গুরুর পায়ের কাছে বসে/ প্রথম পর্ব

 
আমি যখন আমার জীবনে ভীষণ বাজে অবস্থার মধ্যে ছিলাম, বাজে অবস্থা মানে, লাইফে কোনও সেটলমেন্ট ছিল না, এস্টাব্লিশমেন্ট ছিল না, তখনকার কথা বলছি। তখন, দেখা যাচ্ছে, আমি চুয়েট থেকে অনার্স কমপ্লিট করিনি, আমকে সবাই দূর দূর ছাই ছাই করছিল। এবং, সমাজে আমার কোনও পাত্তা বলে কিছু ছিল না। এমনকি, আমার ফোনটাও কেউ রিসিভ করত না। আমি হয়তো কাউকে কোনও কাজেই ফোন করছি, কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না, এরকম একটা ব্যাপার ছিল। আমি এমন একজন মানুষ হয়ে উঠেছিলাম অন্যদের চোখে, যার ফোন রিসিভ করার কিছু নেই। আর দেখা যেত, বন্ধুরা সবাই মিলে কোথাও একটা গেটটুগেদারের মতো করছে, সেখানে আমার যাওয়াটা অলিখিতভাবেই বারণ ছিল। কিংবা আমি গেলেও কেউ আমার সাথে কথা বলতে বা আমাকে বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতে চাইত না। ওরা সবাই পাস করে বিভিন্ন জায়গায় চাকরিবাকরি করছে, আর আমি তখনও অনার্সই কমপ্লিট করতে পারিনি। আমি তো ইঞ্জিনিয়ার নই, আদৌ কখনও পাস করে বেরবো কি না, তার নেই ঠিক, তাই আমাকে বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতে ওরা একটু অস্বস্তিবোধ করত বোধহয়। তখনই আমি প্রথম বুঝতে পারি, আসলে যাদের আমরা চিন্তাভাবনা না করেই বন্ধু বলে ফেলি, ওদের বেশিরভাগই আসলে আমাদের ক্লাসমেট। ক্লাসমেট আর বন্ধুর মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য আছে। প্রথমটি বিরিয়ানি হলে দ্বিতীয়টি ভাত। ক্লাসমেটকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা যায় না, বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা যায়।


তো, তখন আমি লিখতাম শুধুই ইংরেজিতে। দুটো কারণে। এক, তখন ফেসবুকে বাংলাফন্টে লেখা যেত না। দুই, ইংরেজিতে চিন্তা করতে ও লিখতে আমার অনেক সুবিধে হতো। ইংরেজিতে লেখার কারণে যেটা হতো, বাংলাদেশে যাঁরা আমার বন্ধু ছিলেন ফেসবুকে, তাঁরা তেমন একটা ইংরেজি বুঝতেন না, বুঝলেও খুব ভারী কোনও লেখা হয় বুঝতেন না কিংবা এমনিই পড়তেন না, তবে হ্যাঁ, কয়েকজন বুঝতেন। আমার লেখায় ওঁদের নামগুলি বলতে চাইছি না, হয়তো ওঁরা বিব্রত হবেন। ওঁরা আমার লেখাগুলি দেখতেন, পড়তেন, আমাকে উৎসাহ দিতেন। ওঁদের বাইরে বেশিরভাগ বাংলাদেশি মানুষই পড়তেন না। আরও যাঁরা পড়তেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ভারতীয়। ওঁদের প্রায়ই অবাঙালি ভারতীয়, কিছু ছিলেন বিদেশি, কিছু ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিছু ছিলেন প্রফেশনাল, কিছু ছিলেন রাজনীতিবিদ, কিছু ছিলেন সিভিল সার্ভেন্ট। ওঁদের সবাই ছিলেন বিদেশি বা ভারতীয়।


তখন ফেসবুকে ফলো করার ফিচারটা ছিল না। মানে ফ্রেন্ডলিস্টের বাইরে কেউ কারও পোস্ট দেখতে পারতেন না। ফলে আমার লিস্টের লোকজনই আমার পোস্ট দেখতে পেতেন। যাকে তাকে লিস্টে রাখতাম না তখন। খুব বেছে বেছে মাত্র কয়েকজন ফেসবুক বন্ধু নির্বাচন করতাম। এখন যেমন চক্ষুলজ্জায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেককেই রাখতে হয়, তখন এমন কোনও ‘দায়’ ছিল না। এখন তো অনেককেই জ্ঞানী, যোগ্য, পণ্ডিত মেনে নিতে হয় চুপচাপ---চাকরিসূত্রে, ভয়সূত্রে, জীবনসূত্রে, আরও নানা-সূত্রে। তখন জীবনযাপনটা এত কঠিনভাবে বাধ্যতার সুতোয় বাঁধা ছিল না। আমার চাইতে যোগ্য, প্রজ্ঞাবান, উঁচু লোকজনের লিস্টে থাকতে চাইতাম সব সময়ই। যার কাছ থেকে শেখার কিছু নেই, এমন কাউকে আমি সব সময়ই এড়িয়ে চলেছি। তো ওঁদের পোস্টে গিয়ে গিয়ে কমেন্ট করতাম, বেশ ভারিক্কি চালেই। এমনভাবে ওঁদের সাথে মিশতে চেষ্টা করতাম, যাতে ওঁরা আমাকে কোনওমতেই হালকাভাবে না নেন। প্রয়োজনে নিজে স্টাডি করে ওঁদের পোস্টে কমেন্ট করতাম, ওঁদের সাথে ইনবক্সে আলাপ করার চেষ্টা করতাম। ওঁরা আমার মতো একজন নগণ্য কারও সাথে আলাপ জমাতেন আমার চেহারা দেখে নয়, আমার গ্রে-ম্যাটার দেখে। যাঁর কাছ থেকে কিছু শেখার আছে, আমি তাঁর পায়ের কাছে বসে যেতে রাজি, নিজের সমস্ত ইগো, অহংকার, মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে হলেও।


