এতে একটু বুদ্ধিও লাগে। কিন্তু সাপলুডুতে কোনও বুদ্ধি লাগে না। ভাগ্য আপনাকে যেদিকে নিয়ে যায়, আপনি সেদিকেই চলে যাবেন। লুডুর দানে বেশি পড়লেই যে ভাল আর কম পড়লেই যে খারাপ, তা কিন্তু নয়। কোনটা সবচাইতে ভাল, তা আগে থেকে জানার কোনো সুযোগই নেই। আপনি স্রেফ ১ পেয়েই মই বেয়ে সাতাশ ঘর ফাও-ফাও এগিয়ে যেতে পারেন, আবার সর্বোচ্চটা, মানে ১৭ পেয়েও সাপের পেটে সাতাশ ঘর নিচে নেমে যেতে পারেন। লাইফেও আমরা মইটা যে কোথায় আছে, আর সাপটা কোথায় আমাকে খেয়ে নেয়ার অপেক্ষায় আছে, সেটা আগে থেকে কেউই বলতে পারি না। বড় চাকরি, বড় মাইনে, বড় যন্ত্রণা—এমন জীবন কোনও জীবনই নয়! কিছু কম মানেও অনেক বেশি হতে পারে! You can never know! বেশি পাওয়ার বিড়ম্বনায় অনেকেরই জীবনযাপনই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। অমন প্রাপ্তির চাইতে একটু কমে বেশি ভাল থাকাই তো ভাল! দুই রকমের লুডুতেই চুরি করার সুযোগ আছে। আঙুলের সূক্ষ্ম খেলায় লুডুর গুটি ঘুরে দানের সংখ্যা বদলে যেতে পারে। তবে যে সংখ্যাটি আসবে, সেটি খুব বেশি হলেও কখনও-কখনও আপনার জন্য আত্মঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। আবার ওই চুরিতে প্রাপ্তিযোগও প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে। জীবনেও এরকম হয়। Doing an unfair thing is not wrong. Doing an unfair thing and getting caught is wrong.

তাস খেলতাম। শুধু দুই ধরনের খেলাই পারতাম। তাস শাফল করে সবাইকে সমান ভাগে দিয়ে দেয়ার পর না দেখে একটা-একটা করে তাস উল্টে নিচে ফেলা হতো। যার তাসটি আগেরজনের তাসের অনুরূপ গোত্রের, সে-ই সব তাস পেয়ে যাবে। এটার নাম কী ছিল, মনে নেই। এটিই সবচাইতে সহজ শিশুতোষ তাসখেলা। আরেকটা খেলা ছিল কলব্রিজ। তাসের ওজন বুঝে কে কমপক্ষে কত পয়েন্ট পাবে বলে মনে করে, সেটা আগেই ঘোষণা করে দিতে হত। ওর চাইতে কম পেলে সেই সংখার আগে একটা মাইনাস বসে যেত। এভাবেই খেলা চলতে থাকত। কেউ-কেউ মাইনাসে-মাইনাসে একেবারে সব মানসম্মান খুইয়ে বসে থাকত। জীবনের খেলায়ও ওরকম। যার দূরদৃষ্টি যত ভাল, সে তত এগিয়ে। ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে না পারলে জীবন জুড়ে শুধু মাইনাসই থাকবে। হায়! জীবনের মাইনাসে-মাইনাসে কখনও প্লাস হয় না।

