জীবনের আরও কিছু পাঠ

যে ফোনটা দেয়ার আগেই বেলা বোস আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে বিনা কারণে, সে ফোনের বিলটা (হোক সামান্য) বাঁচিয়ে দেয়ার জন্য হলেও তো বেলা বোস একটা ধন্যবাদ পেতেই পারে! যে বেলা বোস এমনিই চলে যায়, সে বেলা বোস কখনওই আপনার ছিল না। ও যতদিন ছিল, তার প্রত্যেকটা দিনই ছিল একটা দুঃস্বপ্নের সাথে অনর্থক সহবাস। যে আপনাকে বোঝেই না, তাকে বোঝার কীসের দায় আপনার? এতো চোখের জল কোত্থেকে আসে? ওইরকম জলপ্রপাতমার্কা চোখ দিয়ে এই জাতি কী করিবে? যে আপনার জন্য নয়, সে আপনাকে ছেড়ে চলে যাবেই যাবে; আগে, কিংবা পরে। যত আগে যায়, ততই মঙ্গল। আরেকজনের বউকে দিনের পর দিন পাহারা দেয়ার কোনও মানে হয়? আপনার কাজকাম নাই? লজ্জা নাই? আত্মসম্মানবোধ নাই? হুদাই! আপনি কি ব্যাংকার, নাকি কাস্টমস অফিসার যে অন্যের ‘সুন্দরী বউকে’ (পড়ুন, ‘ধনসম্পদকে’) নিষ্ঠার সাথে পাহারা দেয়ার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন? ওরা তো তাও বেতন পায় ওই কাজ করে, আপনি কী ঘোড়ার ডিমটা পান, শুনি? ফ্রেন্ডদের একটা ব্রেকআপ পার্টি দিয়ে দিন না! বেচারারা কতদিন ভালমন্দ খায় না! ব্রেকআপ পার্টির খাবারের টেস্টই আলাদা! আইসক্রিম থেকেও পোড়া কাবাবের মন মাতালকরা গন্ধ বের হয়!

কারওর কথা মাথায় নিয়ে মেজাজখারাপ হচ্ছে? কারওর কাজে বিরক্ত হচ্ছেন? আপনি যা করছেন, কিংবা করছেন না, সেসব নিয়ে অহেতুক কথা বলে আর ছড়িয়ে কেউ আপনার মেজাজ আর মন, দুটোই খারাপ করে দিচ্ছে? নিজের কাজগুলি ঠিকভাবে গুছিয়ে করতে পারছেন না? মাথার সবকটা চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে? একটু থামুন! আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আপনি আসলে কার কথা কেয়ার করবেন? আমার তো মনে হয়, শুধু এ তিন ধরনের লোকেরটা করলেই হয়: এক। যারা আপনাকে নিয়ে বলার যোগ্যতা রাখে, মানে, আপনার সমকক্ষ কিংবা আপনার চাইতে বেটার। দুই। যাদের না-থাকায় আপনার কিছু এসে যায়। তিন। যারা আপনার ভাল চায়। …………. আপনাকে নিয়ে যারা বাজে কথা বলে, তারা আপনার ভাল চায় না। আমি দেখেছি, যারা না থাকলে জীবনটা এতো সুন্দর হতো না, তারা আমার জন্য ভালকিছু ভাবা আর করার কাজে এতোটাই ব্যস্ত যে, আমাকে নিয়ে বাজেকিছু ভাবার, বলার কিংবা করার সময়ই তারা কখনওই পায়নি। আপনাকে বুঝতে হবে, কে আপনাকে পরোয়া করে, কে করে না; আর যারা করে, তাদের মধ্যে কজন আপনার ভাল চায়। বিধাতা এমন কাউকেই এ পৃথিবীতে পাঠাননি, যে আপনাকে পরোয়া করে না, অথচ আপনার জন্য অপরিহার্য। বস্তুত, পৃথিবীতে আপনি নিজে ছাড়া আর কেউই আপনার জন্য অপরিহার্য নয়। আপনার ভাল একজন বন্ধু, ওকে ভরসা