ঘরটিই যখন শ্রাবণঢলে


কোথায় গেলে বলো, নিজের একটা ঘর পাবো?
যে ঘরে একজন ভালোবাসার মানুষ থাকবে…এই আমারও,
যে মানুষটি বাইরে থেকে ঘরে ফিরলেই আমার নামটি ধরে ডেকে ডেকে
সারা বাড়ি মাথায় তুলবে!


আমার একটু মন খারাপেও যার খুব এসে যায়,
আমার না থাকায় যে মানুষটি খুব অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে ঠিকই,
---এমন একটা ঘর কি কেউ দেবে আমায়?
একান্তই নিজের একটা ঘর,
একান্তই নিজের একজন মানুষ…পাবো কোথাও?


আমারও, এমন একটা ঘর লাগবে,
যে ঘরের মানুষ হবে আমার মনের মতো,
দিনরাত্রি প্রতিটি ক্ষণই কাটবে যাদের ভালোবাসা আর স্নেহের ছায়ায়,
কোলাহল আর আনন্দে হবে ভরপুর, এমন একটা ঘর,
যে ঘরে থাকবে না কেউ দূরের মানুষ,
থাকবে না হিসেব কোনও লাভ-ক্ষতি আর ভাগাভাগির…
এমন ঘর হয় কি আদৌ, কোথাও, বলো?
না কি কেবল কল্পনাতেই মেলে এমন ঘরের দেখা?


ঘর কি কেবল হয় ওটাই,
যেখানে হরেক রকম মানুষ থাকে নিতান্ত বাধ্যতাতেই,
একে অন্যের সাথে কেবল জড়িয়েই থাকে, নির্লিপ্ততাতেই?
কিংবা প্রায়ই, একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি হচ্ছে যদিও,
ওরা পরস্পরের কাছ থেকে খানিকটা যেন লুকিয়েই বাঁচে?


এ আবার কেমন ঘর, যেখানে নেই কোনও মায়ার বাঁধন?
যেখানে নেই কোনও নাড়ির টানই?
যেখানে থেকেও---একই ঘরের ভেতরে, একই ছাদের তলায়,
কারও কষ্টই যেন করে না উদ্‌বিগ্ন অন্য কাউকেই,
কিংবা একজনের যন্ত্রণা আরেকজনের তৃপ্তির খোরাকই মেটায় শুধু?


এমন একটা ঘর না থাকলেই-বা কী এসে যায়?
যদি ওটা যায়ও ভেঙে ঝড়ের ঘায়ে, কিংবা কালো মেঘ জমেও থাকে ছাদের কোনায়?
কী এসে যায় এমন ঘরের ভাঙা-গড়ায়?
যে ঘরে সুখ কিংবা দুঃখের ভাগটা ওঠে না হয়ে একে অপরের,
এমন ঘরকেও, ঘর বলার অমন দায়ই-বা কীসের?


দিনের শেষে, সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে পরমশান্তি পাবে, এমন আশায় মানুষ ঘরটা বাঁধে।
সেখানে প্রতিটি মানুষই সমান সমান, কেউ বড়ো নয়, কেউ ছোটো নয়,
যেখানে সম্পর্কগুলো নয় নিছকই সম্পর্ক শুধু, বরং একই সুতোয় গাঁথা একটি মালা,
কোনওভাবে সুতোর একটি প্রান্ত যদি যায়ই ছিঁড়ে, তবে ফুলগুলো আর এক কি থাকে?


প্রতিদিনই একটু একটু করে, নিজের রক্তবেচা দামে আমরা যে ঘরটা বাঁধি,
আশায় আশায় বুক বেঁধে যাই---এবার আমার নিজের একটা জায়গা হবে,
এবার হবে আমারও একটা এমন কিছু, যা দেখলেই নিজের বলে দাবি করা যায়!
অথচ দিনান্ত এলেই অনেক স্বপ্নই যেন অদৃশ্য হয়ে যায় মিলিয়ে,
আমরা ঘরের দুঃখ ভুলতে কিনা বাইরে এসে ঘামের স্রোতটা ঝরাই,
ক্লান্ত হই-ই আরাম ভুলে!


এ যেন ঘরে থেকেই ঘরকেই ভুলে থাকার চেষ্টা করা,
সারাদিনই, সারাবেলাই, নিজের একান্ত পরমশান্তির আশ্রয়টুকুই সরিয়ে দেবার সে কী আশা!
অথচ কত রক্ত-স্বেদ ঝরিয়ে তবেই এল এমন এ-ঘর,
কত মূল্য দিয়ে হয়েছিল পেতে একটি এমন ঘর, আশ্রয়!
দিনশেষে আমরা সবাই ঘরে ঠিকই ফিরি,
ঘরে আমাদের ফিরতেই হয়,
কেউ ফেরে বাধ্য হয়ে,
কেউ ফেরে নিতান্তই অভ্যেসের বশে,
কেউ ফেরে পরমস্নেহের আশ্রয় পেতে,
কেউ ফেরে ভালোবাসার মানুষগুলোকে দেখার দায়ে,
আবার কেউবা ফেরে কেবল…ফেরার মতো অন্য কোনও জায়গা নেই বলেই!


তোমরাই বলো, সে ঘর কি কখনও ঘর হয়ে ওঠে,
যে ঘরে জনা কয়েক অদ্ভুতুড়ে মানুষ আর,
কিছু পড়শি বসত গড়ে?
দিনশেষে কেউ কেউ ফেরে ঘরে…মন না চাইলেও,
ইট-পাথরের জঞ্জাল ঠেলে, তা-ও…ঘরই গড়ে!


ভীষণ প্রশ্ন জাগে,
ঘর কি মানুষ গড়ে?
না কি ঘর নিজেই মানুষ গড়ে?
ঘর কি কখনও আপন হয়?
না কি ঘরের মানুষগুলোই ঘরকে আপন করে?
ইট-পাথরের জঞ্জালেই যেন ছেয়ে গেছে পুরো পৃথিবী!
এ যেন পৃথিবীই নয়, বরং কেবলই এক ঘর-সমাধি,
যেখানে ঘরের প্রয়োজনটাই বড়ো, এমনকি ঘরের মানুষগুলোর চেয়েও!


একটি ঘরের দরোজা খুলেই অপর ঘরের দেয়াল আসে,
মানুষই এখানে নগদ জঞ্জাল,
মানুষই পশু, ঘরের খোঁজে ঘরহারা এক,
মানুষ এখন, ঘরের নেশায়
এই পৃথিবীর অনাকাঙ্ক্ষিত সবচে বড়ো উটকো স্তূপের আবর্জনা!


আমার এই রৌদ্রগুলি ছেড়ে দিয়ে মেঘের দলকে আঁকড়ে ধরে
করেছ ভালোই, বেশ করেছ!
আরও গভীর জলে নামতে এবার তবে ছুটিই পেলাম?
আরও একটি আলো তবে এবার নিভেই গেল?
হায়, আরও একটি পাহাড় পড়ল ভেঙে শ্রাবণঢলে!


Sushanta Paul