তবুও অপেক্ষা/ তিন

 
যা-ই হোক, আমার প্রথম রিলেশনটা ব্রেকআপ হয়ে যাবার পর আমি আর সম্পর্কে জড়াইনি। ২০১৬ সালে ফেইসবুকের রংতুলি গ্রুপে যুক্ত হলাম। ওই সময় একটা ছেলে গ্রুপে প্রায়ই উলটাপালটা কমেন্ট করত। দৃষ্টিআকর্ষণ করার জন্য কি না জানি না। গ্রুপের পরিবেশ নষ্ট করে দিত। রংতুলি-র মেম্বাররা ওর প্রতি মহাবিরক্ত। সবখানে গিয়ে সে ইচ্ছে করে করে ঝগড়া লাগাবে। হাস্যকর সব কমেন্ট দিবে। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগল। ফেসবুকে ওর আইডি’র নাম ‘অন্ধকারের নেকড়ে’। ওকে রিকোয়েস্ট দিলাম। তার আইডিতে পরিচয় দেওয়া…বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার। আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র হবে। রিকোয়েস্ট দেবার পর আমার একটা পোস্টে সে কমেন্ট দিয়েছিল। আমার পোস্টটা ব্যঙ্গাত্মক ছিল। শিরোনাম ছিল: বিবাহযোগ্য পুরুষের জন্য দশটি পরামর্শ, সাথে একটি ফ্রি! সেই পোস্টে এক জায়গায় লিখেছিলাম হতাশ হয়ে অনেকটা এরকমভাবে: আমার ক্রাশ রিজভি ভাইয়ার পছন্দ এমন মেয়ে, যে মেয়ে ভাইয়ার হয়ে তাঁর আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখবে, কারণ ভাইয়া আত্মীয়স্বজনদের খোঁজখবর নিতে ভুলে যান! রিজভি ভাইয়া হচ্ছেন পুলিশের এএসপি, ফেসবুকে খুবই অ্যাক্টিভ, সবাই চেনে তাঁকে। ওঁকে আমি খুব পছন্দ করতাম তখন।


সেই পোস্টে ওই ছেলে কমেন্ট করেছে, অদ্ভুত এক কমেন্ট। কমেন্টটা পড়ে আমি অভিভূত হই! আমার বন্ধুমহলেও বেশ সাড়া পড়ে। অনেকটা এরকম কমেন্ট ছিল: আমি বউ হিসেবে এমন মেয়ে চাই, যে একলাফে নারিকেলগাছে চড়তে পারে, ঝাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরতে পারে, সবগুলি টিকা নেওয়া আছে, সব গান গাইতে পারে, সব রান্না জানে, এক থেকে বিশের নামতা পারে, একমিনিটে আমেরিকার সব প্রেসিডেন্টের নাম বলতে পারে, দাঁত দিয়ে ট্রাক টানতে পারে…সে বিশাল এক কমেন্ট! পরবর্তীতে শুনেছি, এই লেখাটা ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। কমেন্টটা পড়ে মাঝরাতে প্রচণ্ড হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল! একদিন রংতুলি-তে খনার বচন নিয়ে একটা লেখা দিল। আমি কমেন্টে একটা খনার বচন দিলাম। কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত। সে আমাকে রাগানোর জন্য কমেন্ট দিল: এগুলি হলো বস্তির ভাষা! আমার আর প্রতিবাদ করার দরকার ছিল না, যদিও করেছিলাম, সাথে অন্য সদস্যরাও ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেদিন প্রথম সে আমাকে ইনবক্সে নক দিয়ে বলে, আপা, ওই লোক আমাকে কমেন্টে ভেড়া বলেছে। আপনি তার কানের নিচ বরাবর দুইটা থাবড় মেরে কমেন্ট দেন। আমি বললাম, আপনাকে সে ভেড়া বলেছে, আপনি ওকে দুম্বা বলেন। আমি কেন ওকে থাবড় মারতে যাব? সে বলে, গ্রুপে তাকে ব্লক করা হয়েছে, সে কোনও কমেন্টই করতে পারছে না।


