তবুও অপেক্ষা/ ছয়

 
যেদিন আমরা দেখা করব, তার আগের দিন রাতে প্রতিদিনকার মতো কথা হচ্ছে আমাদের। রুমি বলল, সে জোরে কথা বলা পছন্দ করে না, আমি যেন জোরে কথা না বলি, আর কথা যেন রিপিট না করি! সে যা বলে, তার পিঠে যেন অন্য কথা না বলি। তার এক্স-গার্লফ্রেন্ডের কথা বলল। স্কুলের বন্ধু। দশ বছর আগে ফেইসবুকের মাধ্যমে সম্পর্কে জড়ায়। মাত্র দুমাস সম্পর্ক টিকেছিল। মেয়েটা ছিল অতীব সুন্দরী, বিরাট ধনী পরিবারের মেয়ে। মেয়েটা ছিল অতিমাত্রায় বাচাল, আর কথায় কথায় গালিগালাজ করত। মেয়েটা সিগারেট-গাঁজা খেত, এজন্য সে ব্রেকআপ করে দেয়। ব্রেকআপের পর মেয়েটা অনেকদিন নাকি ওকে জ্বালিয়েছে। মধ্যরাতে ফোন দিত। কথায় কথায় রাগ করে হাত পা কাটত, ড্রিংক করত, সিগারেট খেত, এইসব করত। মেয়েটা নাকি সাইকো টাইপ! আমি মেয়েটার কথা শুনতে চাইছিলাম না, কিন্তু রুমি তা বুঝতে না পেরে মেয়েটাকে নিয়ে অনেক কথা বলল। সে সুন্দরী, সে লম্বা, সে হেন সে তেন… আমি চুপচাপ শুনে গেলাম, কেননা কিছু বললে যদি সে আবার ক্ষেপে যায়, তাই।


সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারিনি। টেনশনে, উত্তেজনায়। যে মানুষটার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, সে সামনাসামনি কেমন হবে! সে বেশি কথা পছন্দ করে না, আর আমি তো বেশি কথা বলি! কেমনে কী! রাজ্যের চিন্তায় উত্তেজনায় সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। অবশ্য আমাকে দেখলে যে সে অপছন্দ করবে না, সে ব্যাপারে কনফিডেন্ট ছিলাম। পরদিন সকাল নটায় বেরিয়েই ও ফোন দিল। আমি দশটার দিকে বেরুলাম। বাস খানিকটা লেট করল। লোকাল বাস। সে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বেশ টেনসড। তাকে এতক্ষণ অপেক্ষা করাচ্ছি! বাস থেকে নেমে ইতিউতি করলাম! কিছুক্ষণ পর পেয়েও গেলাম! কিছুটা হতাশও হলাম। ফেইসবুকের সেই ঝকঝকে মানুষ আর বাস্তবের মানুষটার অবয়ব-আকৃতিতে একেবারেই কোনও মিল নেই। তবুও চিনতে পারলাম। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে একজনের সাথে কথা বলছে। কাছে গেলাম। মুখের দিকে চেয়ে হেসে দিলাম! এই হাসি হচ্ছে চিনে-নেবার হাসি। সে কোনও কুশলবিনিময় করতে পারল না! শুধু অসহায় চোখজোড়া নিয়ে আমাকে দেখল! ফোনের কথা শেষ করল। ততক্ষণে আমি বারবার সরি বলছি দেরি হবার জন্য। অনেক বেশিই নার্ভাস ছিলাম।


ওদিকে আমাকে প্রথম দেখায় সে ভীষণ ইমপ্রেসড। তার ইমপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছিল, সে পাগল হয়ে গেছে আমাকে দেখে! কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না! আমি লজ্জায় তার সাথে চোখাচোখি হলাম না। আড়চোখে যতটুকু দেখলাম, তাতে তার গেটআপ দেখে আমি যারপরনাই আহত, হতাশ। এরপর ওকে সোজা নিয়ে গেলাম আমার ডিপার্টমেন্ট দেখাতে। এরপর সেখান থেকে ক্যাফেটোরিয়ার কাছে নিরিবিলিতে বসলাম। আমার ব্যাগ থেকে উপহারগুলি বের করে দিলাম। সে আনন্দে উদ্‌বেলিত হয়ে বলল, অনেক বছর ধরে তাকে কেউ কখনও গিফট দেয় না। এর আগে একদিন বলেছিল, বারো বছর ধরে সে নাকি নিজের জামাকাপড় কিনে না। তার মা সব কিনে দেয়। সে কখনওই এক্সপেক্ট করেনি তাকে কেউ ভালোবাসবে। কারণ বেশিরভাগ মানুষই তাকে ঘৃণা করে, খুব কম মানুষের ভালোবাসা সে পেয়েছে। তাকে দেখে সবাই নাকি ভুলভাবে নেয়। সবাই ভাবে, সে সাইকো, আর তখনই সবাই তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। তাকে বোঝার চাইতে ভুল বোঝাই সহজ। বাইরে থেকে দেখলে তাকে যা মনে হয়, সে আসলে ওরকম না। সে নিজেকে ইচ্ছে করেই ওরকমভাবে উপস্থাপন করে। মানুষ তাকে উলটাপালটা ভাবলে নাকি সে মজা পায়।


