টিউশনি ছেড়ে দেওয়ার গল্প

স্টুডেন্টলাইফে পাবলিক পড়াশোনার পাশাপাশি সময় বের করে টিউশনি করে, আর আমি টিউশনির পাশাপাশি সময় পেলে পড়াশোনা করতাম। আমার নিজের কোচিং সেন্টার ছিল। পলস্ কোচিং হোম। ক্লাস নাইন থেকে অনার্স পর্যন্ত পড়াতাম। একেবারে সকাল থেকে রাত অবধি। ননস্টপ কথা বলতে হতো! চুয়েটে অতো ক্লাসটাস করতাম না। আমি পড়াতে অসম্ভব রকমের ভালোবাসতাম। আমি যা জানি, তার সর্বোচ্চটুকু দেয়ার চেষ্টা করতাম। অনেক-অনেক বেশি ডেডিকেটেড ছিলাম পড়ানোর ব্যাপারে। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে, কম ঘুমিয়ে স্টুডেন্টদের জন্য কঠিন-কঠিন নোট, লেকচার শিট তৈরি করার ক্ষেত্রে কী পরিমাণ যে পরিশ্রম করতাম, সেটা এখন ভাবলেও আমি অবাক হই। আমি সত্যিই মনে করতে পারি না, সে সময় কোন যাদুর জোরে অমন অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারতাম! প্রতি শুক্রবার সকালে বাংলা সাহিত্য পড়াতাম আর বিকেলে আইবিএ’র বিবিএ ভর্তি পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্য ক্লাস নিতাম। একেবারে টপ লেভেলের গ্রামাটিক্যাল এক্সারসাইজ আর ভোকাবুলারির শিট রেডি করে স্টুডেন্টদের সলভ করাতাম। ইন্টারের স্টুডেন্টদের সায়েন্সের অন্তত ৩-৪টা বই সলভ করতাম, যাতে ওরা ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিক্যালে চান্স পায়। (খুব প্রফেশনাল ছিলাম, তবে কখনও কমার্শিয়ালি পড়িয়েছি, এটা আমার কোনও স্টুডেন্ট বলতে পারবে না।) তখন মনে হতো, এতোগুলো মুগ্ধ চোখ আমার দিকে ক্লাসে তাকিয়ে আছে, আমার স্টুডেন্টরা কতো ভাল রেজাল্ট করছে, দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করছে, এটা পৃথিবীর সবচাইতে আনন্দের বিষয়। এই এক খুশিতেই জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। জীবন তো এখানেই! আমার মতো সুখী আর কে আছে?

২০০২-২০১১। দীর্ঘসময়। লিখতে গেলে অনেক কথা লিখতে হয়। (কখনও সময় পেলে সময় নিয়ে লিখবো, দেখি।) আড্ডার দেয়ার সোনালি সময়টা কীভাবে যে ‘নষ্ট’ করেছি পড়ে আর পড়িয়ে সেটা ভাবলে এখনও আফসোস হয়। অতোটা কষ্ট কোনও স্বাভাবিক মানুষ করতে পারে স্রেফ আনন্দের জন্য, এটা মাথায় এলেও এখন বিশ্বাস হতে চায় না। অনেক পড়াশোনা করে স্টুডেন্ট পড়াতাম। ওদের সিলেবাসের বইগুলো অন্তত কয়েকশ’বার আমার নিজেরই পড়া হয়ে গিয়েছিল। ওদের বেসিক স্ট্রং করার জন্য যেভাবে পড়াতাম, সেটা ছিল ওদের জন্য রীতিমত টর্চার। প্রচুর এক্সট্রা ক্লাস নিতাম। বেতন নিতাম অন্যান্য কোচিং সেন্টারের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। (ঠিকমতো পড়াশোনা না করলে প্রচুর বকাঝকা করতাম, বেত দিয়ে মারতাম। প্রতি মাসেই কিছু অমনোযোগী স্টুডেন্টকে কোনও না কোনও অপরাধের কারণে কোচিং থেকে বের করে দিতাম।) সব বিষয় আমি নিজেই পড়াতাম। শুধু ইন্টারের বায়োলজি আর কমার্সের সাবজেক্টগুলোর জন্য আরও ২ জন স্যার ছিলেন। পুরো একক চেষ্টায় একটা কোচিং পুরোপুরি দাঁড় করানোর রেকর্ড আর আছে কি না আমার জানা নেই। সেসময় যে কী অফুরন্ত প্রাণশক্তি ছিল, এখন তা কল্পনাতেও আনতে পারি না। নিজের সাথেই চ্যালেঞ্জ করতাম, এই বলে যে, আমি যা পড়াই, তা যেন এর চাইতে ভালভাবে পড়ানো না যায়। আমি জানি, এই ভাবনাটা স্রেফ পাগলামি। কিন্তু ওইসময়ে ভাবতাম, আমি পৃথিবীর সেরা পড়াটা পড়াই। সে ভাবনা আমাকে আমার সেরাটুকু দিতে সাহায্য করতো। ওই সময়ে ভূতের মতো পরিশ্রম করতে পারতাম। (আমার ইনকাম ছিল আমার বয়সের যেকোনও ছেলের চাইতে অনেক-অনেক বেশি। এতোটাই ব্যস্ত থাকতাম যে বখে যাওয়ার সময়ও ছিল না। আমাদের ফ্যামিলি যথেষ্ট সচ্ছল। তাও আনন্দের জন্য ওসব করতাম। অনেক স্টুডেন্টকে ফ্রি পড়িয়েছি। ওদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল গরিব, কিছু ছিল যারা আমার টাকা মেরে দিত।)

