ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

একটি ঘর। সে ঘরে নিপা নামের একটি মেয়ে বেড়ে উঠছিল। নিপা বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে। নিপার মাকে ওর বাবা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। প্রথম স্ত্রীকে বিয়ে করার সময়ও নিপার বাবার ভালোবাসা ছিল, তবে সে ভালোবাসা শুধুই অর্থের প্রতি। বাবা পুলিশে চাকরি করেন, এর পাশাপাশি টুকটাক কিছু ব্যবসাও করেন। উনার আয়ের ভাগীদার নিপার দুই মা, বড় মায়ের ৪ সন্তান, নিপা আর ওর ছোটভাই রাজন। নিপার মাকে ঘরে আনার আগেই বাদল সাহেবের আগের ঘরের বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। স্রেফ ভালোবাসার কারণে বড় স্ত্রীর অমতে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে নিপার মাকে ঘরে আনার পর থেকে শুরু করে নিপার ছোটভাই রাজনের জন্মের আগ পর্যন্ত ছোটবউয়ের জন্য বাদল সাহেবের ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ ছিল। নিপার জন্মের এক বছরের মাথায়ই রাজন মায়ের পেটে আসে। এরপর থেকেই কী এক অজানা কারণে ছোটবউ আর তার দুই সন্তানের প্রতি বাদল সাহেব আর উনার বড় স্ত্রী প্রভুসুলভ আচরণ করা শুরু করে দেন। অবশ্য এর একটা কারণ হতে পারে এ-ই, বাদল সাহেব ব্যবসার প্রয়োজনে বড়বউয়ের গহনা বিক্রি করে কিছু টাকা পেয়েছিলেন। আর ছোটবউ তো ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারত না। সাধারণত পুরুষের দিক থেকে, প্রথম স্ত্রীর বর্তমানে দ্বিতীয় বিয়েতে ভালোবাসার দাবি খুবই সাময়িক সময়ের জন্য। যে পুরুষের শুধু ভালোবাসা হলেই চলে না, সে পুরুষের কাছে ভালোবাসার সকল দাবিই নিরর্থক। বাবা চাইতেন না যে, নিপা আর ওর ছোটভাই পড়াশোনা করুক। বাড়ির ভৃত্যস্থানীয় ছোটবউ আর উনার দুই সন্তান একেবারেই অনাদরে বাড়িতে বাস করতো দিনের পর দিন। নিপার মা ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী মহিলা। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি চাইতেন, নিজে জীবনে যাকিছু করতে পারেননি, তার দুই সন্তান যেন তা করতে পারে। সেলাই করে, গ্রামের কিছু ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে যে টাকা পেতেন, সে টাকা দিয়ে সংসারের কিছু-কিছু খরচ আর ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। নিপার বাবা যে কোনও টাকাপয়সাই দিতেন না, তাও কিন্তু নয়। স্ত্রীর মর্যাদা বিবেচনায় হোক না হোক, শারীরিক সম্ভোগের বিনিময়ে কিছু-কিছু টাকা ছোটবউকে দিতেন বাদল সাহেব। নিপার মায়ের বয়স ছিল বাদল সাহেবের বয়সের প্রায় অর্ধেক।

ছোটবেলা থেকে মা ছাড়া শুধু আরেকজনের ‘নিখাদ ভালোবাসা’ পেয়েছিল নিপা, সে হল নিপার সৎমায়ের বড় মেয়ের স্বামী মিশুর। নিপার সেই দুলাভাই নিপাকে ছোটবেলা থেকেই অনেক আদর করতো। সে আদর যতটা না ছিল মানসিক, তার চাইতে ঢের বেশি শারীরিক। বাড়ির সবাই সবকিছু বুঝেও কিছু না বোঝার ভান করতো। মিশু নিপার মায়ের সাথে খুবই ভাল ব্যবহার করতো বলেও উনিও তেমন একটা সন্দেহ করতেন না। নিপার জন্য ড্রেস, চকোলেট, নানান প্রসাধন সামগ্রী কিনে নিয়ে আসতেন। নিপা যখন ক্লাস ফাইভে, তখন একদিন সুযোগ বুঝে নিপাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে মিশু। ব্যর্থ হয়ে নিপাকে গলাটিপে ধরে বলেছিল, “খবর্দার! কাউকে বলবি না, কাউকে কিছু বললে একেবারে মেরেই ফেলবো!” নিপা ভয়েই কাউকে কিছুই বলতে পারেনি। সে ঘটনার পর থেকে মিশু নিপাকে নিয়মিত আগের মতোই ‘আদর’ করে গেলেও ধর্ষণের চেষ্টা আর করেনি। মিশু চট্টগ্রাম শহরে একটি শিপিং কোম্পানিতে উচ্চবেতনে চাকরি করতো, শ্বশুরকেও ব্যবসার জন্য নিয়মিত টাকাপয়সা দিত। স্ত্রীর সামনে চাওয়ার আগেই সবকিছু হাজির করে দিত, স্ত্রীকে সবসময়ই সুখী রাখার চেষ্টা করতো। শ্বশুরবাড়িতে ওর কদর ছিল সবার থেকে আলাদা। শ্যালক-শ্যালিকাসহ শ্বশুরবাড়ির সবার জন্যই ও কিছু না কিছু উপহার নিয়ে যেত সবসময়ই। স্ত্রীর তুলনায় দেখতে অতো সুন্দর না হলেও ওর ব্যবহার আর আন্তরিকতায় সকল দৈহিক অসৌন্দর্য ঢাকা পড়ে যেত। এক কথায়, সে ছিল একজন আদর্শ স্বামী ও জামাতা। ক্লাস ফাইভে ওর সাথে দুলাভাই কী করার চেষ্টা করেছিলেন, ওটা বোঝার মতন বুদ্ধি কিংবা বয়স, কোনওটাই নিপার তখনও হয়নি। ও শুধু এইটুকু বুঝেছিল, ও খুব ব্যথা পেয়েছে, এবং সেটা কাউকে না বলতে দুলাভাই ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু সেটা কাউকে বলে দিলে কী হবে, এটা সে বোঝেনি।

