চাকরি থেকে শেখা/ প্রথম পর্ব

 (ডিসক্লেইমার। এই লেখার বক্তব্য আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতাপ্রসূত। ভিন্ন মতামত বা অভিজ্ঞতা থাকতেই পারে। তাই, আমার কোনও বক্তব্যকেই সেটরুল বা এরকমই-হয় ভাবাটা ঠিক হবে না। আমি এখানে কিছু টেকনিকের কথা বলেছি, যার অনেকগুলি আমি নিজেই সবসময় ফলো করতে পারি না। তার চেয়ে বড় কথা, এই লেখার অনেক দিক আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করি না। আমি যা নিজে দেখেছি ও অন্যদের কাছে শিখেছি, তা-ই লিখেছি মোটামুটি অকপটভাবে। কমেন্টে আপনি আপনার নিজের অভিজ্ঞতা বা মতামত শেয়ার করলে আমার ও পাঠকদের ভালো লাগবে।)


পেশাগত ঝামেলা এড়িয়ে চলার তেমন কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, তবে তা কমানোর কিছু টেকনিক নিয়ে এখানে কথা বলেছি, যেগুলি পরিস্থিতি বুঝে আপনাকে আপনার নিজের মতো করে কাস্টমাইজ করে নিতে হবে, সেগুলির কোনও কিছুকেই গাইডলাইন হিসেবে নেবেন না, এই পরামর্শ রইল। এই লেখার অনেক টেকনিক আমাদের শ্রদ্ধেয় সিনিয়র অফিসারদের কাছ থেকে শেখা। কিছু শিখেছি সিভিল সার্ভিসের প্রাক্তন কর্মচারীদের বিভিন্ন লেখা পড়ে। তাই, এর অনেক কিছুই মৌলিক নয়। তাঁদের প্রতি সবিনয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। লেখাটির খসড়া লিখেছিলাম প্রায় সাত বছর আগে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের ট্রেনিং একাডেমিতে ৩১তম বিসিএস ব্যাচের অফিসারদের একটা ক্লাসের লেকচার ম্যাটেরিয়াল হিসেবে। পরবর্তীতে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের একটা ট্রেনিং সেশনেও সেই প্রেজেন্টেশনটি উপস্থাপন করেছি। সেই পয়েন্টগুলিকে আরও সম্পাদনা, পরিমার্জন ও সংযোজন করে নিজেকে পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক রেখে বর্তমান লেখাটি তৈরি করেছি। এই লেখা কখনও প্রকাশ করব না, এটাই মাথায় ছিল, কী মনে করে জানি প্রকাশ করতে মন চাইল, তাই করলাম। আর একটা ব্যাপার হলো, আমি এই অভিজ্ঞতা লাভ করেছি বাংলাদেশ কাস্টমস এনভাইরনমেন্টে কাজ করে, আমি কখনও অন্য কোনও চাকরি করিনি। তাই আমার জানায় ও বোঝায় কিছু ভ্রান্তি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আমার ভুলগুলিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার বিনীত অনুরোধ রইল।


সিভিল সার্ভিসে ৪ ধরনের অফিসার আছেন: এক, HE (Honest and Efficient); দুই, DE (Dishonest but Efficient); তিন, HI (Honest but Inefficient); চার, DI (Dishonest and Inefficient)। আপনি কোন ধরনের হবেন, সেটা নির্ভর করছে কোন ধরনের হলে আপনি খুশি হবেন, তার উপর। আপনার সততা কিংবা অসততা নিয়ে সত্যিই কারও কোনও মাথাব্যথা নেই, যদি আপনি কোনও ঝামেলা পাকানো ছাড়াই সব কিছুকে ঠিকভাবে ম্যানেজ করে কাজ করতে পারেন। আপনার সততার জন্য বাড়তি কিছু প্রত্যাশা করবেন না, সৎ থেকে মানসিক যে শান্তিটা পাচ্ছেন, সেটাই আপনার পুরস্কার। Honesty or dishonesty--it’s a choice, not a rule. আমাদের এই অঞ্চলে এমন একটাও সিভিল সার্ভিস সিস্টেম নেই, যেটা শতভাগ সততার উপর দাঁড়িয়ে আছে। একটা সিস্টেম দুর্নীতিমুক্ত, এর মানে কিন্তু এ নয় যে সিস্টেমটি নিখুঁত। আইডিয়াল স্টেট হলো এই, সিস্টেমে কিছু খুঁত থাক, কিছু অনিয়ম থাক, তবু সিস্টেমটি দ্রুত ও সঠিকভাবে সেবাদানে শতভাগ সক্ষম হোক। যে লোক সৎ, আবার কাজেও অথর্ব, সে লোকের কোনও দরকার নেই। এমন নিষ্ক্রিয় সততা দেশের কোনও কাজে লাগে না। আর যদি এমন কাউকে পাওয়া যায়, যিনি সৎ ও কাজে পারদর্শী, তবে তো আর কথাই নেই, ওরকম ব্যক্তি চাকরিতে ও চাকরির বাইরে সবার কাছেই শ্রদ্ধেয়! তাঁদের দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের অনেক কল্যাণ হয়। যাঁরা একই সাথে অসৎ ও অদক্ষ, তাদের চাকরি থাকাই উচিত নয়! তাঁদের সত্যিই ঘাড়ে ধাক্কা মেরে চাকরি থেকে বের করে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া গেলে দেশের অনেক উপকার হতো। এবং, যদি কেউ ‘সহনীয় মাত্রায়’ অসৎ হয়, কিন্তু কাজেকর্মে খুবই পারদর্শী হয়, তবে তেমন কর্মীর কাছ থেকে কাজের আউটপুট অনেক বেশি পাওয়া যায়। সিস্টেম ও বাস্তবতাই অনেক সময় অসৎ হতে বা অসততা প্রশ্রয় দিতে বাধ্য করে। উল্লেখ্য, সততা বলতে আমরা প্রায় মানুষই কেবল আর্থিক সততাকেই বুঝি। আসলে সততা বলতে আরও অনেক কিছুই বোঝায়। ঠিক সময়ে কাজটা করা, অফিসে ঠিক সময়ে আসা, কথায় ও কাজে মিল থাকা, কমিটমেন্টের প্রতি সর্বোচ্চ পরিমাণ আন্তরিকতা দেখানো, অফিসটাকে ঠিকভাবে ম্যানেজ করা, মানবিক হওয়া এই সব কিছুই সততার মধ্যে পড়ে। এ বিষয়ে আরও জানতে প্রাক্তন আমলা ড. আকবর আলী খানের ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ পড়ে দেখতে পারেন।


