টিকেট কেটেছিলে তো?

 
শীতল অক্টোবর সন্ধ্যা।
ধূসর হ্রদ। একটা দুর্দান্ত ভূতের শহর।
এ শহরে প্রায় আত্মাই প্রবাসী হয়ে বাঁচে।
একটি ভয়াবহ মাকড়সা শিকারের খোঁজে।
বাতাসে শরতের পাতা। পালাচ্ছে, চলছে।
দূরের দুর্গের জানালাগুলি আলোকিত।


শরতের হাওয়া বইছে,
আমরা মৃদু মেজাজের ও মনের, কিছুটা পাগলাটে গোছেরও।
আমরা সামনের মাস থেকে খুব ভয় পেতে শুরু করবো।
সে সময় আমাদের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে উঠবে, চোখে ভারি পর্দা নামবে।
আমরা আমাদের ছোট্ট ঘরের তাকগুলিতে ফুল ও ফলের পরিবর্তে
গল্পের বই রেখে দেবো। আমাদের পরের প্রজন্মের মধ্যে পুষ্টির কোনো
অভাব দেখছি না, গল্পের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আমরা একে অপরকে
আলতো করে চুমু খেয়ে মুখের উপর শীতের কম্বল টেনে গ্রীষ্মের সুখস্বপ্ন
দেখতেদেখতে ঘুমিয়ে পড়ি। অতঃপর, আমাদের গুহার মুখের সামনে আগুনের স্তূপ
দেখে আকাশের জ্বলজ্বলে নক্ষত্রটি দিঘির জলেভাসা পাতাগুলিতে নেমে গেল।


প্রত্যাশার ব্যর্থতা কিংবা অকেজো প্রার্থনার চাবি কোনোকিছুরই রোমন্থন করে না।
আসুন, বরফের উপর চাটাই বিছিয়ে দিয়ে বড়ো মেরুগাছের নিচে বামনদের মাঝে
বসে থাকি, আমাদের নিজেদের নিস্তব্ধতায় আবৃত করি, আমাদের চোখকে আধোঅন্ধ
করে রাখি। এবং তারকারা ঝলমল করতে শুরু করার সাথেসাথেই, আসুন, আমরা
ভবিষ্যতের কথা ভাবি---আমাদের কীভাবে ও কতটুকু কথা বলা উচিত? কথাই তো ধর্ম!


পবিত্র গ্রন্থের প্রাকইতিহাস সে গ্রন্থেরই প্রত্যক্ষ পৌরোহিত্যে পুনরাবৃত্ত হচ্ছে।
ওদের প্রেরিত দূতের কোনো প্রজ্ঞা বা অভিজ্ঞতা ছিল না, কেবলই কিছু
বার্তা ছিল। নোংরা বিদ্বেষ ও ভ্রান্তি ছড়িয়ে যারা সকল শুভবুদ্ধির ছুটি
কামনা করে, তাদের বারোয়ারি আর্তনাদে আমি, আরও অনেকের সাথে,
দিশেহারা হয়ে ঘর কিংবা একটি আশ্রয় খুঁজতে থাকি, এবং যে করেই হোক,
অন্তত জ্যান্ত থাকার চেষ্টা করি। আমি দরোজার কাছে অসাড় হয়ে থামব,
এবং অনেকক্ষণ ধরে শুনব, তিনটি কবুতর কীভাবে বাসা বাঁধে, সে গল্প।


আমি যখন নানান দোরগোড়া পেছনে ফেলে সামনে হেঁটে যাই,
তখন মনে পড়ে, এক শ্রাবণসন্ধ্যায় জীবন বিনীত হতে শিখেছিল।
লোকের চুপচাপ স্বভাব আমাকে চুপসে ফেলেনি,
কোনো হট্টগোল বা ঝক্কি আমাকে স্পর্শ করেনি।
আমি ঘণ্টাখানেক বধির হয়ে অপেক্ষা করছিলাম,
রাতে ভূগর্ভস্থ শেকড়ের বৃদ্ধি কিংবা বীজের অঙ্কুরোদগম
ঘটার সময়ে ঈশ্বরের, কবির কিংবা বিজ্ঞানীর নয়, বরং
স্কুলের মাঝবয়েসি বায়োলজি শিক্ষকের কথা মনে পড়ে গেছে।


যদি অন্য দেশে জন্মগ্রহণ করতেন, তবে তিনি আজও, সত্যবলার অপরাধ সত্ত্বেও,
বেঁচে থাকতেন। মূক ও বধির হয়ে বাঁচলে দ্রুতই স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে যায়, তখন যেমন
খুশি, তেমন সেজে, লোকে যাকে ভালথাকা বলে আরকি, ওরকম করেই থাকা যায়।


যারা মেধার শিখরে পৌঁছয় সরব গৌরবে,
তাদের দূরে সরিয়ে রাখাই এখানকার রীতি।
শিক্ষক তো আর পিঁপড়া হয়ে জন্মাননি যে
নগণ্যের ছদ্মবেশে বাঁচবেন, তার উপর তিনি
বেঁচেই রয়েছেন আলো ছড়িয়ে দিতে! অতএব,
ওরা তাঁকে ছিনতাই করে প্রয়োজনে দিনের আলোতেই
হত্যা করবে। এমনি করে এখানে আবাদযোগ্য ভূমি
শ্মশানের মাঠ হয়ে টিকে থাকে। তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী
পবিত্র কিছু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নেয় হত্যাকারীরাই
সবার আগে। মৃত শিক্ষকের আত্মাকে অভিশাপ দিয়ে
ক্রমাগত প্রচুর অশ্লীল কুৎসা ছড়িয়ে দিতে হবে।
তাঁকে মাতাল কিংবা অথর্ব বানিয়ে দেয়া গেলে
খুব চমৎকার কাজ হয়। ঈশ্বর এইসব প্রত্যক্ষ
করেন এবং বলেন, আমার ভাষা ও ইশারা, দুইই
দুর্বোধ্য। অপেক্ষা করো অনুকূল সময় আসা পর্যন্ত।
পাপীদের ও ঈশ্বরের যৌথ প্রযোজনায় অনুষ্ঠিত
এই ক্রীড়ায় দর্শক হিসেবে অংশ নিলে স্বর্গত
পিঁপড়াটির জিজ্ঞাস্য হবে, টিকেট কেটেছিলে তো?