করে আপনি একটা কথা বললেন। দেখা গেল, পরবর্তীতে সে কথা নিয়েই ও আপনাকে বিভিন্ন জায়গায় হেয় করছে। অমন বন্ধু আপনাকে পরোয়া করে ঠিকই, কিন্তু আপনার ভাল চায় না। আপনার ভাল চায় যারা, তাদেরকে সময় দেয়ার অভ্যেস করেই দেখুন না! দেখবেন, বাজে লোকদের সময় দেয়ার মতো সময়ই থাকবে না। জীবনটা ছোট তো! সময় ভীষণ কম! যে কটা দিন বাঁচব, একটু ভালভাবেই নাহয় বাঁচি! বাজে লোকের সাথে ভালভাবে বাঁচা সম্ভব নয়। যে লোক অন্যকে হেয় করে, অসম্মান করে, সে আবার ভাল হয় কীকরে? ফালতু বাজে লোকের সঙ্গ ক্ষণিকের সুখ দিলেও জীবনটাকে অর্থহীন করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি এ জীবনে কখনওই কোনও বাজে লোককে বড় হতে দেখিনি। বাজে লোকমাত্রই ছোটলোক। একজন বড় মানুষের পায়ের কনিষ্ঠার নখের কণার যোগ্যতাও একটা ছোটলোকের নেই। বাজে লোকরা সুন্দর করে ভাবতে জানে না, সুন্দর কাজ করার কোনও সামর্থ্যই নেই ওদের। জীবনে নিচে নামতে চাইলে নিচু লোকদের সাথে মিশুন, উপরে উঠতে চাইলে ওদের সঙ্গ এড়িয়ে চলুন। জীবনটাকে কীভাবে কাটাতে চান, সে পছন্দ সম্পূর্ণই আপনার! সস্তা লোকের সাথে চলে দামি জীবনের স্বাদ পাওয়া যায় না।

বাজে লোকদের একমাত্র পরিচয়, ওরা বাজে। এখন বাজে কিছুকে আপনার জীবনে আসার সুযোগ দেবেন কিনা, সেটা আপনার ব্যাপার। আরেকটা কথা। বাজে’র অনেক রকমফের আছে। শিক্ষিত বাজে, উচ্চশিক্ষিত বাজে, সফল বাজে, সুশীল বাজে, ধনী বাজে, সুশ্রী বাজে, ভণ্ড বাজে, এরকম আরও অনেক যাদেরকে চেনা যায় না সহজে। একজন মানুষ শিক্ষা আর সাফল্যের শীর্ষে, এটা দিয়ে আপনার কী? ভেবে দেখুন, সে ভালমানুষ কিনা। ওরকম না হলে দিন না লাইফ থেকে ব্লক করে! এই কাজটি এই মুহূর্তেই করা শুরু করে দিন। শুরুটা করবেন ৫জন বাজে পণ্ডিত ও জাগতিকভাবে সফল ঈর্ষাকাতর লোককে দিয়ে। বিশ্বাস করুন, ওদের চাইতে রাস্তার আবর্জনাও উত্তম। নিজের চাইতে বেশি সম্মান পৃথিবীর আর কাউকেই করবেন না। বাজে কাউকে লাইফ থেকে ব্লক করে প্রমাণ করুন, ওকে পরোয়া না করে চলার শক্তি আপনার মধ্যে আছে। অন্যের ক্ষমতাকে পরোয়া না করে চলার আর্টটা রপ্ত করার প্রাথমিক ধাপই হচ্ছে, নিজের ক্ষমতাকে এতোটাই বৃদ্ধি করা যাতে চলতে গেলে ওকে না লাগে। নিজের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিন, নিজেকে ক্রমাগত আঘাত করতে-করতে বারুদের মতোই বেপরোয়া করে তুলুন। বিনীতের কাছে বিনয় দেখান, দুর্বিনীতের কাছে দুর্বিনয়। পেশী নয়, মগজ দিয়ে লড়াই করতে শিখুন। আর দেরি নয়, এখুনিই শুরু করুন, শুরু করুন, প্লিজ শুরু করুন আপনার লাইফে ব্লকলিস্টটা ভারি করার কাজ! ব্লক করে দিতে পারার অহংকারের মধ্যে আলাদা এক ধরনের শক্তি আছে। যাদের উপস্থিতি