স্বামী যে সামান্য খরচ দিতেন, সেটি আর নিজের উপার্জন জমিয়ে অনেক দিন আগে ২টি হাইব্রিড গরু কিনেছিলেন নিপার মা। ৫-৬ বছর পর অনেকগুলো গরু হলো, সেগুলি বিক্রি করে ছেলেমেয়ের জন্য একটা ছোট্ট জমি কিনেছিলেন। ব্যাংক থেকেও কিছু টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। নিপা আর রাজন, দুইজনই মেধাবী ছিল, ওদের মধ্যে ক্লাসের গ্যাপ ছিল দুই। ওরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিল, যেখানে ধনীঘরের সন্তানরাও পড়ত। নিপার হাই স্কুলের ভর্তি পরীক্ষার ফরমের টাকা দিয়েছিলেন ওর প্রাইমারি স্কুলের একজন ম্যাডাম, কারণ নিপার মায়ের ধারণা ছিল, নিপা ওই ভাল স্কুলটিতে চান্স পাবে না, শুধু শুধু টাকা নষ্ট হবে। ছোটবেলা থেকেই স্কুলে সব ক্লাসেই নিপা হয় সেকেন্ড কিংবা থার্ড হতো। ক্লাস সেভেন থেকে এইটে ওঠার সময় বার্ষিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ায় খুশি হয়ে ওকে শহর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল নিপার সেই অমায়িক দুলাভাই। নিপার মা খুশিমনেই নিপাকে মিশুর সাথে শহরে যেতে দিয়েছিলেন। স্ত্রী আর নিপার চাইতে তিন বছরের ছোট ওদের একমাত্র ছেলেটিকে নিয়ে চকবাজারে একটি ভাড়াবাসায় মিশু থাকত। নিপাকে ও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেল। পার্কে, চিড়িয়াখানায়, পাহাড়ে, রেস্টুরেন্টে, মার্কেটে। নিপার বড়আপু বারবারই বলছিল, “কী দরকার এসব বাজে খরচের?” কিন্তু সে কথায় কান না দিয়ে নিপাকে অনেক আদরযত্ন করল মিশু।

নিপা আপুর বাসায় ৩ দিন ছিল। তৃতীয়দিন সকালে। “চলো, মার্কেটে গিয়ে ওকে একটা জামা কিনে দিই।” “আমি পারবো না, আমাকে পার্লারে যেতে হবে।” “তাহলে আমি বের হয়ে কিনে দিই।” “তুমি কী বোঝো মেয়েদের জামার?” “না বোঝার কী আছে?” “তোমার যা পছন্দ!” “দেখ, আমার পছন্দ কিন্তু খারাপ না!” “আমার চাইতে নিশ্চয়ই ভাল না! আমার পছন্দ তোমার পছন্দের চাইতে মাচ বেটার!” “আমারও একই ধারণাই ছিল তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হওয়ার আগ পর্যন্ত!” এটা শুনেই ‘শয়তান! খারাপ লোক!!’ ইত্যাদি বলে স্বামীর দিকে বালিশ ছুঁড়ে মারল নিপার আপু। দুইজনের খুনসুটি দেখে নিপা হাসতে-হাসতে গড়াগড়ি খেল। এরপর নিপাকে সানমার ওশান সিটিতে নিয়ে শপিং করে দিল দুলাভাই। ওরা মার্কেটের ফুডকোর্টে লাঞ্চও সেরে নিল। বাড়িতে ফেরার সময় নিপার আপুর সাথে কথা বলে জানা গেল, পার্লারে অনেক ভিড়, পার্লারে থেকে এক বান্ধবীর বাসায় যেতে হবে। বাসায় ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। ঠিক তখনই তড়িৎগতিতে একটা বুদ্ধি খেলে গেল দুলাভাইয়ের মাথায়! একটু দূরে গিয়ে কার সাথে যেন ফোনে কী সব কথা সেরে নিল মিশু। নিপাকে ওর এক ফ্রেন্ডের বাসায় নিয়ে গেল। ফ্রেন্ডের স্ত্রী চাকরিসূত্রে সিলেটে থাকে। “তোর আপুর ফিরতে তো দেরি হবে। একটা বাসায় চল। যাবি?” “চলেন ভাইয়া, যাবো!” ওখানে গিয়ে নিপার সাথে ফ্রেন্ডকে পরিচয় করিয়ে দিল। “আমার শালী, অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট। গতবার ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে।” এরপর নানান কথাবার্তায় সময় পার হতে লাগল। নিপা একটু ফ্রি হয়ে গেলে নিজেই বাসা ঘুরে দেখতে লাগল। “দোস্ত, তোর ফ্রিজে কোক নেই?” “না।” “একটু নিয়ে আয় না। নিপা, কোক খাবি তো?” “না ভাইয়া, আমার ইচ্ছে করছে না।” “আরে খা, খা!” এটা বলেই বন্ধুকে নিচে পাঠিয়ে দিল দুলাভাই। এরপর কৌশলে নিপার মুখে স্কচটেপ পেঁচিয়ে দিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েক দফায় ধর্ষণ করল। ক্যামেরায় অনেক ছবিও তুলে রাখল। ওর গলায় একটা ছুরি ধরে ভয় দেখাল, “কাউকে কিছু বললে এই ছবিগুলি বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে গ্রামে তোর নামে আজেবাজে কথা রটিয়ে দেবো! এরপর তোর আপুকে তালাক দিয়ে দিব, আর তোর বাবা তোদেরকে ঘর থেকে লাত্থি মেরে বের করে দিবে।” ভয়ে নিপা সেদিনের কোনও কথা কাউকে কোনওদিনও বলেনি। নিপা একটু সুস্থবোধ করলে ওরা রাতে বাসায় ফিরল। নিপাকে সামনে রেখে মিশু স্ত্রীর কাছে এতো চমৎকারভাবে সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর আর শপিংয়ের গল্প করল যে, স্বামীর সেই ভয়ংকর কাজের কথা কল্পনাতেও আনতে পারল না নিপার আপু।

