জাদু লেপটে আছে চোখে

 
তুমি চলে যাবার পর আমি কী কী করি, সেদিন তা বলেছিলাম।
আজ বলছি, তুমি আসার আগে কী কী করি। মন দিয়ে শোনো।


বাজারে যাই। তাজা গরুর মাংস কিনি। বাসায় ফিরে রান্না করি।
একটা এয়ারটাইট বক্সে ঢুকিয়ে ফ্রিজে রেখে দিই। তুমি যে বিফপ্রিয় মানুষ, তাই!


খুঁটে খুঁটে বেছে বেছে জ্যান্ত মাছগুলিই কিনি।
জানি, তুমি মাছের ভুনা কটকট করে চিবিয়ে খেতে ভালোবাস।


মুরগির মাংসটাও এনে রেঁধে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখি।
হঠাৎ যদি বলো, চিকেন খাব, তখন…?


তুমি কিছু চাইবে, আর আমি তা দিতে পারব না,
…আমি চাই না, পৃথিবীতে এমন কিছু থাকুক।
তুমি হয়তো জানোই না, আমি পুরোপুরি সবজিভোজী।
আমি খুব নির্বিবাদী মানুষ কিনা, ওসব জীব-খুনটুন
আমি ঠিক মেনে নিতে পারি না।
তবু, আমি তোমার জন্য সবই পারি!
আমায় কখনও কখনও খুন করে ফেলো ইচ্ছে করেই!
আমি তাও বুঝতে পারি, আবার মানতেও পারি!


ছাদবাগানের গাছগুলিতে নিয়ম করে রোজবিকেলে জল ঢালি।
সরু লম্বা টুলটা দক্ষিণমুখী করে রেখে দিই।
কখনও হঠাৎ যদি ছাদে থেকে আকাশদেখার বাহানা করে বসো, তখন…?
তুমি জানোই তো না, ছাদলাগোয়া এই চিলেকোঠার বাসাটা নিয়েছিলাম
তোমার পাশে বসে চাঁদ দেখব বলেই!
অথচ দেখো, তুমি আজও কোনও দিন ছাদেই গেলে না!


জলখাবারের সব উপকরণ ফুরোবার আগেই ঘরে এনে রাখি।
তুমি এসেই তো ব্যস্ত হয়ে বায়না ধরো, ঝাল কিছু দাও, এক্ষুনি দাও!
তোমার বায়না, তোমার ফরমায়েশ আমার খুব ভালো লাগে।
তুমি জানোই তো না, আমি বিকেলে কখনও নাস্তা করি না।
তোমার সাথে দুইএক কামড় খাই, তুমি খাইয়ে দাও,
আমি সেই মুহূর্তটির জন্য প্রতীক্ষা করে থাকি।
তুমি আমার একটা অভ্যেস, একটা প্রতীক্ষিত যাপন।


বড় বড় দুধের প্যাকেট, এক্সট্রা চিনি, আর বেশি করে চা-পাতা কিনে রাখি।
তুমি বাসায় ঢোকার অন্তত আধাঘণ্টা আগেই চা বানিয়ে রেখে দিই।
চায়ে দুধ-চিনি ঠিকঠাক হয়েছে কি না, চা-পাতা ঠিকমতো পড়েছে কি না, এলাচির সংখ্যাটা ঠিক হলো কি না…
সবকিছুই বোধহয় কয়েকশোবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি।
তোমার চায়ের নেশা খুব, আমি জানি। সে চা হতে হবে ভীষণ কড়া, নরকের চাইতেও কড়া!
তুমি জানোই তো না, আমি কখনওই চা খাই না।
তোমার পাশে বসি, তোমার চায়ের কাপে দুইএক চুমুক যে দিই,
ওটা কেবলই তোমার ঠোঁটের ছোঁয়াকে ভেবেই দিই।
চা আমার সত্যিই ভালো লাগে না। এটা কখনও বুঝতে পেরেছ? পারার কথা নয়!


সিগারেটপোড়া ঠোঁটদুটো লিপস্টিকে ঢেকে ফেলি।
চোখে হালকা করে কাজল টানি, শ্যাম্পু করে চুলগুলোকে জ্যান্ত করি।
যদি কখনও চুলধরার বাহানা করো…ঠোঁটছোঁয়ার বায়না ধরো…তখন…?
তুমি জানোই তো না, সাজগোজ আমার একদমই ভালো লাগে না।


ফুলদানিটা সাজিয়ে রাখি, বিছানাটা গুছিয়ে রাখি, ড্রেসিং-টেবিলের আয়নাটা মুছে রাখি।
তুমি ঘরে ঢুকেই আয়নায় নিজেকে বারবার দেখো, আমি এটা অনেকবার খেয়াল করেছি।
তুমি জানোই তো না, আমার ঘরটা সব সময় এত গোছানো থাকে না।


তোমার ব্যবহার্য চায়ের কাপ, নাস্তার প্লেট, থালাবাটি, দুধ-খাওয়ার মগ…
সবকিছুই সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে মুছে শুকিয়ে রাখি।
তুমি ভীষণ খুঁতখুঁতে, খুব পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাস, আমি এটাও জানি।
তুমি জানোই তো না, আমার অ্যালার্জি আছে, তাই সাবানধরা ভীষণ রকমের বারণ!


