চাকরি-রঙ্গ

(অনেক ভারিক্কি কথা হল। ৩-৬-১২ তারিখ চাকরিতে জয়েন করি। চাকরির কিছু মজার ঘটনা এ লেখায় শেয়ার করছি।)

এক।

: না ভাই, তুমি যা-ই বলো ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিমই বেস্ট; মানিক নয়।

: স্যার, এটা মানতে পারলাম না। উপন্যাসের প্লট, উপস্থাপনা, ভাষার গাঁথুনি, ডিকশন সবকিছু মিলিয়ে মানিকই বাংলা সাহিত্যের সেরা ঔপন্যাসিক।

এভাবে অনেক তর্কবিতর্কের পর স্যার অবশেষে নিতান্ত অনিচ্ছায় আর যুক্তিতর্কে না গিয়ে মানিকই সেরা এটা মুখে না বলে সম্মতিসূচকভাবে চুপ করে রইলেন। (পদমর্যাদায় উনি অনেক সিনিয়র। স্যারের অভিব্যক্তিতে বুঝলাম, বঙ্কিমকে যথেষ্ঠ যুক্তি দিয়েও শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে না পারানোর কারণে আমার উপর উনার বিরক্তি আর রাগের শেষ নেই। রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময়ও উনি আমাকে পেছন ফিরে আরও ভাল করে বঙ্কিম পড়ার পরামর্শ দিলেন।)

ওখানে বসেছিলেন পদমর্যাদায় স্যারের একটু নিচে কিন্তু আমার অনেক উপরে আরেক সিনিয়র যিনি আমাকে বিশেষভাবে স্নেহ করেন। এতক্ষণ উনি একবার ঘাড় ঘুরাচ্ছিলেন স্যারের দিকে, আরেকবার আমার দিকে, আর একটু পরপর হাই তুলছিলেন। সাহিত্য বিষয়ে উনার কণামাত্রও অনুরাগ নাই। বঙ্কিম অনুরাগী স্যার রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর উনি খুব গম্ভীর স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বঙ্কিম মানিকের চাইতে ভাল উপন্যাস লিখলে তোমার কোনও ব্যক্তিগত সমস্যা আছে?” আমি সাথে-সাথেই উত্তর দিলাম, “নাই স্যার, কিন্তু বিশ্বাস করেন, উনি মানিকের চাইতে ভাল লিখেন নাই। আমি যা বলসি, ভুল বলি নাই, স্যার। আমি তো যুক্তি দিয়ে………” আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, “চুপ একদম! সমস্যা আছে কি না সেটা বল! বঙ্কিমও মইরা ভূত হইসে, মানিকও মইরা ভূত হইসে, আর মিয়া তুমি আইসো প্যাঁচ লাগাইতে! অসুবিধা কী বঙ্কিম ভাল লিখলে? সুশান্ত, তুমি নতুন চাকরিতে আসছ, এখনও কিসু বুঝো না টুঝো না। খামাকা স্যারের সাথে তর্ক করলা কেনো? উনি কিন্তু মাইন্ড করসেন। এই কাজটা তুমি ঠিক কর নাই।”

: স্যার আপনার কথা ঠিক। কিন্তু, মানিক বঙ্কিম থেকে অনেক বেশি ভাল লিখসেন, এইখানে আমার কী দোষ? আপনি যদি একটু পড়ে দেখেন……

