গ্লুমি সানডে-অ্যা সং অব লাভ অ্যান্ড ডেথ (১৯৯৯)

গ্লুমি সানডে: বিষণ্ণ রোববার। মূল গানের নাম এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড। হাঙ্গেরির পিয়ানোবাদক ও কম্পোজার রেজো সেরেস ১৯৩৩ সালে এ গানটা সৃষ্টি করেন। এরপর এ জনপ্রিয় গানের বেশ কয়েকটা সংস্করণ বের হয়েছে। কবি লাজলো জাভো ‘স্যাড সানডে’ নাম দিয়ে গানটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের করেন। গানটির সবচাইতে প্রচলিত নাম ‘গ্লুমি সানডে’, যা স্যাম এম. লুইসের করা। বিলি হলিডের কণ্ঠে লুইসের সংস্করণটিই সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করে। বলা হয়, সারাবিশ্বে শতাধিক মানুষের আত্মহত্যার সাথে গানটা জড়িয়ে আছে। গানটিকে বলা হয় ‘হাঙ্গেরিয় আত্মহত্যার গান’। এ গানের রয়্যালটির অর্থ তুলতে হাঙ্গেরি ছেড়ে আমেরিকায় যেতে রাজি ছিলেন না বলে সেরেসকে বাঁচতে হয়েছে আর্থিক অনটনের মধ্যে। জীবনে কখনোই হাঙ্গেরি ছেড়ে যাবেন না, এই গোঁয়ার্তুমিতে তিনি তাঁর নিজের শহর বুদাপেস্টে ‘কিস্পিপা’ নামক একটা রেস্টুরেন্টে পিয়ানো বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। জায়গাটি ছিল বেশ্যা, মিউজিশিয়ান, ভবঘুরে এবং ইহুদি শ্রমজীবী মানুষের আড্ডাখানা। এ গানের মতো আরেকটা গান লেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, তিনি আর নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারছেন না এইসব কারণে একসময় তাঁর মধ্যে প্রবল নৈরাশ্য বাসা বাঁধে। তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর সে নৈরাশ্য এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে তিনি একটা ভবনের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। তাঁকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি সেখানে গলায় তার পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। ঘটনাটি ঘটে গানটি প্রকাশের প্রায় ৩৫ বছর পর। এ গান নিয়ে ১৯৯৯ সালে তৈরি হয়েছে ‘গ্লুমি সানডে-অ্যা সং অব লাভ অ্যান্ড ডেথ’, তবে মুভির কাহিনি প্রায় পুরোপুরিই ভিন্ন। স্যাম এম. লুইসের সংস্করণটির বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করছি:

রোববারটা বিষাদেঘেরা, ঘুম নেই তাই মুহূর্ত যায় নির্ঘুম হায়,

একএক করে ছায়ারা আসে, কাটে একাকী সময় কাটে ওদেরই সাথে,

সাদা ছোট ফুল কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, তোমার ডাকে আর আসে না,

কষ্টগাড়ি গেছে বাড়ি তোমায় নিয়ে, যায়নি তো কেউ তোমার সাথে,

দেবদূতেরা মিলিয়ে গেছে দূরের দেশে, ফিরবে না আর তোমার কাছে,

যদি আমিও হাঁটি তোমার পথে, ওরা কি তখন খেপবে ভীষণ?

রোববারটা বিষাদেঘেরা।

বিষাদ দেখি রোববারেতেই, দিনটা কাটে কান্না গিলে………

এমনি করে কতই-বা আর বাঁচবো, বলো? হৃদয় বলে, বিদায় তবে!

