চিতায় বসবাস

: কী রে পাগলি! বিয়ের ছবিতে তোকে দেখতে তো পুরো রাজকন্যার মতো লাগছে!

: হয়তোবা! কিন্তু বাবার ঘরের রাজকন্যাটা অন্য ঘরে বড়ো কষ্টে আছে, দাদা।

: মানে?

: কাউকে বলতে পারি না, তোমাকে বলি।

: বল।

: দাদা, তোমার মনে আছে, আমি প্রায়ই বলতাম, ও আমাকে কথায় কথায় শুধু মারে?

: হুম।

: দাদা, তুমি বলেছিলে, ওকে ছেড়ে দে। ওর মধ্যে এটা থাকলে বিয়ের পরেও যাবে না। আমি বিশ্বাস করিনি কখনও, উলটো তোমার সাথে অভিমান করেছিলাম।

: তুই তো বলতিস, ও তোকে আদর করে গায়ে হাত তোলে।

: হ্যাঁ, দাদা। খুব ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইলও করত। যখন যা ইচ্ছে, তখন তা-ই করত। তোমাকে বলতাম, মনে আছে, দাদা?

: হ্যাঁ। আমি তোকে বলতাম, সরে আয়। তুই এটা শুনে অনেক দিন কথাও বলিসনি আমার সাথে।

: ঠিক। অন্ধ ছিলাম গো, দাদা। ভাবতাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালোবাসতাম যে!

: তো, এখন কী হয়েছে?

: কিছু না, দাদা। সবাইকে যে বলাও যায় না। বাবাকে বলিনি, গায়ের নীল-কালো দাগ দেখে মা একটু আঁচ করতে পেরেছে বোধ হয়। আগে শুধু ও-ই মারত, এখন ওর বাবা, মা, এমনকি ছোটো বোনও গায়ে হাত তোলে। এই তো সেদিন আমার শ্বশুর চায়ের কাপ ছুড়ে মারলেন আমার মুখের উপর। এমন কোনও গালাগালি নেই, যেটা আমাকে ওর বোন করে না।

: কী বলিস তুই! ওরা তো অনেক বনেদি বলেছিলি তুই।

: সে তো বটেই। বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছু বুঝবে না। ফ্যামিলিতে সবাই খুব উচ্চশিক্ষিত, স্মার্ট।

: আসলেই মারে তোকে? আমার তো কেমন জানি লাগছে শুনতে। ও ডিএমসি’তে আছে না? ওর বোনটা তো ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে, না? বাবা আগে পিডিবি’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিল বোধ হয়, না কি?

: সব ঠিক আছে, দাদা। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে মার খাই, এটাও ঠিক।

: তুই কিছু বলিস না? তোর বাসায় জানে এটা?

: বাসায় বলিনি এখনও। বিয়ে হলো তিন মাস মাত্র, তার উপরে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছি। এখন কিছু বললে বাবা মরেই যাবে। হার্ট-অ্যাটাক হলো তো বেশি দিন হয়নি। ডাক্তার বলেছেন বাবাকে সাবধানে রাখতে। জানো, দাদা, সেদিন ওর মা’র সামনেই এত জোরে জোরে ১০-১৫’টা চড় মারল যে অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছিলাম।

: কী বলছিস এসব! ছিঃ!

: সত্যি কথা বলছি, দাদা। এই মানুষটাই একটা সময়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে জাহাঙ্গীরনগরে গিয়ে পড়ে থাকত শুধু আমার জন্য। এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। ও বড্ড বদলে যাচ্ছে, দাদা!

: তুই এখন কোথায় আছিস?

: আমাদের বাসায় এসেছি দু-দিনের জন্য। পাঁচ দিন হয়ে গেল, ওখানে আর যেতে ইচ্ছে করে না। এখানে থাকলে মারের হাত থেকে একটু বাঁচতে তো পারছি! অনেক ব্যথা পাই গো, দাদা। মনের কষ্টের চাইতে শরীরের কষ্টই যে বেশি, সেটা মার খাওয়ার আগে বুঝিনি কখনও। এখন আমাকে দেখলে চিনতে পারবে না। জানো, কালকে ওর মা ফোন করে বললেন, তুই যে ওখানে সুখে বসে আছিস, বাসার কাজগুলি কে করে? এবার আয়, দেখাচ্ছি মজা।

: এই শোন, তুই বাসায় সব কিছু জানিয়ে দে। কেস কর। ওকে ডিভোর্স দে। ওর এই স্বভাবটা আগে থেকেই ছিল। এটা কখনওই যাবে না রে, শ্যুওর থাকতে পারিস। দিন দিন ও আরও বাজে হয়ে যাবে। ওর বাসায়ও তো সবাই জানোয়ার। তুই ওখানে থাকবি কীভাবে?

: না, দাদা, এটা হয় না। ওকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমি চলে এলে ওর দেখাশোনা কে করবে? মরতে মরতেও ওকে ভালোবেসে যাব। মার খেলে গায়ে অনেক ব্যথা পাই, এটা ঠিক। কিন্তু ওকে ছেড়ে এলে যে সত্যি সত্যিই মরে যাব। আমি পারব ওকে ভালো করতে। কী দাদা, পারব না?