আমাকে দাবা খেলা শিখিয়েছিল আমার মামাতো ভাই। যেদিন প্রথম এই খেলাটা শিখি, সেদিন ভীষণ উত্তেজনায় মনে হচ্ছিল, এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খেলা! ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওর সাথে হেরে যাওয়ার জন্যই খেলেছিলাম সেদিন। এভাবে করে দুইদিন খেলার পর তৃতীয়দিনে ওর সাথে জিতে যাই। সেদিন আমার সে কী খুশি! ওস্তাদকে হারিয়ে দিয়ে মনে হচ্ছিলো, যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছি! এরপর থেকে মনে হতে লাগল, আমি খেলাটা শিখে গেছি। শুধু জিতলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, খেলাটা আমিও পারি! আমি এখন চাইলে সবাইকেই হারিয়ে দিতে পারব! জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হল, আমি শুধু জেতার জন্যই খেলব। আমি জানি, আমি খেললেই জিতব। অনেকগুলি জয়ের জন্য প্রথম জয়টা খুব খুব খুব জরুরি। সেদিনের পর থেকে দাবা খেলায় ভীষণভাবে মগ্ন হয়ে গেলাম। দাবা খেলতে পারে এমন কাউকে দেখলেই, খুব অনুরোধ করতাম, যাতে ও খেলে আমার সাথে। হারতাম, শিখতাম কেন হেরেছি, এরপর আবার খেলতাম, একটা সময়ে জিততামও। জেতার জন্য খেলা, নাকি খেলার জন্য জেতা? এটা একটা বড় প্রশ্ন! জিততে হলে খেলতে হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, খেলতে হলেও জিততে হবে। কখনওই জিততে না পারলে খেলতেই তো আর ইচ্ছে করে না!

এইচএসসি’তে চিটাগাং কলেজে পড়ার সময়ে যে কয়েকটি কারণে অনেকেই আমাকে চিনত, সেগুলির মধ্যে একটি হল, আমি ভাল ক্যারম খেলতে পারতাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কমনরুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ক্যারম খেলতাম। এই খেলাটি শিখেছিলাম এর অনেক আগেই। দুইরকমের খেলা পারতাম। একটা হলো কলাগাছ। সাদাকালো গুটিগুলি পরপর সাজিয়ে সবচাইতে সম্মানিত রেডটাকে মাঝখানে রেখে একটা গাছ সাজানো হয়। এরপর স্ট্রাইকারের যাদুতে যে যতটা গুটি ‘খেতে’ পারে। সাদা গুটির দাম ১০, কালোর ৫, রেডের ৫০। রেড খেলে আবার ‘কভার’ দিতে হবে, মানে রেডটা পকেটে ফেলার পর আরেকটা গুটি ফেলে রেড খাওয়াটাকে ‘জায়েজ’ করতে হবে। সর্বোচ্চ ৪ জনের মধ্যে যার গুটির টোটাল পয়েন্ট সবচাইতে কম, সবাই তত পয়েন্টের গুটি বোর্ডে দিয়ে আবারও খেলা শুরু করবে। এভাবে খেলতে-খেলতে যে আগে ফতুর হবে, সে আউট। আরেকটা খেলা হল বোর্ডখেলা। একটা টিম সাদা গুটি নিয়ে খেলবে, আরেকটা টিম কালো। রেডের পয়েন্ট ৫, বাকিগুলোর ১ করে। ক্যারম খেলায় স্ট্রাইকার ধরার কৌশল, ওটাকে আঙুলের কায়দায় ছুঁড়ে দেয়ার কৌশল, সরাসরি গুটির দিকে তাক করলে ভাল হয়, নাকি একটা গুটি দিয়ে আরেকটাতে তাক করলে বেশি সুবিধে হবে, নাকি বোর্ডের কোন একটা জায়গায় স্ট্রাইকার ছুঁড়ে পরোক্ষভাবে গুটিতে লাগালে গুটিটি পকেটে ঢুকে যাবে সহজে, এসব বুঝতে হয়। জীবনটাও এরকম। এখানে শুধু ছোটাটাই বড় কথা নয়, কীভাবে ছুটছি, সেটা বোঝাটাও খুব জরুরি। শুধু ছুটেই গেলাম, পেলাম না কিছুই—-জীবনের এরকম গল্পই বেশি!