: আরে ধুউর! আমি বইটই পড়ি না তুমি জানো, আর তাই আমারে যা ইচ্ছা তা-ই ভুংভাং বলতেসো। শুন, তোমারে তো মেরিটোরিয়াস ভাবসিলাম, এখন তো দেখতেসি তুমি একটা বলদ, দুনিয়াদারির কিসুই বুঝো না। জুনিয়র পোলাপান, মাথায় কোনও বুদ্ধি নাই। শুন, আমি যখন এসি (অ্যাসিসটেন্ট কমিশনার) ছিলাম, তখন আমার কমিশনারের সাথে টেনিস খেলতাম। উনি টেনিস খুব একটা ভাল খেলতে পারতেন না, কিন্তু উনার বিশ্বাস, উনি অনেক ভাল খেলেন। আমি জীবনেও উনাকে আমার সাথে কোনও খেলায় হারতে দিই নাই। উনারে দেখলে বুঝতা উনি যে কী জিনিস! উনি এত বাজে টেনিস খেলতেন যে উনার সাথে হারা আসলেই ব্যাপক কঠিন ছিল। অথচ, সে কঠিন কাজটাই আমি দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে করে গেসি। তুমি কী মনে কর? আমার কি কষ্ট হয় নাই উনার সাথে হারতে? উনি আর কারও সাথে খেলায় পারতেন না বলে আমার সাথেই খেলতেন সবসময়। আমার কোনও ব্যাচমেটকে উনি আমার চাইতে বেশি পছন্দ করতেন না, কারণ ওরা ছিল তোমার মতো বলদ, স্যাররে সহজেই হারাইয়া দিত। স্যার আমার সম্পর্কে সবাইরে বুক ফুলাইয়া বলত, “এই যে দেখতেসো, এই ছেলেটা, খুব ভাল ছেলে, তবে টেনিসটা একটু কম পারে। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওকে টেনিস খেলা শিখাই। হি ইজ অ্যা ভেরি গুড অফিসার।” অসুবিধা কী? আমার পোস্টিং সবসময়ই ভাল ছিল, আমারে এসিআর’ও ভাল দিসে। বস পদাধিকার বলে সবসময়েই তোমার চাইতে বেটার। বুঝসো কিসু? নতুন আসছো, বুঝেশুনে চলবা, ঠিকাসে?

(অতঃপর আমি পুরাই মাননীয় স্পিকার হয়া গ্যালাম।)

দুই।

ম্যাঁঅ্যাঁঅ্যাওওও . . . . . !!! মানে, তুমি কে? এখানে কী চাও? . . . . . . আরো কিছু দূরে তিনটা বেড়াল গ্যাংস্টার স্টাইলে পায়চারি করছে। ওরা এই বেড়ালটার চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড। ওরাও চোখমুখ কুঁচকে গোঁফ ফুলিয়ে আদুরে অভিমানী গলায় বললো, মিঁয়াঁয়াওওওওও . . . . . !!! মানে, ঝামেলা করার ইচ্ছে থাকলে সে ইচ্ছে ভালয়-ভালয় এক্ষুনি বাদ দাও। এই এয়ারপোর্ট আমাদের। আমরা ঠিক করেছি, এই এয়ারপোর্টে আমরা আর কাউকে পাত্তা দেবো না। পারলে, আজকের ৬ কোটি রুপি থেকে কিছু টাকা বিড়াল কল্যাণ তহবিলে ডোনেট কর। নয়তো, ভাগো! হুমমম্ . . . . . !!!

এই বেড়ালগুলো ঠিক বেড়ালের মতো!!

আমি আর কথা বাড়ালাম না। সটকে পড়লাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, বেড়াল একটা ফাজিল প্রাণী। ওর সব কথার রিপ্লাই দিতে হয় না। (রবীন্দ্রনাথ না বললে অন্য কেউ বলেছেন। অন্য কেউ না বললে, রবি বাবু-ই বলেছেন। আর কেউই না বললে আমার কী দোষ?) ১৫-২০ জন অফিসার বসে-বসে আজকের আটককৃত কাগুজে মুদ্রার নাম্বার নোট করছেন। আইনানুযায়ী এটা করতে হয়। প্রায় ১ লক্ষ নোটের নাম্বার লিখতে হচ্ছে। বিশাল ক্লান্তিকর বিরক্তিকর কর্মযজ্ঞ। আমার কাজ পুরো টিমটার কাজ মনিটর করা। যাঁরা আজকে এখানে আছেন, উনারা সারাদিন অফিস করেছেন। সারারাত না ঘুমিয়ে এই কাজ করা সহজ নয়। আমি এয়ারপোর্টে হাঁটছি, খাচ্ছি, যতটুকু সম্ভব সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, কোটি টাকার সামনে বসে থাকার সুখের দামও কোটি টাকা। ভাবুন, আপনারা এখন সবাই কোটিপতি। ইশমাইল পিলিজ! (গরররর্ . . . . . . .) সমস্যা হল, এই কোটি টাকা জাল টাকা। ৬ কোটি জাল টাকার সামনে বসে থাকার চাইতে ৬ টাকার বাদামের ঠোঙার সামনে বসে থাকা অধিক আনন্দের। কিন্তু সেটা কেউ আমার মুখের উপর বলে দিতে পারছে না।

