জলঘড়ির স্তব্ধস্বরের নিভৃতসুর

 
ধরো, একদিন আমি দুম্‌ করে মরে গেলাম!
খবরটা শুনে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকবে, তাই না?
হুঁশ এলে তড়িঘড়ি হয়ে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে
আমার নম্বরে বারবার কল দিয়ে দেখবে,
কেউ ফোনটা ধরছেই না। এমনও হতে পারে,
কেউ ফোন ধরে শীতলকণ্ঠে বলছে, ‘আপনি যাকে চাইছেন, সে মারা গেছে।’


তখন কাঁপতে কাঁপতে তোমার হাতগলে
টুক্‌ করে ফোনটা বুঝি নিচে পড়ে যাবে?
তীব্র কষ্টে নীল হয়ে হাঁটুগেড়ে ফ্লোরের উপর ঝিম ধরে বসে থাকবে?
অনেকক্ষণ বিশ্বাসই করতে চাইবে না, যা শুনেছ তা সত্য! তাই না?
অপেক্ষা করার পরও, কিছুই যখন মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে না, তখন
খানিক বাদে ঝরঝর করে কেঁদে উঠবে?


তার পর? তার পর চারিদিকে হাতড়ে হাতড়ে এপাশ ওপাশ তন্নতন্ন করে খুঁজবে! তাই না?
ল্যাপটপের স্ক্রিনটাতে আমায় খুঁজবে।
কফির ধোঁয়ায় আমায় খুঁজবে।
হাতঘড়ির কাঁটাগুলোতে আমায় খুঁজবে।
খুঁজবে তো? অস্থির হয়ে আঁধার কি আলো, তা খুঁড়ে আমায় খুঁজবে।
রৌদ্র সরিয়ে কিংবা রাত্রি ফুঁড়েও আমায় খুঁজবে।
এদিক ওদিক, এপাশ ওপাশ…হন্যে হয়ে আমায় খুঁজবে। ভুল বলেছি, বলো?


সন্ধে নামলে ছাদে উঠে কার্ণিশ ধরে উদাস হয়ে আকাশের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকবে।
আর অনেক অনেক তারার ভিড়ে ঠিক কোন তারাটা আমি, পাগল হয়ে খুঁজবে!
হঠাৎ সেই মুহূর্তে, তোমার চোখ ধাঁধিয়ে একটা প্যাঁচা হুস্‌ করে
তোমার সামনে দিয়ে উড়ে যাবে! কিছু সময়ের জন্য তারার রাজ্য থেকে ফিরে আসবে।
আর রাতের সমস্ত আঁধার গায়ে মেখে এই শহরে থেকেও এই শহর থেকেই মুখ লুকিয়ে
আমায় ভেবে হু হু করে কেঁদে উঠবে! হবে এমন?


মেসেঞ্জারের টপলিস্টে আমায় খুঁজবে।
যতই দিন সামনে গড়াবে, আমার আইডিটা সেই লিস্ট থেকে
ধীরে ধীরে নিচে নামতে নামতে একদিন…অনেকদূরে তলিয়ে যাবে। ঠিক না?
সেইদিনও, মেসেঞ্জার খুলে বারবারই আমাদের পুরনো কথোপকথন…পড়বে?


সকাল হতেই ‘শুভ সকাল, বাবুইপাখিটা!’ এই মেসেজটার জন্য
অপেক্ষা করে থাকবে? যখন রাত্রিটা তোমার চোখে ঘুম নামাবে,
তখন ভুল করে ‘শুভ রাত্রি!’ টেক্সটের অপেক্ষায় থেকে থেকে বিষণ্ণ হয়ে যাবে?