মোমের আলোয়, প্রার্থনাতে আমায় ডেকো, জানি, খুব কান্না পাবে,

তবু কাঁদতে ওদের বারণ কোরো, জানিয়ে দিয়ো আমার হয়ে,

সত্যি বড়ো সুখে আছি মরতে পেরে।

মৃত্যু কোনো স্বপ্ন তো নয়, মৃত্যু পেয়েই পেয়েছি তোমায়,

আমার শেষ দমটাও বলবে জেনো, ভাল থেকো।

রোববারটা বিষাদেঘেরা।

স্বপ্ন, কেবল স্বপ্ন শুধুই,

ঘুম ভাঙতেই তোমায় দেখি, ঘুমিয়ে আছো বুকের মাঝে, এখানটাতে।

প্রিয়, স্বপ্ন আমার দেয়নি হানা তোমার ঘরে, তোমারই ঘোরে,

হৃদয়ের ব্যথা বুঝে নিয়ো, প্রিয়, জীবনে কেবলই চেয়েছি তোমায়।

রোববারটা বিষাদেঘেরা।

মার্জনা করবেন, হয়তো আমার অনুবাদের হাত ভাল না, আপনি মূল গানের লিরিক গুগল করলেই পেয়ে যাবেন, শুনে একটু বলবেন, এই গানে এমন কী আছে যা শুনলে মরে যেতে ইচ্ছে করে? কিংবা মরার সময়টাতে যা শুনেশুনে মরতে ইচ্ছে করে? নাকি, হারানো প্রেমের অনেক গানের ভিড়ে এই গানটিকেই জনপ্রিয় করার জন্যই এতো প্রচারণা চালানো হয়েছে, খুঁজে দেখলে প্রতিটি মৃত্যুর আলাদাআলাদা কারণ পাওয়া যাবে? যা-ই হোক, আগেই বলেছি, ‘গ্লুমি সানডে’ মুভির যে গল্প, তা কিছুটা আত্মহত্যানির্ভর হলেও মূল গানের গল্পের সাথে মুভির গল্পের অনেক ফারাক। ‘গ্লুমি সানডে’ দেখে আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগার কোনো কারণই নেই, তবে ছবির নায়িকাকে দেখে বুকে কেমন জানি ঢেউ ওঠে, হাহাকার করে, ‘জীবনে এমন একটা মেয়েকে না পেলে বেঁচে থেকে কী লাভ?’ জাতীয় দুষ্টুমিষ্টি ভাবনার উদ্রেক হয়। ওই হাঙ্গেরীয় সুন্দরীর মধ্যে কী যেন আছে! দেখতেদেখতে মাথা ঝিম ধরে আসে, মেয়েটাকে কাছে পেতে ভীষণ ইচ্ছে করে।

এ লেখায় মুভির কাহিনি বলছি না। মুভিটা মাস্টারপিসের পর্যায়ে পড়ে, তাও না, বরং মুভির কিছু ব্যাপার আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়েছে। তবু, আপনার হার্টে যদি হৃদয় বলে কিছু থেকে থাকে, আর কিছু না হোক, অন্তত নায়িকাকে অনুভব করার জন্য হলেও মুভিটা দেখে ফেলতে পারেন, তবে বিফলে কিছু ফেরত দিতে পারবো না। মুভির শুরু থেকে শেষ অবধি যে কয়েকটি দৃশ্য নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, বলছি:

রেস্টুরেন্টের মালিক সাবোর সাথে সুন্দরী ওয়েট্রেস ইলোনার প্রেমের সম্পর্ক। কাস্টমারদের পিয়ানো বাজিয়ে শোনানোর জন্য আন্দ্রাসকে নিয়োগ দেয়া হয়। আন্দ্রাস সুদর্শন, দারুণ পিয়ানো বাজায়। প্রথম দেখাতেই ইলোনা আন্দ্রাসের প্রেমে পড়ে যায়। এদিকে ইলোনার জন্মদিনে আন্দ্রাস বার্থডে গিফট হিসেবে ‘গ্লুমি সানডে’ লিখে তাকে উৎসর্গ করে। ইলোনা পটেমটে ছারখার হয়ে যায়। সাবোর সামনেই আন্দ্রাসকে চুমু খায়। আনন্দের বিষয়, এটা মেনে নিতে সাবোর কোনো আপত্তি নেই। বরং ইলোনাকে আশ্বস্ত করে: আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি তো সবসময়ই বলেছি, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই নিজের স্বাধীনতা থাকা উচিত। বাজার থেকে রেস্টুরেন্টের জন্য আলু কিনে ফেরার সময় দুইজন মিলে বস্তাটা বহন করে নিয়ে আসে, পাশে ইলোনা হাঁটতে থাকে। যেন ইলোনার ভার দুইজনই সমান ভাগ করে নেয়। (আসুন, সাবোর জন্য সবাই মিলে জোরে তালি দিই!) উল্লেখ্য, আমাকে ‘আবারো’ কাঁদিয়ে ইলোনা সেদিন আন্দ্রাসের বিছানায় রাত কাটায়। ‘আবারো’ কেন বললাম? মুভি দেখলে বুঝে ফেলবেন। জীবনে একখান ‘গ্লুমি সানডে’ লিখতে পারলাম না! কী হবে এ চুলের জীবন রেখে? (আত্মহত্যায় ক্যাম্নে প্ররোচিত করে, দেখলেনই তো!)