এয়ারপোর্টের ঘুম নেই। আমাদেরও। ঘুমহীন রাতে চেনা সবকিছুই অন্য রকম হয়ে যায়। শেষ ঘুমিয়েছি গতকাল রাত ২টায়। সারাদিন ছোটাছুটি। রাতেও তা-ই। শরীর ভেঙে আসে। ঘোরলাগা রাতে আশেপাশের ঘুম-নেই মানুষের ঘুম-ঘুম চোখে রাত কাটানো। কোটি-কোটি টাকার সাথে আমাদের রাত্রিযাপন। হোক জাল, টাকা তো! সামনে বিরক্তিকর টাকার পাহাড়। নকল মুদ্রা, অর্থহীন অর্থ। এয়ারপোর্টের আরেক দিকে একেকটা ফ্লাইট নামে, ঘুমিয়ে-পড়া মেঝের টাইলসগুলো কিছু সময়ের জন্য আবার জেগে ওঠে। এয়ারপোর্টের ঘুমই জেগে ওঠার প্রতীক্ষামাত্র। আবার চুপচাপ। শুধু বেড়ালগুলো কাউকে তোয়াক্কা না করে দাপিয়ে বেড়ায়—ঘুমকেও না, আমাদেরকেও না, এয়ারপোর্টকেও না! আমার সারাদিনের ক্লান্তি আমাকে বেড়ালের ভাষাও বুঝতে শেখালো। মিঁউঁউউউউউউ. . . . . !!! এর মানে, আজ চাকর বলে………

ফিলিং . . . . . . সারারাত এয়ারপোর্টে ঘুরতে-ঘুরতে ছিলিম হয়া গ্যালাম।

তিন।

গতকাল একটা মিটিং ছিল। আমাদের ডিপার্টমেন্ট প্রতি বছরই বাজেট পরবর্তী একটা ভোজসভার আয়োজন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অনুষ্ঠানে এসে আমাদেরকে সম্মানিত করেন। এবারের সভাটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে, আজকে; সন্ধ্যায়।

: সুশান্ত, তোমাকে দেখলে সিরিয়াস মনে হয় না। চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, ঘুমাচ্ছো অথবা ঘুম থেকে উঠসো। এই চোখে খালি প্রেম ছাড়া আর কিসু হয় না। তুমি বোধ হয় কালকে একটা গুবলেট পাকায়ে ফেলবা।

: স্যার, আমি কী করবো? আমার চোখগুলাই ঘুম-ঘুম টাইপের। বাট স্যার, সত্যি বলতেসি, আমি জেগে আছি। আর আপনার কথা ঠিক, আমাকে দেখলে সিরিয়াস-সিরিয়াস লাগে না।

: না স্যার, সুশান্তকে দেখলে হয়তো ওরকম মনে হয়, কিন্তু ও সিনসিয়ার ছেলে। কোনও ঝামেলা পাকাবে না। (আরেক সিনিয়র কর্মকর্তা আমাকে সেভ করলেন।)

: তাই নাকি? গুড, গুড! কিন্তু চেহারায় একটা সিরিয়াস ভাব ফুটায়ে তোলারও দরকার আছে। সুশান্ত, বুঝসো?

: জ্বি স্যার। (আমার চেহারায় সিরিয়াস ভাবটা আসে না, হাসি পেয়ে যায়। আমার নীতি, Don’t be serious, be sincere. আমি মজা করতে ভালোবাসি, হাসতে ভালোবাসি। আবার দেখলেই যেকোনও কিছু ফস্ করে বলে ফেলা যায়, এরকম লুকটাও আমার চেহারায় নেই। দেখলেই প্রেম-প্রেম ভাব জাগ্রত হয়, সেরকম কুল লুকও নাই; বেকুব-বেকুব টাইপের একটা ফর্মাল লুক আছে চেহারায়। When I try to look serious or seriously humorous, I look just humorously serious in both cases. Patehtic!)

