ছেঁড়া-চিরকুটে লেখা আছে যা

 
তুমি বল, আমি নাকি জিতিয়ে দিই,
আমি নাকি স্বেচ্ছায় হেরে যাই…
পরাজিত পাখির বেশে হাসিমুখে লুটিয়ে পড়ি তোমার আকাশে।
হয়তো এ-ও বলে ফেলবে কোনও একদিন…
বেশ অভিজ্ঞ পুরনো এক তস্কর আমি!


আমি মনের দামটা ঠিকঠাক দিতে জানি।
হায়, জানলে না তুমিই কেবল
আমার এঘরে সত্যিই তুমি কতটা দামি!
যখন আমাকে এমনি করে বিবস্ত্র কর,
আমি নতজানু হয়ে ওই কাঠগড়াতে দাঁড়াই যখন,
তখন অধীর হয়ে থাকি এই আমিও চেয়ে…
আমার এবার একটা বিচার হবে,
এসবের সত্যিকারের একটা বিহিত হয়ে যাক---আমিও এসব চাই!


আচ্ছা, তোমার বিচারকটা কে?
আমি কাকে দেবো আমার সব কৈফিয়ত?
আর কে-ইবা হবে সাক্ষী আমার?
আমি তো সবটাই জানি! এই রায়টা হবার আগেই
আমি জেনে বসে আছি রায়টা যে কী!
পরাজয় আমার অনিবার্যই!


আমার কোনও সাক্ষী নেই,
আমার একটা উকিল নেই,
আমায় যখন প্রশ্নবাণে আঘাত কর,
তখন কই চলে যায় আমার ভালোবাসারা?


বুকের গভীরে এক আর্তচিৎকার আর
আহাজারিতে ভরে ভরে যায় পাথরকঠিন হৃদয় আমার!
বাইরের সেই পাথরখুঁড়ে ওই উকিল তোমার
আমার ভেতর যে জলটা আছে, তা খুঁজে পায় না।
ভাবে, এ-ই বুঝি আমি! বুঝি এমনই আমার প্রেম!


প্রশ্ন ওঠে, আমি তোমার হতে পারি ঠিক কতটা!
সে যোগ্যতাই-বা কই আমার?
তা থাকেই যদি, তবে কেনই-বা হারছি এমন বারেবারেই?
স্বেচ্ছায় হেসে চুরির দায়টা কেন নিচ্ছি কাঁধে?
এতই যদি বিত্ত আমার, তবে সে বিত্তের
ছিটেফোঁটাও দেখাই না কেন?
এ কেমন ভালোবাসা আমার!


নয়তো ভেবেই বস কখনও কখনও,
আমি বুঝি হেরে গিয়েই খুঁচিয়ে আনি রাজ্যের সুখ!
আমি তোমাকে আর জানিই-বা কত!
তোমার জজসাহেবকে জিজ্ঞেস করেই দেখো,
ভালোবাসার শেষ বিচারটা ঠিক কত দিন আগে করেছিল সে?
কোন পক্ষটা জিতেছে সেদিন?
জিতে যে নিয়েছে সেদিন সবই, সে কি ছিল ততটা বিত্তশালী?
যে হেরেছে হেসে, সে কি হারিয়েছিল আদৌ কিছু?


আমারও এই বুকের ভেতর একটা সংসার আছে।
সে সংসারের সবটা দায় কেবলই আমার!
তোমার উকিল কি মাপতে জানে
বিচারে কোথায় কেন কতকটা হার?
আর আমার সব প্রশ্নের জবাব, জানে কি সে?
জানে না তো? জনাব, সে খোঁজ আমি ভালোই জানি!


এই যে যখন তোমায় নিজের কাছেই হারতে দেখি,
আমার কাছেও যখন তুমি হারতে থাকো,
বলো তো, তখন তুমি সত্যিই হারো?
না কি আসলে হারি আমিই?
খোঁজ নিয়েছ, সে মানুষটা কে, যে
তোমার জেতার মাঝেই…তোমার আগেই জিতে নিতে চায়?


যখন তুমি জেত, তারও বহু আগেই আমার ভালোবাসাটা ঠিক জিতে যায়!
তখন আমার হার বলতে আর থাকে না কিছুই!
যেদিন এই অনুভূতিটা নতুন সাজে সাজবে দারুণ,
সেদিন তুমি দেখে নিয়ো, জিতেছিল কে…
সে জেতা আবার কেমন জেতা, যে জেতায় আমি তোমাকেই হারাই?
যদি কেবলই তোমাকে জিতি,
মেনে নেব হার হয় যদি তা একপৃথিবীও সমান!