ওদিকে আরেক কাহিনি। ইলোনার জন্মদিনে রেস্টুরেন্টের আরেক কাস্টমারের জন্মদিন। নাম হ্যান্স, জাতিতে জার্মান। ইলোনার প্রেমে তার অবস্থাও কাহিল। রেস্টুরেন্টে বার্থডে সেলিব্রেট করে ইলোনার সাথে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ইলোনাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করে বসে। প্রত্যাখ্যাত হয়ে দেবদাস-মার্কা চেহারা নিয়ে নদীর উপরে ব্রিজ ধরে হাঁটতে থাকে। সাথে সাবো। ওদিকে ইলোনা আন্দ্রাসের ঘরে কানামাছি খেলতে গেছে। হ্যান্স আর সাবো মিলে ভাবতে থাকে, ওই সুরের অর্থটা কী হতে পারে। “যেন কেউ তোমাকে এমন কিছু বলছে, যা তুমি শুনতে চাইছ না। অথচ তুমি মনেমনে সত্যিটা জানো।” “আমাকে এখন যেতে হবে।” বলেই হ্যান্স ব্রিজ ধরে হেঁটে চলল। সাবো অন্যদিকে ঘুরে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর। ঝুউপপপ্‌!! হ্যান্স গাধার বাচ্চাটা নদীতে লাফিয়ে পড়েছে। সাবো গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। হ্যান্স সাবোকে বলে, ইলোনাকে কিছু বোলো না। আরো বলে, আজকের এই উপকারের বদলে একদিন আমিও তোমার উপকার করবো। হ্যাঁ, সত্যিই করে। কীভাবে?……….ইয়ে মানে, আন্দ্রাসও কম যায় না। আরেকদিন সাবো আর ইলোনা ইনডোর গেমস খেলার সময় আন্দ্রাস সেই বিল্ডিংটার নিচে বসেবসে সিগ্রেট ফুঁকতে থাকে। আহা, কত্ত বড়ো মন! আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, ভুঁড়িতে না বড়ো হয়ে মনে বড়ো হবে?

ক্যামেরা এখন আন্দ্রাসের ঘরে। সেখানে যা হচ্ছে, তা দেখে মেজাজ খারাপ হওয়ার যোগাড়! ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। এরপর? নাহ্‌! আন্দ্রাস ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো মাথা নিচু করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ইলোনার শত চেষ্টা সত্ত্বেও সে এর বেশি কিছু করতে রাজিই হচ্ছে না। অগত্যা কী আর করা! ইলোনা রুম থেকে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করলো। এমন একটা মুহূর্তে ইলোনার মতো লাস্যময়ী মেয়েকে কেউ ফিরিয়ে দিতে পারে? ওরকম একটা মেয়ের সাথে উভয়ের সম্মতিতে কিছু করার পাপও শত পুণ্যের চাইতে বেশি প্রশান্তির! কিছু পাপ থাকে, যেগুলি করতে না পারার আফসোসে জীবন কেটে যায়। ছাগলটা এগুলি বোঝে না? আন্দ্রাসের মাথায় গ্যাস্ট্রিক নাকি? ব্যাটার নির্ঘাত সমস্যা আছে! তার চর্ম ও যৌন রোগের ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। কিংবা এমনও হতে পারে, ক্যামেরা সামনে দেখে সে আসলেই অভিনয় করতে শুরু করে দিয়েছে! ভাবছেন, এইডা কিসু হইলো? ওয়েট ওয়েট! পিকচার আভি বাকি হ্যায়, মেরে দোস্ত!…….আচ্ছা, এসবের মানে কী দাঁড়াল? সাবোর মুখে শুনুন: তুমি তো জীবনে দুইজন পুরুষ পেয়েছ, আর আমরা দুইজনই পেয়েছি অর্ধেক করে নারী।