১৩ বছর বয়সি নিপা অনেক ছোটবেলা থেকেই বঞ্চনা দেখেছে, নির্যাতন দেখেছে, বাবার ঘরে কীভাবে ঝিগিরি করে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হয়, সেটা শিখেছে। একমাত্র যে মানুষটিকে সে মা আর ছোটভাইয়ের বাইরে ভালোবাসতো, আপন ভাবত, তার কাছ থেকে ওরকম একটা নির্যাতনের শিকার হয়ে নিপা বিশ্বাস করতে শুরু করে, আসলে পৃথিবীটাই এরকম নিষ্ঠুর! দূর থেকে ভালোবাসাতে আর শ্রদ্ধা করাতে এক ধরনের অদ্ভুত সুখ আর তৃপ্তি আছে। কাছে গেলে অনেক সময়ই হতাশ হতে হয়। কারণ ওতে প্রত্যাশা বেড়ে যায়। প্রত্যাশা মাত্রই কষ্ট দেয়। কাছে গেলে অনেক লুকানো কদর্য জিনিসও বেরিয়ে পড়ে। সেসবও কষ্ট দেয়, ভালোবাসার মানুষটির অন্ধকার দিকগুলিকে মেনে নিতে না পারার কষ্ট। একজনের কাছে যা স্বাভাবিক, আরেকজনের কাছে তা একেবারেই অভিনব হতে পারে। কাছে গেলেই সেই অভিনবত্বটুকুতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারার ব্যর্থতা খুব কষ্ট দেয়। কিন্তু নিপা কি মিশুর কাছে গিয়েছিল? ওকে জোর করে কৌশলে কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সবার চোখে ওই ভাল মানুষটিই। ওর ওতে কী-ই বা করার ছিল? ও কেন পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে গেল? কেন সবাই ওকে ‘দেখতে ভারি মিষ্টি’ বলে? হঠাৎ করেই নিজের মেধা আর শারীরিক সৌন্দর্যের প্রতি নিপার এক ধরনের প্রবল ঘৃণা জন্মাল। নিপা আগে থেকেই খুব চুপচাপ লক্ষ্মী স্বভাবের মেয়ে ছিল, আস্তে-আস্তে আরও বেশি চুপচাপ হয়ে গেল। বাদল সাহেব কখনওই চাননি যে, উনার ছোটবউয়ের দুই সন্তান পড়াশোনা করুক। শুধু মায়ের মনের জোরেই ওরা এত দূর এসেছে। নিপার কোনও সহপাঠীই জানত না, ওদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্লটি ঘরের সব কাজকর্ম ঠিকঠাক করে দেয়ার বিনিময়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। দুই ভাইবোনের কেউই দশম শ্রেণী পর্যন্ত টাকার অভাবে প্রাইভেট পড়তে পারেনি। স্কুলের শিক্ষকদের কেউ-কেউ এসবের কিছু-কিছু জেনে ওদেরকে সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে, কোনও-কোনও মাসে টাকা না নিয়েই উনাদের প্রাইভেটে অন্যান্যদের সাথে বসার সুযোগ দিতেন। জীবনের কাছ থেকে ক্রমাগত আঘাত পেয়ে রাজন কিছুটা প্রতিবাদী আর একরোখা হয়ে উঠত কখনও-কখনও, কয়েক দিন কোনও পড়াশোনাই করতো না। নিপা ওকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে আবারও পড়াতে বসাত। এভাবে করে একটা সময়ে এসএসসি’তে এপ্লাস পেয়ে ইন্টারে ভর্তি হয় নিপা। বাদল সাহেবের আগের ঘরের তিন মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেটি এইচএসসি পাসের পর দুবাই চলে গেছে একটা চাকরি নিয়ে।

