জিনিয়াসদের ‘ব্যাকরণ’

এ জগতে যত মহৎ সৃষ্টি ও কাজ হয়েছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে কোনও-না-কোনও পাগলাটে জিনিয়াসের হাত ধরে। জিনিয়াস হতে কী লাগে? চারবেলা দুধ-ডিম আর পুষ্টিকর খাবার? না না, ওসব কিছু লাগে না। বেশিরভাগ জিনিয়াসই জন্মগতভাবেই জিনিয়াস। ক্রমাগত সাধনায় ওদের এই আশ্চর্য দিকটা আরও শানিত ও পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।


খেয়াল করে দেখবেন, আপনার অফিসেই আপনার এক কলিগ আট ঘণ্টার কাজ আট ঘণ্টা ধরেই করে যাচ্ছেন কোনও ফাঁকি দেওয়া ছাড়া। আবার ঠিক একই কাজ অন্য এক কলিগ হয়তো দুই-আড়াই ঘণ্টায় চমৎকারভাবে শেষ করে ফেলছেন। বাকি সময়টাতে তিনি নিজের আনন্দের কাজগুলো করছেন। আবার বস যদি একটু কাজপাগল গোছের হন, মানে বসে-থাকাটা পছন্দ না করেন, তবে তিনি কম সময়ে কাজ সম্পন্ন করা সেই ব্যক্তির ঘাড়ে তুলে দেন আরও কিছু কাজের লিস্ট। হয়তো সেই বাড়তি কাজও ওই জিনিয়াস কর্মী অপেক্ষাকৃত কম সময়ে শেষ করে ফেলেন। বাকিটা সময় বের করে নেন নিজের আনন্দের কাজগুলো করতে। হ্যাঁ, তিনি যে-কোনও উপায়ে কিছু অবসর বের করে নেবেনই, এবং সেটি অবশ্যই অবশ্যই তাঁর কাজে ফাঁকি না দিয়ে। অফিসের কাজটা ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন করেন একটু কম সময়ে। জিনিয়াসরা তাঁদের পছন্দের কাজের জন্য সময় বের করে নেনই। দরকার হলে অন্যরা যে সময়ে ঘুমায়, পরিবারের সাথে সময় দেয়, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারে, ঘোরাঘুরি করে এদিক ওদিক, সে সময়ে তাঁরা নিরলস খেটে যান তাঁদের প্যাশনের জায়গায় অবগাহন করতে।


এতে করে কী বোঝা গেল?


একটু বুঝিয়ে বলি। যদি চব্বিশ ঘণ্টাই খাটুনি করে জিনিয়াস হওয়া যেত, তবে অনেক জিনিয়াস আমরা রাস্তাঘাটেই দেখতে পেতাম। সামর্থ্যের কিছু ব্যাপারও আছে এখানে। সবাই চাইলেই সব কাজ করতে পারে না। একটি হরিণ শিকার করে খেতে বাঘের যত সময় লাগে, একই হরিণটা শিকার করতে গাধার লাগবে কয়েক দিন বা কয়েক মাস, যদি সে আদৌ হরিণটা শিকার করতে পারে আরকি!


জগতে সবারই মাথার খুলি আর ব্রেইনের গঠন মোটামুটি একই রকম হলেও, সবার প্রতিভার ধরন আর ক্ষেত্র একই রকম হয় না। একজন জিনিয়াস ফটোগ্রাফারের একটি ক্লিক অন্য একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারের ক্লিকের চাইতে অনেক অনেক আলাদা হয়। ক্যামেরা থাকলেই যদি ফটোগ্রাফার হওয়া যেত, তবে পৃথিবীর পথেঘাটে ফটোগ্রাফাররা ঘুরে বেড়াত। একটি চমৎকার দৃশ্যকে ছবিতে ধারণ করতে একজন জিনিয়াস ফটোগ্রাফারের যে সময়টা লাগবে, সেই একই দৃশ্য তুলে ধরতে সাধারণ মানের কারও সময় লাগবে তার শতগুণ বেশি। এমনকি ওই সময়টা দিলেও কাজটি করতে তিনি ব্যর্থও হতে পারেন!