আইন জানতে হবে, বুঝতে হবে। এর মানে কী? এর মানে হলো, আইনটা কোথায় আছে, সেটা জানতে হবে। A good lawyer is he who knows rather where the law is than what the law is. আইন মুখস্থ করার চাইতে আইন ও আইনের ফাঁকফোকরগুলি ভালোভাবে বোঝা বেশি জরুরি। অনেক সময় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অনেক কাজই আপনাকে করতে হবে, যা আইনসিদ্ধ নয়, তবে আইনের ফাঁকসিদ্ধ। আইন সম্পর্কে ভালো না জানলে সে-কাজ নিরাপদে (নিজেকে ও নিজের চাকরিটাকে বিপন্ন না করে) করবেন কী করে? বই তো আপনার সামনেই থাকবে। চাকরি করতে করতে কী কী লাগে, কী কী লাগে না, এটা শেখা হয়ে যায়। বাকি কাজ সহজ--আইনবিধি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা সিদ্ধান্ত চাওয়া। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, The language of law is more difficult than the law itself. এটা ইচ্ছে করেই করা হয়েছে। কিন্তু কেন? উত্তর সহজ। এই আইনগুলির বেশিরভাগই তৈরি হয়েছে ব্রিটিশদের হাতে। ওঁরা আইনগুলিকে এমনভাবে বানিয়েছেন, যাতে সাধারণ লোকজন সেগুলি বুঝতে কম পারে এবং ‘আইনের মারপ্যাঁচ’ নামক একটা কনসেপ্টের উদ্ভব হয়। রান্না করার চাইতে রান্নার রেসিপি লেখা যেমনি কঠিন, তেমনি আইনের প্রয়োগের চাইতে আইনের বিধিবিধান বানানো কঠিন। তা ছাড়া, প্রচলিত অধিকাংশ আইন বিভিন্ন বিদেশি আইনের ছায়ায় ও অনুকরণে বানানো। ফলে বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে ভাবানুবাদ না করে আক্ষরিক অনুবাদ করার কারণেও আইনের ভাষাটা জটিল হয়ে গেছে, এটাও হতে পারে। আইন কী ও কেন, এ নিয়ে আয়ান মরলির লেখা ‘দ্য ডেভিলস অ্যাডভোকেট’ পড়ে দেখতে পারেন, আনন্দ পাবেন।


চাকরির নিয়ম হলো, এখানে যে খুন করে, তার ফাঁসি হয় না। যে ধরা খায়, ফাঁসি হয় তার। ভুল করা ভুল নয়, ভুল করে ধরা খাওয়াই বড় ভুল। এদেশে যে-কোনও তুচ্ছ বিষয়কেও ঠিক পথে ঠিক পদ্ধতিতে সবার সামনে তুলে এনে সেটিকে অনেক বড় বিষয় বানিয়ে ফেলা যায়। আবার অনেক বড় বিষয় আমলে না নিলে সেটি গ্রাহ্য করার মতো কোনও বিষয়ই হয়ে ওঠে না। চাকরিতেও তা-ই। চাকরিতে পারতপক্ষে শত্রু তৈরি করা যাবে না, যদিও আপনি কারও সাতেও-নাই-পাঁচেও-নাই জাতীয় মানুষ হলেও অনেকেই কোনও কারণ ছাড়াই আপনাকে শত্রু ভাবতে পছন্দ করবে। ওরা যে তোমার চোখে জল আনবে হায়…বিনা কারণে! কিছু মানুষ সব জায়গায়ই আছেন, ঝামেলা না পাকিয়ে বাঁচতে যাঁদের ভালো লাগে না। চাকরিতে ব্যক্তিগতভাবে খুব কাছের কেউ না হলে বাকি সবার সাথেই ফর্মাল ব্যবহার করা ভালো। আমাদের এক বস আছেন, ইচ্ছে করেই রোবটের মতো একেবারে মাপামাপা কথা বলেন, হিসেব করেই হাসেন। স্যারকে কখনওই কোনও কিছু নিয়ে অতি-উৎফুল্ল বা অতি-বিষণ্ণ হতে দেখিনি। মজার ব্যাপার, আদতে উনি ভিন্ন রকমের মানুষ।…নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কারও সাথেই মন খুলে কথা না বললেই ভালো। আপনার কথাই আপনাকে বিপদে ফেলে দেবে সবচাইতে বেশি।