একদিন কোনও এক বর্ষণস্নাত দুপুরে। বাবা চট্টগ্রামে ডবলমুরিং থানায় বদলি হয়ে গেছেন, আসা-যাওয়া করে অফিস করেন, মা নানাবাড়িতে, বড়মা মেজোমেয়ের বাড়িতে নায়র গেছেন, বাসায় শুধু নিপা আর রাজন। ওদের বাবার এক কলিগ হাসান আঙ্কেল প্রায়ই আসতেন ওদের বাসায়, উনি ওদের বিশেষ আস্থাভাজন পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। ‘ভদ্রলোক’ জেলা পর্যায়ে সেরা পুলিশ কর্মকর্তার পদকও পেয়েছিলেন। নিপাদের বাসায় উনার ভালই আসা-যাওয়া ছিল। সেদিনও অন্যান্য অনেক দিনের মতোই ওদের বাসায় এলেন। সেই সুযোগসন্ধানী জানোয়ারটা খবর নিয়ে জেনেছিল, বাসায় কেউ নেই। “বাদল কখন ফিরবে?” “আঙ্কেল, বাবার তো ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।” “তা, তোমাদের কী খবর? পড়াশোনা কেমন চলছে-টলছে? কোনও সমস্যা হচ্ছে নাতো?” এই ধরনের বিভিন্ন আলাপ শুরু করলেন উনি। ছোটবেলা থেকেই উনাকে চিনত বলে উনার কুমতলবের কিছুই কল্পনাতেও আনতে পারেনি নিপা। চা খেতে-খেতে গল্প করার এক ফাঁকে রাজনকে উনার জন্য সিগারেট, তিনজনের জন্য বিরিয়ানিসহ আরও কিছু জিনিস আনতে টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন উনি। রাজন সরলমনেই সেগুলি আনতে যায়। এরপর নিজের রিভলভার বের করে ভয় দেখিয়ে নিপার মুখ, হাত, পা বেঁধে পরপর দুইবার ধর্ষণ করেন। সে সময় বেশিকিছু ছবি তুলেন, ভিডিও করেন। নিপাকে ভয় দেখান, কিছু বললে সবকিছু নেটে ছেড়ে দেবেন, এসিড মেরে ওর মুখ ঝলসে দেবেন, রাজনকে গুলি করে মেরে ফেলবেন। নিপার গলা চেপে ধরে জোর করে কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল খাইয়ে দেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার-টাবার নিয়ে হাসিমুখে ফেরে রাজন। বিশেষ জরুরি কাজের দোহাই দিয়ে কিছুই না খেয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে জানোয়ারটা চলে যায়। নিপার সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হতে থাকে। ‘মাথাব্যথা করছে’ বলে রুমের লাইট অফ করে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে নিপা। ছোটভাইটি কিছুই বুঝতে পারে না। নিপা কাউকেই কিছু জানাতে পারেনি ভয়ে। পরিবারের সম্মানের ভয়ে, নিজের সম্মানের ভয়ে, ছোটভাই আর মায়ের জীবনের ভয়ে, সমাজের ভয়ে। ওর আরও ভয় ছিল, এসব জানতে পারলে যদি বাবা রাগ করে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন! কিংবা ওই জানোয়ারটাকেই বিয়ে করতে বলেন, যার ঘরে স্ত্রী সন্তান সবই আছে। নিপার টিনএজ বুদ্ধিতে এর বেশি কিছু আসে না। সে ভাবতে থাকে, এসব জানাজানি হয়ে গেলে নিজের পড়াশোনা, মায়ের স্বপ্ন, কিছুই পূরণ করতে পারবে না সে। এসব ভাবতে-ভাবতেই নিপার দুই দিন চলে যায়। সপ্তাহখানেক পর আবারও সেই হাসান আঙ্কেল আসেন আরেক বন্ধুকে নিয়ে। সেদিনও নিপা আর রাজন একা ছিল বাসায়। রাজনকে খাবার আনতে পাঠিয়ে আগের ছবি আর ভিডিও ফাঁস করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে দুই জানোয়ার মিলে ধর্ষণ করে নিপাকে। ওদিকে নিপার মা তখনও নানাবাড়িতে। জমিজমার ঝামেলার সূত্র ধরে মায়ের চাচাত ভাইয়েরা লাঠি দিয়ে মেরে নিপার মায়ের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। নিপার বাবা স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসার তেমন কোনও আগ্রহবোধ করেন না। তার উপরে সেই বীভৎস যন্ত্রণার পুনর্ঘটন! এসব মানসিক যন্ত্রণায় শারীরিক আর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে নিপা। কাউকেই কিছু বলতে পারে না, নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দেয়, সারিয়ে তোলে। প্রায়ই মানসিক অসুস্থতা থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সবাই ভাবে, পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় এসব হচ্ছে। এতকিছুর পরও দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকে নিপা। অতঃপর এইচএসসি পরীক্ষা। অনেক কষ্টে পরীক্ষা দিয়ে এ পায় সে।

সবাই বলাবলি করছিল, স্যারদের বাসায় যাওয়ার নাম করে শুধু ঘুরে বেরিয়েছে, পড়াশোনা কিছু করেনি। নাহলে ম্যাট্রিকে এপ্লাস পাওয়া-মেয়ে ইন্টারে এ পাবে কেন? বাবা চাইলেন, জোর করে বিয়ে দিয়ে দিতে। বাবার সাথে জেদ করে বাড়ির থেকে পালিয়ে বগুড়ায় চলে যায় নিপা। ওর এক প্রাইমারি স্কুলের বান্ধবীর বাসায় গিয়ে ওঠে। টিউশনি করে নিজেই নিজের খরচ চালাতে থাকে। টাকার অভাবে কোথাও ভর্তি কোচিং করতে পারেনি। মানসিক যন্ত্রণায় ঠিকমতো পড়াশোনা করতে না পারায় কোনও পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স না পেয়ে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে অর্থনীতিতে ভর্তি হয়। সে সময় বগুড়ায় বাড়ি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, এমন এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল নিপার। ছেলেটি নিপাকে মেস ঠিক করে দেয়া, সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করেছিল। ছেলেটির নাম রাজ। পরবর্তীতে রাজের অনুপ্রেরণায় ও উৎসাহে দ্বিতীয়বার নিজে-নিজে পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় নিপা। রাজ নিপার চাইতে এক বছরের বড় ছিল। ওরা এক সময় খুব ভাল বন্ধু হয়ে ওঠে। নিপা যখন থার্ড ইয়ারের শেষের দিকে, তখন রাজ নিপাকে প্রপোজ করে। শুরুতে রাজের সাথে রিলেশনে জড়াতে চায়নি নিপা। কারণ অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে করে সে সবসময়ই ভাবত, সে রাজের যোগ্য নয়। শুধু রাজ কেন, সে কারোরই যোগ্য নয়। সে কারও সাথে জড়ানোর মানেই হল, ওকে ঠকানো, ওর সাথে প্রতারণা করা। তবুও রাজের জোরাজোরিতে নিপা অবশেষে অতীতকে ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখার সিদ্ধান্ত নেয়, রাজকে ‘হ্যাঁ’ বলে।