আমরা হাঁটতে লাগলাম। আমি কিছুটা ভয়ে ছিলাম। এত রিজার্ভড মানুষ! আর আমি প্রাণখোলা মনখোলা মেয়ে! ওকে অনেকটা অপরাধীর কণ্ঠে কৈফিয়তের সুরে বললাম, আমি আসলে আগে এত কথা বলতাম না, মা মারা যাবার পর থেকে কথা বেশি বলি। সে বলল, তোমার সব কথা শুনব, সবই বলবে। আমার ভয় কিছুটা কাটল। তাকে আমার জন্য এতটা পাগল, উদ্‌ভ্রান্ত দেখে তার জন্য মায়া লাগল খুব! সে নাকি ঘুরতে, বেড়াতে পছন্দ করে না, একজায়গায় বসে থাকতে পছন্দ করে, আবার হাতে মাত্র দুঘণ্টার সময় নিয়ে এসেছে। আর সেই মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার ক্যাম্পাসে আমার সাথে হাঁটতে চেয়েছে, ঘুরতে চেয়েছে। তার বাহ্যিক অবয়ব-আকৃতি আনস্মার্টনেস দেখে আমি যথেষ্ট হতাশ ছিলাম। কিন্তু তার কেয়ারিং অ্যাটিটিউড দেখে আমি পুরোই বিমুগ্ধ! তার মাথায় চুল খুবই কম। অনেক মোটা, দেহের আকৃতিও বেঢপ, বিশাল। সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার, সে তার প্রেয়সীর সাথে প্রথম দেখা করতে এসেছে আনশেভড, মুখভর্তি জঙ্গলাদাড়ি নিয়ে। ইন-করা সাদা টিশার্ট আর প্রস্তরযুগের প্রায় ছিন্ন পুরাতন ঢলঢলে খাকি রংয়ের টেট্রনের তালি-দেওয়া প্যান্ট পরে। সাথে অতিপুরাতন ছেঁড়া-শু, বাদামি রংয়ের। এই কাঠফাটা রোদ্দুরেও সে পরেছে কালো ফার-কোট, তা-ও ওটা তার বড়ো ভাইয়ের! এমন উদ্‌ভ্রান্ত উদ্ভট উন্মাদ কিনা আমার কপালেই জুটল!


আমি কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না একজন বিসিএস ক্যাডার ডাক্তার কী করে এমন পোশাক পরে! আর আমি কাজল-লিপস্টিকবিহীন গতরাতের একরাশ চোখের কালি আর কপালে ছোট্ট কালোটিপ, আর কালোরঙের জামাটা পরে তার সাথে দেখা করতে এসেছি! হাঁটতে হাঁটতে আমরা কথা বলছি। সে কোনও দিনই লোকাল বাসে চড়েনি। ২০০৮-এ তার বাবা মারা যান। সরকারি বিভিন্ন প্রজেক্টের কনট্রাকটর ছিলেন বাবা। বাবা মারা যাবার পর থেকে তাদের নাকি অনেক স্ট্রাগল করে চলতে হয়। গাড়িটা বিক্রি করে দিতে হয়। তারও কিছু লোন ছিল। সব শোধ করেছে। এইসব। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভার্চুয়ালি আর ভিজুয়ালি আমার মধ্যে পার্থক্য কী? সে বলল, আমি নাকি বাস্তবে ফেইসবুকের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। ফেইসবুকে আমার ছবিতে ওর মিউচুয়াল জামান ভাই যখন কমেন্ট করেন, ‘মাথানষ্ট সুন্দরী। ‘আগুন-সুন্দরী’ তখন নাকি আমাকে তার অতটা আহামরি সুন্দরী লাগেনি। আর ফেইসবুকে আমাকে যতটা বদরাগী দেখা যায়, বাস্তবে আমি তার উলটা---অনেক নরম একটা মেয়ে! হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা সুন্দর লেকের পাশে বসলাম। চারপাশে হু হু বাতাস। সুন্দর প্রকৃতি। জায়গাটার নাম ‘কাশ্মীর-ভ্যালি’। সে আমার ভারী ব্যাগটা তার কাঁধে করেই রাখল। আমার ব্যাগ আর তার কোটটা খুলে সামনের গাছের ডালে ঝুলিয়ে আমরা ঘাসের উপর বসলাম। সে জুতা খুলল! আমি হাঁ করে ওর লাল মোজার দিকে তাকিয়ে রইলাম! মোজার ছিদ্র দিয়ে বুড়ো আঙুলের পুরোই দেখা যাচ্ছে! গোড়ালির কাছেও বিশাল একটা ছেঁড়া। দুই পায়েরই!


ওর পুরো গোড়ালিই দেখা যাচ্ছে! ফাটা ফাটা গোড়ালি। এক পর্যায়ে সে ঘাসের উপর আধশোয়া হয়ে গল্প করছে। আমার কাছে তখন ওকে পুরোই একটা বদ্ধপাগলপ্রতিম মনে হচ্ছিল! এই পাগল মানুষটার চোখেমুখে আমাকে ভালোবাসার যে আকুতি - বাচ্চামি - পাগলামি সেদিন দেখেছিলাম, সেখান থেকে আমার আর ইউটার্ন করার জো নেই। আমি এই পাগল মানুষটাকেই ভালোবেসে ফেললাম। এরপর আমরা রিকশায় চড়লাম। পুরো ক্যাম্পাসটা তাকে ঘুরিয়ে দেখাব! রিকশাওয়ালা-মামাও এককাঠি বেশি সরেস! আমার মুখে তো অনবরত খই ফুটছিল! সাথে রিকশাওয়ালাও যোগ দিলেন! ‘ভাইজান কী করেন? আপনাগো মানাইছে খুব। এরপর আইলে আমার বাড়ি আইসেন!’ সিনেমায় নায়ক-নায়িকার দেখা হলে যেমন বৃষ্টি হয়ে রোমান্টিক আবহের সৃষ্টি হয়, আমাদেরও তা-ই হলো। সত্যি সত্যিই ঝিরঝির বৃষ্টি নামল। আমার কাশি। সে তার কোটটা খুলে আমাকে পরিয়ে দিল। আমার মাথায় তখন গান বাজছে…রিম ঝিম গিরে সাওয়ান…সে অমিতাভ, আমি মৌসুমি…আহা!