একজন পাবলো পিকাসো তাঁর তুলির কয়েক আঁচড়ে ছবিকে জীবন্ত করে তুলতে যতক্ষণ সময় খরচ করবেন, সেই একই কাজটি করতে আমার বা আপনার মতো কাউকে সাধনা করতে হবে কয়েক যুগ কিংবা কয়েক জন্ম! জিনিয়াস তৈরি করা যায় না, জিনিয়াসরা জন্ম নেয়।


কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির কথা ভাবি, চলুন।
জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার কথা ভাবা যাক। বাংলা সাহিত্যের এই বিখ্যাত কবিতাটা লেখা হয়েছিল বনলতা সেন নাম্নী নিতান্ত সাধারণ এক রাজবন্দিকে মাথায় রেখে। তিনি ১৯৩২ কিংবা ১৯৩৩ সালে রাজশাহীর জেলে নিবর্তক আইনে বন্দি ছিলেন। রাজশাহী থেকে কাছেই অবস্থিত নাটোরের নামটা ব্যবহার করে তিনি লিখে ফেললেন এই জনপ্রিয়তম কবিতাটি। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আমরাও তো কত মানুষের কথা শুনি, নাম জানি। তবু কি কারও কথা ভেবে ওরকম কিছু লিখতে পারব কয়েক যুগ চেষ্টা করেও? জিনিয়াস আর সাধারণের মধ্যে আকাশ-পাতাল দূরত্ব আছে।


আমরা সাকিব-আল হাসানকে অহংকারী, গোঁয়ার হিসেবেই জানি। এজন্য ওঁকে কেউ কেউ চরম ঘৃণাও করি। একটু ভেবে দেখেছি কখনও, ওরকম মানের একজন জিনিয়াস টিমে পাওয়াটাও কতটা ভাগ্যের ব্যাপার? বিশ্বের নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার বাংলাদেশি, এটা ভাবতে বুকটা গর্বে ভরে যায় না? একজন সাকিব তাঁর অহংকারটাকে ক্যারি করতে পারেন। হ্যাঁ, তাঁকেই মানায় অহংকার। আপনার আমার মতো কাউকে গুনে চলার সময় তাঁর কেন থাকবে, এটা কি আমাদের মাথায় আসে না? তাঁর মতো একজন আর্টিস্ট লেভেলের প্লেয়ার হতে অন্যান্যদের সাধনার পর সাধনা করে যেতে হয়, এর পরেও তো কেউ তাঁর ধারে কাছেও যেতে পারেন না। একই কথা ভারতের বিরাট কোহলির বেলাতেও সত্য। হ্যাঁ, ওঁদের লেভেলের একজন প্লেয়ার দলের বাকি দশজনের চাইতেও দামি!


কেউ ছয় বলে ছয় রান নেয়, কেউবা এক বলেই ছক্কা মেরে ছয় রান নেয়। আবার কেউ কেউ ছত্রিশ বলেও ছয় রান নিতে পারে না। পার্থক্য তো আছেই, তাই না? পৃথিবীর সব মানুষই সমান, এটা বলেন কোন যুক্তিতে? হাতি আর ছাগল সমান হয় কী করে? আরে ভাই, হাতি শুয়ে থাকলেও তো ছাগলের চাইতে উঁচু হয়। এর পরেও কি বলবেন, হাতি ছাগল ভাই-ভাই, এ দুইয়ের মধ্যে কোনও বিভেদ নাই? তবে হ্যাঁ, ছাগলকে ভাই না বানানোর ‘অপরাধ’-এ ছাগলদের দল হাতিকে অহংকারী তকমা দিয়ে দিতেই পারে! ওতে হাতির কী করার আছে? সে বেচারা তো চাইলেও ছাগলের মতো লাফাতে পারবে না! তার জন্ম তো আর তিড়িং-বিড়িং করার জন্য হয়নি!