সম্পর্কের কয়েক মাস পর রাজ নিপার কাছ থেকে জানতে চায়, রাজ নিপার ফার্স্ট লাভ কিনা, নিপা কুমারী কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। কুমারিত্বের ব্যাপারটি নিপা প্রথমদিকে এড়িয়ে গেলেও পরে প্রচণ্ড অপরাধবোধ থেকে রাজকে সবকিছু জানিয়ে দেয় নিজেকে হাল্কা করতে, ওর কাছে নিজেকে আরও বিশ্বাসী করে তুলতে। রাজ সবকিছু শোনার পর কিছুতেই মানতে পারে না, ব্যাপারটিকে সহজভাবে নিতে পারে না। নিপার সাথে তিনদিন সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রাখে। খুব কষ্ট হলেও নিপা মেনে নেয়, এটাই ওর নিয়তি। রুমের দরোজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে অনেক কান্নাকাটি করলেও রাজকে বিরক্ত করে না। নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য নিজেকেই অভিশাপ দিতে থাকে। এরপর আবারও যোগাযোগ করে রাজ। মুখে ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আসলে তোমার তো কোনও হাত ছিল না।’ এই জাতীয় কথাবার্তা বললেও দিনের পর দিন নিপাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকে। নিপার প্রতি ন্যূনতম সম্মানবোধও ছিল না রাজের। রিকশায় বসেই যখন-তখন চড়থাপ্পড় মারত, সুযোগ বুঝে চুলের মুঠি ধরে ঘুষি দিত। প্রায়ই বলতো, “তুই তো নষ্টা, ইচ্ছে করে ওদের সাথে শুয়েছিস। ওদেরকে দিয়েছিস, আমাকেও কিছু দে।” নিপা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, একটা মানুষ কীভাবে তার ভালোবাসার মানুষটিকে এতো জঘন্য কথা বলতে পারে। নিপাকে লোভ দেখিয়েছিল, ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক করলে নিপাকে বিয়ে করবে। কিন্তু সেই কৈশোরের তীব্র আঘাত নিপাকে আর কোনও পুরুষকেই বিশ্বাস করতে দিত না। এভাবে করে চলতে থাকে। অনেক চেষ্টা করেও রাজের মনের মধ্যে কোনও জায়গা করে নিতে পারছিল না নিপা। একপর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। টানা তিনদিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে সে বেঁচে যায়। একটু সুস্থ হয়ে ও হলে ফিরে এলে রাজ ওকে ফোন করে বলে, “কী বিষ খেয়েছিলি যে মরতেই পারলি না? তোর মতো নষ্টা মেয়ে দশটা ভাল ছেলেকে নষ্ট করে দেবে। তুই মরে গেলেই ভাল হতো।” এরকম আরও অনেক কথা। নিপার বাবাকে ফোন করে সবকিছু বলে দেয়। অনেক বাড়িয়ে বাড়িয়েও বলে। নিপাও বাবার কাছে সবকিছু স্বীকার করে। বাদল সাহেব পুরো ব্যাপারটা গোপন রেখে নিপার জন্য দ্রুত পাত্র খুঁজতে শুরু করেন। ওদিকে নিপার অনার্সও প্রায় শেষের দিকে। নিপা যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে, তখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ বিনা চিকিৎসায় নিপার মা মারা গিয়েছিলেন। নিপার ছোটভাই রাজনের এইচএসসি’তে রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল। ওকে আর পড়াশোনা না করিয়ে ইন্টার পাস করার পরপরই নিজের একটা ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন বাদল সাহেব। এখন শুধু এই আপদটা দূর করতে পারলেই বেঁচে যান ভদ্রলোক!

অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক ব্যাংকার পাত্র পাওয়া গেল। জনি; নিপার চাইতে ২১ বছরের বড়। আগের স্ত্রীর সাথে বিয়ের ৩ মাসের মাথায়ই ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। এর পেছনে অবশ্য জনিই দায়ী ছিল। বিয়ের আগে কয়েকজন মেয়ের সাথে ওর দৈহিক সম্পর্ক ছিল যা সে বিয়ের পরেও বন্ধ করেনি। আগের স্ত্রী কিছু বললেই সাথে-সাথে জনি ফোঁস করে উঠত, “তুমি নিজেও তো বিয়ের আগে ভার্জিন ছিলে না। পরশের সাথে ৪ বছর কী করেছ, সেটা কি আমি জানি না?” আরও কিছু তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ওদের মধ্যে মনোমালিন্য হতে হতে একটা পর্যায়ে ওরা পরস্পরকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। এরপর ৯ বছর আগের মতোই বিভিন্ন মেয়ের সাথে সম্পর্ক রেখে গেছে জনি। নিপার বাবা ছেলের অতীত নিয়ে কিছু-কিছু জানতেন। কিন্তু কীভাবে অতি দ্রুত যে করেই হক, নিপাকে ঘর থেকে বিদায় করা যায়, এ চিন্তা থেকে নিপাকে কিছু না জানিয়েই তাড়াহুড়া করে গোপনে জনির সাথে নিপাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। জনির বাড়ি ছিল দিনাজপুরে, তাই নিপার অতীত সম্পর্কেও ভাল করে কোনও খোঁজখবর নিতে পারেনি ও। বিয়ের প্রথম তিন সপ্তাহ খুব ভালোই কাটল। নিপাও খুব কৌশলে ওর কিংবা জনির অতীত নিয়ে সব ধরনের প্রসঙ্গই এড়িয়ে যাচ্ছিল। নিপার তখন জীবন থেকে একটাই চাওয়া: স্বস্তি। এরপর একদিন পৃথিবীর অন্য ১০জন চিরন্তন পুরুষমানুষের মতোই জনি নিপাকে জিজ্ঞেস করে বসল, “তুমি কি ভার্জিন?” নিপা মিথ্যে বলতে পারল না, সবকিছুই বলে দিল। ছেলেরা নিজেরা যা-ই কিছু করুক না, একটা মেয়ের ভার্জিনিটি ওর কাছে অনেক বড় একটা ইস্যু। একটা মেয়ে যতটা একটা ছেলের বর্তমান নিয়ে ভাবে, একটা ছেলে এর চাইতে দশগুণ বেশি একটা মেয়ের অতীত নিয়ে ঘাঁটে। নিপা একটিবারের জন্যও জনিকে সেই একই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেনি। এটা নিয়ে ওর কোনও মাথাব্যথাই ছিল না। কিন্তু জনির কাছে নিপার কুমারিত্ব ছিল নিপার চাইতেও বড়। অন্য ১০টি হিপোক্রিট ছেলের মতোই জনিও বিশ্বাস করতো, ভার্জিনিটি হল মেয়েদের জন্য অলংকার আর ছেলেদের জন্য কলংক। মেয়েরা অলংকার পরে বসে থাকবে আর ছেলেরা কলংকমুক্ত হবে। সমাজ বলবে, আহা আহা! তালিয়া তালিয়া!! নিপাকে নিজের বাবা-মা আর ছোটবোনের সামনে দিনের পর দিন অপমান করে একটা সময়ে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। নিপা কোনওদিনই জানতে পারে না, কিংবা জানার কৌতূহলবোধ করেনি, জনি নিজে কী। এরপর রাগ করে নিপার বাবাও ওকে আর গ্রহণ করেননি। নিপাকে আত্মীয়স্বজন আর সমাজের সামনে ত্যাজ্যকন্যা ঘোষণা করলেন। সবাই বাদল সাহেবকে উনার দৃঢ়তার জন্য বাহবা দিল!

এরপর নিপা একেবারেই একা হয়ে পড়ল। ওর ছোটভাই রাজনও ওকে ভুল বুঝে আর কোনও যোগাযোগ রাখল না। নিপার মাথাই আর কাজ করছিল না। ও কিছুতেই কোনওকিছু বুঝে উঠতে পারে না। নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে, আমার কী ভুল ছিল? আমি ধর্ষিত হওয়ার জন্য কি আমি দায়ী ছিলাম? আমার স্বপ্ন-দেখা, আর সেই স্বপ্নপূরণের চেষ্টা কি ভুল ছিল? আমার আসলেই কি করা উচিত ছিল? মিথ্যে বললেই কি জীবনের সব পুরনো হিসেব বদলে যায়? আমি যে ভালোবেসেছিলাম, সেটার কি কোনও দামই নেই? আচ্ছা, মেয়েদের যোগ্যতা শুধুমাত্র কুমারীত্ব দিয়ে বিচার করা হয় কেন? সেটা কেমন ভালোবাসা, যেখানে প্রেমিকার সমাজ-আরোপিত ‘অসম্পূর্ণতা’কে মেনে নেয়া যায় না? আমার তো কখনওই রাজ কিংবা জনির কোনও অসম্পূর্ণতা নিয়ে বিন্দুমাত্রও প্রশ্ন ছিল না! তবে কেন এমন হল? ওই অল্প বয়সে ওরকম একটা সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোতে থেকে আমার মতন একটা অসহায় মেয়ে আর কী-ই বা করতে পারত? ………. এসব ভাবতে-ভাবতে নিজের আর সমাজের সাথে যুদ্ধ করতে-করতে নিপা হাঁপিয়ে ওঠে। জন্মের পর থেকেই বাবার আর আত্মীয়দের অনাদরে অবহেলায় বড় হয়েছে। সবসময়ই অভাবের মধ্যে ছিল, বাবা কখনওই মানসিক কিংবা আর্থিকভাবে সাহায্য করেননি বললেই চলে। বাবার আদর কী, এটা নিপা কোনওদিনই অনুভব করতে পারেনি। মা এতো কষ্ট করেছে, প্রতিনিয়তই নিজের সমস্ত শরীরটাকে ভেঙেচুরে ফেলে ওদের দুই ভাইবোনকে বড় করেছে। ওদের ভাল কিছু দেখার আগেই মা ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। ওর মা নেই, বাবা নেই, ভাইবোন নেই, কেউই নেই; এমনকি সমাজের চোখে নারীর শ্রেষ্ঠ ধন সতীত্বটুকুও নেই। সবচাইতে বড় ব্যর্থতা, ওর কপট হওয়ার ক্ষমতা নেই। সমাজ যে জিনিসটাকে মাথায় করে রাখে, আবার সেটিকেই পায়ের তলায় ফেলে দুমড়েমুচড়ে নষ্ট করে দেয়! নিজের জীবন থেকে সে শিখেছে, এ সমাজে নারীদের সতীত্বের দাম ওদের ভালোবাসার চাইতেও বেশি। অসতীত্বের আগুন কোনওকালেই পুরুষকে পোড়ায়নি, বরাবরই শুধু নারীদেরকেই অঙ্গার করেছে।