আপনার ঠিক কাজের জন্য সম্ভাব্য পুরস্কার হয়তো পাবেন স্রষ্টার কাছ থেকে। কিন্তু, ভুল কাজের জন্য নিশ্চিত শাস্তি নগদে পাবেন বসের কাছ থেকে। ঠিক কাজ কিংবা ভুল কাজ বুঝবেন কীভাবে?...সময়ই এটা শেখাবে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এখানে অনেক কাজ আছে, যেগুলি ভুল কি ঠিক, তা পরিস্থিতি ও আপনার বসের মর্জির উপর নির্ভর করে। জীবনে উচিত অনুচিত বলে কিছু নেই--জীবনে আছে কেবল দুটো জিনিস: যা ঘটে, যা ঘটে না--আর চাকরিতে তো নেই-ই! যা করলে আপনি বিপদে পড়তে পারেন, তা হচ্ছে অনুচিত কাজ; যা করলে আপনি বিপদমুক্ত থাকতে পারেন, তা হচ্ছে উচিত কাজ। আপনার আগের জন যে ভুল কাজ করে পার পেয়ে গেছেন, সে একই ভুল কাজটি করে আপনি ধরাও খেতে পারেন। এটাও মাথায় রাখুন। বিপদে পড়ার হাত থেকে নিজেকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে চলতে হবে, বিপদে পড়লে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়, যা সত্যিই অনেক যন্ত্রণা দেয়।


আপনি এখানে কোনও স্টেকহোল্ডারের উপকার করলে উনি আপনার সুনাম করবেন তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিবার-পরিজনের কাছে। আর উপকার করতে না-পারলে উনি আপনার সম্পর্কে উল্টাপাল্টা বোঝাবেন আপনার বসকে। এখানে কারও কোনও ক্ষতি না করলেও আপনি তাঁর শত্রু হয়ে যেতে পারেন। কীভাবে? তিনভাবে। কোনও একটা কাজ আইনে কভার করে না বলে কিংবা কাজটা করে দিলে আপনি নিজে ঝামেলায় পড়ে যেতে পারেন, সে ভয়ে আপনি কাজটা করতে রাজি না হলে। হয়তো আপনাকে এমন কেউ পছন্দ করেন না, যার সাথে উনার সম্পর্ক ভালো। হয়তো এমন কারও দুর্ব্যবহার, অন্যায় প্রস্তাব বা হেয়ালিপনা আপনি সহজভাবে নিতে পারলেন না, যে ব্যক্তির সাথে আপনার বসের খুব ভালো সম্পর্ক, তখনও তিনি আপনাকে শত্রু বানিয়ে ফেলতে পারেন।


আপনার বস যদি খোঁড়া-কানা-কালা-বোবাও হন, তবু মনে রাখবেন, উনি আপনাকে সবসময়ই ওয়াচ করছেন। বিশ্বাস না হলে, অসাবধানে উল্টাপাল্টা কিছু করে দেখুন। নগদে ফল পাবেন! আপনার বস মূল্যায়িত হতে চান, মাঝেমাঝে অতি-মূল্যায়িত হতে চান, এটা মাথায় রাখুন। যদি বসের কাজ ও জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা না রাখেন কিংবা বস কখন কোথায় কীভাবে আপনার গতিবিধির উপর নজর রাখছেন, তা বোঝার চেষ্টা না করেন, তা হলে চাকরি-করাটা আপনার পক্ষে সহজ নয়। বসের যোগ্যতার মূল্যায়ন না করা আর নিজের পায়ে কুড়াল মারা, একই কথা। বসের কোনও যোগ্যতা থাকলে তা বসের সামনে বলুন, না থাকলেও বস যা শুনতে চান, তা বানিয়ে বানিয়ে বলুন। আপনার বড় বড় সার্টিফিকেট এবং অর্জনকে পকেটে ঢুকিয়ে রাখুন, ওসবকে কেয়ার করার সময় কিংবা দরকার আপনার বসের নেই। বরং আমি দেখেছি, যার অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেটের ভার যত কম, তার পক্ষে চাকরি-করা তত সহজ। বেশি কোয়ালিফাইড কর্মীদের বসরা পছন্দ কম করেন। আপনার অনেক কোয়ালিফিকেশন থাকতে পারে, কিন্তু আপনাকে দিয়ে আপনার ডিপার্টমেন্টের বা বসের কোনও কাজ না হলে, আপনার দাম শূন্য। চাকরিটা ছেড়ে দিন, তখন আপনার বসের সাথে রাস্তাঘাটে দেখা হলে…হাই আক্কাস ভাই, হাউ আর ইউ, বেইবি? বলতে পারেন, কোনও সমস্যা নাই, কিন্তু চাকরি করছেন মানেই, আপনার পায়ে শেকলপরানো…সো, নো আজাইরা এক্সট্রা-ভাব! আর একটা ব্যাপার মনে রাখবেন: কখনওই আপনার বসের জন্য থ্রেট হয়ে উঠবেন না। আপনার কোনও কাজে বা আচরণে আপনার বসের কোনও কিছুই যেন কোনওভাবেই ব্যাহত না হয়, সে-দিকে খেয়াল রাখবেন। পথের কাঁটাকে কেউই পছন্দ করে না।