তখন তাঁদের মধ্যে একজনকে পেয়েছিলাম, যিনি ভীষণরকমের জীবনবোধসম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান, পণ্ডিত, দার্শনিক গোছের এবং অনেক অনেক উঁচু অবস্থানের একজন মানুষ। ওঁর নাম হচ্ছে গায়ত্রী তালরেজা। (নামটা ছদ্মনাম। আমি চাই না, আমার এই লেখা পড়ে কেউ ওঁর মতন একজন বড়ো মানুষকে বিরক্ত করুক।) উনি ছিলেন একজন চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। ডিজনিল্যান্ড পার্কের নাম তো আমরা সবাই কমবেশি শুনেছি। মজার ব্যাপার, সেখানকার ইঞ্জিনিয়ারদের বলা হয় ইম্যাজিনিয়ার। ওরা বিশ্বাস করে যে, ইম্যাজিনেশন ইজ মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান নলেজ, এবং ওরা ইম্যাজিনেশনকে খুব গুরুত্ব দেয়। তো ডিজনিল্যান্ডে উনি জব করতেন এবং উনি ছিলেন একজন আমেরিকান চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট, জন্মসূত্রে ভারতীয়। ভারতে থাকার সময় ওঁর রাজেন কাপুরের সাথে প্রেম ছিল। তো রাজেনকে তাঁর পরিবার মেনে নেয়নি। পরবর্তীতে রাজেন কাপুর অনেক সফল হন। উনি ভারতের সব চাইতে নামকরা ফিল্ম-প্রডিউসারদের মধ্যে একজন হয়েছিলেন। রাজেন কাপুরও আমার লেখার ভীষণ ভক্ত ছিলেন, তিনি আমাকে অনেকবারই মুম্বাই চলে যেতে বলেছিলেন ওই সময়। বলেছিলেন, ‘তুমি শুধু এখানে একবার আসো, তোমার বাদবাকি দায়িত্ব আমার। আমি তোমাকে আমার ফিল্মের নায়ক বানাব। তোমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।’ আমি যাইনি তখন। একধরনের অবিশ্বাস্য রকমের আত্মঅহমিকা ছিল। সে অহমিকাটা কীসের, আমি নিজেই জানি না। এখন বুঝি, এই পৃথিবীতে অনেক ধরনের গাধা থাকে।


গায়ত্রীদিদি বিয়ে করেন মহেশ চোপড়া নামে একজনকে, মানে ফ্যামিলি থেকে মহেশের সাথে দিদিকে বিয়ে দেওয়া হয়। মহেশ ছিলেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং পরবর্তীতে একটা নামকরা সফটওয়্যার-ফার্মের মালিক হন। ওই ফার্মটি আমেরিকার শীর্ষ দশটি সফটওয়্যার-ফার্মের একটি ছিল। আমি চাইলে সেখানে কাজ করে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে থেকে গিয়ে কয়েক কোটি ডলারের মালিক হতে পারতাম। সে ফার্মটির সাথে আমার যোগসূত্র নিয়ে আমার একটি লেখা আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তো গায়ত্রী তালরেজা চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট কিন্তু ইন্ডিয়া থেকে হননি, আমেরিকা থেকে হয়েছেন। ওটাকে রয়েল চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট না কী একটা নামে যেন ডাকে! উনি ওখানে সিএ কোয়ালিফাই করে ডিজনিতে জব নেন। একজন মানুষ কতটা শক্তিশালী হতে পারে, একজন মহিলা কতটা দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন হতে পারে, এটা তাঁর কাছ থেকে শেখার আছে! এটা কেন বললাম, ধীরে ধীরে বোঝা যাবে। উনি হচ্ছেন আমার জীবনের গুরু, দার্শনিক, আইডল, যা-ই বলেন না কেন। উনি না থাকলে আমি আজকের জায়গায় আসতে পারতাম না।


