চিত্রাঙ্গদা: দ্য ক্রাউনিং উইশ (২০১২)

একটা ইচ্ছের গল্প। একজন মানুষ—গড়নে পুরুষ, ভাবনায় নারী। পড়ায় ইঞ্জিনিয়ার, পেশায় কোরিওগ্রাফার, নেশায় নৃত্যশিল্পী। উঁচুদরের আর্টিস্ট। জীবন তাঁকে অনেককিছুই দিয়েছে। মেধা, নৈপুণ্য, একাগ্রতা। তাঁর আশেপাশে অনেকেই থাকতে চায়, তাঁর কাজে মুগ্ধ হয়। মানুষটার সবই আছে, তবু কী যেন নেই! তাঁর কথাতে স্পষ্ট করে জানা যাক: কদর তো কত লোক করে, ভালোবাসার সাহস কয়জনের আছে, বলতো?………হ্যাঁ, একাকীত্ব। এক্সট্রাঅর্ডিনারি মানুষের কমন বৈশিষ্ট্য। গল্পের মানুষটি একাকীত্ব আর কাজ নিয়ে দিব্যি দিন কাটিয়ে দিচ্ছিলেন।

হঠাৎ একদিন এক ছেলের সাথে তাঁর দেখা হল। ছেলেটি ছন্নছাড়া, চালচুলোহীন, উরাধুরা টাইপের। মুহূর্তের আবেগে ও সিদ্ধান্তে চলে, এমন একটা ছেলে। তার উপর ড্রাগ নেয়। ছেলেটিকে তাঁর ভীষণ ভাল লেগে যায়। ভাললাগা থেকে কাছে আসা, ধীরেধীরে প্রেম, অবশেষে ভালোবাসা। এই ধরনের সৃষ্টিছাড়া গোছের ছেলেরা যখন কারো প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে, তখন সে অনুভূতি প্রচণ্ড মাত্রার হয়। ছেলেটার এমন রেসপন্স দেখে মানুষটি অসীম ভালোবাসায় ডুবে গেলেন। ছেলেটির সকল সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি মেনে নিয়েই তিনি ছেলেটিকে ভালোবাসলেন। সমপ্রেম। নিষিদ্ধ ও বিশুদ্ধ।

একদিন ছেলেটি বলল, তার বাচ্চাদের খুব ভাল লাগে। তারও একটা সন্তান চাই। ওরা তো চাইলেই একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করতে পারে, তাই না? না, পারে না। সেইম-সেক্সের দুইজন মানুষ চাইলেই তা করতে পারে না। আইনে বারণ। ততদিনে তাঁদের ভালোবাসা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সে ছেলের জন্য কোরিওগ্রাফার সবকিছুই করতে পারেন। ঠিক করলেন, তিনি ছেলেটির সন্তানের মা হবেন। তাঁর ভালোবাসার মানুষটির ইচ্ছেপূরণ করবেন। কীকরে? মেয়ে হয়ে! অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট!

ডাক্তারের কাছে গেলেন। তিনি সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি করাবেন। প্রচণ্ড যন্ত্রণার একটা প্রসেস। তবু তিনি তা করাবেন। তাঁর ভালোবাসার ছেলেটির জন্য। তাঁর ভালোবাসার দাবিতে। কাজটি সহজ নয়। পুরো প্রসেসটি কমপ্লিট করতেও সময় লাগে। এক স্টেপ থেকে আরেক স্টেপে যেতে হয়। ওই জার্নিটার সময় ছেলেটি আবারো হারিয়ে যায়। ওরকম ছেলেরা থাকে না, হারিয়ে যায়ই। মানুষ আগে বোঝে না, হারানোর পর বোঝে। ওরা এমন প্রাণী, যাদের ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, এবং ভালোবেসে ফেললে পরে কষ্ট পেতে হয়। হয়ই! যার জন্য তিনি এতটা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন, নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত বদলে ফেলছেন, অর্ধেকটা বদলে ফেলেছেনও, সে-ই কিনা এখন বলছে, আমার সন্তান দরকার হলে আমি তা কোনো মেয়ের গর্ভে নেবো, একজন রূপান্তরিত মেয়ে (তার ভাষায়, সিনথেটিক মেয়ে)-র গর্ভে কেন সন্তান নেবো আমি?………এরকমই কিছু একটা সংশয়। ভালোবাসার মানুষের চাইতে মানুষটার আইডেন্টিটি তার কাছে বড়ো হয়ে দাঁড়াল।