সে আমার সব কথাই রাখল, শুধু একটা কথা বাদে! ক্যাম্পাসের বটতলায় সে দুপুরে খাবে না। খাবে ভালো কোনও রেস্টুরেন্টে। রিকশা করে গিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে আমরা একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসলাম। দুজন মিলে কথা শুরু করলাম। দিনটা ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি। ঠিক হলো, আজ থেকে ছয় মাস পর আগস্টে আমরা বিয়ে করব। সে ঘরোয়াভাবে আমাকে নিয়ে যাবে। এখন আমাদের মধ্যে যিনি মিউচুয়াল করেছেন, সেই হেমা ম্যামকে আমরা ফোন দিয়ে জানাব। সে বলল, আমাকে তোমার ভালো লেগেছে কি লাগেনি, তা ম্যামকে ফোন দিয়ে জানাবে। আমিও তাঁকে জানাব যে তোমাকে আমার খুবই ভালো লেগেছে। এরপর আমি তাকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। যেহেতু ছয় মাস পর আমাদের বিয়ে, তাই এর আগে তোমার সাথে আর কোনও দেখা করতে বা কথা বলতে, কোনওটাই চাই না। সে বলল, বুঝতে পেরেছি, তুমি এখন কোনও অ্যাটাচমেন্টে আসতে চাইছ না। এরপর সে উবার ঠিক করল। সে আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে। বিকাল চারটার দিকে আমরা উবারে করে বাসার কাছে এলাম। সে জোর করে আমার ব্যাগে কিছু টাকা দিয়ে দিল। আমি তো কিছুতেই নিব না, সে তা-ও জোর করেই দিল।


বাসায় এসে দেখলাম, তিন হাজার টাকা। সন্ধ্যার পর ওকে ফোন দিলাম ঠিকমতো পৌঁছেছে কি না! একটু বকাও দিলাম, কেন এতগুলি টাকা আমাকে দিল! সে বলল, আমার উবারে চলাফেরা করার জন্য সে দিয়েছে। এরপর বলল, তার ইচ্ছে ছিল, সে আমার আগে আসবে, এবং সে-ই প্রথম কুশলাদি জিজ্ঞেস করবে। প্রথম ইচ্ছে পূরণ হলো, দ্বিতীয় ইচ্ছেটা হলো না। সে ফোনে কথাবলা অবস্থাতে খেয়াল করে দেখল, ‘অপরূপ সুন্দরী একটা মেয়ে, যার মুখে রোদ পড়েছে, সে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমি কোনও কথা বলতে পারছি না! ফোনে কথা শেষ করে তারপর ভালো করে তাকালাম। আমার সমস্ত চিন্তা চলে গেল তোমার হাসি দেখে! আমি আমার বাহ্যিক শারীরিক আকৃতি নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম কিন্তু তোমার হাসি দেখে সব ভয় দূর হলো! তুমি যখন আমাকে গিফটগুলি দিলে, আমার চোখে পানি চলে আসছিল। তোমার দুইগাল হাত দিয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আর বারবার মনে হচ্ছিল, হেমা ম্যাডাম আমাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটি দিলেন!’ ওর আমাকে প্রথম দেখেই এই উপলব্ধি হয়েছিল, এই মেয়েকেই আমার চাই, একেই আমার পেতে হবে! আর সে বারে বারে মুগ্ধ হয়ে আমাকে দেখছিল। আমি তাকে জানালাম যে তাকে প্রথম দেখে আমার মধ্যে তেমন ফিলিংস কাজ না করলেও তার কেয়ারিং আচরণে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। ও বলল, ওর জায়গায় যে-কোনও ছেলে থাকলেই এরকম কেয়ারিং হতো আমার বেলায়।


রাতে হেমা আপুকে ফোন দিলাম। বললাম তার উদ্ভট পোশাকআশাকের কথা! বললাম, সে আমার প্রতি খুব কেয়ারিং। সিদ্ধান্ত জানালাম, ছয় মাস আমরা নিজেদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ করব না। আপু বললেন, না না, যোগাযোগ বন্ধ কোরো না। আউট অব সাইট, আউট অব মাইন্ড। তোমরা দেখা করবে। একসাথে মুভি দেখবে। ওর জন্য নুডলস রান্না করে চানখারপুল যাবে, ঘুরবে, গল্প করবে, শুধু ফিজিক্যাল রিলেশনটা কোরো না এখন। পরদিন হেমা আপু সকালে আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, রুমির সাথে কাল রাতে আমার ইনবক্সে কথা হয়েছে। ও বলেছে, ম্যাডাম, আজ আমরা দেখা করেছি। আমার মনের বাসনা পূরণ হয়েছে। প্রথম দেখাতেই তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এরপর হেমা আপু বললেন, কেমন দেখলে ওকে? রুমি উত্তর দিল, সে অসম্ভব রূপবতী। বিনয়ী। নিরহংকারী। দয়ালু। নিজের আবেগ অকপটে প্রকাশ করতে পছন্দ করে। তার সব কথা শুনেছি, শুধু একটা কথা শুনি নাই। হেমা আপু বললেন, কী? সে বলল, আমাকে বটতলায় খাওয়াতে চেয়েছিল। সেখানে কী বিশ্রী আয়োজন! দেখলেই বমি আসে! এত সুন্দরী মেয়ে, অথচ বটতলায় ভাত-ফুচকা-চটপটি খেতে চায়! ওখানে ভদ্রভাবে ডেটিং করার পরিবেশ নাই! তা ছাড়া আমার দুইবার হেপাটাইটিস-বি হয়েছিল। যেখানে সেখানে খাওয়া আমার বারণ।