তো দিদি ডিজনিতেই চাকরি নেন চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে। উনি বিভিন্ন বই-পত্র পড়তেন। স্পিরিচুয়াল বই-ই উনি বেশি পড়তেন, সাথে মোটিভেশনাল বইও। ওঁর প্রিয় লেখক ছিলেন অশো বা ওশো, আপনি যেভাবেই উচ্চারণ করেন, ইংরেজিতে Osho লিখে। তাঁর দ্বিতীয় প্রিয় স্পিরিচুয়াল লেখক ছিলেন সদগুরু, ইংরেজিতে Sadguru। অশোর কথা আমি ওঁর কাছ থেকেই প্রথম শুনি এবং আমার মোটিভেশনাল বই পড়ার যে দীক্ষা, এই দীক্ষাটা হচ্ছে গায়ত্রীদিদির কাছ থেকে নেওয়া। উনিই প্রথম আমাকে মোটিভেশনাল বই পড়তে উৎসাহিত করেন। আমি তখন খুবই হতাশ ছিলাম আমার নিজের জীবন নিয়ে। মরে যেতে ইচ্ছে করত প্রতিদিনই। উনি আমাকে প্রথম পড়তে বলেছিলেন রোন্ডা বায়ার্নের ‘দ্য সিক্রেট’ বইটা। এটা পৃথিবীতে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় এই বই ৫ নম্বরে ছিল তখন। ১ নম্বরে ছিল মনে হয় বাইবেল। যা-ই হোক, ওঁর সাথে আমার প্রতিদিনই কথা হতো। উনি আমাকে সময় দেওয়ার বা আমার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ হচ্ছে আমার লেখা। উনি আমার লেখা পড়তে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসতেন। উনি আমাকে বলতেন দ্য লিটল ফিলোসফার এবং উনি আমাকে যথেষ্ট রকমের মূল্যায়ন করে নানান কথা বলতেন, মানে খুব সম্মান করে ও দাম দিয়ে কথা বলতেন আমার সাথে। ওঁর অবস্থানের একজন বড়ো মানুষ আমার মতো একজন নোবডিকে এতটা গুরুত্ব ও সময় দিয়ে কথা বলছেন, এটা ভাবতেও দুঃসাহস লাগে। আমি সে সাহসটা বুকের মধ্যে অনুভব করতাম, এবং এটাও গায়ত্রীদিদিরই অবদান। উনি আমাকে নিজেকে সম্মান করতে ও সাহসী হয়ে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন।


আমি পুরো পৃথিবীতে শুধু একটা মানুষের কাছে গিয়ে শক্তিশালী অনুভব করতাম। কখনও লো ফিল করতাম না। যার সাথে কথা বললে আমি লো ফিল করি, নিতান্ত বাধ্য না হলে তার সাথে আমি কখনও কথা বলি না, সে যে-ই হোক না কেন। গায়ত্রীদিদির সাথে কথা বললে আমার কাছে মনে হতো, আমার দাম এখনও কিছু হলেও পৃথিবীতে অবশিষ্ট আছে এবং তাঁর সাথে যতই কথা বলতাম, ততই আমি আমার নিজের ভেতরে শক্তিটা অনুভব করতে পারতাম। সে সময় এই পুরো পৃথিবীতে শুধু একটা মানুষের সাথে কথা বললে আমার মনে হতো, জীবনে আমিও কিছু একটা করতে পারব, সেই মানুষটি হচ্ছেন গায়ত্রী তালরেজা। তো ওঁর সাথে আমি মেসেঞ্জারে কথা বলতাম। আর উনি কেন আমার সাথে কথা বলতেন? কেন উনি আমাকে না চিনে, না জেনে অতক্ষণ সময় দিতেন দিনের পর দিন? কারণ, উনি আমার লেখার ভক্ত ছিলেন; ওঁর ধারণা ছিল, আমি একজন দার্শনিক ধরনের মানুষ; এবং উনি বিশ্বাস করতেন, আমি জীবনে ভালো কিছু করতে পারব। উনি আমাকে কখনওই বলতেন না যে আমি পারব না। আমার সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল অনেক উঁচু।


উনি আমাকে সব সময় আমার ভেতরটাকে চিনতে সাহায্য করতেন এবং ওঁর সাথে কথা বলতে বলতে একটা সময় অনুভব করলাম, আমরা যে ঈশ্বর বলি, আল্লাহ্‌ বলি, গড বা যা-ই বলি, যেটাই বলি, সেই অসীম শক্তিশালী সত্তার অধিষ্ঠান হচ্ছে আমাদের হৃদয়। প্রার্থনার অর্থই হলো, নিজের ভেতরের মানুষটার সাথে যোগাযোগ-স্থাপন করা। যে প্রার্থনায় নিজের ভেতরটা সাড়া দেয় না, সে প্রার্থনা আসলে অসম্পূর্ণ। আমাদের হৃদয়ের ভেতরের শক্তিটাকে যদি জাগাতে পারি, তা হলে আমাদের স্বপ্নের দিকে নিজেকে পরিচালিত করতে যা যা শক্তির দরকার, তা নিজের ভেতর থেকেই আসবে, এবং আমাদের মনের সমস্ত আশা পূরণ হবে। আমাদের মনের আশা পূরণ হলে আমরা নিজেদের ও আশেপাশের মানুষকে সাহায্য করতে পারব। পরিবারকে সাহায্য করতে পারব। ভেতরটা যার যত বেশি জাগ্রত, সে তত বেশি এগিয়ে এবং আমরা যে প্রার্থনাই করি না কেন, সেটা হচ্ছে মূলত আমাদের ভেতরের সত্তার বা আত্মার সাথে সংযোগস্থাপন করা। এটা ওঁর কাছ থেকেই আমি প্রথম শিখি।