: আচ্ছা সুশান্ত, এই নাম্বারে একটা ফোন কর। উনার নাম কামাল; বাঁশের সাপ্লাইয়ার। উনি আমাদের প্রোগ্রামের জন্য আজকে দুপুরের আগেই বাঁশ পৌঁছে দেয়ার কথা। এখনও দেয় নাই। ফোন করে খবর নাও।

: ওকে স্যার। (ফোন দিলাম।) ……. হ্যালো, আসসালামুয়ালাইকুম। কামাল সাহেব বলছেন? ……. আমি বাংলাদেশ কাস্টমস থেকে বলছি। আচ্ছা ভাই, আপনার তো আজকে আমাদের বাঁশ দেয়ার কথা ছিল। এখনও দিলেন নাতো! কখন দিবেন? দ্রুত দেয়ার ব্যবস্থা করেন। আপনি আমাদের বাঁশ না দিলে তো আমরা প্রবলেমে পড়ে যাবো। বিকেলের মধ্যে বাঁশ দেন। ঠিক আছে? ওকে থ্যাঙ্কয়্যু।

(হাসির রোল পড়লো। আমি বিস্ময়ে ভাবতে লাগলাম, আঁই কিচ্চি!!)

: সুশান্ত, ও আজকের মধ্যে বাঁশ দিবে তো? (স্যার হাসতে-হাসতে জিজ্ঞেস করলেন।)

: জ্বি স্যার, টেনশন করবেন না, আমি যোগাযোগ রাখবো।

: গুড! এইতো লাইনে আসছো। কালকের কাজটা সহজ, কিন্তু ভেরি সেনসিটিভ। তোমার কর্মীবাহিনীকে সবদিকে ঠিকমতো ম্যানেজ করবা।

: আই হাম্বলি ডিসঅ্যাগ্রি স্যার, কালকের কাজটা আসলে কঠিন, কঠিন কাজ কঠিনই হয় স্যার, কঠিন কাজকে সহজ বললেই সহজ হয়ে যায় না। আমাদের কাজ অনুষ্ঠানে খাবারের প্যাকেটগুলো সংগ্রহ ও বিতরণ করা। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আসবেন স্যার, উনাদের ড্রাইভার মহোদয়রা (!) প্যাকেট সংগ্রহ করবে। (মহোদয় বলার কারণ, বড়ো-বড়ো স্যারদের সিপাহি, পিওন, ড্রাইভারদেরও ভাব সেই রকম!) এই জাতীয় অনুষ্ঠানে সবাই অন্তত এক সপ্তাহ রোজা রেখে আসে স্যার, অত্যন্ত ক্ষুধার্ত থাকে, তাই খাবারের প্যাকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। বড়ই হৃদয়বিদারক দৃশ্য, স্যার। বাট আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট!

: হাহাহা …. ঠিকই বলসো, সাবধানে কাজ করবা। যাদের কাছে টোকেন আছে, সবাই যেন খাবার পায়। কেউই যেন বাদ না যায়। যদি ন্যাংটা ভিক্ষুক এসেও টোকেন দেখায়, হাসিমুখে খাবার দিবা। প্রম্পটলি কাজ করতে হবে। বুঝসো?

: বুঝসি স্যার, কিন্তু আমার একটা ছোটো আপত্তি ছিল।

: কী যন্ত্রণা! আবার কী?

: আমার নামটা লিস্টে ঠিকভাবে আসে নাই। নাম লেখা আছে, সুশান্ত কুমার পাল। কিন্তু স্যার, আমি তো সুশান্ত পাল।

: ভাই, তোমার পিলিজ লাগে, এইবার থামো, আর পেইন দিয়ো না। তুমি তো এখনও বিয়া কর নাই, একটু কৌমার্য থাকুক না, অসুবিধা কী? আর শোন, এসব কৌমার্য-টৌমার্য নিয়ে মাথা কম ঘামানোই ভাল। হেহেহেহে ………

(আবার হাসির রোল। স্যারের সেন্স অব হিউমারে আমি তো রীতিমতো থ! কে বলে অল দ্য সিভিল সার্ভেন্টস আর রাম গরুড়ের ছানাস!)