আপনাকে ভাল থাকতে দেয় না, তাদেরকে দূরে রেখে ভাল থাকার প্র্যাকটিস করুন। পৃথিবীর কেউই আপনার ভালথাকার দায়িত্ব নেবে না, ওই দায়িত্ব সম্পূর্ণই আপনার। আপনার আশেপাশে থাকতে দিন রাশি-রাশি শান্তি। অশান্তিদের দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দিন। শান্তিরা বাইরে সুন্দর, অশান্তিরা ব্লকলিস্টে। জীবাণু ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই জীবাণুকে কোয়ারান্টাইন করে দিতে হয়। এটাই ভালথাকার নিয়ম। কষ্টকে বহন করতে হয় না, কষ্টকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পথ চলতে হয়। যে মানুষ জেনেবুঝেই কষ্টকে বহন করে, সেটা থেকে বেরিয়ে না-আসার বিলাসিতা দেখায়, একটাসময় পর নিয়তি কষ্টের সাথেই তার জীবনকে বেঁধে ফেলে। সেদিন এক প্রচুর পড়াশোনাজানা উচ্চ প্রতিষ্ঠিত নিম্ন চিন্তাভাবনার ঈর্ষাপরায়ণ আমলাকে ফ্রেন্ডলিস্টে রাখবো কী রাখবো না, কিছুদিন ভাবতে-ভাবতে অবশেষে আনফ্রেন্ড করার পর উনি আমাকে ইনবক্সে নক করলেন। “আপনি আমাকে আনফ্রেন্ড করেছেন?” “হ্যাঁ দাদা।” “আমাকেও করলেন? আপনি এটা করলেন কীভাবে? ভাল, ভাল!” “ওরকমই দাদা। আপনি আমার প্রোফাইলে গেলে ব্যাপারটা শিওর হতে পারবেন। দেখবেন, ‘অ্যাড ফ্রেন্ড’ কথাটি দেখায়। এর মানে হল, আমি আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই।” আসলে আমি ভাবি, কী দরকার? যে যার জায়গা আর ভাবনা থেকে ঠিক। আরেকজনের ভাবনার জন্য আমি আমার শান্তিকে নষ্ট হতে দেবো কেন? অন্যকারওর বাজে মানসিকতার দায় কেন আমি নেবো? হতে পারে, উনি অনেক বড় মানুষ, কিন্তু উনি আমার জন্য তেমন কেউই নন। ফেসবুকে আমি এখনও পর্যন্ত এমন একজনকেও পাইনি, যাকে ফ্রেন্ডলিস্টে রাখতেই হবে, যাকে ফলো করতেই হবে, যাকে আনফ্রেন্ড করা যাবেই না, যাকে ব্লক করা যাবেই না। আমি কারওর জন্যই অপরিহার্য নই, কেউই আমার জন্য অপরিহার্য নয়—এটা মাথায় রেখে ফেসবুক ব্যবহার করুন, নিজের জীবনটা কাটান। দেখবেন, আগের চাইতে অনেক-অনেক ভাল আছেন, শান্তিতে আছেন।

জ্বলে? পানি ঢালেন। চুলকায়? পেভিসোন লাগান। ঈর্ষা করে কিংবা আজেবাজে কথা বলে জ্বলা কমে না, চুলকানি কমে না। নর্দমার কীটের জন্ম, বৃদ্ধি, মৃত্যু—৩টিই নর্দমাতে। কীট সারাজীবন কীটই থাকে। কীটের মতো বাঁচবেন কিনা, সে রুচি আর সিদ্ধান্ত আপনার।

ভুল জায়গায় ফালতু কথা বলে নিজের চুলকানির জ্বালা কমানোর চেষ্টা করার চাইতে ঠিক জায়গায় পেভিসোন লাগিয়ে আরোগ্যলাভই উত্তম পন্থা।