উনি এসব বলতেন আর আমি ওঁর পায়ের ধুলোর কাছে বসে মাথানত করে শুনতাম। যেদিন থেকে ওঁকে নিজের জীবনের গুরু মানতে শুরু করলাম, সেদিন থেকে আজ অবধি কখনওই ওঁর একটি কথারও বিরুদ্ধ-যুক্তি খুঁজিনি। উনি যা-ই বলেন, তা-ই আমার কাছে গুরুবাক্যের মতো, আমি কণামাত্রও চিন্তাভাবনা না করে তা মেনে নিতে রাজি। আমার এই কথাটি পড়ে আপনি আমাকে যা ইচ্ছে, তা-ই বলতে পারেন, আই সিমপ্লি ডোন্ট কেয়ার! কেননা আমি তো জানি, আমার জীবনে আপনার অবদান শূন্য, আর ওঁর অবদান অসীম বা তার চেয়েও বেশি। অতএব আপনি এবং আপনার মতামত, দুইই আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়। আমি আমার জীবনের সংকট-মুহূর্তে যে সকল ঈশ্বরতুল্য মানুষকে পাশে পেয়েছি, তাঁদের সকল যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসি, মানি। আর গায়ত্রীদিদি তো এমন একজন মানুষ, যাঁর চিন্তা যেখান থেকে শুরু হয়, আপনার আমার চিন্তা সেখান পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারে না আমৃত্যু! অতএব, তাঁকে বা তাঁর কোনও মতাদর্শ নিয়ে কেউ না বুঝে মন্তব্য করলে আমি সে লোকটার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারি!


দিদি অনেক বড়ো একজন দার্শনিক ছিলেন। আমার যা দরকার ছিল আজকের অবস্থানে আসতে, তার পুরোটাই পেয়েছি ওঁর কাছ থেকে। নিজের মনটাকে সবার আগে প্রস্তুত করতে হয় ভালো কিছু করতে গেলে। সেটাই করে দিয়েছিলেন উনি তাঁর কথাবার্তার মাধ্যমে। ওঁর সব কথাই আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম। কখনও কোনও কথা যুক্তিতর্ক দিয়ে ভাবিনি, বিচার করিনি। ওঁর সম্পর্কে একটা মজার তথ্য হচ্ছে, উনি যে ডিজনিল্যান্ডে জব করতেন, সে জবটা উনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এর কারণ হচ্ছে, বিয়ের দীর্ঘদিন পরেও দিদির কোনও সন্তান হচ্ছিল না। পরে ওঁর একটা সন্তান হয়, ছেলে; ছেলের নাম নীল। এই নীলকে মানুষ করার জন্যই উনি চাকরিটা ছেড়ে দেন। যখন উনি চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছেন, তখন ওঁর বেতন ছিল বাংলাদেশি টাকায় প্রতিমাসে প্রায় ২৮ লক্ষ টাকা; ‘প্রতিমাসে’ শব্দটি খেয়াল করে দেখা যায়! উনি চাকরিটা কেন ছেড়ে দিলেন? ওঁকে আমি জিজ্ঞেস করছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এই চাকরিটা ছেড়ে দিলে আমি আমার ছেলের প্রতি বেশি কনসেনট্রেট করতে পারব। সে আমার জন্য এই চাকরির থেকেও বড়ো সম্পদ। তবে সত্যি কথা বলতে কী, ওঁর হাজব্যান্ড ছিলেন অনেক বেশিই ধনী। আমেরিকার শীর্ষ ১০টা সফটওয়্যার কোম্পানির একটা ছিল ওঁর। তাঁকে নিয়েও একটা গল্প আছে, ওটা আমার ‘একটা ‘না’র গল্প’ লেখাতে পাবেন, ইচ্ছে হলে পড়ে নিতে পারেন।


চাকরিটা ছেড়ে দিয়েই দিদি তাঁর ছেলের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেন। উনি জীবনটাকে দেখতেন, একেবারেই সহজভাবে। বিন্দুমাত্রও জটিল চিন্তাভাবনা করতে ওঁকে কখনও দেখিনি। জীবনটাকে সহজভাবে নেওয়ার প্রথম লেসনটা আমি পাই ওঁর কাছে। আমি কিন্তু নিজেও তার আগে জীবনটাকে খুব কমপ্লিকেটেডভাবে দেখতাম। অনেক বেশি ভাবতাম, ওভারথিংকিং করতাম কোনও কারণ ছাড়াই। যেটা নয়, সেটা নিয়েও ভাবতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেকগুলো জিনিস নিজের মাথায় নিজেই বানাতে থাকতাম, যেগুলোর আসলে বাস্তবে কোনও অস্তিত্বই ছিল না। কোন মুহূর্তে কী নিয়ে ভাবা দরকার এবং কে কী বলল না বলল, সেটাকে পরোয়া না করে চলা---এই দুইটি ব্যাপার শিখছি ওঁর কাছ থেকে। দিনের শেষে কিন্তু আমি কী ভাবছি, আর সে ভাবনা থেকে কী আউটপুট আসছে, সেটাই হচ্ছে ইম্পরট্যান্ট। কেবল মাথায় মাথায়ই পুরো দুনিয়া বা নিজের জীবন নিয়ে একটা ছক দাঁড় করিয়ে ফেলে তো লাভ নেই, জীবনের মাঠে নামতে হবে। জীবনের মাঠে যে জয়ী, সে-ই প্রকৃত জয়ী। মুখে বা মাথায় জয়ী হয়ে তো কোনও লাভ নেই।