চার।

একটু আগে জেন্টস্ টয়লেট থেকে যাকে বের হতে দেখলাম, তাকে ঠিক পুরুষ মনে হলো না। কিয়্যুরিয়াস হয়ে কাছে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ঠিক টয়লেট থেকে (হয়তো) ঠিক কাজটি সেরে বেঠিক অবয়বে ঠিক মানুষটিই বেরিয়েছেন। দীর্ঘকেশা যুবক। আহা! ওর সিল্কি-সিল্কি মিষ্টি কেশ যেকোনো রমণীর বুকেও ঝড় তুলবে—ঈর্ষার।

এই এয়ারপোর্টে কাজ করতে গিয়ে আমার যে মস্তো সুবিধে হয়েছে, তা হলো এই, পৃথিবীর তাবত্ চিড়িয়াখানার যাবতীয় মজা এখানে একসাথে পাওয়া হয়ে যায়। সাথে কিছু বোনাসও। বিনা উপলক্ষে অবাক হওয়ার বোনাস। এই চিড়িয়ারা বড্ডো বেশি আনপ্রেড্কিটিবল। এখানে পোস্টিং পাওয়ার পর থেকেই চিড়িয়া হিসেবে অনেক বছর ধরে জমা হওয়া আত্মবিশ্বাস প্রতিদিনই কমছে। একটু-একটু করে। দেশে-ফেরা লোকজনের অনেকেই আমাদেরকে বড্ডো বেশি আপন ভেবে ‘তুমি’ ‘তুমি’ সম্বোধন করেন। গায়ে পড়ে আপন করতে চাওয়া পাবলিক খুব একটা সুবিধার হয় না সাধারণত। অপরিচিত লোক ইনফরমাল হবে প্রথম পরিচয়েই, এটা মানতে আমার বরাবরই আপত্তি। কিছু-কিছু কাজে জেন্টলম্যান অ্যাটিটিউড্ কাজটিকে অনেক সহজ করে দেয়। পরে দেখলাম, দে রিয়েলি ডোন্ট মিন অ্যানিথিং হোয়াইল ডুয়িং সো। আপনি থেকে তুমিতে আসার সাধারণ ব্যাপারটাতে চাটগাঁয়ের লোক উল্টোরথে চলে। খুবই আন্তরিকতার সাথে দুর্বোধ্য আঞ্চলিক টানে গালিকথা কিংবা কথাগালি’তে কথার সুরই যেনো কোথায় হারিয়ে যায়। ওরা খুব ইমোশনালও। ‘ওরা’ ‘ওরা’ বলাটা আসলে ঠিক হচ্ছে না। আমি নিজেও ওদেরই দলভুক্ত দলছুট মানুষ। (আমি খুশি, নোয়াখালি আর সিলেট-এর লোকজন দয়া করে চিটাগাং এয়ারপোর্ট দিয়ে খুব একটা নামে না। ভাবনার আবর্ত বিবেচনায় ওরাও একই গোত্রীয়।) ওরা বলে, এতো রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করে কেনো চোরের মতো দেশে ঢুকতে হবে? কীসের চেকিং-ফেকিং? কীসের কাস্টমস? স্বার্থের প্রয়োজনে সবাই দেশকে রেপ করতে পছন্দ করে। এবং করে। এটা অনেক রিস্ক-ফ্রি। ইমোশন মিশিয়ে কৌশলে এটা করতে পারলে শাস্তি তো হয়ই না, বাড়তি পুরস্কারও জুটে যেতে পারে।

সেই এলোকেশী (থুক্কু, কেশা) ‘লাভলি ম্যান’কে পেছন থেকে দেখে যে কনফিউসড্ আকর্ষণে ছুটে গিয়েছিলাম, তার দোষ আমার পারফেক্টলি ব্যাচেলর হৃদয়ের আর কবিদের। ছেলেদের ঘনকালো লম্বা চুল নিয়েও অন্তত দু’একটা কবিতা লেখা হোক। (জীবনানন্দ, আবার ফিরে আসো, তোমার পিলিজ লাগে। বনলতার যুগ শেষ। বনমানুষ এসে গেছে। ওদের কবিতাও চাই।) মহিলা কবিরা ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখবেন কি? কবিদের সুবিধের কথা ভেবে ‘লাভলি ম্যান’রা চুলের দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে আর একটু উদার হতে পারেন। এখন সময় এসেছে ‘দীঘল’ শব্দটাকে জেন্ডার ইক্যুয়িটির আওতায় নিয়ে আসার। ‘হ্যান্ডসাম ওমেন’দের ড্রেসে যে দৈন্যের যে ছাপ দেখতে পাই, চুলেও সেটার ছাপ দেখি না কেনো পুরোপুরি? আর একটু ছোট করে চুল রাখলেই তো আপনাদেরকে ‘লাভলি ম্যান’দের থেকে আলাদা করা যেতো সহজেই।