কেন বৃথাই প্রশ্ন ছোড়---
আমার কাছে কোনটা আগে?
জয়টা আমার কোথায় আছে?
…এসব প্রশ্নের অর্থটা কী?
সত্যি, তুমি এক আজব মানুষ!


আমার কাছে এক তুমি ছাড়া
এমন কী আর পৃথিবী আছে!
আমার তো আছে চিরকুটই এক,
সেখানে কেবলই প্রশ্ন আছে---একটিকথার,
তার উত্তরটাও---একটিকথারই!
তোমাকে পেলে পৃথিবীঘোরার স্বাদ মিটে যায়,
তোমাকে না পেলে নিজের কাছে বিবসনাই থাকি!


বলো, আমার কী আর আছে বলতে নিজের?
আমি তো পথের ভিখিরি শুধুই!
আমাকে আমার ভালোবাসারা খুব বকে যায়…
বলে, তোর আছে কী তবে?
দিনের শেষে পৃথিবীটা থেকেই যাবে যেমন আছে,
অরণ্য পাহাড় মেঘ বৃষ্টি…ওরা সবাই ঠিক থাকবে নিজের মতোই,
ওই মাটিতে-চলা সাপ-বিচ্ছু…ওরাও একটা জীবন পাবে,
ভোর আসবে, রাত ফুরাবে,
নক্ষত্রদের কয়েক কোটি চোখ ফুটবে,
তারাদের মিছিলে হবে, সওদাগরটা চাঁদই হবে,
নিত্যদিনের বাজারহাটে জটলা হবে,
সন্ধে হলে তার কালিমা ভেদ করবে আগুনে-পোকা,
ভোরের হাওয়া তার স্নিগ্ধ কায়ায় ধুয়ে দেবে চারিদিকে,
বারুদের স্রেফ ঘ্রাণেই হবে গোটা একটা যুদ্ধ কাবু,
পুরনো সে মেঘ ঘুরেফিরেই একআকাশেই ছুটবে এমন,
নিয়তি ঠিকই ভাসাবে ভেলা কাউকে তার যাত্রী করে,
ঋতুবদলের খেলায় সবুজ বদলাবে রং চেনা ধাঁচে,
…সবখানেতেই সব সবটা চলবে এখন যেমন চলে কিংবা আগে চলত যেমন,
অথচ সেখানে কোথাও পাব না তোমায়!


ঠিকই চলে সব কিছুই, যেমনি ওদের চলার কথা,
কারও জন্যই থেমে থাকে না কখনও কিছুই!
ওটাও যদি জিতে-যাওয়া হয়,
তবে সে জেতায় বলো আমি কী পেলাম?
হারালাম যত, পাওয়ার ভাগ কি তারও ভারী?
তোমায় না পেলে তার চাইতেও বড় হারানো হারায় কি কেউ?
তার চেয়েও বড় চুরির মামলা ওঠে কোন আদালতে?


তোমার উকিল ভালোই জানে এর উত্তর!
চাইলে ওকে শুধিয়েই দেখো!
…স্যার, বলুন তো ভেবে, ঠিক কয়টা হিসেব এল, তার বদলে কয়টা গেল?
হলো কতকটা জয়? কতটা কী হলো এলোমেলো?


আমার কাছে সকল জয়ের নাম একটাই---
সে কেবল তুমিই তুমি!
যদি না পাই তোমায়, যদি হারিয়েই ফেলি নিজের দোষে,
তবে জেনে রেখো, সব পেয়েও আমি হেরেই গেছি!
নতুন করে হারতে আর নেইকো বাকি!


তুমি নেই তো থাকে না কিছুই কোথাও কোনও!
তুমি নেই তো তার অর্থ আমার মৃত্যু কেবল!
তুমি নেই তো যা বিত্ত আছে, তাতে চিত্তই যে নেই!
তুমি নেই তো এই প্রাসাদে আমার মাকড়সারাই জাল বুনে যায়!
এই জীবনে তুমি নেই তো তার বদলায় নাম ‘ছেঁড়া-চিরকুট’-এ!