দিদির কাছ থেকে ফিলোসফিকাল অনেকগুলো দীক্ষা পেয়েছিলাম। এই যেমন, একটা মেয়েকে, মেয়ে হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখা---এটা প্রথম শিখেছি ওঁর কাছ থেকে। এর আগে আমাকে কখনও কেউ এভাবে করে বলেনি। একটা মেয়েকে কীভাবে মানুষ হিসেবে দেখতে হয়, সম্মান করতে হয়, ওঁর কাছ থেকেই প্রথম পরিপূর্ণভাবে শিখেছি। আমি ওঁর সাথে কথাবলার সময় প্রথম দিকে খুব লজ্জা পেতাম। এই লজ্জাটা উনি ধরতে পেরেছিলেন, এবং উনিই এটা ভেঙে দিয়েছেন। মেয়েদের সম্মান করতে ও মূল্যায়ন করতে শিখি প্রথম ওঁর কাছ থেকেই। মজার বিষয়, ওঁর সাথে আমার তখনও ফোনে কথা হয়নি, কথা হয়েছে অনেক পরে গিয়ে---উনি আমাকে আমার জন্মদিনে ফোন করেছিলেন একবার, তখন একবার; আর পরে এমনিই ফোন করেছিলেন একদিন, তখন আর-একবার। অত বড়ো মানুষের সাথে কথাবলা কঠিন। আমার শুধুই মনে হতো, কী সব ভুলভাল বলছি ফোনে। কথা জড়িয়ে যেত, এলোমেলো হয়ে যেত। এই জীবনে মন থেকে কাউকে এতটা সমীহ করেছি বলে মনে পড়ে না। ওঁর সাথে আমার কথা হতো শুধুই চ্যাটিং-এ।


উনি আমাকে বিভিন্ন লাইফলেসন দিতেন, পরিবার নিয়ে নানান লেসন দিতেন, চারপাশের সমাজটা কেমন, সমাজ আমাদের কীভাবে দেখে, আমরা সমাজে কেন আছি বা কীভাবে আছি, এসবই ওঁর কাছ থেকেই শেখা। হয়তো আমি আগেই জানতাম এসব, তবে ওঁর মতো করে ভাবতাম না। এ অনেকটা চাকাকে পুনরায় আবিষ্কার করার মতোই একটা ব্যাপার! এই সমাজের প্রতি যে আমাদের কিছু কমিটমেন্ট আছে, এটা আসলে আমি ওঁর সাথে কথা বলার আগে ওরকম করে ভাবিনি বা অনুভব করতে পারিনি। পরিবারের প্রতি আমাদের যে কমিটমেন্ট, এটাও আমার ওঁর কাছ থেকেই শেখা। আমরা শুধুই নিজের জন্য বাঁচতে আসিনি, এটা তো অনেকবারই শুনেছি, কিন্তু এই যে অন্যের জন্যেও বাঁচা, তার জন্য নিজেকে আগে আগে কী কী করার মধ্য দিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে, সেটা পুরোপুরিই আমার গায়ত্রীদিদির কাছ থেকে শেখা। নিজের এবং অন্যের জীবনের জন্য নিজেকে তৈরি করে নেওয়া, এটাই মানুষের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।


উনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমি পড়তে আসো। তোমার মতো মানুষের ভালো একটা ভার্সিটি থেকে পিএইচডি করা উচিত! যেখানে আমাকে কেউ কখনও বলেনি যে আমি চুয়েট থেকে ডিগ্রিটা কমপ্লিট করতে পারব, সেখানে ওঁর মতো একজন বড়ো মানুষ আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, তুমি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসো! এটা ভাবলেও আমার আশ্চর্য রকমের একটা অনুভূতি হতো। উনি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকতেন। আমি ভাবতাম, আমাকে উনি কতটা বিশ্বাস করলে ভাবতে পারেন, আমি আমার পেন্ডিং অনার্সটা শেষ করে, আমেরিকার মতো জায়গা থেকে পিএইচডি করতে পারব! আমার শক্তির উপর ওঁর এতটা আস্থা জন্মাল কীভাবে! অথচ ওঁর পায়ের নখের যোগ্যও নয়, এমন লোকজন বিশ্বাস করেন যে আমি চুয়েট থেকে অনার্সটা শেষ করতেই পারব না। আমি বুঝলাম, বড়ো যাঁরা, তাঁরা মানুষকে বড়ো চোখে দেখতে জানেন। এখানেই দিদির সাথে বাকি পৃথিবীর পার্থক্যটা।