“এই সুরের কোনো শব্দের দরকার নেই। সুরটাই তো কথা বলতে পারে!” রেস্টুরেন্টের এক কাস্টমারের মন্তব্য। হ্যাঁ, আন্দ্রাসকে রেস্টুরেন্টে বারবারই সুরটি বাজাতে হতো। প্রথমে সে সুরটিকে কোনো কথা দিয়ে বাঁধেনি, অনেক পরে বেঁধেছে। ওদিকে কিছু লোকের মৃত্যুর সাথে ‘গ্লুমি সানডে’র একটা সংযোগ আছে, এমন দাবি মিডিয়াতেও প্রচারিত হতে লাগলো। আন্দ্রাসকে শুনতে হল, ‘গ্লুমি সানডে’ মানুষকে দিয়েছে মৃত্যু, আর সুরের স্রষ্টাকে দিয়েছে অর্থ। সে খুবই সংবেদনশীল মনের মানুষ। সহ্য করতে না পেরে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সুরের লিরিকটা ছিঁড়ে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সে আর কখনো মিউজিক সৃষ্টি করবে না। সাবো আর ইলোনা তার পাশে ছুটে যায়। “এতো মানুষ মারা যাওয়ার চাইতে বরং আমি মরে গেলেই ভাল হতো।” “ওরকম করে ভেবো না। তুমি তো ওদের মরতে বলোনি। তুমি কেবল ওদের বিদায়টাকে আরও আনন্দময় করে দিয়েছ।” ডায়লগটা সাবোর। আমারও তা-ই মত। সত্যিই যদি কেউ ‘গ্লুমি সানডে’ শুনে নিজেকে শেষ করে দেয়, তবে সে দায় মিউজিকের নয়, তার। যে যাওয়ার, সে এমনিই যেত, বরং এই সুরের কারণে তার শেষযাত্রাটা আনন্দের হয়েছে। সুরের নৌকায় চড়ে সে অন্যপারে চলে গেছে। আন্দ্রাসের পকেটে একটা বিষের শিশি ছিল, সাবোর কথা শুনে সে বলে, “আমার এটার আর দরকার নেই।” সাবো সেটা নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়। বলে, “তবুও, এটা আমার কাছেই বেশি নিরাপদ।” সাবোর মৃত্যুর পর শিশিটা চলে আসে ইলোনার কাছে।

একদিন আন্দ্রাস সুরটির লিরিক লিখতে বসে। “যে নিঃশ্বাসে জীবন ফুরোয়, সে নিঃশ্বাস আমায় ফেরায় ঘরে, আমি ছায়ার দেশে বেড়াই ঘুরে মনে কোনো ভয় না রেখেই।” ইলোনা বলে, “আমার কাছে ওয়াদা করো, তুমি কখনো ওটা (আত্মহত্যা) করবে না।” “যতদিন তোমায় পাশে পাবো, ততদিন করবো না।” আন্দ্রাসের শপথ। এই শপথটা মুভিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেন, সে কথায় পরে আসছি। ওদিকে হ্যান্স হিটলারের নাৎসি বাহিনিতে যোগদান করে। একদিন কিছু সহকর্মীর সাথে সে রেস্টুরেন্টে তার প্রিয় বিফ রোল খেতে আসে। সেদিন তার সহকর্মীর গুলির হাত থেকে সে সাবোকে রক্ষা করে পুরনো উপকারের প্রতিদান দেয়। তখন আহত সাবোকে আন্দ্রাস বাড়িতে নিয়ে গেলে হ্যান্স ইলোনাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার পথে ইলোনাকে একান্তে চায়। ইলোনা রাজি হল না। সে যাকে মনে স্থান দেয়নি, তার সাথে শোয়া ইলোনার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। একটা মেয়ে ভালোবেসে একাধিক জনেরও শয্যাসঙ্গিনী হতে পারে, কিন্তু যাকে সে ভালোবাসে না, তাকে সে একটা চুমুও খেতে পারে না।