ধরো, সত্যি আমি মরেই গেলাম। মানুষ সত্যি সত্যিই মরে যায় কিন্তু!
যদি একদিন আমি চলেই যাই, সেদিন, ওই যে তোমার ব্যালকনির অর্কিডগাছে
ফুল ধরল, চোখে রোদ্দুর নাচিয়ে সে-কথা কাকে জানাবে?
পূর্ণিমারাতে, জানালা খুলে আকাশ দেখে দেখে কাউকে জ্যোৎস্নার গল্প শোনাতে ইচ্ছে করবে না?
এক একটা কবিতা লেখাশেষে কাকে ফোন করবে আবৃত্তি করে শোনানোর জন্যে?
গল্পগুলো গুছিয়ে দিতে পাঠাবে কার মেইলে?
যে দুঃখগুলো আমার কাছে জমিয়ে রাখো, ওগুলো তুমি কাকে রাখতে দেবে?
সারারাত জেগে কার সাথে লেখাগুলো ভাগাভাগি করবে?
কার সাথে রাতজেগে আলতো করে ভোরটা টেনে আনবে?
কে তোমায় তোমার গল্পের বানানভুল ধরিয়ে দেবে?
কে তোমায় তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেবে?
কখনও বসের বকুনি শুনে মনখারাপ হলে, সেই গল্প কাকে শোনাবে?
যাচ্ছেতাই বিচ্ছিরি যত শব্দ আছ, সেগুলো দিয়ে গালাগালির চর্চাটা তুমি কার সাথে করবে?
ওই যে, তোমার ভাইয়ের মেয়েটা মাত্রই হাঁটতে শিখল, তোমায় ‘কাকা’ বলে ডাকতে শিখল…
খুশি হয়ে এইসব গল্প কাকে বলবে?


যেদিন আমি সত্যিই মরে যাব, সেদিন…
তোমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে, এই কথাটা অভিমান করে কাকে বলবে?
যদি বলই-বা, শুনে ভীষণ কাঁদবেটা কে? হুঁ?


সকালবেলায় বাসা থেকে অফিসে যাবার সময় টিফিনবক্সে করে কোন খাবারটি নিয়ে গেলে,
দুপুরে কী খেলে, বিকেলে রংচায়ে চিনি বেশি পড়েছে কি না,
সন্ধেবেলায় কোন ক্যাফেতে কফি খেলে, কোন কলিগের কার সাথে নতুন প্রেম হয়েছে,
কোন আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে সবচে মজার কোন খাবারটি খেলে,
রাত্রিবেলায় বাসায় ফিরে কোন কবিতাটা পড়ে তব্দা খেয়ে গেছ…এইসব তুমি কাকে বলবে?
কাকে বলবে সেদিন…
তোমারও যে আমার মতোই ভূরি ভূরি ব্যথা লুকানো ওই বুকপকেটে?


ধরো, মরেই যদি যাই, তখন…
তোমার কি বারবারই মনে পড়বে, কেউ একজন
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করত একসময়?
ঘরের ফুলদানিটা সাজিয়ে রাখত, তোমার গা-মোছা তোয়ালেটা
কেউ একজন গায়ে জড়াত, তোমার কাপে ঠোঁট ভিজিয়ে
সে তোমায় ঠোঁটে লেপটে রাখত?


কেউ একজন খুব গোপনে দুঃখগুলো পুষে রাখত নাকি বুকে?
…এইসব খুব মনে পড়বে, তাই না? আর এসব ভেবেই মধ্যরাতে
ঘুমভেঙে জেগে উঠে বালিশে মুখগুঁজে নিঃশব্দে কাঁদবে খুউব?


ধুউর ছাই! আমি কাঁদছি কেন? এই দেখো না, নিজের মৃত্যু ভেবে ভেবে…
নিজেই কেমন কাঁদছি…
কেবল তুমি কাঁদবে বলে!


জানো, আমি হুট্‌ করে মরে গেলে,
আমার অনেক কথাই না-বলা থেকে যাবে!
এই কলিজার পোড়াপোড়া দাগগুলো তোমার অদেখাই থেকে যাবে!
অনেক অনেক অশ্রুমোড়ানো চোখদুটো বৃথাই মাটির তলে পচে যাবে!
ব্যথায় ভাঙা একটা হৃদয় ঠায় গলে ধুলোয় মিশে যাবে।
…ভাবা যায়?


মন দিয়ে শোনো!
তোমার আগে আমি চলে গেলে, সেদিন…
কেঁদো না। একদমই না!
তুমি কাঁদলে এই কলজেটা পচেগলেও নড়েচড়ে উঠবে!
আর আমার আত্মাটা যন্ত্রণায় ছটফট করবে!


তো, এই কথাই রইল…
ধরে নিচ্ছি, ডিল পাক্কা! আমি মরলে তুমি একটুও কাঁদবে না।
…সেদিন আজকের এই ডিলটা মাথায় থাকবে তো?