কেউ যখন আপনার উপর আস্থা রাখেন, আপনার ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রাখেন, এবং আপনি যদি কোনওভাবে তাঁকে পছন্দ করেন, তাঁকে আপনার লাইফে স্পেস দেন, তখন আপনি দেখবেন, ওই জায়গায় নিজের সম্মান রক্ষা করার জন্য, তাঁর চোখে আপনি যেমন, নিজেকে তেমন করে গড়ে তোলার জন্য, আপনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকবেই। সেই মানুষটার দিকে তাকিয়ে হলেও আপনি কিছুতেই তাঁর চোখে আপনার যে অবস্থান, সে অবস্থানটা থেকে সরে আসতে পারবেন না। মানে ওঁর বিশ্বাসটা আপনার অক্ষুণ্ণ রাখতে ইচ্ছে করবে। আমার নিজের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। তখন আমি ভাবলাম, ওঁর মতো একটা মানুষ আমাকে এতটা সময় দেন, এতটা সম্মান করে কথা বলেন, এতটা গুরুত্ব দিয়ে আমার কথা শোনেন, এতটা বিশ্বাস করেন আমাকে…এই আস্থার জায়গাটা রক্ষা করার জন্য হলেও আমার নিজেকে তৈরি করতে হবে---যে-কোনও উপায়েই হোক। মজার বিষয় হচ্ছে, যাঁরা আপনাকে বিশ্বাস করেন ও সত্যিই নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন, তাঁদের ভালো কথাগুলো আপনার জীবনে খুব প্রভাব ফেলে। আর আপনার উপর যাঁদের আস্থা নেই, তাঁরা যতই মেধাবী, সফল বা ভালো মানুষ হোক না কেন, তাঁদের কোনও সাহচর্য বা কথাই আপনার জীবনে তেমন কোনও কাজে লাগবে না। কারও অসীম যোগ্যতার চাইতে বেশি জরুরি সে যোগ্যতা থেকে আপনি নিজে কী শিখলেন ও তার কতটা কাজে লাগাতে পারলেন, তা।


গায়ত্রীদিদি যতটা বড়ো মাপের মানুষ, আমি তার সিকিভাগও হওয়ার স্বপ্নও দেখি না, তবে উনি আমাকে আমার মনের ক্ষমতাকে চিনিয়েছেন, তাই ওঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার কোনও শেষ নেই। ওঁকে দেখে, ওঁর কাছ থেকে শিখে যদি আমি নিজে কিছু করতে না পারতাম, তা হলে কিন্তু উনি যত বড়ো মানুষই হোন না কেন, আমার নিজের তাতে কিছু এসে যেত না। আমি ওঁর কাছ থেকে জীবনের অনেক খুঁটিনাটি শিখেছি। যেমন ধরুন, উনি যখন নক করতেন, শুরুতেই উনি জিজ্ঞেস করতেন, ‘সুশ, (উনি আমাকে সংক্ষেপে এই নামেই ডাকতেন) তোমার হাতে কি সময় আছে? তোমার গতরাতের পোস্ট নিয়ে কিছু কথা ছিল।’ কিংবা ‘সুশ, আমাকে কিছুক্ষণ সময় দিতে পারো? আমার নিজের কিছু কনফিউশন তোমার সাথে শেয়ার করি?’…ভাবা যায়? ওঁর মতো একজন মানুষ আমার মতো একটা রাস্তার ছেলেকে এতটা সম্মান দিয়ে কথা বলছেন! আমি কিন্তু তখন ছিলাম পুরোপুরি বেকার একটা মানুষ। আমাকে কেউ কখনও নক করে জিজ্ঞেস করেনি যে আমার হাতে সময় আছে কি না! ‘তোমার হাতে কি কিছু সময় হবে?’ এইটুকুও কেউ কোনও দিন জিজ্ঞেস করেনি আমাকে! সবাই ধরেই নিত, আমার হাতে অফুরন্ত সময়। কারণ আমি তো বেকার! বেকারদের আবার ব্যস্ততা কীসের? ব্যস্ততা থাকলেও সেটাকে পাত্তা দেওয়ার কী আছে!


সেই আমাকেই কিনা উনি জিজ্ঞেস করতেন, তোমার হাতে সময় আছে? আমার মতো একটা মূল্যহীন মানুষকে উনি বাদে আর কেউ ওরকম করে বলত না। দিদির সাথে কথা যখন হতো, তখন আমি নিজেকে একটু হলেও মূল্যবান ভাবতে পারতাম। দিদি তো অনেক বড়ো একজন মানুষ, তিনিও আমাকে অতটা মূল্য দিয়ে কথা বলতেন, এটা ভাবতেও অনেক সাহসের প্রয়োজন ছিল সে সময়। একটা কথা বলে রাখি, দিদি কিন্তু আমাকে খুশি করতে কিংবা স্রেফ বলার জন্যই আমাকে মূল্য দিয়ে আমার সাথে কথা বলতেন না। উনি খুব ব্যস্ত থাকতেন নানান কাজে, আমাকে খুশি করাটা, এমনকি আমাকে সময় দেওয়াটা তাঁর জন্য দরকারি কিছু ছিল না। আর আমি নিজেই বুঝতে পারি, কে আমাকে সত্যিই মূল্যায়ন করছে, আর কে শুধুই বলার জন্যই অত কিছু বলছে। এটা ধরে ফেলা যায়। যা-ই হোক, আমি দিদির সাথে মিশে মিশে নিজেকে মূল্যবান ভাবতে শুরু করলাম। নিজেকে অনেক দামি একজন মানুষ হিসেবে অনুভব করতে শুরু করলাম এবং এই অনুভূতিটার দাম অনেক অনেক বেশি। এই অনুভূতিটা আমার মধ্যে একধরনের দায়িত্ববোধ তৈরি করে দিত। ফলে এরপর ওঁর সাথে কথা বলার সময় আমাকে অনেক দায়িত্ব নিয়েই কথা বলতে হতো। এটা হচ্ছে নিজের প্রতি একটা দায়িত্ব, নিজেকে একধরনের বেঁধে-ফেলা।