আমি জানি না, আপনারা পড়ানোর ব্যাপারে আমার পাগলামো কতোটা আঁচ করতে পারছেন। আমি জানি, আমার জায়গায় না থেকে সেটা ভাবাও একটু কঠিন। আমি আমার ক্যালিবার-ক্যারিয়ার কোনওকিছুর প্রতিই বিন্দুমাত্রও সচেতন ছিলাম না। আমি বরাবরই যা করতে ভাল লাগে তা-ই করা’দের দলে। আমি পড়ানোতে পুরো পৃথিবীর সব সুখ একসাথে পেতাম। সেই আমি সেখান থেকে সরে এলাম। কীভাবে? কয়েকটা ঘটনা থেকে। ২টা শেয়ার করছি।

প্রতি বছর আমার অনেক স্টুডেন্ট বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানে চান্স পেয়ে আমাকে ফোন করে জানাত। ওদের বাবা-মা যতটা খুশি হতেন, আমার খুশি তার চেয়ে একটুও কম ছিল না। আমার খুব প্রিয় এক স্টুডেন্ট বুয়েটের ইলেকট্রিক্যালে চান্স পেয়েছিল। আমি ওকে খুব পছন্দ করতাম ওর বিনয়ী ব্যবহারের জন্য। ও যে চান্স পেয়েছে, সেটা ও আমাকে জানায়নি। আমি অনেক পরে সেটা জানতে পেরে ওকে অভিনন্দন জানাতে ফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বুয়েটে চান্স পেয়েছ জেনে অসম্ভব খুশি হয়েছি। আমি আশীর্বাদ করি, তুমি অনেক দূর যাও। অনেক কষ্ট করেছ। ভাই, তুমি আমাকে এই খুশির খবরটা জানাওনি কেন? কোচিং-এ এসো, তোমাকে মিষ্টি খাওয়াবো।” ওর উত্তর ছিল, “স্যার, আমি তো অনেক ব্যস্ত ছিলাম, তাই আমার মনে ছিল না। আমি চান্স পেয়েছি কি না এটা তো আপনারই ফোন করে আমাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। আমরা বেশি-বেশি চান্স পেলে তো আপনারই লাভ, আপনার কোচিংয়েরই সুনাম। আপনি সামনের বার আরও বেশি স্টুডেন্ট পাবেন। আর স্যার, এখন তো একটু বিজি, অ্যাডমিশন কোচিংগুলি থেকে টানাটানি করছে। বোঝেনই তো। আমি সময় পেলে দেখা করতে আসব, স্যার।” আমার মনে হল, কেউ যেন আমার গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। সেদিন ওকে কিছুই বলিনি, কিন্তু মনে-মনে জেদ চেপে গেল।