হেমা আপু আমাকে পুরো চ্যাটিংটাই পড়ে শোনালেন। এরপর সকালে রুমি আমাকে ফোন দিল। আগের দিন রাতেই আমাকে বলে রেখেছিল। আজ আমাকে ওদের ধানমন্ডিতে নিয়ে যাবে। সকালে একসাথে নাস্তা করব। এরপর আড়ং থেকে ম্যাডামের জন্য একটা ড্রেস কিনবে। এরপর আমাদের আর দেখা হবে না। আজই শেষ। সে সকালবেলাতেই বাসার সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল! আমি এলে উবার ঠিক করে আমরা ধানমন্ডি গেলাম। এদিকে আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। সে আমাকে রেস্টুরেন্টে বসিয়ে ওষুধ কিনল। সাথে হ্যান্ড-স্যানিটাইজার। আমরা নাস্তা করলাম। এরপর আড়ং। ওখান থেকে হেমা আপুর জন্য ড্রেস কিনলাম। আমাকে বলল ছোটোখাটো কিছু একটা নিতে। আমি সবচেয়ে কম দামের ২০০/৩০০ টাকার মধ্যে একটা গলার আর কানের গহনা নিলাম। এরপর সে আমাকে নিয়ে গেল ওখানকার সবচেয়ে বড়ো টাওয়ারে। মোবাইলের শোরুমে। জিজ্ঞেস করল, কোন কালার পছন্দ?


আমি হতভম্ব। বুঝলাম, সে আমার জন্য মোবাইল কিনছে। আমি কিছুতেই নিব না। বলল, এখানে কিছু বোলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। মোট একত্রিশ হাজার পাঁচশো টাকা দিয়ে সে আমার জন্য মোবাইল কিনল, ম্যাজেন্টা কালারের। আমার ভীষণ মন খারাপ হলো! তাকে নিয়ে উপরের ফুডকোর্টে বসলাম। বললাম, আমি এখন এটা কোনওভাবেই নিতে পারব না। তুমি কি আমাকে অন্য মেয়েদের মতো ভেবেছ যে দামি মোবাইল পেলেই আমি খুশি হব? আমাকে বেলিফুলের মালা কিনে মাথায় পরিয়ে দিলেই আমি খুশি! সে বলল, আমি খুব ভালো করেই জানি তুমি অন্য মেয়েদের মতো নও! এটা তোমাকে নিতেই হবে। কোনও বিনিময় চাই না। বেলিফুলের মালা পরে হবে। তুমি না নিলে আমি এটা ফেলে দিব। আমি খুবই স্টাবর্ন মানুষ। আমি দেখেছি, তোমার পুরনো মোবাইল দিয়ে অনেক কষ্ট হয়। ছবিও ঝাপসা আসে। এটাতে লেখালেখির জন্য অনেক সুবিধা হবে, তুমি ভালো টাইপ করতে পারবে। বললাম, আমি চেয়েছিলাম, চাকরি পেয়ে নিজের টাকা দিয়ে প্রথম মোবাইলটা কিনতে। তোমার এটা নিতে পারি, কিন্তু শর্ত আছে, আমি বেতন পেয়ে তোমাকে শোধ করে দেবো। আর এখন নতুন সেট ইউজ করব না। যেভাবে দিয়েছ, সেভাবেই রেখে দিব। তিন মাস পর ইউজ করব আমার বিসিএস পরীক্ষার পর।


সে উত্তরে শুধু হাসল, কিছু বলল না। এরপর আমাকে উবারে করে বাসায় পৌঁছে দিল। বাসায় পৌঁছে ফোন দিতে বলল। এত কেয়ারিং সবকিছুতে, এত ভালোবাসায় আমি পুরোপুরিই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। দুনিয়াদারি ভুলে গিয়েছিলাম। এমনকি সৃষ্টিকর্তাকেও! মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে ও ছাড়া আর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। প্রতিদিন সন্ধ্যায়, রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা চলতে লাগল। সে হয়ে গেল আমার গোটা পৃথিবীটাই!


দেখা হবার দ্বিতীয় দিনই, মানে বৃহস্পতিবার, সে আমাকে বলল, তোমার জুতোজোড়া কেমন মলিন হয়ে গেছে। তোমাকে একজোড়া জুতো কিনে দিব। বললাম, ঠিক আছে, দিয়ো। আমার স্কুলে জয়েনিং-এর সময় নতুন জুতা লাগবে, তখন কিনে দিয়ো। সে বলল, রবিবার থেকে তার জয়েনিং ঢাকায়। এরপর আর সময় পাবে না। এর মধ্যে আমাদের সব সময়ই ইমোতে কথা হতে থাকে। শনিবার সকালে ঘুম ভেঙে ইমোতে ওর সাথে কথা বলছিলাম। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তোমার প্রাক্তনের সাথে কতটুকু ঘনিষ্ঠ হয়েছিলে? সে বলল, শুধু একবার ওদের ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছিল। সম্পর্কের দুমাসের মাথায় মেয়েটা নাকি জোর করে রুমিকে তার নিজের খালি ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। তখন রুমি প্রাইভেট মেডিকেলে শেষবর্ষে পড়ত। মেডিকেলের পাশেই ওদের ফ্ল্যাট। মেয়েটা ওখানে একা থাকত। এরপর রুমি নিজেই রিলেশন ভেঙে দেয় ফ্যামিলির কথা চিন্তা করে, কেননা সে মেয়েটা ঠিক ম্যারেজ-ম্যাটেরিয়াল নয়।