জিনিয়াসদের অহংকার মানায়। আমাদের চোখে যা অহংকার, ওদের কাছে সেটাই স্বাভাবিক জীবনাচরণ। ওদেরকে ওদের মতোই থাকতে দেওয়া উচিত। ওরকম কাউকে বোঝার চেষ্টা করেও লাভ নেই। একজন জিনিয়াসকে বুঝতে হলে মাথায় যথেষ্ট পরিমাণে ঘিলু ও বোঝার মানসিকতা থাকতে হয়।


জগতখ্যাত ভাস্কর রোঁদ্যা। পাথর খোদাই করে মূর্তি গড়েন। পাথরের যে টুকরোগুলো অন্য দশজন সাধারণ লোকের চোখে কেবলই অপ্রয়োজনীয় পাথর, সেগুলো একজন রোঁদ্যার কাছে ভাস্কর্যের মহামূল্যবান উপাদান বা খনি। পাথরের গা কেটে কেটে তিনি তৈরি করেন অনন্যসাধারণ সব ভাস্কর্য। নগণ্য পাথরের মধ্যে লুকিয়ে আছে শিল্পের এমন একটি সম্পদ, যা দেখতে চাইলে একজন রোঁদ্যার চোখ থাকতে হয়। পাথর তো সবাই-ই দেখে, পাথরের ভেতরের সৃষ্টিটাকে রোঁদ্যার মতো কে-ইবা দেখতে পায়? কয়জনই-বা একজন রোঁদ্যা হতে পারে, এমনকি নিরলস সাধনা করলেও? মেধাবী ভাস্কর হয়তো অসীম চেষ্টায় হওয়া সম্ভব, তবে একজন রোঁদ্যা হতে চাইলে জিনিয়াস হতে হয়। জিনিয়াস আর মেধাবী, এই দুইয়ের পার্থক্যটা ঠিক এই জায়গায়।


আবারও বলছি, কিছু মানুষ বরাবরই অন্যদের চেয়ে অনেক অনেক উপরে। সকল মানুষ সমান হলে দুনিয়া আরও কয়েক হাজার বছর এগিয়ে যেত। পথেঘাটে, রাস্তায় রাস্তায় জিনিয়াস বিক্রি হতো সের দরে। সকল মানুষের জ্ঞান, মেধা ও মনন কখনওই একরকম নয় বলেই প্রত্যেকটা মানুষ বৈশিষ্ট্যে, কাজেকর্মে, এমনকি চিন্তাচেতনায়ও ভিন্ন ভিন্ন হয়। সকল জিনিয়াসই মেধাবী, কিন্তু সকল মেধাবী জিনিয়াস নয়। স্কুলে, কলেজে, ভার্সিটিতে, নানান পরীক্ষায় যারা ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়, তারা বড়োজোর মেধাবী হতে পারে, জিনিয়াস নয়। জিনিয়াস অন্য বস্তু!


উত্তমকুমারের অভিনয় দেখলে মনে হয় যেন বাস্তব সত্য কোনও ঘটনা দেখছি, এটা অভিনয় হতেই পারে না। উনি যখন ভিখারির চরিত্রে অভিনয় করেন, তখন মনে হয়, উনি বোধহয় জন্ম থেকেই ভিখারি! অন্যান্য চরিত্রেও তাঁকে অতটাই মিশে যেতে দেখি! দেখলেই সত্যি অবাক হতে হয়! আমির খানকে যে ধরনের চরিত্রই দেওয়া হোক, উনি সে চরিত্রেই নিজেকে মানিয়ে ফেলেন অদ্ভুতভাবে। একটু ভিন্ন ঘরানার মুভির দিকে তাকালে একজন ওম পুরি কিংবা একজন স্মিতা পাতিলের আশেপাশেও দাঁড়াতে পারেন, এমন একজনকেও তো দেখি না। ওরকম কেউ একজন কয়েক যুগে একজনই জন্মায়। তার পরেও কি বলব সব মানুষই সমান?


যে কাজ আমি আপনি অনেক কষ্টসাধ্য উপায়ে করে থাকি, সে কাজটি জিনিয়াসরা নিজের মেধা ও সহজাত প্রতিভার জোরে আমাদের চেয়ে অনেক সহজে কিন্তু শতগুণ ভালোভাবে করতে পারেন। একজন জিনিয়াস যা করতে পারেন, একজন মেধাবী কিংবা দক্ষ মানুষ তা চেষ্টা করলেও করতে পারবেন না, হয়তো তেমন কিছু করার কথা তাঁর মাথাতেই আসবে না। একজন জিনিয়াসের মাথায় যা আসবে, লক্ষ মেধাবী ও দক্ষ লোকের মাথায়ও তা আসবে না। কোনও কোম্পানি চাইলেই একজন মেধাবী লোক হায়ার করতে পারে, তবে জিনিয়াস কাউকে চাইলেই হায়ার করা যায় না, যদি না তিনি সেখানে কাজ করতে রাজি থাকেন। তাই আমার মনে হয়, মেধাবী ব্যক্তির বেতন কোম্পানি ঠিক করে, আর জিনিয়াস ব্যক্তির বেতন তিনি নিজে ঠিক করেন। ‘বেতন’ কথাটি এখানে রূপকার্থে ব্যবহার করেছি, মানে এই বেতন কেবলই পয়সা দিয়ে মাপা যাবে না।