আপনি ভালো কাজের বন্যায় দেশ উদ্ধার করে ফেললেও কোনও লাভ হবে না, যদি সে-খবর আপনার বসের কানে নিয়মিত না পৌঁছে। Feedbacks are important. মনে রাখবেন, আপনাকে আপনার বস চেনেন কি না, এটা যতটা না উনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপনার নিজের জন্য। চাকরি করতে গেলে দেখবেন, কেউ কাজ না করেও পুরস্কৃত হয়, কেউ কাজ করেও তিরস্কৃত হয়। কেন? আপনি কাজ করছেন, এটা যাতে আপনার বসের মাথায় আসে, সে আপনি কাজ করুন আর না-ই করুন। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। শুধু কাজ করাটাই জরুরি নয়, কাজটা আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মনের মতো হচ্ছে কি না কিংবা আপনি তাঁদের অপছন্দের কোনও কাজ করা থেকে বিরত থাকছেন কি না, এসব খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কী করছেন, তা ইতিবাচকভাবে ফেসবুকে শেয়ার করুন। আপনার বসকে ট্যাগ করে তাঁর প্রশংসা লিখে দিন সেই পোস্টে।


পৃথিবীতে শুধু মানুষ পয়দা করা ছাড়া এমন কোন ক্ষমতা নাই যা মহান সৃষ্টিকর্তা প্রতারকদের দেন নাই। ওদের কাছ থেকে সাবধান থাকবেন। ওদের কিছু বৈশিষ্ট্য বলে দিই। ওদের ব্যবহার খুবই ভালো। খুবই আন্তরিকভাবে কথা বলে। কখনওই কোনও ব্যাপারেই মাথা গরম করে না। ওরা লোকের কাছ থেকে মধুর মধুর কথা বলে টাকা ধার নেয়, পরে আর ফেরত দেয় না। আমার বাবা অমুক, দাদা তমুক, চাচা এই, মামা সেই, আমাদের ফ্যামিলি খুব নামকরা, এ ধরনের নানান পরিচয় দিতে থাকে। ছ্যাঁচড়ামি করার ব্যাপারে ওদের ধৈর্য অসীম, আপনি অনেক চেষ্টা করেও ওদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে পারবেন না। ওদের ব্যবহার খুব ভালো, কখনও রেগে যায় না, নানান মিথ্যা কথা বলে আপনার সহানুভূতি বা বিশ্বস্ততা আদায় করার চেষ্টা করে। ওরা প্রচুর প্রচুর প্রচুর কথা বলতে পারে, দরকার হলে একনাগাড়ে কথা বলতে পারে…তার বেশিরভাগই মিথ্যা কথা। ওদের কথা শুনলে মনে হবে, এই বুঝি এখনই ওরা আপনাকে স্বর্গে নিয়ে যাবে, আপনার অনেক কাজ করে দেবে, ওদের জীবনের দুঃখের ধরন অনেকটাই আপনার নিজের জীবনের সাথে মিলে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কতটা বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে মিথ্যা বলা যায়, ওদের না দেখলে এ জীবনে আপনি কখনও বুঝতে পারবেন না। ভালো অমায়িক আন্তরিক ব্যবহার দিয়ে ওরা খুব সহজেই আপনার মন জয় করে নেয়। আপনি মুগ্ধ হয়ে একবার ওদের ফাঁদে পা দিলেই শেষ! রাস্তার কুকুরদের যা লজ্জা থাকে, ওদের তাও নেই। এদের মধ্যে আর একটা দল আছে, যাদের সাথে মিশলে মনে হবে, এদের বিশ্বাস করা যায়, মনের সব গোপন কথা অকপটে বলা যায়। এদের দেখলে, এদের সাথে আলাপ করলে এদের বুকে টেনে নিতে ইচ্ছে করে, এদের দেখলেই আপন আপন লাগে। এরা হচ্ছে আপনার বসের গুপ্তচর। আপনি কী বললেন কী বললেন না, তার সব কিছুই বাড়িয়ে বাড়িয়ে আপনার বসের বা কোনও ক্ষতিকর কলিগের কান পর্যন্ত পৌঁছে দেবে, তার বিনিময়ে নিজের কিছু কাজ করিয়ে নেবে।