ইলোনা যখন আহত সাবোকে বলে, আমি শুনেছি জার্মানরা হাঙ্গেরির সব ইহুদিকে মেরে ফেলতে চায়, তখন সাবো খুব দারুণ একটা কথা বলে: “আমার বাবা ইহুদি ছিল, মাও ইহুদি ছিল, সে কারণেই আমি ইহুদি হয়েছি। কিন্তু এটা নিয়ে কে এমন করে ভাবে?” সত্যিই তো, যখন কাউকে আমরা তার ধর্ম দিয়ে বিচার করি, তখন কি একবারও মাথায় আসে, জন্মের উপর কি তার কোনো হাত ছিল? সে কি তার ধর্মটা নিজে পছন্দ করে বেছে নিয়েছে? যদি নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের অনুসারী হওয়াটা অপরাধ হয়, তবে সে অপরাধ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে তার কি কিছু করার ছিল? যারা ধর্ম দিয়ে মানুষ বিচার করে, তাদের চাইতে বড়ো নির্বোধ আর হয় না।

এখন আমার সবচাইতে প্রিয় দৃশ্যটার কথা লিখছি। নাৎসি বাহিনির কর্নেল হ্যান্স সহকর্মীকে নিয়ে সাবোর রেস্টুরেন্টে খেতে আসে। আন্দ্রাসকে সে আগে থেকে পছন্দ করতো না। আন্দ্রেসও তাকে তেমন একটা পছন্দ করতো না। সে আন্দ্রাসকে ‘গ্লুমি সানডে’ বাজাতে বলে। আন্দ্রাস বাজাতে চায় না। তখন সে রেগে তার পকেটঘড়িটা বের করে আন্দ্রাসকে বলে, তোমার হাতে দশ সেকেন্ড সময় আছে। তুমি এর মধ্যে বাজাবে। (না বাজালে সে আন্দ্রাসকে গুলি করে হত্যা করবে, তার হাবভাবে এরকমই ইঙ্গিত ছিল।) আন্দ্রাস তাও বাজায় না। তখন আন্দ্রাসকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে ইলোনা তার পাশে ছুটে যায় এবং বলে, বাজাও, বলেই আন্দ্রাসের লেখা গানের লিরিকটা গাইতে থাকে। বলে, আমার জন্য বাজাও। শুধু তখনই আন্দ্রাস বাজায়। গাওয়া শেষ করে ইলোনা দৌড়ে সেখান থেকে বেসিনের দিকে চলে যায়। একটু পরেই গুলির শব্দ শোনা যায়। হ্যান্সের পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে আন্দ্রাস আত্মহত্যা করেছে। প্রশ্ন হল, আন্দ্রাস এমন করল কেন? আমি নিজের মতো করে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। একদিন আন্দ্রাস ইলোনাকে গাইতে অনুরোধ করে। সেদিন ইলোনা তাকে বলেছিল, আমি শুধু তখনই গাই, যখন আমি একা থাকি। এই যে রেস্টুরেন্টে আন্দ্রাস পাশে থাকা সত্ত্বেও ইলোনা গান গাইলো, সেটা প্রমাণ করে, ইলোনা নিশ্চয়ই নিজেকে সেই মুহূর্তে একা অনুভব করছিলো, নইলে সে গান গাইলো কেমন করে? আন্দ্রাস পাশে আছে, অথচ ইলোনা একা হয়ে গেলো? তার মানে কী দাঁড়াল? ইলোনা তার পাশে আন্দ্রাসকে আর অনুভব করতে পারছে না, আন্দ্রাসের পাশে এখন ইলোনা নেই। সে তো বলেইছিল, ইলোনা তার পাশে না থাকলে সেও আর পৃথিবীতে থাকবে না। কী এক অসীম কষ্ট বুকে নিয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়ে সে কথা রেখেছে! আর্টিস্টদের তো আমরা এমনই হতে দেখেছি—খ্যাপাটে, অভিমানী! হ্যান্স তার আত্মসম্মানে আঘাত করেছিল বলে আন্দ্রাস মরেনি, বরং ইলোনা গেয়েছে বলেই সে মরেছে। আন্দ্রাস চরিত্রটা এ মুভির সবচাইতে সংবেদনশীল চরিত্র।