আরেকটা খেলা ছিল বিজনেস গেম, মানে পাশাখেলা। এটা মূলত ভারতীয় খেলা। লুডুর বোর্ড আকৃতির একটি বিশাল বোর্ডে দুইটি গুটি হাতের তালুতে আড়াল করে দুই হাতের মাঝে গুটি দুটোকে ওলটপালট করে ছড়িয়ে দিতে হত। এরপর বিভিন্ন ব্যবসা সংক্রান্ত কাজকর্ম, যেমন জায়গা কেনাবেচা, বসতি স্থাপন করা, পরিবহনে মালামাল পাঠানো, বাড়িকেনা সহ বিচিত্র সব সিদ্ধান্ত নিতে হত খুব দ্রুততা, দূরদর্শিতা আর বিচক্ষণতার সাথে। সিদ্ধান্তে একটু এদিকওদিক হলেই বিশাল অংকের আর্থিক মাশুল গুনতে হতো। এই খেলাটি খেলার সময় বুঝতে পেরেছিলাম, যারা ব্যবসা করেন, নিজের ভাগ্য নিজেই গড়েন, অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন, তারা কিছুতেই সাধারণ মানুষ নন। ওরকম জীবন নিয়ে খেলার যোগ্যতা কিংবা সাহস সবার থাকে না। যারা ওটা পারেন, তারা নিশ্চয়ই অন্য সবার চাইতে আলাদা! আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম, আমিও ওরকম নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে নেবো! পরবর্তীতে ব্যবসা করা শুরু করেছিলাম, অনেকদূর এগিয়েও গিয়েছিলাম, কিন্তু শেষ করার আগেই লেজ গুটিয়ে পালিয়ে এলাম!

ছোটবেলায় আরও কী কী যেন খেলতাম। চোর-ডাকাত-বাবু-পুলিশ, নাম-দেশ-ফুল-ফল, গানের লড়াই, ফুলটোক্কা, কাটাকুটি (tic-tac-toe), কুতকুত, আরও কত কত বাহারি নাম! অতো মনেটনেও নেই। অনেক মজার মজার খেলা খেলে ফেলেছি নামটাম না জেনেই! কী জানি, ওগুলির আদৌ কোনো নাম ছিল কিনা! আমি হাই স্কুলে ওঠার পর আর কোনও দিনই কোনও আউটডোর গেমসে অংশ নিইনি। একবার ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ক্লাসের ছেলেরা সবাই মিলে আমাকে বহুকষ্টে রাজি করালো, যাতে ক্লাসছুটির পর আমি ওদের সাথে একটু ক্রিকেট খেলি। প্রথমদিকে আমি যখন বললাম, “আমি খেলব না। আমি খেলতে পারি না।” তখন ওরা বলল, “তোকে খেলতে হবে না, তুই শুধু দাঁড়িয়ে থাকবি। তোর কথা বললে স্যার মারবে না।” ওদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে রাজি হলাম। খেলার মাঠে আমি জাস্ট দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখেছি, ওরা কী করে। আর কিছুই না। ফার্স্ট বয় ছিলাম বলে ওরা আমাকে দিয়ে বলও আনায়নি। পরেরদিন ক্লাসে আমাদের ক্লাস টিচার সুনীল স্যার আমরা যারা স্কুলছুটির পর খেলেছিলাম, তাদেরকে ডেকে আমি বাদে সবাইকে ভীষণ পেটালেন। একজনের বেল্টে বিকটদর্শন ড্রাগনের বাকলেস ছিল। তাই ওর মাইর খাওয়ার পরিমাণ ছিল দ্বিগুণ। তখন এক ছেলে আর রাগ ভেতরে রাখতে না পেরে সাহস করে বলেই ফেলল, “স্যার, সুশান্তও ছিল আমদের সাথে।” তখন স্যার বললেন, “আরে গাধা, সুশান্ত তো ক্রিকেট খেলেও পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। আর তোরা তো ফেল করিস। খেললে সুশান্ত খেলবে, তোরা খেলবি কোন যুক্তিতে? ও যদি এখন ক্লাসে ড্রাগন, ড্রাকুলা, ভূতপেত্নীর বেল্টও পরে আসে, আমি তো ওকে কিছুই বলবো না। কারণ ও ক্লাসের সব পড়াই পারে। তোরা কিছু পারিস না, তাই তোরা যা-ই করবি, সেটাই খারাপ। যে পড়াশোনা করে না, তার সবকিছুই খারাপ। যার আসলই ঠিক নাই, তার কিছুই ঠিক নাই।” সেই ছোটবেলায় স্যারের এই কথাগুলি আমার মাথায় খুব ভালোভাবে গেঁথে গিয়েছিল। পরবর্তীতে স্যারের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাটি সারাজীবন কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। স্যারকে ধন্যবাদ।