এসব শুনে আমি প্রচণ্ড কষ্ট পাই। আমি যা, আমি তেমনটাই ডিজার্ভ করি। এমনটা আমি চাইনি। ওকে বললাম, আমার দশ বছরের রিলেশন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে চরিত্রবান নামাজি ছেলের সাথে, যে কোনও দিনই আমার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেনি, আর তুমি দুমাসের মাথায় সব করে ফেললে! এখানেই তোমার আমার পার্থক্য। আমি রাগ করেছি বুঝতে পেরে সে আমার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করল। সাথে সাথে ফোন দিয়ে বলল, আমি তোমাদের ওখানে আসছি, তোমাকে জুতা কিনে দিবার জন্য। বলেই সে রওনা দিল। তাকে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াতে বললাম। এসে দেখলাম, আমার বাস যেখানে থামবে, ঠিক সেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কয়েকটা বেলিফুলের মালা। আমি বাস থেকে নামতেই সে আমার হাতে ফুলগুলি দিল। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম, আমার সব রাগ জল হয়ে গেল।


আমরা দুজন জুতার দোকানে গেলাম। মোটামুটি আরামদায়ক জুতা কিনলাম। দাম নিল এক হাজার টাকা। সে একটু রাগ করল এজন্য যে এত কম দামি কিনলাম কেন? এরপর দুজন রেস্টুরেন্টে বসলাম। অর্ডার-করা খাবার এল। সে আমাকে স্যুপে ওনথোন ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিল। তার পাত থেকে আমার পাতে মুরগির মাংস উঠিয়ে দিল। তখনও আমি মুখ ভার করে আছি। সে বলল, ছেলেরা বা মেয়েরা অ্যাডভেঞ্চার টাইপ অপজিট জেন্ডারের সাথে প্রেম করে। কিন্তু বিয়ে করার সময় ছেলেরা সংসারী মিষ্টি মেয়ে খোঁজে। মেয়েরাও এলোমেলো অগোছালো ছেলেদের বিয়ে করে না, শুধু প্রেম করে। তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। ম্যাডামের কাছে তোমার কথা, তোমার ফ্যামিলির কথা যা শুনেছি, আমার কাছে তা-ই এনাফ। আমি তোমার সম্পর্কে আর কিছুই জানতে চাই না। এ-কথা সে-কথা বলে সে আমার মন ভালো করার চেষ্টা করল। কথায় কথায় বললাম, ইদানীং দাঁতে খুব শিরশির করছে। সে সাথে সাথে আমাকে ভালো একটা ফার্মেসিতে নিয়ে যেতে বলে। নিয়ে গেলাম। আমার এক পরিচিত ডেনটিস্ট আপু আছেন। তাঁকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে বলে, কোন পেস্ট নিব। ফোন করলাম। পেস্ট নিলাম। ফার্মেসির কাছেই ছিল কবরস্থান। আমার বাবা, মা, বড়ো বোন তিনজন সেখানে শুয়ে আছে। তাকে দেখাতে চাইলাম। সে রাজি হলো।


আমরা একসাথে কবরস্থানে গেলাম। তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালাম। আসার পথে কবরস্থানের পরগাছা থেকে একটা মানিপ্ল্যান্ট তুলে নিলাম আমার বারান্দার গাছের জন্য। সে রাগ করল। এভাবে অন্যের আমানত কেন ছিঁড়লাম, তাই! তাকে বললেই তো হতো, সে নার্সারি থেকে কিনে দিত। তাড়াতাড়ি কবরস্থানের কল থেকে সে আমার হাত ধুইয়ে দিল। হাত মুছতে তার জ্যাকেটটা খুলে দিল। এরপর হাতে স্যানিটাইজার লাগিয়ে দিল। নইলে হাত চুলকাবে। এত কেয়ার, এত ভালোবাসা, এত সুখ আমার সইবে তো! আমার রীতিমতো পাগল পাগল লাগছিল! সে আমাকে বাসার কাছ পর্যন্ত পৌঁছে দিল। রাস্তায় যেতে যেতে বললাম, আজই কিন্তু শেষদেখা, এরপর আর দেখা করব না। সে প্রচণ্ড রেগে গেল। বলল, বারবার কেন এককথাই বলছি! সে হয়তো বুঝে গিয়েছিল, এখন থেকে তার কোনও কথায় আমি আর ‘না’ করব না। যা-ই হোক, বাসায় এলাম। সে দুপুরের পর ফোন দিল ঠিকমতো পৌঁছেছি কি না জিজ্ঞেস করতে।