জিনিয়াসরা ব্যক্তিগতভাবে একটু পাগলাটে গোছের হয়। পাগলাটে, এই অর্থে যে, ওদের কাজকর্ম আমাদের সাধারণ মস্তিষ্কে বা অভিজ্ঞতায় বোধগম্য হয় না। ওদের কোনও নিয়মে বা ব্যাকরণে ফেলা যায় না। কিছু মজার কথা বলি, শুনুন।


বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তাঁর ঘরের দরজা-জানালা খোলা রেখে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে প্রায় এক ঘণ্টা পড়াশোনা ও লেখালেখি করতেন। তিনি এই ব্যাপারটির নাম দিয়েছিলেন ‘এয়ার বাথ’।
সাবেক ইউএফসি লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন বিশ্বতারকা লিয়োটো ম্যাসিডা তাঁর বাবার মতোই প্রতিদিন সকালে ব্রেকফাস্টে ‘ন্যাচারাল মেডিসিন’ হিসেবে নিজের মূত্র নিজেই পান করেন। তিনি মনে করেন, এই অভ্যাসটি তাঁর শরীরকে আবর্জনামুক্ত করতে সাহায্য করে।
ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা স্টিভ জবসের জীবনী পড়ে জানা যায়, স্টিভ জবস সপ্তাহের সাত দিনই ঠিক এক ধরনেরই খাবার খেতেন। গাজর হলে সারাসপ্তাহ কেবল গাজরই খেতেন, আপেল হলে স্রেফ আপেলই খেতেন।
মার্ক জুকারবার্গ সবসময়ই একই রঙের ড্রেস পরেন---ধূসর রঙের টি-শার্ট আর নীলচে জিনস। এই ড্রেস ছাড়া ওঁকে কখনও দেখা যায় না। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি নিজের হাতে শিকার করা ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীর মাংস কখনও খেতেন না।
লিখতে বসার আগে স্টিফেন কিং সবসময়ই চিজকেকের একটা স্লাইস খান। তাঁর ধারণা, এই অভ্যাসটি তাঁকে লিখতে সাহায্য করে।
সুপারজিনিয়াস আর্টিস্ট পাবলো পিকাসোর অসংখ্য প্রেমিকা, বান্ধবী, অনুরাগিণী ও রক্ষিতা ছিল। যৌনতার ব্যাপারে তাঁর তেমন বাছবিচার ছিল বলে জানা যায় না। তার মানে কিন্তু এ নয় যে পিকাসোর মতো ওরকম বেপরোয়া যৌনাচরণ করলেই পিকাসো হয়ে যাওয়া যাবে। অত সোজা হলে আমরা চোখ মেললেই পথে-ঘাটে-হাটে অসংখ্য জিনিয়াস দেখতে পেতাম।
হুমায়ূনকে নিয়ে নানান তর্ক-বিতর্ককে মাথায় রেখেই বলছি, আমাদের পরমসৌভাগ্য যে আমাদের একজন হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন। বাংলাদেশের পাঠকদের সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন এই হুমায়ূনই। একটি বইয়ের স্বত্ব বিক্রি করে তাঁর চাইতে বেশি অর্থ কেউ পেয়েছেন বলে আমরা জানি না। তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে যাঁদের বেশি চুলকানি, তাঁরা সবাই মিলেও কখনও একজন লেখক হুমায়ূন আহমেদের অর্ধেক প্রতিভার সমতুল্য হতে পারবেন না। জিনিয়াসদের কাজের দিকে তাকাতে হয়, ব্যক্তিগত জীবনের দিকে নয়।
অবিশ্বাস্য রকমের জিনিয়াস আর্টিস্ট কিশোরকুমার বিয়ে করেছিলেন চারটি। এ ছাড়াও তাঁর আরও প্রেমের কথা সুবিদিত। সেতারের ঈশ্বরখ্যাত পণ্ডিত রবিশঙ্কর বিয়ে করেছেন দুইটি, প্রেম ও লিভ-ইন করেছেন বেশ কয়েকজনের সাথে। তাঁদের পারিবারিক জীবনও সুখের ছিল না বলেই আমরা জানি। তবু এসব ব্যক্তিগত বিষয় তাঁদের কিংবদন্তিতুল্য শ্রেষ্ঠত্ব থেকে কণামাত্রও বিচ্যুত করতে পারেনি। অবশ্য, ওঁদের প্রতি নারীরা আকৃষ্ট হবে, এটাই তো স্বাভাবিক! মেয়েরা ওঁদের প্রেমে পড়বে না তো কি আপনার আমার মতো প্রতিভাশূন্য মানুষের প্রেমে পড়বে নাকি? আচ্ছা, ভাবুন তো, সাধারণ কাউকে চারশো বিয়ে করার 'সুযোগ' দিলেও কি তাঁদের পায়ের ধুলোর সমানও হতে পারবে সে কখনও? আসলে একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনাচরণের সাথে তার কীর্তির কোনও সম্পর্ক নেই। জিনিয়াসদের এই এলোমেলো জীবন পৃথিবী সহ্য করে আর হাসিমুখে মেনে নেয়, বাকিদের ক্ষেত্রে ছিঃ ছিঃ করে।