তুমি আসার আগে, জানলার গ্রিলটা ধরে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকি।
গ্রিল পেরিয়ে বারবারই দৃষ্টি ছুড়ে দিই তোমার এখানে আসার পথটাতে।
ঠায় দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করতে করতে ভাবি,
এই বুঝি তুমি গুটিগুটি পা ফেলে ওই ঢালুগলির পথধরে উঠে আসছ!
অধীর হয়ে এই অপেক্ষাটা এত যে মধুর, তা আগে কখনও বুঝিনি।


তোমার জন্য নিজের হাতে রাঁধতে বড় ভালো লাগে।
হোক না সে খাবার অখাদ্য, বিস্বাদ…আমি তা-ও তোমার জন্য রান্না করি!
আমার কাছে পৃথিবীর সবচে সুন্দর দৃশ্য সেটাকেই মনে হয়,
যখন তোমায় ভারি তৃপ্তি নিয়ে আমার রাঁধা অখাদ্য খাবারগুলিও
গপাস গপাস করে মুখে পুরতে দেখি।
মনে মনে ভাবি, আহা! আমার পাগল একটা!


দামি দামি রেস্তরাঁর মজাদার প্লেটার কিংবা ঘরের রাজকীয় রান্নার মেন্যু ফেলে
তুমি যখন আমার হাতের অখাদ্যগুলি ‘কী অপূর্ব! কী অপূর্ব!’ বলে
টুক টুক করে খুব তৃপ্তি নিয়ে খেতে থাকো,
তখন দেখতে বড় ভালো লাগে।


সেদিন পাস্তা রেঁধেও তোমাকে দিইনি কেন, তুমি জানো না।
রাগ করেছিলে, রান্নাঘর থেকে জোর করে নিয়ে খেয়েছিলে।
তুমি আসার আগে, পাস্তা কেমন হলো, তা চেখে দেখতে অনন্যাকে দিয়েছিলাম।
সে চোখমুখ কুঁকড়ে বলেছিল,
খুবই জঘন্য রে! এটা তো কুকুরও খাবে না, তবে বয়ফ্রেন্ড খেলেও খেতে পারে!
নিজের উপর খুব রাগ হয়েছিল শুনে! তাই দিইনি।
অথচ সেটাই তুমি কী যে খুশিমনে খেয়ে নিলে!
তোমায় দেখে আমার চোখে জল এসে গেছে, তুমি তা দেখোনি।
ওই অনুভূতির সাথে কীসের তুলনা হয়, বলো তো?


আমি জানি, আমার রান্নায় কখনও নুন কম হয়, কখনওবা ঝাল বেশি।
কখনও মসলা বেশি হলো তো কখনওবা মসলাই পড়েনি!
তবুও কেমন লোভাতুর ক্ষুধার্ত চোখে টপাটপ প্লেটসহ চুষে খেয়ে নাও!
এই বোকাটা, এমন কেউ করে…হুঁ?


তোমার জন্য রাঁধতে গিয়ে হাত পুড়তে ভালো লাগে।
তোমার ফেলেরাখা অবশিষ্ট খাবারের কণাগুলি খুঁটে খেতে, চেটেপুটে খেয়ে ফেলতে ভালো লাগে।
অস্থির হয়ে জানলার গ্রিলটা ধরে অপেক্ষা করতে ভালো লাগে।
টকটক শব্দ শুনে দরজা খুলেই তোমায় দেখতে ভালো লাগে।
কখন ফিরবে, কবে ফিরবে তা ভাবতেও ভালো লাগে।
তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে ভালো লাগে।
পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠ কামড়াতে ভালো লাগে।
কানের গোড়ায়, ঠোঁটে জিভ ঠেকিয়ে চুমু খেতে ভালো লাগে।
তোমার হাতের তালুতে মুখগুঁজে চোখ বন্ধ করে রাখতে ভালো লাগে।
শুঁকে শুঁকে তোমার সারাগায়ের ঘ্রাণ নিতে ভীষন ভীষণ ভালো লাগে।
…সত্যি বলছি, তোমার সবকিছুই তো ভালো লাগে, সবকিছুই তো ভালোবাসি!


আমি তোমার অপেক্ষায় অনেকগুলি বছর বেঁচে থাকতে চাই।
তোমার তৃপ্তিমাখা চোখদুটো জনম জনম ধরে দেখে যেতে চাই।
তোমার বুকে কান পেতে তোমার হৃৎপিণ্ডের ধুকধুক শব্দটা কয়েকটা জন্ম শুনতে চাই।


তোমাকে চাই বলেই আমি চাই,
জন্মান্তর সত্য হোক!
পরজন্ম সত্য হোক!
…আমার যে তোমায় বারবার ছুঁয়ে দেখবার ইচ্ছে মিটবে না শতজন্মেও!