তবে হ্যাঁ, সে বিবর্ণ রূপান্তর-পথে তিনি যে পুরোপুরি একাই হেঁটেছেন, তা নয়। তাঁর সাথে আরও একজন ছিলেন। সে ‘আরও একজন’ তাঁকে সময় দিতেন, তাঁর সাথে গল্প করতেন, তাঁর সমস্যাগুলি শুনতেন। কে উনি? আদৌ কি উনি কেউ? কিংবা, আরও স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করলে……উনি কি আলাদা কেউ? যা কিছু স্পষ্টের চাইতেও স্পষ্টতর, দৃশ্যের চাইতেও দৃশ্যমান, সত্যের চাইতেও ধ্রুব, তা কিছুর অস্তিত্ব কি স্রেফ স্পর্শনির্ভর? নাকি কিছু উপস্থিতি এতটাই প্রকট যে তা স্পর্শের চাইতেও বিশ্বস্ত? শরীর আর মন কতটা বদলালে মানুষ ভিন্ন কেউ হয়ে যায়? সে বদল কি একই মানুষের মধ্যে ভিন্ন শরীর-মন এনে দেয়? নাকি পুরো মানুষটাকেই বদলে দেয়? শিপ অব থিসিয়াস কী বলে?

ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চিত্রাঙ্গদা: দ্য ক্রাউনিং উইশ’ মূলত আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মোপলব্ধির এক ধূসর আখ্যান। এ ফিল্ম কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যেগুলি মানুষের জেন্ডার ও আইডেন্টিটি রিলেটেড। সে প্রশ্নগুলির উত্তর দেয়া যায় না, দিতে দুঃসাহস লাগে। মিথের দিকে তাকালে দেখি, চিত্রাঙ্গদার বাবা চেয়েছিলেন, চিত্রাঙ্গদা পুরুষের মন আর পুরুষের সামর্থ্য নিয়ে বাঁচুক। অর্জুনের সাথে দেখা হবার পর চিত্রাঙ্গদা নারী হয়ে উঠতে চাইল। ভালোবাসা মানুষের আত্ম-পরিচয়ের রাস্তা বাতলে দেয়, বদলেও দেয়।

ঋতুপর্ণও দেখিয়েছেন, ছেলেটির বাবা চাইলেন, ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ার হোক। পড়ালেনও। ছেলেটির ইচ্ছে ছিল অন্যদিকে। গেলও সেদিকে। কোরিওগ্রাফার হল, ডান্সারও। ছেলে বাবা-মায়ের কথা কখনোই আমলে নেয়নি অতোটা, তবে সে যখন মেয়ে হচ্ছে, তখন যার জন্য মেয়ে হচ্ছে, তাকে সে পাশে পেল না, তবে বাবা-মাকে ঠিকই পেল। সেই ভালোবাসাই প্রকৃত ভালোবাসা, যে ভালোবাসা ভালোবাসার মানুষটিকে মানুষটি যেমন আছে, তেমন করেই নিতে শেখায়, এমন-কী মানুষটি যদি অন্যরকমও হয়ে যেতে থাকে, তবু তাকে ছেড়ে না যাওয়ার নামই ভালোবাসা। ‘চিত্রাঙ্গদা: দ্য ক্রাউনিং উইশ’ মুভিতে কোরিওগ্রাফারের জন্য এমন ভালোবাসা তাঁর বাবা-মাকে অনুভব করতে দেখেছি; তিনি যে ছেলেটিকে ভালোবেসে ছিলেন, সে ছেলেটি, তাঁর বাহ্যিক অবয়বের রূপান্তর, যা তিনি ছেলেটির জন্যই করছিলেন, কিছুতেই মেনে নিতে পারল না, তাঁর জীবন থেকে দূরে সরে গেল। ভালোবাসা মানুষকে মেনে নিতে শেখায়।

কেউ ভালোবাসুক আর না-ই বাসুক, তুমি তা-ই হও, যা তুমি হতে চাও।

কেউ পাশে থাকুক আর না-ই থাকুক, তুমি সে রাস্তায়ই হাঁটো, সে রাস্তায় তুমি হাঁটতে চেয়েছ।

যতো সীমানাই দেখো না আশেপাশে, যদি ইচ্ছে তোমার সীমা ছাড়িয়ে যেতে চায়, তবে ইচ্ছেকে সঙ্গ দাও, ওতে তোমার যতো কষ্টই হোক না কেন!

কে কী বলল, তার চাইতে অনেক বেশি জরুরি, তোমার হৃদয় তোমাকে কী বলল। নিজেকে প্রথার মধ্যে ভেঙো না, প্রথাকে নিজের মধ্যে ভাঙো।

‘চিত্রাঙ্গদা: দ্য ক্রাউনিং উইশ’ একটি ছদ্মভালোবাসার গল্প যে ভালোবাসা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়: তুমি আমার জন্য কতটা কষ্ট নেবে?…….এর কোনো উত্তর মেলেনি। আর মেলেনি বলেই গল্পটি ভালোবাসার যতটা, তার চাইতে অনেক বেশি ইচ্ছেপূরণের।