আপনি কি জানেন, পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে, আপনি যাদের কথা পাত্তা দিলে, যাদের সাথে ‘দয়া করে’ যুদ্ধ করলে, যাদের কাজে নিজের মনখারাপ করলে, ওরা তখুনিই জাতে উঠে যায়? লড়াইটা হতে হয় সমানে-সমানে। আপনি ওদের কথা অগ্রাহ্য করার মানেই হলো, ওদেরকে আপনি আপনার সাথে লড়াইয়ের যোগ্যই মনে করছেন না। এতে ওরা মুখে স্বীকার না করলেও মনে-মনে অনেক কষ্ট পায়। এ পৃথিবীতে পাত্তাহীনতায় কেউই বাঁচতে চায় না। ওদের পর্যায়ে নিজেকে নামাবেন না। আপনার অবস্থান ও মানসিকতা ওদের চাইতে অনেক উপরে। কেন ওদের ওরকম অবস্থান ও মানসিকতায় নিজেকে অহেতুক কষ্ট দিচ্ছেন? ওদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানার সময়টুকুও আপনার নেই, এমন একটা ড্যাম কেয়ার ভাব দেখিয়েই দেখুন না কী হয়? আপনি খুব সহজেই ওদেরকে আরও বিব্রত করে দিতে পারবেন। মানুষকে তার অবস্থান দিয়ে নয়, মানসিকতা দিয়ে গ্রহণ কিংবা বর্জন করুন। শুয়োর দেখেছেন না, শুয়োর? ওরা কোথায় থাকে? নোংরায়। ওদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার একমাত্র নিয়মই হল, ওরা যেখানে থাকে, সেখানে, মানে নোংরায় নেমে যুদ্ধ করতে হবে। কারণ ওরা তো আপনার জায়গায় এসে যুদ্ধ করতে পারবে না, ওদের সে ক্ষমতাই নেই। নামলেন নোংরায়, করলেন যুদ্ধ। ধরুন, জিতেও গেলেন। মানুষের কাছে শুয়োরের পরাজয়। শুয়োরের কাছে এ পরাজয় গ্লানির নয়, গৌরবের। কেন? নিজের শরীর নোংরা না করে শুয়োরের সাথে যুদ্ধে জেতা অসম্ভব। শুয়োরের সাথে লড়াই করে ওর কাতারে নেমে আপনি স্বেচ্ছায় শুয়োরকে সম্মানিত করলেন। আপনি হয়ে গেলেন শুয়োরের সাথে লড়াইয়ে জিতে-যাওয়া শুয়োরের মতোই নোংরা একজন মানুষ। শুয়োরের প্রমোশন হল মানুষে, মানুষের ডিমোশন হল শুয়োরে। শুয়োর বুদ্ধিমান, তাই খুশি। আপনি বেকুব, তাই খুশি। উইন-উইন সিচ্যুয়েশন! শুয়োরের অন্যতম কাজ, ওর নোংরা আপনার গায়ে লাগানোর ক্রমাগত চেষ্টা করে যাওয়া। যদি ও এ কাজে জিতে যায়, তবে ওর লাভে লাভ! ওর জাতভাই আরেকটা বাড়ল। আমার অভিজ্ঞতা বলে, ওরকম ১ লক্ষ শুয়োরেরও ক্ষমতা নেই মেধা আর প্রজ্ঞায় আপনার ধারেকাছেও আসার। অর্থাৎ, আপনি তো জিতেই আছেন! কী দরকার ওকে হারানোর নেশায় নিজেকে হারিয়ে দেয়ার? কখনও-কখনও লড়াইয়ে জেতার সবচাইতে ভাল উপায়টি হচ্ছে, লড়াইয়েই না নামা! বুদ্ধিমানরা লড়াই করে জিতে, জ্ঞানীরা লড়াই না করেই জিতে।

কারওর কাছ থেকে দোয়া চেয়ে কী লাভ? তার চাইতে এমন কাজ করুন যাতে আপনার জন্য দোয়াটা উনার মন থেকে এমনিই আসে। যদি দেখেন, আপনাকে লোকে সম্মান করছে না, আরেকজনকে করছে, তার মানে, আপনি এমনকিছু করতে পারছেন না, যেটা দেখে আপনাকে সম্মান করা যায়। আরও সহজ করে বললে, আপনাকে সম্মান করার কিছু নেই। সারাদিন রাস্তাঘাটে বসে-বসে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে কিংবা ‘সম্মান করবি কি না বল!’ টাইপের জেদ থেকে যদি জোর করে সম্মান আদায় করা যেত, তাহলে তো আর কোনও কথাই ছিল না! যারা জীবনে কিছু করে দেখাতে পারে না, মুখ আর পেশির জোরেই দুনিয়া কিনতে চায়, ওদেরকেও লোকে থুতু না ছিটিয়ে উল্টো সম্মান করতো। এখনও দেখলাম নাতো ওরকম কাউকে সম্মান পেতে! ওরা রাস্তার ভিক্ষুকদেরও করুণার পাত্র। যে প্রেমিক তার প্রেমিকার একটাও প্রেমপত্র পায় না, নিশ্চয়ই সে প্রেমিকের মধ্যে এমনকিছু নেই, যেটার জন্য ওকে একটা প্রেমপত্র লেখা যায়। ওরকম একখানা পত্র লিখে সময় নষ্ট করার কথা প্রেমিকার মাথায়ই আসেনি কোনওদিন। প্রেমিকার নিশ্চয়ই মনে হয়েছে, অমন প্রেমিকের কাছে প্রেমপত্র লেখার চাইতে একটি নিষ্পাপ ছাগলছানার মুখে দুগাছি কচি ঘাস তুলে দেয়া সময় কাটানোর পক্ষে অধিক স্বস্তিদায়ক। প্রেমিকার প্রেমপত্র পাওয়ার মতো যোগ্য হওয়ার চেষ্টা না করে প্রেমপত্র অপ্রাপ্তির শোকে আর ক্ষোভে প্রেমিকাকে ‘প্রেমপত্র দিবি কি না বল!’ জাতীয় ভয়ভীতি দেখায় যে প্রেমিক, সে প্রেমিকপুরুষ নয়, আস্ত একটা বলদপুরুষ! আমার কাছে, বলদের কথামাত্রই হাম্বারব!

ভাবুনতো, সাহিত্যের কোন ছাত্রটিকে ভাল সাহিত্য লিখতে দেখেছেন? হাতের আঙুলের কড়ে গুনতে থাকুন! সংখ্যাটি খুব বেশি হবে না। যে দেশে অন্যকোথাও চান্স না পেয়ে স্টুডেন্টরা সাহিত্য নিয়ে পড়ে, সে দেশে সাহিত্যের গ্র্যাজুয়েটদের কাছ থেকে সাহিত্য আশা করা যায় না। সরস্বতী সবার উপর ভর করেন না, অসুরের উপর তো নয়ই! সরস্বতীর কৃপা পেতে চাইলে অসুরের জীবন থেকে বেরিয়ে আসুন। সাধনার প্রথম ধাপই হচ্ছে বিনয়। খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, সাহিত্য নিয়ে অগাধ জ্ঞান থাকলেই সাহিত্য লেখা যায় না। শব্দ তো আর কাঁঠালপাতা নয় যে, চাইলেই চিবিয়ে খেয়ে হজম করে ফেলা যাবে! শব্দগুলিকে জোর করে টেনে আনা যায় না, সুন্দরসূক্ষ্ম অনুভূতিতে শব্দরা আপনিই ধরা দেয়। গান তো অনেকেই শেখেন, কৌশিকীর মতো করে গাইতে পারেন কজন? কেন পারেন না? পৃথিবীর সবচাইতে বাজে অনুভূতির মানুষগুলি অপরকে ঈর্ষা করে, অপরের গীবত করে, অপরের ক্ষতি করে। অমন অনুভূতি নিয়ে আর যা-ই হোক, এমনকিছু করা সম্ভব নয়, যেটা অন্য ১০টা আলাদা করে চোখে পড়ে। আপনি যতবেশি ওরকম অক্ষম বাজে মানুষকে নিজের জীবনের আশেপাশে ঘেঁষতে দেবেন, আপনি ততবেশি নিজের অবচেতনেই ওদের বেশ কিছু বাজে জিনিস নিজের মধ্যে ধারণ করে ফেলবেন। গ্রেট আর্টিস্টরা কাজ করেন মাথা নিয়ে নয়, অনুভব দিয়ে, হৃদয় দিয়ে। আপনার ভাল দিকগুলির যত্ন নিন। দেখবেন, ওরাই আপনাকে ভাল রাখবে। একটু গভীরভাবে ভেবে দেখুন, আপনার কোন দিকটির জন্য আপনি অনন্য। সেটির সর্বোচ্চ যত্ন নিন। পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা দিয়ে আমি এই পর্যন্ত কাউকেই অনন্য হতে দেখিনি। যার মধ্যে ন্যূনতম যোগ্যতা আছে, সেও ওসব করতে পারে। স্রেফ আপনার রেজাল্ট, আপনার চাকরি কিংবা ব্যবসায় উন্নতি দিয়ে আপনাকে আলাদা করে মনে রাখার কিছু দেখি না। বুদ্ধদেব গুহ নমস্য চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে নয়, লেখক হিসেবে। অন্নদাশঙ্কর রায় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন, এই তথ্যটি মাথায়ই তো রাখতাম না যদি লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়কে না চিনতাম! আর্ট নিয়ে অশোক মিত্রের অসামান্য লেখাগুলি পড়ার সময় কার মাথায় থাকে, ভদ্রলোক একজন বিখ্যাত আইএএস অফিসার ছিলেন? সমরেশ মজুমদার ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের থার্ডক্লাস চাকুরে ছিলেন, অথচ সেই ডিপার্টমেন্টের সকল অধিকর্তাকে এক করলেও একজন সমরেশ মজুমদারের সমান তো দূরে থাক, ধারেকাছেও কিছু হবে না। যদি বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একজন শিক্ষকের নাম বলুনতো, তবে বেশিরভাগ লোকই বলবে হুমায়ূন আহমেদের নাম। অথচ, উনি বেশি পরিচিত শিক্ষক হিসেবে নয়, লেখক হিসেবে, ফিল্মমেকার হিসেবে; যিনি ‘আগুনের পরশমণি’ বানাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন সেইদিন যেইদিন তাঁর সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে প্রমোশন হওয়ার কথা ছিল। ব্যাপারটা মজার না? এর মানে কী দাঁড়াল? লোকে আপনাকে মনে রাখে আপনার যা পারার কথা নয়, কিন্তু পারেন এবং খুব ভালভাবে পারেন, তার জন্য। শুধুই পড়াশোনা দিয়ে কিছু হয় না। সারাজীবনই স্রেফ পড়াশোনা করে আর তাক লাগিয়েদেয়া রেজাল্ট করে অমর হয়েছেন, এমন লোকের সংখ্যা হাতে গুনে বলে দেয়া যায়। সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না। শ্রীকান্তের পরিবারের ইচ্ছে ছিল শ্রীকান্ত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে জয়েন করবে, নামকরা আইসিএস অফিসার হবে। আমাদের পরম সৌভাগ্য, শ্রীকান্ত তা করেননি। বরং, উনি যা ভাল পারতেন, সেটার যত্ন নিয়েছেন, সাধনা করে গেছেন। একজন আর্টিস্ট শ্রীকান্ত আচার্য একলক্ষ অফিসার শ্রীকান্ত আচার্যের চাইতে অনেক বড়। একজন জিনিয়াস দেশকে যা দিতে পারেন, একলক্ষ দক্ষ মানুষ তার অর্ধেকও দিতে পারেন না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকেই ইঞ্জিনিয়ার পাস করে বেরিয়েছে। ওদের কাকে আমরা চিনি? ওদের ডিগ্রিতে আমাদের কার কী এসে যায়? ইতিহাস কার কথা লিখে রেখেছে? অথচ যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ চুকানোর আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন, সেই