নিপা গোপনে চট্টগ্রামে ফিরে আসে। কাটগড়ে ওর এক বান্ধবীর বাসায় গিয়ে ওঠে। ওর কাছে জীবন আর মৃত্যু, দুইই এখন সমান। যার জীবনে হারানোর কিছুই নেই, সে হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচাইতে বেপরোয়া মানুষ! নিপাকে ওর বান্ধবীর হাজব্যান্ড বিভিন্ন চাকরির তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকেন। এক সময় পরীক্ষা দিয়ে ইপিজেডের একটি কোরিয়ান কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে প্রোডাকশন একজিকিউটিভের চাকরি জুটিয়ে ফেলে। আমাদের সমাজ একলা-চলা নারীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে। বড়-বড় কথা-বলা ভণ্ডরা সুযোগ পেলেই পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের উপর। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে বান্ধবীর বাসায়ই থেকে অফিস করতে থাকে নিপা। বাসার খরচ নিপাও কিছু শেয়ার করতো। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ও খুব ভালভাবে কাজটি বুঝে ধরে ফেলে এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সুদৃষ্টিতে চলে আসে। ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে পারত বলে নিপাকে ফরেন বায়ারদের সাথে বিভিন্ন বিজনেস ডিলিং-এর সময় সাথে রাখা হতো। এভাবে নিপা বিভিন্ন ফরেন বায়ারদের সাথে পরিচিত হতে থাকে। কোম্পানির বিক্রি কীভাবে বাড়ানো যায়, প্রোডাক্টের কোয়ালিটি কীভাবে আরও ভাল করা যায়, কীভাবে আরও বেশি বায়ার অ্যাট্রাক্ট করা যায়, সুন্দরভাবে কর্মী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে দূরত্ব-হ্রাস করাসহ আরও অনেক ক্ষেত্রেই প্রোঅ্যাক্টিভ হয়ে কাজ করে-করে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে লাগল নিপা। সে কখনওই স্রেফ বেতনের জন্য কাজ করতো না। যে কাজের জন্য বেতন দেয়া হয় না, সে কাজটিতেও নিজেকে অপরিহার্য করে তুলে ধরতে পারলে যে কারোরই উন্নতি হবেই হবে। পরপর দুই বছর বেস্ট এমপ্লয়ি অ্যাওয়ার্ড জিতে ৬টা দেশ ঘুরে আসার সুযোগ পেল নিপা। জীবন যখন একবার বদলে যেতে শুরু করে, তখন শুধু বদলায় আর বদলায়। নিপার ক্ষেত্রেও তা-ই হতে লাগল।

সিঙ্গাপুরের এক তরুণ ব্যবসায়ী জিম নিপার কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে ওকে ব্যবসার ওয়ার্কিং পার্টনার হওয়ার অফার দিলেন। যেহেতু নিপার কোনও ইনভেস্টমেন্ট নেই, সেহেতু বিজনেস থেকে যে প্রফিটটা আসবে তার শতকরা ১০ ভাগ নিপার। নিপা ব্যবসার জন্য নতুন-নতুন প্ল্যানিং দেবে, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন আর কর্মীদের তদারকি করবে। কোম্পানি থেকে ওকে সার্বক্ষণিক ড্রাইভারসহ গাড়ি দেয়া হবে, একটা ফুলফার্নিশড্ ফ্ল্যাট দেয়া হবে, প্রতিমাসে একবার ফরেন ট্যুরের সুযোগও আছে। এরপরের সব কিছু গল্পের মতন। নিপা চাকরি ছেড়ে সিঙ্গাপুরে চলে গেল। জিমের কোম্পানিতে ৩ বছর চাকরি করার পর কম্পিউটার অ্যাক্সেসরিজের খুঁটিনাটি সব কিছু নিষ্ঠার সাথে শিখে নিল। সেই ৩ বছর নিপা প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছিল, গড়ে প্রতিদিন মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা ঘুমাত। কোন দেশের কোন কোম্পানি থেকে কোন পার্টসটা কিনতে হয়, কোনটার দাম কোথায় সস্তা, কোথায়-কোথায় বিক্রি করতে হবে, কীভাবে মার্কেট ধরতে হয়, কাস্টমার ডিলিংস্, এসব খুব ভাল করে শিখে নিল নিপা। ওর যতটুকু কাজ, তার ৩ গুণ কাজ সে কোম্পানির জন্য করে দিত। শুরুতে ২টা ডিপার্টমেন্ট দেখাশোনা করলেও পরবর্তীতে ৬টা ডিপার্টমেন্ট ওর তদারকিতে ছিল। জিমের ব্যবসা বাড়তে লাগল। কাজের চাপ আর পরিধি বেড়ে যাওয়ায়, টোটাল প্রফিটের ১০ ভাগের পরিবর্তে ১৫ ভাগ চাইল নিপা। কিন্তু জিম সেটা মেনে নিতে রাজি না হওয়ায়, ৩ বছর পর নিজেই বিভিন্ন দেশের কোম্পানি থেকে কম্পিউটার অ্যাক্সেসরিজ কিনে বাংলাদেশে সাপ্লাইয়ের কাজটি শুরু করল। আস্তে-আস্তে আরও কয়েকটি দেশ থেকেও অর্ডার আসতে লাগল। এরই মধ্যে ওরই এক এক্সকলিগ কপিলকে, যিনি ছিলেন জন্মসূত্রে শ্রীলংকান নাগরিক, বিয়ে করল নিপা। কপিল নিপাকে ব্যবসার কাজে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন। মাত্র ৪ বছরের মধ্যেই নিজের ব্যবসার টাকায় ২টা গাড়ি আর একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলল নিপা। সিঙ্গাপুরের উঠতি সেরা ১০জন নারী উদ্যোক্তার মধ্যে একজন নিপা। সে তালিকায় নিপা ছাড়া আর কোনও বাঙালি নারী ছিল না। ওখানকার বিজনেস ম্যাগাজিন বিজটুডে’তে নিপাকে নিয়ে কাভার-স্টোরি হয়। নিপা হয়ে উঠতে থাকে একজন বিজনেস আইকন। নিপা-কপিল দম্পতির এক ছেলে, এক মেয়ে; দুইজনই স্কুলে যায়। ওদেশে মানুষের বর্তমানকে ম্লান করে দিয়ে অতীত নিয়ে গবেষণা করার মতো সময় কারোরই নেই। অন্যের ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার, অন্যের ঠিক এবং ভুল নিয়ে জাজমেন্টাল হওয়ার মতো বেকার সময় কিংবা ফালতু সস্তা বাজে মানসিকতা, ওখানকার সবচাইতে কম ব্যস্ত কিংবা কম শিক্ষিত লোকটিরও নেই। নিপার এখন যা কিছু আছে, তা কিছু শুধুই বর্তমান আর সামনের ভবিষ্যৎ। সবকিছু মিলিয়ে এই ৪ জনের ছোট্ট সংসারটি বেশ শান্তিতে আছে।