পাঁচ।

আমরা যারা সরকারি চাকরি করি, তারা সবসময় সবাইকে খুশি করতে পারি না। সরকারি চাকরি মানেই মাঝেমধ্যে অখুশি করার চাকরি। তবে আমরা যেটা করতে পারি, সেটা হলো, কেনো উনাকে খুশি করতে পারছি না সেটা হাসিমুখে বুঝিয়ে বলা। সুন্দর ব্যবহার করে এক কাপ রঙ চা খাওয়ালে, হাসিমুখে ‘না’ বললেও লোকজন মাইন্ড কম করে, অ্যাট লিস্ট পারসনালি নেয় না। এক সিনিয়র স্যারকে দেখেছি, উনি খুব হাসিমুখে মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে ঠিকভাবে আদরআপ্যায়ন করে কোটি-কোটি টাকার অবৈধ মালামাল বাজেয়াপ্ত করে দিতেন। ফাইলে শেষ সিগনেচার করার আগে সিপাহিকে (ওরা আমাদের ফরমায়েশ খাটে) ডেকে বলতেন, এই বেকুব! চা দিসো, বিস্কিট দাও নাই কেনো? ভালো বিস্কিট নিয়ে আসো, যাও! তারপর ভাই, আপনার বাড়ি তো বিক্রমপুর, না? ওখানকার লোকজন খুব ভদ্র হয়। আমার এক ফ্রেন্ড আছে, খুব ভাল স্টুডেন্ট ছিল, এখন বুয়েটে পড়ায়। ও ছিল ক্লাসে ফার্স্ট। আমিও ছিলাম ফার্স্ট, তবে পিছনের দিক থেকে। তাই এই চাকরিতে! বোঝেনই তো! হেহেহে…… ওর বাড়ি আপনাদের ওখানেই। চিনেন নাকি? ওর নাম ………

উনি আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর চেহারার কঠিন মনের মানুষ। সুন্দর চেহারার মানুষ কঠিন মনের হলে মেনে নিতে কষ্ট হয়, মানে, মেনে নিতে ইচ্ছে করে না। তার উপর স্যারের কথা বলার ধরন অসাধারণ! অসম্ভব মিহি সুরে মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে বাঁশপ্রদান করতেন। স্যারের সাথে কাজ করার সময় স্যার বকা না দিলে মনে-মনে টেনশন শুরু হতো। ইচ্ছে করতো স্যারকে বলেই ফেলি, স্যার, কখন বকা দিবেন? আজকের ভুলগুলা ঠিকভাবে করতে পারি নাই? ওয়েট করতে-করতে অস্থির হয়ে গেলাম! বকতে টায়ার্ড লাগলে প্রয়োজনে ধইরা মাইর দ্যান, স্যার! নো প্রবলেম! আমি হাসিমুখে মাইর খাইতে প্রস্তুত! কিছু একটা করেন, স্যার! …….. কখনও-কখনও বকা খাওয়ার চাইতে বকা না খাওয়াটা অধিক প্যারাদায়ক!

সরকারি চাকরি করার সুবাদে, গত ১০ বছরের মধ্যে কখনওই যোগাযোগ করেনি, এমন ফ্রেন্ডও আমাকে হঠাৎ ‘মিস’ করা শুরু করে। তখন মনে হতে থাকে, পৃথিবী বড়ই সুন্দর। কোনও বন্ধুই হারিয়ে যায় না। আহা, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে-পাতালে-চাতালে! গভীর জীবনদর্শনে ধর্ষিত (পড়ুন, দর্শিত) জ্ঞানী পাব্লিকও এয়ারপোর্ট দিয়ে ট্যাক্স না দিয়ে বা কম দিয়ে টিভি আনতে চায়। এরাই একদিন বলে বেড়াতো, সুশান্ত কাস্টমস ফার্স্ট চয়েস দিলো কেনো? আমরা কি বুঝি না? অন্যের গীবত করার নেশা বড়ো নেশা। আমি সবসময়ই ওদের জন্য যেটা চেষ্টা করি, সেটা হল, যাতে কাজটা করতে গিয়ে ওদের অহেতুক ঝামেলায় পড়তে না হয়, সেটা নিশ্চিত করার।