এভাবেই আমাদের চলল। সে কখনও শর্ট-টেম্পারড, আবার কখনও খুব ভালো। আমি তার সাথে ভয়ে ভয়ে কথা বলতাম। কোন কথায় রেগে যাবে, কোন কথায় রাগবে না, বুঝতে পারতাম না! ওর সাথে যখন প্রথম দেখা করি, ও তখন খুব ভয়ে ছিল ওকে পছন্দ হবে কি হবে না! কারণ আমি সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলেদের পছন্দ করি, এটা ও আমার কথায় নোট করেছিল। কিন্তু ওর আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় আমি আপ্লুত হয়ে যাই। ও আমাকে ‘বাবুই’ ছাড়া কথা বলত না। খেয়েছ, বাবুই? এসেছ, বাবুই? ঘুমিয়েছ, বাবুই? শুনে আমার যে কী ভালো লাগত, বলে বোঝানো যাবে না। আমি তখন পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর স্বপ্নটির মধ্যে বসবাস করতাম! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটো উক্তি মনে পড়ছে। একটি দিবারাত্রির কাব্য উপন্যাসের: প্রেম অসহ্য প্রাণঘাতী যন্ত্রণার ব্যাপার। আর-একটি পদ্মা নদীর মাঝি’র: অন্ধকারে যে বাস করে, মৃদুআলোতে তাহার চোখ ঝলসাইয়া যায়।


সত্যিই ওর অসহ্যপ্রেমে আমার চোখ ঝলসে গিয়েছিল, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে ভয় ঢুকেছিল, এত প্রেম যদি হারিয়ে ফেলি! ওদিকে বাসায় ব্যাপারটা লুকাতে পারিনি। আমার মধ্যে কোনও প্রাইভেসি নেই। এত ঘন ঘন দেখা করা, মোবাইলে কথা বলা, কিছুই লুকাতে পারিনি। বোন আর দুলাভাইকে সবই বললাম। বুঝলাম, তারা এত দেখাদেখির ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ করছে না। তা ছাড়া বোন ছেলেটার ব্যাপারে একদমই রাজি না। একে তো ওর দাদাবাড়ি চট্টগ্রামে, তার উপর আমাদের সম্পর্কটা একেবারেই ভার্চুয়াল, আমরা পরস্পরের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। তারপরও আমি অ্যাডাল্ট বলে ওরা আমাকে তেমন কিছু বলতে পারল না।


ও ভোরবেলা উঠে ঢাকা মেডিকেলে যেত ধানমন্ডি থেকে। দুপুরে বা বিকালে বাসায় এসে ফোন দিত। সন্ধ্যায় দুজনেই পড়তে বসতাম। এরপর আবার নয়টা-দশটায় ফোন করে দুই-তিন ঘণ্টা কথা বলতাম। এভাবে আমার পড়াশোনা একেবারেই শিকেয় উঠল! কথাবলা থেকে কিছুতেই নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারছিলাম না। এ এক অসহ্যপ্রেম! নেশালাগা প্রেম। এই নেশা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার কোনও উপায় নেই। বারবার বলেছি, এখন তো ঘরে বসে আছি, তাই তোমার সাথে কথা বলছি। স্কুলে জয়েন করার পর আর কথা বলব না। আসলে এসব কথা ওকে বলতাম, না কি নিজেকেই সান্ত্বনা দিতাম এসব বলে বলে, আমি জানি না। মানুষ প্রেমে পড়লে নিজেই নিজেকে অজুহাত দেখাতে শুরু করে দেয়।


ওর সাথে দেখা হবার পর অনেক বিষয়েই ধাক্কা খেয়েছি। সে আমার সাথে লোকাল-বাসে যাবে না, উবারে যাবে। ঝুপড়ি-হোটেলে খাবেনা। দামি এসি রেস্টুরেন্টে বসবে, কারণ সে মালদার! সে ক্রেডিটকার্ডে চলে! অথচ আমি তাকে ভেবেছিলাম গ্রামে চিকিৎসা-দেওয়া সৎ গরিব ডাক্তার! সবচেয়ে আহত হই এটা ভেবে যে, সে বাংলাতে খুব ভালো দেখে আমি তাকে ভেবেছিলাম সাহিত্যঅনুরাগী, তার উপর সে সুন্দর করে লিখতে পারে। কিন্তু তার পছন্দ মাস-কমিউনিকেশন, ল, বিবিএ। আমাকে সে এগুলি পড়তে বলে। তাহলে নাকি সে পড়ার টাকা দিবে। আমাকে বলে ব্যবসাতে অথবা ব্যাংকে ঢুকতে। এসব শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি! আমার শিক্ষকতা পছন্দ। ওখানে ছেলেমেয়েদের ভালোবাসা পাওয়া যায়। খুবই সম্মানজনক পেশা। আর যে পেশাতেই যাই, আমার সারাজীবনের নিয়ত, হালাল-পথে উপার্জন করব। সুদ ঘুষ খাব না, ইনশাআল্লাহ্‌।


যা-ই হোক, এসবের পরেও তার ভালোবাসায় আমি প্রচণ্ড রকম মুগ্ধ ছিলাম। আমি ঘুরতে চাইতাম বিয়ের পর। সে বলে, এসব করার টাইম নাই তার। বলেছিলাম, আমার খুব ইচ্ছে, সাজেকে হানিমুন করব আমরা। দুই-তিনবার বলেছিলাম। কিন্তু তার একটাই কথা, সে যাবে না ওখানে। আমি চেয়েছিলাম অবরে সবরে প্রেম করতে। কিন্তু ও যেটা চেয়েছিল, সেটা প্রেম নয়, অন্য কিছু! আমি চেয়েছিলাম, ওর সাথে যুক্তিতর্ক করব এই দুনিয়ার নানা বিষয় নিয়ে, নানা মতবাদ দিয়ে। দুজন মিলে রিকশায় ঘুরব, ফুচকা চটপটি খাব। এমনকি ওকে বিয়ের আগে তুমি করে বলারও ইচ্ছে আমার ছিল না! একদিন ফোনে কথোপকথনে ওকে বললাম, তোমার সাথে থাকতে থাকতে আমি ডাক্তার হয়ে যাব! ওপাশ থেকে ও বলল, আর আমি হয়ে যাব কবি!...আমাদের ক্ষণিকপ্রেমের এটাই ছিল আমার ভালোলাগা সবচেয়ে সুন্দর সংলাপ। এই সংলাপের উপর ভর করে আমি আমাদের বিয়ের পর লিখব, এমন একটা লেখার প্লটও আমি তৈরি করে ফেলেছিলাম!