যদি হঠাৎ মনে হয়, সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে, আল্লাহর হুকুমে সেটা হলেও হতে পারে। কিন্তু যদি প্রায়ই আপনার মনে হয়, আপনার সেবাগ্রহীতারা ও কলিগরা সত্য কথা বলছে, তবে আমি আপনাকে বলব, এত সহজসরল মন নিয়ে সিভিল সার্ভিসে কাজ করাটা আপনার জন্য একটু কঠিন। উঠতে বসতে আপনাকে অর্ধসত্য ও মিথ্যার সাথে বসবাস করতে হবে। সে ধরনের মানসিক প্রস্তুতি রাখুন। কাউকেই বিশ্বাস করবেন না, আর কাউকেই যে বিশ্বাস করছেন না, এটা কাউকেই বুঝতে দেবেন না। সবচাইতে সফল কর্মীরা সবার সাথেই হাসিমুখে কথা বলে, কারও সাথেই মেজাজ গরম করে না। মেজাজ খারাপ হলে একটা টেকনিক ফলো করতে পারেন, তা হলো, তখন কারও সাথেই কোনও কথা বলবেন না, দাঁতে দাঁত চেপে হলেও একদম চুপ করে থাকবেন। কখনও কারও পেছনে তার সম্পর্কে বাজে কথা বলবেন না। এতে যে আপনার পেছনে আপনার সম্পর্কে কেউ বাজে কথা বলবেন না, তা কিন্তু নয়, তবে সে বাজে কথা বিশ্বাস করার লোকের সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে যাবে। যার কাছে কারও সম্পর্কে বাজে কথা বলছেন, সে কোনও একদিন কথাটা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে বা ফাঁস করে দিয়ে আপনার কাছ থেকে বা অন্য কারও কাছ থেকে কোনও সুবিধা আদায় করতে চাইবে না, এটা বুঝলেন কী করে? কথা যতক্ষণ মুখের ভেতর থাকে, ততক্ষণই সেটা সম্পদ, মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়লেই সেটা দায়ে পরিণত হয়, কেননা তখন সে-কথার দায়িত্ব আপনাকেই বহন করতে হবে।


আপনার কলিগরা, সাবঅর্ডিনেটরা, স্টেকহোল্ডাররা কে কী বলছেন, সেটাকে নিজের মতো করে যাচাই করে করে নেবেন। আপনাকে জবাবদিহিতা করতে হবে আপনি কী করছেন সেটার ভিত্তিতে, উনারা কী বলছেন সেটার ভিত্তিতে নয়। তবে কিছু বস আছেন, যাঁদের নামেই একটা মাথা আছে, কিন্তু আদতে কান ছাড়া আর কিছুই নেই। এমন বসরা কানকথা শোনেন, বিশ্বাস করেন এবং তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেন। আপনি শত চেষ্টা করলেও তাঁদের এমন প্রবৃত্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না। এক্ষেত্রে ভালো হয়, ওঁরা কী চান, সেটা খুঁজে বের করা এবং ওঁদের চাহিদা পূরণ করা। সব সময় সেটা করা সম্ভব নাও হতে পারে, সেক্ষেত্রে তাঁদের ওরকম অন্যায় সিদ্ধান্ত বা আচরণ মেনে নিয়ে চাকরি করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তবে আমি এমন স্মার্ট অফিসারও দেখেছি, যাঁরা বসের কানে কথা পৌঁছে দেয় যারা, তাঁদের সাথেই ভালো সম্পর্ক তৈরি করে রাখেন। ফলে নিজেকে অনেকটা ঝামেলামুক্ত রাখতে পারেন। আবার এমনও বস দেখেছি, যাঁরা কাউকে একবার অপছন্দ করলে সারাজীবনের জন্য অপছন্দ করে ফেলেন। তখন সে ব্যক্তিটি যা-ই করুক না কেন, তা-ই তাঁদের চোখে খারাপ মনে হয়। কেবলই সে ব্যক্তির খুঁত ধরতে থাকেন, খুঁত না-থাকলেও খুঁত আবিষ্কার করে ফেলেন। তাঁদের ব্যাপারে আসলেই তেমন কিছু করার থাকে না। আপনি চাইলেই তো বস বদলে ফেলতে পারবেন না, কিংবা মনের পছন্দমতো বস ঠিক করতে পারবেন না।


চাকরি নিয়ে কমপ্লেইন করে কোনও লাভ নেই। আপনাকে বাসায় পুলিশ পাঠিয়ে ধরেবেঁধে এনে চাকরিতে বসিয়ে দেওয়া হয়নি। ভালো না-লাগলে চাকরি ছেড়ে দিন। আপনি এমন কেউ নন যে আপনি চাকরি ছেড়ে চলে গেলে কারও কিছু এসে যায়। সিভিল সার্ভিসে কেউই অপরিহার্য নয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতটিকেও যদি সিভিল সার্ভিস থেকে বের করে দেওয়া হয়, তাতে দেশের ও সেবাগ্রহীতাদের কোনও ক্ষতি হবে না। যদি আপনার মনে হয়, আপনার হাতে বেটার কোনও অপশন আছে, আমি আপনাকে বলব, গো ফর দ্যাট! এবং আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনি চলে যাবার পর আপনাকে আপনার ডিপার্টমেন্ট কখনও মিস করবে না, আপনার কথা তেমন কেউই মনে রাখবে না। যতক্ষণ চাকরি, ততক্ষণই সালাম! চাকরি নাই তো সালামও নাই। এটাই নিয়ম। আপনি বলতে পারেন, আপনি এসবের তোয়াক্কা করেন না। দ্য ফ্যাক্ট ইজ, আপনি কী তোয়াক্কা করেন, কী তোয়াক্কা করেন না, সেটার তোয়াক্কা সিভিল সার্ভিস করে না। আপনার এইসব ইমোশনের দাম অন্তত সিভিল সার্ভিসে শূন্য। প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের সামর্থ্য, ভাগ্য ও সুযোগ অনুযায়ী বাঁচে। আপনি এর বাইরে নন। আপনি সিভিল সার্ভিসে থেকে যাওয়ার চাইতে ভালো কিছু করতে পারলে যে এখানে থেকে যেতেন না, এটা আপনার কলিগরা খুব ভালো করেই বোঝেন কিন্তু!