বন্ধুদের বলছি, সরকারি অফিসে যারা কাজে আসেন, তারা অনেক আইনবিধিই জানেন। সাথে, আরো ২টা ব্যাপার জেনে নেবেন। এক। কাজটা কার? এর কাছে ওর কাছে ধর্না না দিয়ে ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে ঠিক কায়দায় নক করতে পারলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। এতে অনেক ভোগান্তি থেকে বেঁচে যাবেন। আমাদের এখানে অনেক নিচের লেভেলের লোকজন অনেক সময়ই আমাদের নাম ভাঙিয়ে অযথা হয়রানি করে, যার কিছুই হয়তো আমরা জানতেই পারি না। সত্যিই অতো খবর রাখা সম্ভব হয় না। দুই। আপনার প্রাপ্য সেবা কী কী? প্রয়োজনে ওয়েবসাইট থেকে সিটিজেন চার্টার দেখে নিন। এটা জানলে যে সেবা পাওয়াটা আপনার অধিকার, সেটা পাওয়ার পর সেটাকে সুযোগ মনে হবে না। আর, আপনি আইন অনুযায়ী পাবেন না, এরকম সেবা চেয়ে বিব্রত হবেনও না, করবেনও না। সরকারি কর্মকর্তাদের ইচ্ছামতো গালিগালাজ করা বড়োই সুখের, কিন্তু শান্তির না। মনের দুঃখে ইচ্ছামতো গালাগালি করে আপন সুখে অজানায় ভেসে যাওয়ায় কী লাভ?

ওপরের ২টা ব্যাপার জেনে নিলে সাথে বোনাস হিসেবে শান্তিও ফ্রি পাবেন। আমি দেখেছি, আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, এরকম সেবা দেয়ার পরও লোকজন ভাবে, অনেক বড় উপকার করে ফেললাম। যে সম্মান আমার প্রাপ্য না, সেটা কেউ দিলে আমি প্রচণ্ডভাবে বিব্রতবোধ করি। আমার যা দায়িত্ব, তার শতকরা ৬০ ভাগ পালন করলেও লোকে খুশিতে বাকবাকুম করতে থাকে। মনে করে, আমি বুঝি উনার জন্য অনেক কিছু করে ফেললাম! অথচ, সে সেবাটা উনার প্রাপ্য।

একটা ছোটো ঘটনা দিয়ে শেষ করছি। আমি তখন ইপিজেড কাস্টমসে অ্যাসেসমেন্টের দায়িত্বে। আমার জীবনের প্রথম চাকরি, প্রথম পোস্টিং। আমাদের কিছু স্টেকহোল্ডারের প্রয়োজনীয় কিছু আমদানি কাস্টমস দলিল ছিল না, তাই ওদের বেশ কয়েকটি কনসাইনমেন্ট পোর্টে আটকে যায়; সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছুর দলিল জালও ছিল। ওদের দাবি, ওরা যেভাবে চাইছে সেভাবে করে ওদের কাজ করে দেয়া হোক। ওরা এতো আইনবিধি মানবে না, মানা যাবে না। আমি বলছি, বিধিমোতাবেক কাজ করতে হবে। আমার অথরিটিও সেটাই চাইছেন। আমি তো আর আমার অথরিটির ইচ্ছের বাইরে যেতে পারি না। তাছাড়া, ওদের দাবিটাও অযৌক্তিক আর বেআইনি। কিন্তু ওরা আমাদের কোনও কথাই শুনবে না। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত ওদের সব রাগক্ষোভ এসে পড়ে যিনি স্টেশনের দায়িত্বে থাকেন, তার উপরে। ওদের একটাই কথা—ব্যাটাকে ধরো, মারো, কাটো। শাস্তি দাও! …….. আমার অফিসের বাইরে মিছিল শুরু হলো। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল, যেকোনও মিছিলে দাবি আদায়ের চেয়ে মিছিল করার সুখ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিৎকারেই সকল সুখ নিহিত। কী উৎসাহ! কী তেজ! বড়োই লোভনীয় সে দৃশ্য! একবার মনে হলো, যাই, ওদের সাথে যোগ দেই। কী আছে আর জীবনে! পরে মনে হলো, ওদের সাথে যোগ দিলে একটা টেকনিক্যাল সমস্যা আছে। গালিটা দিবো কাকে? …….. থাক আজকে নাহয় মিছিল এনজয় করি, পার্টিসিপেশন আরেকদিন হবে!