আমি চেয়েছি মেটাফিজিক্যাল লাভ অথবা প্লেটোনিক লাভ, আর ও আমার হাত ধরে অন্ধকারের অলিতে-গলিতে আমাকে নিয়ে যেতে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল। যে প্রেমে ‘প্রেম’ নেই, শুধুই ‘কাম’ আছে! ‘লিবিডো’ প্রেম! শরীরী-ভালোবাসা!


আমি সারাদিন বাসায় থাকি। কোনও কাজ নেই। মন বসে না পড়ার টেবিলে। সন্ধ্যার পর তার সাথে যখন কথা বলতাম, তখন কথার ঝাঁপি খুলে বসতাম। মুখে আমার যেন ফল্গুধারা ঝরত! তার উপর দেশের এই পরিস্থিতিতে আমি খুবই প্যানিকড, তাকে নিয়েও টেনশন করতাম। এত কথায় হয়তো সে বিরক্তই হতো। সারাদিন বেচারা অফিস করে আমার প্যানপ্যান ঘ্যানঘ্যান শুনত। শুধু হ্যাঁ না হুম হুঁ ছাড়া আর কোনও কথাই বলত না। আমার তখন খুব খারাপ লাগত, তবু সে খুব প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া আর কিচ্ছু বলত না। আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করত না। এমনকি আমার জন্মদিন কবে, সেটাও জানার প্রয়োজন মনে করত না। আমিই সেধে সেধে ওর পছন্দ কী, আমার কী পছন্দ, এসব বলতাম। ওর মা কী পোশাক পরেন? ভাই কোথায় পড়েছে? ভাবি কোথায় পড়েছে? এসব মেয়েলি প্রশ্ন করতাম। সে যতক্ষণ বাসায় থাকত, তার রুম ছাড়া সে কোথাও একদমই যায় না। ওখানেই বসে বসে পড়ে। শুধু এটুকু বলেছে, আমরা একসাথে পড়াশোনা করব। এই কথাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। অদ্ভুত ব্যাপার, তার চাচারা কয়জন, ফুপুরা কয়জন, এসব সে কিচ্ছু জানে না। কারও সাথেই তাদের যোগাযোগ নাই। ওর ফ্যামিলির কথা জিজ্ঞেস করলে ও খুবই বিরক্ত হতো।


কিন্তু এসব সাধারণ কথায় হ্যাঁ না বললেও আমার সাথে ইমোশনাল কথাবার্তায় ওর আগ্রহ দেখতাম! সম্পর্কের কিছুদিনের মাথাতেই ঘনিষ্ঠ আর ইরোটিক কথাবার্তা বলত। আমি ওভাবে চাইতাম না। সে বলত, তুমি একটু ঝেড়ে কাশো তো। আমি আসলে সবকিছুর মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজতে পছন্দ করি। অসুন্দর কথা বা অসুন্দর প্রেমে অভ্যস্ত নই বা হতেও চাই না। তার কিছু কিছু কথাবার্তা আমার খুবই বিকৃত লাগত। তাকে আমার হাইপার-সেক্সুয়াল মনে হতো। একদিন ইমোশনাল কথার এক পর্যায়ে সে বলে, সে প্রথম প্রেমে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক করে যে ভুল করেছে সেই ভুলটা সে আর করবে না, আমি যদি এখন চাই ফিজিক্যাল রিলেশন করতে, তবে দুজন সাক্ষী রেখে সে গোপনে আমাকে বিয়ে করে রাখবে। আমি রাজি হলাম না। বললাম, বিয়েতে মুরুব্বিদের দোয়া ইমপর্টেন্ট। মুরুব্বিদের দোয়া ছাড়া আমরা বিয়ে করব না। সেক্স করার কথা এরপর সে আর কখনও তুলেনি।


তবে একটা ব্যাপার আমি প্রায়ই তুলতাম। বলতাম, আমার একটা আকুতি রাখবে? বিয়ের পর আমাদের বাসররাত তোমাদের বাসাতেও না, আমাদের বাসাতেও না, দূরে কোথাও হবে। সে কিছুই বলত না। বলত, সেটা তখন দেখা যাবে। আর বলত, তাকে যেন আমি কখনও এরকম অ্যাডভান্স কথা না বলি। আর ফোর্স না করি কোনও ব্যাপারে। সে জোর করা অপছন্দ করে। তাকে যেন আমি তার মতো থাকতে দিই।