একটা সময়ে জীবনের প্রতি বীতস্পৃহ হয়ে আত্মহত্যায় ব্যর্থ মেয়েটি, পরিবার হতে ত্যাজ্যকন্যা হয়ে-যাওয়া মেয়েটি, বারবারই পদে-পদে নিষ্ঠুর সমাজের কাছে নিগৃহীত হওয়া মেয়েটি, মুহূর্তে-মুহূর্তে রং বদলে-ফেলা দ্বৈত অবয়বের ভণ্ড সমাজটির কাছে নষ্টা মেয়েটি এখন বাংলাদেশের অহংকার হয়ে সবার কাছে মাথা উঁচু করে বাঁচছে। সে অন্তত ৮৫০ জন বাংলাদেশি বেকার ছেলেমেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করেছে। যে পরিবার থেকে একটা সময়ে ওকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছিল, সে এখন সেই পরিবার এবং ওকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় আজে-বাজে কথাবলা ওরই আত্মীয়স্বজনের আরও ৪টা পরিবারের সব ধরনের দেখাশোনা করে। ওর গ্রামের আরও ৩৭টা অসহায় ফ্যামিলির সব খরচের দায়িত্ব ওর। ১৬৫ জন এতিম শিশুর পড়াশোনার খরচ চালায়। দুর্গত অসহায় লোকজনকে সাহায্য করতে প্রতি বছর লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচ করে। একটা সময়ে যে মেয়েটির পিঠ দেয়ালে, শুধু ঠেকে নয়, একেবারে গেঁথে গিয়েছিল, সেই মেয়েটিই নীরবে নিভৃতে নিজের সমস্ত সাফল্য আর অর্জন দিয়ে এই সমাজের উপর পৃথিবীর সুন্দরতম প্রতিশোধটি নিয়ে নিয়েছে, নিচ্ছে। নিজের সকল অপ্রাপ্তির মধ্য থেকেই সে খুঁজে নিয়েছে জীবনের মহত্তম প্রাপ্তিগুলি। জীবনের কাছ থেকে এর চাইতে বেশিকিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই নিপার।

সম্প্রতি উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বিদেশে সেরা বাংলাদেশি নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিপাকে সম্মাননা পদক প্রদান করে। সেই জমকালো অনুষ্ঠানে বাবাকে সাথে নিয়ে স্টেজে উঠে নিপা খুবই বিনীতভাবে বলে, “আমার বাবা। উনি আমাকে জন্ম দেয়ার কাজটি করেছেন, বাকি কাজটুকু আমি করেছি। বাবা না থাকলে আমি থাকতাম না। আমি না থাকলে আজকের এই দিনটা আসত না। বাবাকে ধন্যবাদ।” এভাবে করেই পরিবারের কুলাঙ্গার সন্তানটি হাজার-হাজার মানুষের সামনে বাবাকে পরিচয় করিয়ে দিল। বাদল সাহেব কিছুই বলতে পারছিলেন না, আবেগে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, শুধুই দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছিল সে ধাঁধানো সন্ধ্যায়।

পুনশ্চ। আমার যে জুনিয়ররা এই লেখাটি পড়েছ, তাদেরকে বলছি, তোমার বিশ্ববিদ্যালয় তোমার জন্মদাতার মতো। তোমার বিশ্ববিদ্যালয় তোমাকে স্রেফ একটি সার্টিফিকেট দিতে দায়বদ্ধ, আর কিছুই নয়। বাকি কাজটি তোমাকেই করতে হবে।

তোমাদের জন্য শুভকামনা রইলো!