আরেকটা ব্যাপার শেয়ার করি। আমার স্টুডেন্টদের গার্ডিয়ানরা বলাবলি করতেন, সুশান্ত স্যার আর কোনওকিছু করতে পারবেন না বলেই কোচিং চালাচ্ছেন। উনি বোধ হয় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াও ছেড়ে দেবেন। এভাবে স্টুডেন্ট পড়িয়েই জীবন কাটিয়ে দেবেন। ভাল কিছু করতে পারলে তো আর স্টুডেন্ট পড়াতেন না। কারও-কারও ব্যবহার ছিল এমন, টাকা দিচ্ছি, স্যার তো পড়াতে বাধ্য। (আমি এখন মাঝেমাঝে ভাবি, এখনকার ডবল গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়া অনেক স্বীকৃত মেধাবী স্টুডেন্ট যে প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় ওয়েটিংলিস্টেই জায়গা পায় না, সেখানে আমি ভর্তি পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়েছিলাম। হায়! ওরাও দম্ভ করে!)

আমি আমার জীবনে যা কিছু পেয়েছি, তার বেশিরভাগই প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে পাওয়া। আমি একটা সময়ে ভাবতে শুরু করলাম, আসলে টিউশনি আমাদের কী দেয়? এক। কাঁচা পয়সা। দুই। খুব সৌভাগ্যবান হলে, সম্মান আর কৃতজ্ঞতা। তিন। স্টুডেন্টদের ভাল রেজাল্টের সাইড-ইফেক্ট হিসেবে নিজের বাজে রেজাল্ট। চার। বোকা-বোকা আত্মতৃপ্তি।……আর কিছুই না। আমি আমার লাইফে যত স্টুডেন্ট পড়িয়েছি, তার একশ’ভাগের একভাগও আপনাদের কেউ পড়িয়েছেন কি না, আমি জানি না। আমার নিজের কোচিং দেয়ার আগে অ্যাডমিশন কোচিং সহ ১৩টা কোচিংয়ে পড়িয়েছি। আমি খুব ভাল করেই জানি, স্টুডেন্টলাইফে টিউশনির ব্যাপারটাকে অন্যরা কীভাবে নেয়, এটা নিয়ে কে কী ভাবে। আমি আমার সেই প্রিয় স্টুডেন্টের কাছ থেকে কখনও পয়সা নিইনি। ওর বাবা ছিল না, তাই ওর প্রতি আমার একটা সফট কর্নার ছিল। আমি নিজেই ওর মাকে ডেকে অনেকটা জোর করে অনুরোধ করে রাজি করিয়েছি, আমাকে বেতন না দিতে। ওকে ফ্রি পড়ানোর গুরুদক্ষিণা ও আমাকে যতোটা দিয়েছে, আমার খুব কম স্টুডেন্টই অতোটা দিতে পেরেছে। সে স্টুডেন্টই আমাকে পয়সা কামানো শেখায়! তবে সত্যি বলছি, এখন আমি ওকে খুব ভালোবাসি ওর সেদিনের বেয়াদবির জন্য। সেদিনের চড়টা আমার দরকার ছিল। আমার স্টুডেন্টদের গার্ডিয়ানদের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ। এই পৃথিবীতে সেটা করাই সবচেয়ে গর্বের আর আনন্দের, যেটা অন্য দশজন ভাবে, আপনি করতে পারবেন না। ওরা ভাবত আর বলত, আমি কিছু করতে পারব না। আমি কিছুই না বলে করে দেখিয়েছি, আমিও কিছু করতে পারি। অর্জনের চাইতে ভাল উত্তর আর কী হতে পারে? নিজেদের অজান্তেই এই চ্যালেঞ্জটা আমার প্রতি ছুঁড়ে দেয়ার জন্য আমি তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

আরেকটা কথা, টিউশনি ছেড়ে দেয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হল, টিউশনি সত্যি-সত্যিই ছেড়ে দেয়া। কয়েক বছর ধরে টিউশনি ছেড়ে দেয়াটা অনেকবার সিগ্রেট ছেড়ে দেয়ার মতো। একটা কাজ কীভাবে শুরু করা যায় কিংবা অনেক দিন ধরেই করছি এমন কোনও কাজ করা কীভাবে বন্ধ করে দেয়া যায়, সেটার সবচেয়ে সহজ টেকনিক আমার খুব-খুব প্রিয় মুভি ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দি আগলি’র একটা ডায়লগ দিয়ে বলছি: When you have to shoot…Shoot! Don’t talk.