: কিচ্ছু পারবি না তুই! এ জানোয়ারটা কোনওদিনই মানুষ হবে না। ওর মধ্যে একটুখানিও মনুষ্যত্ব থাকলে তোর গায়ে হাত তুলতে পারত না। আমাকে আঙ্কেলের নাম্বারটা দে, আমি কথা বলি।

: না, দাদা, তোমাকে এসব এমনি এমনিই বললাম। কাউকে বোলো না, প্লিজ। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো।

: তার মানে, তুই ওখানে ফিরে যাবি?

: হ্যাঁ, দাদা, যাব। ওকে ভালো মানুষ করে তুলব। আমি পারব তো, দাদা?

: যা ইচ্ছা কর গিয়ে! এই শোন, তোকে ওরা খেতে-টেতে দেয় তো ঠিকমতো?

: কাজ করলে দেয়। কাজ পছন্দ না হলেও দেয়, তবে সব তরকারি দেয় না। সেদিন আমার ননদ আর শাশুড়ি আমার কবিতার খাতাদুটো পুড়িয়ে ফেলেছে। অনেক কেঁদেছি, দাদা, তবু শোনেনি। তুমি আমার জন্য ভেবো না। নিজের প্রতি খেয়াল রেখো, একটা বিয়ে কোরো। প্রেম করোনি বলে ভেবো না যে সুখী হবে না। আগে ও আমাকে ভালোবাসত আর মারত। এখন আর ভালোবাসে না, শুধু মারে। দাদা, জানো, কোনও একদিন মার না খেলে সেদিন কী যে ভালো লাগে! তখন ওকে শুধুই বেশি বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে!

: তুই আর ও বাড়িতে যাস না রে! তোকে ওরা মেরেই ফেলবে।

: মেরে ফেলবে না, দাদা, বাঁচিয়ে ঠিকই রাখবে। মেরে ফেললে মারবে আর কাকে?

: দেখি, তোর একটা সেলফি তুলে পাঠা। তোকে একটু দেখি।

: ধুউউউরো দাদা, কী যে বলো না! আমি ঠিক আছি, আমাকে দেখতে হবে না। খুব জোরে মারে না তো, আমি কাঁদতে শুরু করলে, পায়ে জড়িয়ে ধরলে ছেড়ে দেয়। আচ্ছা দাদা, এসব নিয়ে আর কিছু না বলি, কেমন?

: তুই কবিতা লিখতিস না? এখন লিখিস-টিখিস তো? অবিকল ভাস্করের মতো লিখিস রে তুই! তোর সাথে কতদিন কবিতা নিয়ে গল্প করি না! শাশ্বতী স্যানাল পড়েছিলি পরে?

: লিখি, দাদা, মনে মনে। কবিতা ছাড়া মানুষ বাঁচে কী করে, বলো! একদিন আমার সব কবিতা ছাপা হবে চিতার আগুনের শিখায়, এ-ও জানি। কবিতার সবক’টা দুঃখী অক্ষর চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে গনগনে আগুনের উড়ন্ত ফুলকির মতো। সেদিন বোনটাকে একটু আশীর্বাদ করে বোলো, ‘অন্তত এখন থেকে ভালো থাকিস রে, পাগলি!’ বলবে তো, দাদা?

আর কিছু লিখতে পারলাম না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করতে লাগল। মনে হতে লাগল, কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে, কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে, আটকাতে পারছি না কিছুতেই! আমার নিজের ছোটো বোন নেই। একটা মেয়ে এমনভাবে কষ্ট পাচ্ছে জানলে সহ্য করতে ভীষণ কষ্ট হয়। প্রায়ই কিছুই করতে পারি না। চোখ ভিজে ওঠে শুধু। যেসব ছেলে মেয়েদের গায়ে হাত তোলে, গালাগালি করে, তাদের প্রতি ন্যূনতমও দয়া কিংবা করুণার কোনও প্রশ্নই ওঠে না! ওদের বিয়ে করে ‘ঠিক করার’ কথা মাথায় এনে নিজের জীবনটাকে নরক বানিয়ে ফেলবার চাইতে বড়ো বোকামি আর হয় না। দেরি হয়ে যাওয়া বলে কিছু নেই। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার শেষচেষ্টাটি করবার মতো সময় মৃত্যুর আগ অবধি হাতে থাকেই থাকে! যা-ই ঘটুক না কেন, জীবনের যে-কোনও পর্যায় থেকেই নতুন করে জীবনটা শুরু করা যায়। মাথায় রাখতে হবে, এ ধরনের ছেলেরা মানসিকভাবে অবশ্যই বিকারগ্রস্ত, অসুস্থ। একজন অসুস্থ মানসিকতার মানুষের সাথে জীবন কাটিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেবার তো কোনও মানেই হয় না! জীবনের দাম কিছুতেই এত কম নয়!