একদিন ভোরবেলা। কথার ফাঁকে সে আমাকে একটা পিক পাঠাল। বলল দেখতে। আমার দেখে গা গুলিয়ে উঠল। সাথে সাথে ডিলিট করে দিলাম। নিজের কাছেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। সম্পর্কের এত অল্প সময়ের মধ্যে একটা ছেলে এত খোলতা হবে? ওর কি শরীরের কোনও দাম নেই? লজ্জা নেই? পণ্যের মতোই সস্তা ওর শরীর? আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরকে কি জিজ্ঞেস করব যে তাদের বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কের শুরুতেই এমন পিক দেয় কি না! এতটা বিকৃত হয় মানুষ! এতটা অরুচিকর! নিজেকে বুঝ দিলাম, ও হয়তো আমাকে ভালোবাসে আর বিয়ে করবে বলেই এসব করেছে! সেদিন সন্ধ্যায় ওকে অনেক ঝাড়ি দিলাম। এতটা অনাবৃত প্রেম আমি চাইনে! সবকিছুর একটা রহস্য থাকা চাই। রহস্য ফুরিয়ে গেলে প্রেম ফুরিয়ে যায়। আমার কাছে প্রেমটা অনেকটা কাহলিল জিবরানের প্রফেট-এর প্রেমের মতো। প্রেম হলো মন্দিরের চারপাশের স্তম্ভের মতন। এক-একটা স্তম্ভের মধ্যে যেমন দূরত্ব আছে, প্রেমেও তেমন থাকা চাই। স্তম্ভগুলি কাছাকাছি ঘেঁষে থাকলে যেমন তারা তাদের শাখা-প্রশাখা মেলতে পারে না, প্রেমও তা-ই।


এর মধ্যে যেহেতু আমি আমার ফেইসবুক আইডি খুইয়েছি, সেহেতু আমাদের যোগাযোগ ইমোতেই হত। আমার একটা ফেইক আইডি আছে, যেটার কথা ও জানত না। ওটা দিয়ে আমি শুধু গ্রুপস্টাডি করি। তারপরও একবার ওকে রিকোয়েস্ট দিয়েছিলাম ওটা থেকে। ও অ্যাক্সেপ্ট করেনি বলে আমিও কিছু বলিনি আর। সে তার আইডির পাসওয়ার্ড আমাকে দিয়ে ওটা ইউজ করতে বলে। আমি তো অবাক যে ও নিজের পাসওয়ার্ড আমাকে দিয়ে দিয়েছে! আমি নিতে চাইনি বা ব্যবহার করতে চাইনি। ও জোর করেই দিয়েছে। ওর সম্পূর্ণ নতুন আইডি! দুমাস ব্যবহার-করা অফিশিয়াল আইডি! ওতেই আমি খুশি। ওর আইডিতে ঢুকে কোনও কিছু লাইক বা কমেন্ট করতাম না, শুধু দেখতাম। একদিন ওর আইডি থেকে ওর প্রাক্তনের আইডি সার্চ দিয়ে দেখলাম। সেদিন ঈশ্বরই আমাকে দিয়ে ভুল করালেন কি না, আমি জানি না! সেই মেয়ের আইডিতে ভুলে ফলো অপশনে ক্লিক চলে গেল। সাথে সাথে উঠিয়ে দিলাম। মেয়েটা সাথে সাথে রিকোয়েস্ট দিল। রিমুভ করলাম। এরপর সে মেসেজ-রিকোয়েস্টে বলল, কী ব্যাপার? ফলো দিলা, অ্যাড করলাম, অ্যাক্সেপ্ট করলা না কেন? ব্লক খাবা? আমি সাথে সাথে মেসেজ ডিলিট করে দিলাম। পরদিন ও ঘটনাটা টের পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ও কী মেসেজ দিয়েছিল? ডিলিট করে দিলে কেন? ওর কিন্তু গালি দেবার অভ্যাস আছে।’ আমি রুমিকে সব খুলে বললাম।


সম্পর্কের কয়েকদিনের মাথায় ও আমার সাথে ক্লোজ হতে চাইলে আমার কিছুটা সন্দেহ হয়। যদিও সে কখনওই আমাকে দেখতে চায়নি। শুধুই ওকে দেখাতে চাইত। ওকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম, তুমি কি ভার্চুয়ালে অন্যদের সাথেও এমন করতে? সে স্বাভাবিকভাবেই অস্বীকার করত। তবু আমার মধ্যে কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা দ্বন্দ্ব কাজ করতেই থাকে। ওর সম্পর্কে অথেনটিকভাবে খোঁজ নেওয়ার জন্য কোনও সোর্সও পাচ্ছি না। যাদের চিনি, ওদের পুরোপুরি বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। ওর সব বন্ধুই ভার্চুয়াল। কাজেই কারও কাছে থেকেই ওর স্বভাব-চরিত্র কেমন, কিংবা ও আসলেই সাইকো কি না, এসব জানার বা বোঝার উপায় আমার নেই। শুধু একটা বন্ধুই (বর্তমানে শত্রু) ভিজুয়ালি ওকে চিনত যে আমার রিয়েল আইডির ফ্রেন্ড ছিল। কিন্তু এই আইডি দিয়ে আমি তাকে খুঁজে পাইনি যে কিছু জিজ্ঞেস করব!


সন্দেহের বশবর্তী হয়েই ওর আইডিতেই ওর ব্লকলিস্টের মেয়েদের ব্লক খুলে খুলে সার্চ দিলাম। কেন সে এই মেয়েগুলিকে ব্লক দিয়েছে! মেসেঞ্জারেও কিছু পেলাম না। কোনও চ্যাট-হিস্ট্রিই নেই কিংবা সে রাখেনি। এরপর ওদের আবার ব্লক করতে গিয়ে আর পারলাম না। আটচল্লিশ ঘণ্টার আগে পুনরায় ব্লক করা যাবে না, তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম বা তখন জানতামই না! তারপর আমি আর ওই ব্যাপারে ঘাঁটিনি। সে-ও কিছু বলেনি আমাকে। আমি খুশি হলাম এটা ভেবে যে সে এটা নিয়ে আমাকে বিব্রত করেনি। কিন্তু আমি জানতাম না, আমার জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে!


(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য।)