একই শার্ট, অথচ একজনকে মানায়, আরেকজনকে মানায় না। অন্তত লোকে তা-ই বলে। কেন এরকম হয়? প্রথমজন দেখতে খুব সুন্দর বলে? নাকি, ওই শার্ট আর ওই ব্যক্তি একেবারে Rab Ne Bana Di Jodi, মানে Made for each other? সবসময়ই যে এরকম হয়, সেটা নাও হতে পারে। এমনটাই বেশি হয় যে, প্রথমজনের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এতে দ্বিতীয়জনের রাগ কিংবা অভিমান আসতেই পারে, কিন্তু একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, শার্ট মানায় শার্টের গুণে নয়, ব্যক্তির গুণে। সবাই শার্টটিকে দারুণ বলে ওই শার্ট যে পরে আছে, সে দারুণ বলেই। তাই সুন্দর পোশাক পরতে হলে সবার আগে সুন্দর মানুষ হতে হবে। নাহলে আপনি যা-ই পরেন না কেন, “আপনাকে ওটাতে মানিয়েছে” এটা বলার মতো কাউকেই পাবেন না। সফল মানুষের রংঢংও ভাল লাগে, আর ব্যর্থদের হক কথা শুনলেও গাজ্বালা করে। ওদেরকে সবাই বলে, “দুপয়সার মুরোদ নেই, শুধু মুখে বড় বড় কথা!” জীবনটা এমনই। কিচ্ছু করার নাই! Success is the sweetest excuse!

পৃথিবীতে সবাই সবকিছু পারে না। জীবনে সবাই সবকিছু পায় না। সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না। এর জন্য মনখারাপ করে থাকার কিছুই নেই। হাতি গাছে চড়তে পারল না বলে হাতি বানরের চাইতে নিকৃষ্ট, এমনটা কিছুতেই নয়। দেখতে হবে, যে যে কাজটি ভাল পারে, সে কাজে ওর পারফরম্যান্স কেমন। ক্রিকেট খেলায় আমি ছিলাম নালা থেকে বল নিয়ে আসার খেলোয়াড়। যারা আমাকে খেলা পারতাম না বলে খেলায় নিতে চাইত না, দুই পয়সারও পাত্তা দিত না, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে শান্তি পেত, তারা কিন্তু আসলেই বেশ ভাল খেলত। ওরা ক্রিকেটের পেছনে অনেক সময় দিত, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ওরা ভাল খেলোয়াড় হয়েছিল। আমি ক্রিকেট খেলা পারতাম না, তাই নালায় বল আনার বদলেও যদি ওরা আমাকে খেলায় নিত, “আমিও খেলছি” এটা ভেবে শান্তি লাগত। আমি নালা থেকে বল তুলে আনার বিনিময়ে আরও একটা জিনিস পেতাম, সেটা হল পরীক্ষায় ওদের চাইতে অংকে ৩৮ নম্বর বেশি পেতাম। ওরা পেত ৬০, আমি পেতাম ৯৮। তাতেও আমার কিছু বলার ছিল না যদি ওরা বড় হয়ে একেকজন সাকিব আল হাসান হত। যদি ওরকম কিছু করে দেখাতে পারত, তবে পুরো পৃথিবীই ওদেরকে সমীহ করত। সেটা তো আর হল না! তাহলে ওরকম পড়াশোনা বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলে জীবনে ওরা কী পেলো? ক্রিকেটও থাকুক, যদি পড়াশোনাটা পুরোপুরি ঠিক থাকে। নাহলে ক্রিকেট দেখেই সারাজীবন হাততালি দিয়েই কাটাতে হবে, নিজের কপালে আর হাততালি জুটবে না। আমাকে যারা ছোটবেলায় মারত, ওদের সব শক্তি ছিল গায়ে, মাথা ছিল ফাঁকা। শরীরের জোর আর মগজের জোরের মধ্যে বন্ধুত্ব আমি নিজে খুব বেশি দেখিনি। যার মাথা দিয়ে কাজ করার ক্ষমতা কম, ভগবান দয়াপরবশ হয়ে তাকে বাহুতে আর মুখে কিছু ক্ষমতা দিয়ে দেন।

আপনি যা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তার পেছনেই সময় দিলে সবচাইতে ভাল। Do what you love. Love what you do.