সাধারনত ৩ ধরনের কলিগ পাবেনঃ
ভালো: এরা ভালো, কারণ এরা উপকার করতে না পারলেও ক্ষতি করে না, তবে চেষ্টা করে উপকার করার। এদের সংখ্যা খুবই কম।
ক্ষতিকর: এরা বুকে ছুরি চালায় না, মুখে মিষ্টি কথা বলে, নিজেকে অনেক আন্তরিক হিসেবে উপস্থাপন করে, আর সুযোগ বুঝে পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়। এদের সংখ্যা একটু বেশি। এরা আপনার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে। এদের সাথে খুব ফর্মাল আচরণ করুন। ওদের কোনও কথাতেই নিজেকে প্রভাবিত হতে দেবেন না।
ভালোও না, ক্ষতিকরও না: এরা গীবতও করে না, প্রশংসা করে না। এরা নিজেদের ধান্দায় ব্যস্ত থাকে, কারও পেছনে লাগে না। এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
কলিগরা সাধারণত বন্ধু হয় না। আবার দুর্ভাগ্যক্রমে, কিছু বন্ধু পাবেন, যারা কলিগ হয়ে যাবার পর বন্ধুত্বটা আর থাকেনি। এর ব্যতিক্রম আছে। আপনার জীবনে যত বেশি এমন ব্যতিক্রমকে জায়গা দিতে পারবেন, আপনি তত বেশি শান্তিতে চাকরি করতে পারবেন। আমরা জীবনের সবচাইতে বেশি সময় কাটাই কলিগদের সাথে। তাই তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারলে আমাদেরই স্বাচ্ছন্দ্য।


আপনি যাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন (অফিস সহকারী, বাইরের লোক, কানামনা, ফালতু, মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ইত্যাদি), ওরা নোটে যা লিখে দেয়, তাতেই স্বাক্ষর করে দেবেন না, ফাইল উপরে পাঠানোর আগে নিজে বারবার পড়ে দেখবেন। এদের সম্পর্কে চোখ-কান খোলা রাখুন। আপনার কোনও অফিসিয়াল পাসওয়ার্ড ওদের কোনওভাবেই জানতে দেবেন না। এরা অনেক সময় না বুঝে, অথবা ইচ্ছে করে উল্টাপাল্টা কাজ করে। দুনিয়ার সব প্রতারক আর দুষ্ট প্রকৃতির সেবাগ্রহীতারা মিলেও এইরকম একজন ক্ষতিকর প্রকৃতির লোকের মতো আপনার রেপুটেশন এতটা নষ্ট করতে পারবে না। মনে রাখবেন, এদের কিন্তু কোনও রিস্ক নেই, যত রিস্ক, সব আপনার। চাকরি করার অর্থই হলো আমি যেখানে স্বাক্ষর কছি, সেখানকার দায়দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া। পরবর্তীতে কখনওই বলা যাবে না, আমি এটা তখন খেয়াল করিনি, ভুলে স্বাক্ষর করেছি, ওরা আমার কাছ থেকে তাড়াহুড়া করে স্বাক্ষর নিয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফাইলে স্বাক্ষর না করে ফেলে রাখবেন না। ফাইল আপনার বাপের সম্পত্তি নয়। ফাইলে স্বাক্ষর দিতে ভয় করলে চাকরি ছেড়ে দিন, বাসায় বসে বসে কার্টুন দেখুন। আপনার সেবাগ্রহীতার কাজে দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে ওই চেয়ারে বসানো হয়নি। সিদ্ধান্ত দিতে শিখুন, দিতে না-পারলে ফাইলটা উপরে ফরওয়ার্ড করে দিন। ফাইল আটকে রাখাটা এক ধরনের অপরাধ। আপনার সিদ্ধান্ত ভুল হোক, ঠিক হোক, সিদ্ধান্তটা দিয়ে দিন। সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় আইনবিধি ও কর্তৃপক্ষের চাহিদার আলোকে দিতে হবে। আইন মানাই শেষকথা নয়, চাকরিটা ঠিকভাবে করতে পারাই শেষকথা।