“এসি সাহেবের চামড়া, তুলে নেবো আমরা!” (ওরা অন্যসময় এসি স্যার বলে, কিন্তু রেগে গেলে এসি সাহেব বলে। আরো রেগে গেলে সরাসরি নাম ধরে ডাকে। রাগ চরমে উঠলে কী বলে, সেটা বলা যাবে না। সেইবার ওদের রাগ একটু কম ছিল বোধ হয়। অথবা এমনও হতে পারে, আমার নামটা মিছিলের শব্দ হিসেবে ব্যবহারের অনুপযোগী; উচ্চারণ করলে ভালো শোনায় না, ঠিকমতো জোশও আসে না।)

“এসি সাহেবের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও, দিতে হবে।”

আমার অথরিটির নির্দেশে ওদের সভাপতি সাহেবের সাথে আমার রুমে মিটিংয়ে বসলাম। আমার পরম সৌভাগ্য, সভাপতি সাহেব ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ভদ্র স্বভাবের মানুষ। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হলো। সভাপতি সাহেবের সাথে আরো গণ্যমান্যজঘন্য ব্যক্তিবর্গও এসেছেন। সবার সাথে হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করে বসতে বললাম। মিটিং শুরু হলো। অনেক কথা হলো। এসব দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষ হয় কিছুটা উইন-উইন সিচুয়েশনের মধ্য দিয়ে। বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদিনী থিওরি এসব ক্ষেত্রে খাটে না। মিটিংয়ের ২-১টা কথা শেয়ার করি।

: ভাই, আপনারা চাইছেন, আমার চামড়া তুলে নেবেন। ব্যাপারটাকে একটু সহজ করা যায় না? এই যেমন ধরেন, ঘুমের ওষুধ কিংবা ইনজেকশন টাইপের কিছু? আমার ধারণা, চামড়া তুলে নিলে আমি বেশি ব্যথা পাবো।

: স্যার, প্লিজ, লজ্জা দেবেন না। ওরা মূর্খ মানুষ, কী বলতে কী বলেছে! মাফ করে দেন।

: না না ভাই, ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি। শুধু, ব্যথা পাবো, এটা ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম। আর একটা বিষয়। আপনারা দাবি করছেন, আমার নাকি কালো হাত! এখানে আমার কিছু বলবার আছে। (শার্টের আস্তিন তুলে) দেখেন, দেখেন, আমার কিন্তু কালো হাত না; পুরোপুরি ধবধবে ফর্সা হাত। ভাই, আমি এখনও বিবাহ করি নাই। আমার প্রতি যদি একটু দয়া করেন, তাহলে আমার বিবাহটা……….

(রুমে হাসির রোল পড়লো।)

: (হাসতে-হাসতে) স্যার, প্লিজ, প্লিজ! …….. আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কিন্তু স্যার, অভিযোগ বলবো না, আমাদের একটা ছোট্টো অনুযোগ ছিল।………আপনি আমাদের আবদার-টাবদার একটু কম রাখেন।

: ভাই, কী যে বলেন! কী যে বলেন! আচ্ছা, এখন থেকে বেশি-বেশি রাখবো।

অতঃপর, অম্লমধুর খুনসুটিতে আমলা, উদ্ভূত মামলা ডিসমিস করিয়া সকল প্রকারের সম্ভাব্য হামলা হইতে রেহাই পাইয়া পরবর্তী কামলা খাটিতে মনঃসংযোগ করিলো।