এটা উনি তৈরি করে দিয়েছিলেন এবং এখানে ওঁর একটা টেকনিক ছিল, যেটা আমি তখন কোনও দিন আসলে বুঝিনি। পরে, অনেক পরে এসে বুঝতে পেরেছি। এই যেমন, এই যে আমি পড়তে পারছি না, তখন আমি ওঁকে বলতাম, দিদি, আমি তো পড়তে পারছি না। উনি আমাকে বলতেন, পড়তে না পারলে কেন তোমাকে পড়তে হবে! তুমি পড়তে না পারলে এই সময়ে এই কাজটা করো, একটা মিউজিক শোনো, ইউটিউবে অমুক লেকচারটা শোনো, একটু হেঁটে আসো, তুমি একটা ভালো বই পড়ো। তুমি তিনদিন না পড়লেও কিছুই হবে না। কিন্তু তুমি যদি ওই সময়ে তিন ঘণ্টাও না পড়ে বই সামনে নিয়ে বসে থাকো, তবে তোমার একটা বিতৃষ্ণা চলে আসবে, যা তোমার ক্ষতি করবে। ভেবে দেখো, পড়া তো হলোই না, উলটো পড়ার প্রতি একটা বিরক্তির উদ্রেক হলো। পড়ে পড়া থেকে দূরে সরে যাওয়ার চাইতে বরং না পড়ে পড়ার কাছাকাছি থেকে যাওয়া অনেক ভালো।


এমন নানান জিনিস উনিই প্রথম আমাকে শেখান। ওঁকে আমি গুরু মানি। আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো সৌভাগ্য এই যে যখন পুরো পৃথিবী আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তখন আমি এমন একজনকে পেয়েছিলাম, যিনি আমার কাছে পুরো পৃথিবীর চাইতেও বড়ো কিছু ছিলেন, যাঁর মধ্যে একপৃথিবীসমান প্রজ্ঞা ছিল। আমার পৃথিবীতে আমি যাঁদের চিনি, তাঁদের মধ্যে উনিই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠতম মননের অধিকারী। একজন যথার্থ গুরুকে খুঁজে পাওয়া অনেক বড়ো একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তার চাইতে বড়ো সৌভাগ্য তখন আসে, যখন সেই গুরু আমাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন---সেটা যে কারণেই হোক না কেন…আমার যোগ্যতায় বা তাঁর অনুগ্রহে আর ইচ্ছেয়, এবং আমিও তাঁর পথটা সঠিক উপায়ে অনুসরণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি। যে-কোনও মূল্যেই হোক, যদি একজন যথার্থ গুরুর পায়ের কাছে নিজেকে সঠিক সময়ে রাখা যায়, তবে জীবনটা বদলে-যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।


তো ওঁর সাথে আমার এরকম করে প্রতিদিনই কথা হতো এবং উনিও আমাকে বলতেন যে, ‘তুমি অনেক ভালো লিখো। আমি সব সময়ই তোমার লেখা পড়তে ভালোবাসি, এবং পরবর্তী লেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকি।’ এই কথাটা একটা ভয়াবহ রকমের শক্তিশালী কথা! ওঁর মতো অত বড়ো একজন মানুষ যখন আমাকে বলেন অমন করে, তখন আসলে নিজেকে যেমন তেমন করে প্রকাশ করা যায় না। সহজ করে বলি। কেউ যখন আপনাকে বলেন, আপনি অনেক ভালো রান্না করেন, তখন আপনার রান্না যেমনই হোক না কেন, পরবর্তীতে রান্না করার সময় আপনার মধ্যে একটা প্রখর দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতাবোধ তৈরি হয়। ওই বোধ দুটোই আপনাকে ভালো রান্না করতে সাহায্য করে। এটি মানুষের আত্মবিশ্বাস অনেক অনেক গুণে বাড়িয়ে দেয়। সাথে বাড়ায় আন্তরিকতা, মনের শক্তি, ধৈর্য। তো দিদি যখন আমাকে বলতেন, ‘তুমি অনেক ভালো লিখো।’ তখন আমার কাছে মনে হতো, হ্যাঁ, আমি তো আসলেই ভালো লিখি! অতএব, পরের লেখাটা আরও ভালো হতে হবে। আমি আমার দিদির জন্যই ভালো লিখব, ভালো উপায়ে নিজেকে প্রকাশ করব। দিদিকে খুশি করতেই নিজের চিন্তাভাবনাকে শাণিত করে তুলব। আমি তাঁকে অন্ধের মতো ভালোবাসতাম।