‘গ্লুমি সানডে’র আরেকটা অর্থ সাবোর মুখে শুনতে পাই: প্রত্যেকটি মানুষেরই নিজের একটা সম্মান আছে। আমরা আহত হই। আমরা অপমানিত হই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সম্মানের একটু হলেও অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সবকিছু সহ্য করতে পারি। কিন্তু যখন সম্মানের শেষটুকুও ফুরিয়ে যায়, তখন বোধহয় এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়াই ভাল। চলে যাবো, তবু সম্মান নিয়েই যাবো।………এই জায়গাটা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে! একদিন সাবোকে নাৎসিরা ধরে নিয়ে যায়। হ্যান্স সাবোকে বাঁচানোর আশ্বাস দিয়ে ইলোনাকে বিছানায় নেয়, তার দীর্ঘ সময়ের অতৃপ্ত আত্মাকে শান্ত করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাবোকে সে বাঁচায় না। প্রেমের প্রত্যাখ্যানের নির্মম প্রতিশোধ সে এভাবেই নেয়। আন্দ্রাসের কবরের সামনে গিয়ে ইলোনা বলে, “তুমি ভাবতেও পারবে না, আমি তোমাকে কতটা মিস করি। আমি তোমাদের দুজনকেই খুব মিস করি। লাসলো (সাবো) মৃত, তোমার মতোই। তোমার তো একটা কবর আছে, ওর তাও নেই। ওর বন্ধু উইক (হ্যান্স) ওকে চুল্লিতে পাঠিয়ে দিয়েছে।………আমি রেস্টুরেন্টটা আবারো খুলছি। আমাকে উইশ করো।” ইলোনার গর্ভে তখন সাবোর সন্তান।

মুভির শেষ দৃশ্য নিয়ে আমার একটু আপত্তি আছে। মুভিতে সবকিছু খাপেখাপে মিলে গেলে কেমন জানি ভাল লাগে না, জীবনে কি আর সবকিছু মিলে? লাইফে হ্যাপি এন্ডিং বলে আদৌ কি কিছু আছে? সেদিক থেকে নিও-রিয়্যালিস্ট ফিল্মগুলি দেখাটা নিরাপদ, আশার পূর্ণতায় আশাহত হতে হয় না। জার্মান শিল্পপতিহ্যান্স তার ৮০তম জন্মদিন পালন করতে আসে ইলোনার রেস্টুরেন্টে, তার স্ত্রীসহ। (আর রেস্টুরেন্ট ছিল না? হ্যান্সকে ইলোনার রেস্টুরেন্টেই আসতে হবে? তাছাড়া রেস্টুরেন্টটা যে আবারো খুলেছে, সেটাই-বা হ্যান্স জানলো কীকরে?) সেদিন তো ইলোনারও জন্মদিন। (এই কাকতালটাও মেনে নিতে হবে কেন?) ভাল কথা। এরপর কী হল? হ্যান্সের অনুরোধে ‘গ্লুমি সানডে’ বাজছিল। রেস্টুরেন্টে রাখা ইলোনার অল্প বয়সের ছবি, যেটা একসময় হ্যান্সই তুলে ইলোনাকে উপহার দিয়েছিল; ওটা দেখে হ্যান্স হঠাৎ অসুস্থবোধ করে, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। বৃদ্ধা ইলোনাকে দেখা যায়, রেস্টুরেন্টের পেছনে বেসিনে শিশিটা পরিষ্কার করছে। এতগুলি বছর পর আন্দ্রাসের বিষের শিশিটা কাজে লেগেছে। ইলোনার ছেলে একটা শ্যাম্পেনের বোতল খুলে, গ্লাসে ঢালে, একটা গ্লাস ইলোনাকে দেয়, মায়ের সাথে মায়ের জন্মদিন উদযাপন করে। সাবো যে হ্যান্সের জীবন বাঁচিয়েছিল, সে গল্প যেমনি ইলোনা জানতো না; তেমনি শিল্পপতি হ্যান্সের মৃত্যুর তদন্তে বিষপ্রয়োগে হ্যান্সকে খুন করার পরিকল্পনাটা ফাঁস হয়ে গিয়েছিল কি না, সে গল্প আমরা জানি না। অনেক দেরিতে হলেও ইলোনা দুইটি মৃত্যুর ও একটি অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে নিলো। (এমন সিনেমাটিক প্ল্যানে জীবন এগোয়? সত্যি?) সবকিছুর পরও, ‘গ্লুমি সানডে’ উপভোগ করার ও অনুভব করার মতো একটা মুভি। এই চমৎকার উপহারটির জন্য পরিচালক রলফ সুবেলকে ধন্যবাদ।