বহু দিন ধ'রে বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে…
এই কবিতাটি মাথায় নেই, এমন শিক্ষিত বাঙালি তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কবিতাটি সৃষ্টি হবার গল্পটা জানা যাক।
বালক সত্যজিৎ একবার সকালে মায়ের সাথে শান্তি নিকেতনের ‘উত্তরায়ণ’-এ গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করতে। সাথে ছিল একটি অটোগ্রাফের খাতা। খাতাটি এগিয়ে দিতেই রবীন্দ্রনাথ বলেলন, ‘এটা থাক আমার কাছে, কাল সকালে এসে নিয়ে যেয়ো।’ পরের দিন কথামতো গেলেন সত্যজিৎ। গিয়ে দেখলেন, টেবিলের উপর চিঠিপত্র, লেখার খাতা, ডায়রি ছড়িয়ে ছিটিয়ে, পেছনে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। বালক সত্যজিৎকে দেখেই বেগুনি রঙের খাতাটি খুঁজতে লাগলেন। মিনিট তিনেক হাতড়ানোর পর বেরোল খাতাটি। সেটি সত্যজিতের হাতে দিয়ে তাঁর মাকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘এটার মানে ও আরেকটু বড়ো হলে বুঝবে।’ সেই খাতায় লেখা ছিল আট লাইনের এই বিখ্যাত কবিতাটি। একজন জিনিয়াসের ‘অটোগ্রাফ’ দিয়েই সাহিত্যের এমন মহৎ একটা সৃষ্টি হয়ে যায়! তাঁদের পায়ের ধুলোর কাছে থাকতে পারাটাও জীবনের অনেক বড়ো একটি সৌভাগ্য!


অমন একটি সৃষ্টি করতে আমাকে আপনাকে কয়েক যুগ চেষ্টা ও সাধনা করার সুযোগ দিলেও কি পারতাম আদৌ অমন কিছু করে দেখাতে? সাধনায় মেধাবী হওয়া যায় হয়তো, কিন্তু জিনিয়াস হওয়া যায় না। জিনিয়াসরা জন্মায়। রবীন্দ্রনাথের মতো স্কুলে না গেলে আমরা কেউই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হয়ে যেতাম না, বড়োজোর কুলিমজুর বা রিকশাওয়ালা হতে পারতাম।