বসের সামনে যাওয়ার সময় অবশ্যই নোটবুক আর কলম সাথে নিয়ে যাবেন। বস প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় যা-ই বলুন না কেন, খুব মনোযোগী শ্রোতা হয়ে (বসের দিকে একটু ঝুঁকে) শোনার ভান করুন এবং প্রয়োজনীয় (প্রয়োজনে অপ্রয়োজনীয়ও) নোট নিন। দরকার না হলে পরে তা ছুঁড়ে ফেলে দিন। বসের রুমে সেলফোনের রিংটোন অফ রাখবেন। কোনও কাজ করতে না পারলে এমনভাবে ‘না’ বলবেন না, যাতে সেটা খারাপ শোনায়। বসের রুমে ঢুকে হুট করে চেয়ারে বসে পড়বেন না, উনি বসতে বললে বসবেন। বস নিজ থেকে হাত না বাড়ালে হ্যান্ডশেক করার জন্য আপনার হাতটা বাড়ানোর দরকার নেই। বস যদি আপনার সাথে হাসিঠাট্টা করেন, তবে আপনিও বসের সাথে হাসিঠাট্টা করতে শুরু করে দেবেন না যেন! বস ফ্রেন্ডলি হতে পারেন, তবে উনি আপনার ফ্রেন্ড নন। বসের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করুন। নিজেকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে দেখিয়ে দিন। আপনাকে কোনও একটা কাজ করতে দিলে সেটি নিয়ে যদি আপনার বসকে আর কোনও টেনশন করতে না হয়, তবে স্বাভাবিকভাবেই বস আপনাকে পছন্দ করবেন। বস আপনার অন্য পাঁচ কলিগকে না ডেকে যদি আপনাকেই ডাকেন বিভিন্ন কাজে, তা হলে বুঝবেন, আপনার অফিসে আপনি আস্তে আস্তে ক্ষমতাধর হয়ে উঠছেন। ক্ষমতাধর হওয়ার অর্থই হলো নিজেকে সবচাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির সুনজরে ও কাছে রাখতে পারা।


বস কোনও কৌতুক বললে হাসি না পেলেও প্রাণখুলে (আই মিন, দাঁতখুলে) হাসুন। পুরনো বা কমন কোনও কৌতুক বললেও এমন ভাব দেখান যে জীবনে প্রথমবার কৌতুকটা শুনছেন। বসের সামনে গেলে বেকুব সেজে যান, উনাকে শেখানোর সুযোগ করে দিন, ভুলেও উনাকে শেখাতে যাবেন না। উনাকে এটা বোঝান যে আপনি উনার চাইতে কম জানেন, কম বোঝেন। মুখে যা-ই কিছু বলুক না কেন, মানুষ সবসময়ই তার নিজের চাইতে কম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বস হতে পছন্দ করে। সে কারণেই বোধহয় নিজের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান মেয়েদের ছেলেরা সাধারণত পছন্দ করে না। মেয়েদের ক্ষেত্রে হয় এর উল্টো। মেয়েরা তার নিজের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ছেলেদের সাধারণত বেশি পছন্দ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবারের কর্তৃত্ব বেশিরভাগ ছেলেদের হাতেই থাকে, সে দিক বিবেচনায় বলছি। যা-ই হোক, বসের রুচিবোধের তারিফ করুন, যদি উনার রুচি অতি জঘন্যও নয়, তাও। বস ফেসবুকে কিছু পোস্ট করলে লাইক বা অন্য প্রাসঙ্গিক রিঅ্যাক্ট দিন, পড়ে হোক না পড়ে হোক, ‘ওয়াও’, ‘দারুণ’, ‘অসাধারণ’, ‘অভিনন্দন’, ‘অনেক সুন্দর লাগছে’, ‘ফেসবুকে আমার দেখা সেরা ছবি’, ‘সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেলাম’, ‘স্যার, আপনি সামনের বইমেলায় একটা বই বের করুন’ জাতীয় কথাবার্তা লিখুন। উনার পরিবারের সদস্যদের ছবি পোস্ট করলে এমন সব কমেন্ট করুন, যাতে উনার মনে হয়, এ পৃথিবীতে উনার পরিবারের সদস্যদের চাইতে সুন্দর কিছু কখনও পয়দা হয়নি। হয়তোবা আপনার কমেন্টে আপনার বস লাইক বা কোনও রিঅ্যাক্ট দেবেন না, তার মানে কিন্তু এ নয় যে উনি আপনার কমেন্ট বা রিঅ্যাক্ট ব্যস্ততার কারণে খেয়াল করেননি। বসরা সবই দেখেন, দেখে চুপ করে থাকেন, যাতে আপনার মনে হয়, উনি এতটাই ব্যস্ত যে আপনার কমেন্ট দেখার সময় পাননি কিংবা জগতের সকল প্রশংসার ব্যাপারে উনি নিঃস্পৃহ। বিশ্বাস না হলে, ‘আমার মেয়ে পিএসসি পরীক্ষায় এপ্লাস পেল’ জাতীয় পোস্টে একপিস হাহা বা কান্নার রিঅ্যাক্ট দিয়েই দেখুন না কী হয়! যে বসের ফেসবুক পোস্টে তাঁর অধস্তনরা লাইক দেয় না, কমেন্ট করে না, তাঁর বেঁচে থেকেই-বা লাভ কী! আমার চাকরিজীবনে বসের পোস্টে লাইক-কমেন্ট না দেওয়ার অপরাধেও আমাকে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।