এখানে একটা মজার বিষয় হচ্ছে, ওঁর সাথে আমার মতো একজন নগণ্য মানুষের তুলনা হয় না কোনওভাবেই। উনি আমার থেকে অনেক উপরে ছিলেন, উনি আমার চেয়ে অনেক বেশি জানতেন। ওঁর যে গভীর জীবনদর্শন ও প্রজ্ঞা, সেখানে পৌঁছুতে আমাকে কয়েকবার জন্মাতে হবে। কিন্তু উনি নিজেকে রাখতেন আমার নিচে, ইচ্ছে করেই। এটা একটা সাংঘাতিক টেকনিক! এর কারণ হচ্ছে, আপনি যখন জানতে পারেন, একজন বড়ো মানুষ আপনার কাছ থেকে শিখছেন, আপনার কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করছেন, আপনাকে তাঁর সমকক্ষ, এমনকি তার চেয়ে উঁচু অবস্থানে রাখছেন, তখন এই ব্যাপারটা আপনার মাথায় কাজ করাবে যে আপনাকে অবশ্যই ভালো কিছু সৃষ্টি করতে হবে, নিজেকে আরও ছোটাতে হবে, নিজের শক্তির সর্বোচ্চটুকু ব্যবহার করতে হবে যে-কোনও মূল্যে, নিজেকে আরও উন্নত করে তুলতে হবে প্রতিদিনই। তাঁকে শেখানোর দায়িত্ব, তাকে ভালো কিছু বলার দায়িত্ব আপনার কাঁধে সমর্পিত! এই জিনিসটা নিজের মধ্যে অনেক বড়ো একটা প্রণোদনা তৈরি করে! আমি নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছিলাম দিদির পায়ে, দিদির ভাবনাবলয়ে। এটা অনেকটা এরকম, ধরুন, এক শিক্ষক গিয়েছেন এক ছেলেকে অঙ্ক শেখানোর জন্য। তো ওই ছেলেটা হচ্ছে চরম ফাঁকিবাজ। কোনও দিনই তাকে কেউ অঙ্ক শেখাতে পারেনি। তো শিক্ষক বুদ্ধি বের করলেন একটা। বুদ্ধিটা কেমন? ওই ছেলেকে গিয়ে বলছেন, ‘ভাই, তুমিও অঙ্ক জানো না, আমিও অঙ্ক জানি না। কোনও সমস্যা নাই। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি তো আরও দুই-একটা টিউশনি করি, সবগুলোই হচ্ছে অঙ্ক-শেখানোর টিউশনি। আর আমি খুবই গরিব ঘরের সন্তান, ভাই। টিউশনিগুলো চলে গেলে আমাকে ও আমার পরিবারকে না খেয়ে থাকতে হবে। আমার খুবই সমস্যা হয়ে যাবে।’ তখন ছেলেটা বলে, ‘তা-ই নাকি, স্যার?’ স্যার বললেন, ‘হ্যাঁ, সত্যিই তা-ই।’ ছেলেটা বলে, ‘তাহলে কী করা যায়?’ স্যার বললেন, ‘তুমি যদি মাঝেমধ্যে আমাকে কিছু অঙ্ক শিখিয়ে দিতে, খুবই ভালো হতো। সত্যিকথাটা বলেই ফেলি, তোমার বাবাকে বোলো না, কেমন? তুমি তো ভাই মোটামুটি পারো, আমি তা-ও পারি না। কিছু কিছু অঙ্ক তুমি আমাকে শেখাতে পারবে?’ তখন ছেলেটা বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি যতটুকু পারি, ততটুকু আপনাকে শেখাতে পারব।’


স্যার সাথে সাথেই বললেন, ‘বাঁচালে ভাই! তাহলে আমার জন্য খুবই উপকার হয়। তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি। আর তোমাকে পড়িয়ে যে বেতনটা পাব, ওটা আমি নেব না, ওটা আমি তোমাকে দিয়ে দেবো। এটা আমার গুরুদক্ষিণা। এই ব্যাপারটা তোমার বাবাকে বলার দরকার নেই। তোমার কাছ থেকে কিছু অঙ্ক শিখে অন্যদের পড়িয়ে আমি কিছু পয়সা তো পাবো।’ ছেলেটা তো মহাখুশি। ‘আরেব্বাবা! এটা দিয়ে তো আমি বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে পারব, খাওয়াদাওয়া করতে পারব, আড্ডা দিতে পারব।’ তখন দিনের পর দিন ছেলেটা প্রচুর স্টাডি করতে লাগল এবং স্টাডি করে করে তার শিক্ষককে ‘অঙ্ক শেখাতে’ শুরু করল। শিক্ষক তখন বোকার মতো থাকতেন, এবং দেখাতেন যে উনি কিছুই পারেন না। ছাত্রকে প্রতিদিনই বিভিন্ন অঙ্ক করতে দিয়ে বলতেন, ‘এটা একটু শিখিয়ে দিয়ো সামনের দিন। আমি নিজেও পড়াশোনা করে আসব। তাহলে তোমার শেখাতে সুবিধে হবে।’ স্যারকে বেশি বেশি শেখানোর জন্য ছেলেটা অনেক অনেক পরিশ্রম করে সব ধরনের অঙ্কই শিখে ফেলত। একসময় সেই ছেলে অঙ্কের মধ্যে মজা পেয়ে গেল, স্যারের কাছ থেকে উৎসাহ পেতে পেতে সে নিজেকে ক্রমেই অঙ্কের সমুদ্রে নিমজ্জিত করতে লাগল। প্রতিদিনই সে স্যারের জন্যই অঙ্ক শিখত, একসময় সেখানে অপার আনন্দ খুঁজে পেল এবং নিজের জন্যই অঙ্ক শিখত। এভাবে করে করে সেই ছেলেটাই একদিন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের একজন হন।


(চলবে…)