এবার আসি আমার পরিচিত এক ব্যক্তির প্রসঙ্গে। চাকরিসূত্রে আমার বস, আমার একজন অ্যাডিশনাল কমিশনার মহোদয়ের সাথে একদিন সিনেমা নিয়ে গল্প করছিলাম। স্যার সিনেমা দেখতে অনেক ভালোবাসেন। তো কথা বলতে বলতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, আপনি রান্না করতে পারেন?’ তিনি আমাকে উত্তরটা দিয়েছিলেন এভাবে: ‘সুশান্ত, আমি রান্না করতে পারি না, আমি খুব ভালো রান্না করতে পারি। আমি আমার পরিচিত যে-কোনও মহিলার চাইতেও অনেক ভালো রাঁধতে জানি।’ এটি অক্ষমের অহংকার নয়, এটি সক্ষমের আত্মবিশ্বাস। আরও জানতে পারলাম, স্যার দারুণ রাঁধতে জানেন এবং এই কাজে তিনি অনেক আনন্দ পান। আপনি কোনও একটি কাজ ভালোভাবে করতে পারেন, এর মানে হলো, সে কাজটি করতে আপনার অনেক ভালো লাগে। মূলত নিজের প্যাশনের প্রতি আন্তরিকতা ও ক্রমাগত চর্চাই মানুষকে জিনিয়াস করে গড়ে তোলে।


জিনিয়াসদের তাঁদের মতো করে থাকতে দিতে হয়। তাঁদের নিজেদের মতো পাগলাটে, অগোছালো এবং অদ্ভুতুড়ে অভ্যেসে জীবনযাপনের সুযোগ দিতে হয়। তাঁরা আসলে তাঁদের এমন পাগলামি এবং আজব কাণ্ডকারখানার মধ্য দিয়েই নিজস্ব বলয়ে সৃষ্টিশীলতার চর্চা করেন। এর অন্যথায় হলে তাঁদের সৃষ্টি করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এটা পৃথিবীর জন্য অনেক বড়ো একটা ক্ষতি। জিনিয়াসদের পাগলাটে জীবনযাপন থেকে ফিরিয়ে আনার কারণে কত জিনিয়াস যে হারিয়ে গেছেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন, পৃথিবীর ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। জিনিয়াসদের তাঁদের মতো করে বাঁচতে বাধা দিলে এর প্রভাবটা যেমনি তাঁদের কাজেকর্মে এবং সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষভাবে পড়ে, ঠিক তেমনি তাঁদের ব্যক্তিজীবনেও এর ভয়ানক প্রভাব দেখা যায়। কাজের প্রবাহে ও জীবনযাপনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে জিনিয়াসরা তাঁদের ভেতরে রাগ পুষতে থাকেন। অবশেষে সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁদের ব্যক্তিজীবনের কাছের মানুষদের উপর। কাছের মানুষদের সাথে অনবরত রাগ বা অভ্যন্তরীণ ক্ষোভের চরম প্রভাবে জিনিয়াসরা ব্যক্তিজীবনে সাধারণত সুখী হন না। তাঁদের বোঝেন, এমন মানুষ সত্যিই বিরল। তাই প্রায়ই দেখা যায়, একজন জিনিয়াস ব্যক্তিজীবনে প্রচণ্ড অসুখী একজন মানুষ।


জিনিয়াসদের কোনও ব্যাকরণ নেই। সাধারণ বুদ্ধিতে ওঁদের আচরণ ও ভাবনা নিয়ে অনুমানেও পৌঁছানো সম্ভব নয়। আমাদের ভাবনার ফ্রেমে একজন জিনিয়াসকে কোনওভাবেই বাঁধা যায় না। সে চেষ্টা করার মানেই হলো, তাঁর প্রতি অবিচার করা। আচ্ছা, অত বিশ্লেষণে না যাই। অতটা মাথায় কুলোয়ও না। সাধারণভাবে বলি, এ জগতে বেঁচে থাকার সবচাইতে শান্তিপূর্ণ উপায়টা হচ্ছে, নিজের মতো করে বাঁচা, এবং অন্যকে তার নিজের মতো করে বাঁচতে দেওয়া। কেউ যদি কারও কোনও ক্ষতি না করে বাঁচে, তবে সে যেভাবেই বাঁচুক না কেন, তা নিয়ে জাজ করার, কানাঘুষা করার, গবেষণা করার কোনও মানেই হয় না। অন্যদের ব্যক্তিগত জীবনাচরণ নিয়ে পড়ে থাকে একমাত্র অপদার্থরাই। কারও পেছনে লাগলে তার চাইতে এগিয়ে যাওয়াটা অসম্ভব, অসম্ভব এবং অসম্ভব! বেঁচে থাকার জন্য মাত্র একটাই জীবন পেয়েছি আমরা। সে জীবনটাকে সুন্দরভাবে কাটাতে পারার চাইতে সৌভাগ্য আর কী আছে?