সকল কৃতিত্ব বসকে দিয়ে দিন। আপনি নিজেও কিন্তু আপনার অধস্তনদের কৃতিত্ব নিজের বলে শুনতে পছন্দ করেন। নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো, সত্যিই করেন না? আপনাকে আপনার বস ভালোভাবে ম্যানেজ না করলে আপনি ওটা করতেন কীভাবে? বসকে কৃতিত্ব দিতে জানাটাও কিন্তু একটা আর্ট। নিজের কৃতিত্ব জাহির করার কাজটা তো একটা গাধাও করতে পারে। কেউই, তার অধস্তন তার চাইতে বেশি উজ্জ্বল, এটা ভাবতে পছন্দ করে না। প্রকাশ্যে (সম্ভব হলে বসের সামনেই) মুখে বলুন, আমি আমার বসের নির্দেশনায়/ বসের সহযোগিতায়/ বসের পরামর্শে অমুক কাজটা করেছি। বস যদি ওটা সম্পর্কে আগে থেকে নাও জেনে থাকেন, তাও ওরকম প্রশংসা শুনলে উনি খুশি হবেন। ভালো কোনও কাজের কৃতিত্ব তাঁকে দেওয়া হলো, যা সম্পর্কে তিনি জানতেনই না, তাই তিনি বলে উঠলেন…এটা তো তোমার কৃতিত্ব, তুমিই এটা করেছ, আমার কোনও ভূমিকা নেই এখানে, ইত্যাদি ইত্যাদি…এমন সৎ ও সরল স্বীকারোক্তি দিতে কাউকেই আমি এখনও পর্যন্ত দেখিনি। বসকে আপনার চাইতে অনেক বেশি যোগ্য ও ক্ষমতাধর প্রমাণ করলে এর সুফল আপনি ভোগ করতে পারবেন খুব প্রত্যক্ষভাবেই। আপনি সিংহ হতে পারেন, কিন্তু আপনার বস যদি ভাবেন, আপনি একটা ছাগল, তা হলে দিনের শেষে আপনি একটা ছাগলই! কিচ্ছু করার নাই! সবচাইতে উজ্জ্বল ও সফল কর্মী তিনিই, যিনি অফিসের বসের সবচাইতে কাছের কেউ। এইসব শুনে আপনার রাগ হতে পারে, কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সত্যিই কিচ্ছু করার নেই।


বস কী বলছেন, সেটা বোঝার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ, বস কী বলছেন না, কিন্তু বোঝাতে চাইছেন, সেটা বোঝা। অনেক কথা থাকে, যা আমরা মুখে বলতে বিব্রতবোধ করি কিন্তু মনে মনে চাই, কেউ আমার কথাটা বুঝে নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করুক। যদি ওরকম কাউকে পেয়ে যাই, তবে তাকে নিজের বিশ্বস্ত মানুষ বানিয়ে ফেলি। বসের মন পড়ার চেষ্টা করুন, যদি সে-কাজে সফল হন, এর সুফল অবশ্যই পাবেন। জীবনে কত যুদ্ধ করে প্রেমিকার মন পড়েছেন, অথচ তার বিনিময়ে কী পেয়েছেন, বলুন…এক ব্রেকআপ ছাড়া? তার চাইতে ভালো…বসকে বুঝুন, বস আপনাকে খালিহাতে ফেরাবেন না। সবাই কিন্তু ভাত খায় না, কেউকেউ রুটিও খায়। সব বসই কিন্তু কাজ খায় না, কেউকেউ কথাও খায়, আবার কেউকেউ অন্য কিছুও খায়। বোঝার চেষ্টা করুন, কে কী খেতে পছন্দ করে। বিভিন্ন ব্যাপারে বসের সাথে তর্ক কম করবেন। যদি আপনার ভিন্নমত থাকে, তবে কৌশলে সে কাজটি এড়িয়ে যান বা সে কাজে ভুলটুল করুন। ওতে কাজটি আপনাআপনিই অন্য কারও কাঁধে চলে যাবে। সক্ষমতা থাকলেই তা সবসময় দেখাতে হবে, এমন নয়। সে-ই সবচাইতে সক্ষম ব্যক্তি, যে জানে কখন কোথায় তার সক্ষমতা লুকিয়ে রাখতে হয়। আমরা যখন কাউকে তার কথার বিপরীতে কিছু বলি, তখন তার মন আমাদের প্রতিপক্ষ বা দূরের কেউ ভেবে নেয়। বসের সাথে তর্ক করে কাজটা না-করলে আপনার দোষ হয় দুইটা, আর তর্ক না করে কাজটা করতে ব্যর্থ হলে আপনার দোষ হয় একটা। এমনকি, যদি বসকে বুঝিয়ে দিতে পারেন যে অনেক আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও আপনি কাজটা করতে পারেননি, তবে বসের মনে গেঁথে যাবে যে আসলে আপনার কোনও দোষ নেই, আপনি আপনার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ, বসের সাথে তর্কে না গিয়ে কৌশলে কাজটি এড়িয়ে গেলেও আপনি বসের ক্রোধের শিকার অতটা হবেন না।