ব্যর্থ ননগ্র্যাজুয়েটটিই লক্ষলক্ষ গ্র্যাজুয়েটকে ম্লান করে দিয়ে আমাদের হৃদয়ে বেঁচে আছেন, থাকবেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর Glimpses of World History পড়ে দেখুন। অপরিণত বয়সের বালিকা ইন্দিরা পিতা নেহরুর কাছ থেকে বিশ্ব ইতিহাসের যে পাঠ পেয়েছিলেন সেই ছোটবেলাতেই, সে মেয়ে বড় হয়ে গ্রেট হবে না তো আমাদের মতো সাধারণ চিন্তাভাবনার মানুষ গ্রেট হবে? যারা গ্রেট, তাদের অনেকগুলি গুণের একটি হল, উনারা অর্ডিনারি এবং এক্সট্রাঅর্ডিনারির মধ্যে যে পার্থক্যগুলি আছে, সেগুলি দীর্ঘদিনের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত চর্চার মাধ্যমে বুঝতে পারেন। গ্রেটদের চিন্তাগুলি অবশ্যই আমাদের চিন্তা থেকে ভিন্ন। ওগুলি নিয়ে না ভাবলে, না জানলে, চর্চা না করলে নিজেকে উন্নত করা সম্ভব নয়।

যে মানুষটা সারাজীবনই বাজে লোক হয়ে বাঁচে, সে মানুষটা মৃত্যুর সময়ও বাজে লোক হয়েই মরে। আপনিই ঠিক করুন, বাজে হয়ে বাঁচবেন কি না, বাজে হয়ে মরবেন কি না। বাজে চিন্তার মানুষগুলি নিজেরাও বাজে, অন্যদেরকেও বাজে করে দেয়। ওদের হাত থেকে নিজেকে মুক্তি দিন। এখুনিই! মানুষের সবচাইতে বড় দুর্বলতা, মানুষ নিজের জায়গাটাই বুঝতে পারে না। অন্যদের কথা শুনে নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ঈশ্বর সবাইকে সবকিছু দেন না, ঈশ্বর যোগ্যতা বুঝে সৌভাগ্যদান করেন। নিজেকে আগে যোগ্য করে তুলুন, এরপর সৌভাগ্যের কথা ভাবুন। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে যারা, তাদেরকে ঈশ্বর সারাজীবনই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগ করে দেন। Small people fight for small things. মজার ব্যাপার হল, ছোটলোকরা বুঝতেই পারে না, কোনটা তুচ্ছ, কোনটা তুচ্ছ নয়। যে মানুষ তুচ্ছকেই বড় করে দেখে জীবন কাটিয়ে দেয়, সে মানুষ কোনওদিনই বড় কিছুর স্বাদ পায় না। ছোটলোক ছোটকাজে আনন্দলাভ করে। অসুস্থ ব্যক্তিত্বের মানুষ অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড় ভাবতে পছন্দ করে। জানি, এতেও আনন্দ আছে। জগতটাই তো আনন্দের জন্য। তবুও, সবকিছুতেই আনন্দিত হয়ে ওঠা কোনও কাজের কথা নয়। সবকিছু থেকেই আনন্দনেয়া থেকে যে করেই হোক, নিজেকে সরিয়ে রাখুন। রাস্তায় ছিন্ন পোশাকের ভিখারিনীর গ্লানিতেও তো কেউ-কেউ এক ধরনের সুখ অনুভব করে। সুখানুভবের ধরন দেখে মানুষ চেনা যায়। নিজের রুচি, ভাবনা আর মানসিকতাকে সুন্দর করে তুলতে পারলে আপনার কাজগুলি অন্য দশজনের কাজ থেকে আলাদা করে চোখে পড়বে। অন্যথায়, আপনিও স্রেফ জীবনটাকে টেনেহিঁচড়ে-নিয়ে-যাওয়া একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নন!