ইনবক্সে এইটুকুই আমাদের কথন। সে কখনওই আমাকে নক করে না। আমিও না। খুব প্রয়োজনে কিছু জানার থাকলে নক করি। সে হ্যাঁ কিংবা না, এইটুকুতেই থাকত। ইনবক্সে বেশি কথা বলত না। এটা আমার খুব ভালো লাগত। মনে হতো, তার চরিত্র খুব ভালো। যেসব পুরুষ রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করার সাথে সাথেই হাই হ্যালো বলে খেজুরে আলাপের জন্য নক দেয়, তাদের আমার চরিত্রহীন লাগে। আমিও আগ বাড়িয়ে কখনওই অচেনা লোককে নক করি না। তো, তার সাথে আমার কমেন্টবক্সেই যুদ্ধ হতো। আমরা ঝগড়া করতাম। সে নারীবিদ্বেষী পোস্ট দিত, আর আমি পুরুষবিদ্বেষী। লোকে ভালো ভালো লেখা ফেইসবুকে দিয়ে মানুষের কাছে ভালো হতে চায়। আর সে দিত উলটাপালটা পোস্ট। হতে পারে, নিজেকে খারাপভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে মানুষের অ্যাটেনশন সিক করতে চাইত। আর তাকে এসব কারণেই কিনা তাকে আমার খুব ভালো লাগত। নিঃসন্দেহে অনেক মেধাবী, ক্রিয়েটিভ মনে হতো তাকে। আমি আকৃষ্ট হতাম। তার সব উদ্ভট পোস্ট আর মজার মজার কমেন্ট পড়তাম। আমার রিয়েল আইডির নাম ‘নটি বিনোদিনী’। মাঝে মাঝেই তাকে রাগিয়ে দিতাম কমেন্টবক্সে। সে-ও আমাকে রাগানোর জন্য ঘটি বিনোদিনী, বটি বিনোদিনী, চটি বিনোদিনী ইত্যকার সম্বোধন করে করে কড়াভাষায় জবাব দিত।


তার মধ্যে কোনও ধরনের লুতুপুতু টাইপ ব্যাপার ছিল না। নিজেকে ভালো দেখানোর চেষ্টা তো ছিলই না, বরং নিজেকে বাজে ছেলে হিসেবে তুলে ধরত। আমার তাকে ভালো লেগে যায়। ছেলেটা কিছুটা পাগল পাগল। ব্রিলিয়ান্টরা অমনই হয়। এবং, এই ভালোলাগা পর্যন্তই আমাকে টানতে হয়। তাকে ভালোবাসার স্পর্ধা আমার নেই। সে দূরের নক্ষত্র! বিসিএস ক্যাডার, আর আমি পাবলিক ভার্সিটি থেকে পাসকরা বিসিএস প্রিলি-ফেল বেকার ছাত্রী! কাজেই তাকে আশা করাই আমার দুরাশা! কোনও দিন তাকে আমি পাব না। ভার্চুয়াল স্ক্রিনে তার পোস্টগুলি ছুঁয়ে-দেখা ছাড়া আমার আর করার কিছুই নেই! তার সামনে আমি অর্বাচীন, অপাঙ্‌ক্তেয়। এসব মনে হতো।


আইডি’র নাম বদলে রাখলাম---অন্তঃপুরবাসিনী। এই ছদ্মনামটা রূপক অর্থে আইডিতে ব্যবহার করেছি। আমার জীবন এখনও অন্ধকারে। আলোর মুখ এখনও দেখিনি। যেদিন সূর্য দেখব, যেদিন একটা ভালো চাকরি পাব, আর যেদিন…(থাক, এটা পরে বলি), সেদিনই আমার আইডিতে আসল নামটা দেবো।…এরকম একদিন তার পোস্টে কমেন্ট করতে গেলে উটকো এক লোক এসে আমার নাম নিয়ে প্রশ্ন তোলে। লিখে, ‘যারা হীনমন্যতায় ভোগে আত্মপরিচয় নিয়ে, তারাই ছদ্মনাম দেয়।’ এতে সেই ছেলেও সায় দেয়। আমি খুবই আবেগী ধরনের মেয়ে। প্রচণ্ড কষ্ট পেয়ে কেঁদে ফেলি। রাগ করে, অভিমান করে তাকে ব্লক দিলাম। সে অনেক দিন আমার ব্লকলিস্টে ছিল, কিন্তু কীভাবে জানি সেই ব্লকটা খুলে গেল। আমার বান্ধবীর পোস্টে সে প্রায়ই কমেন্ট করত। (সে মজার মজার পোস্ট করত বিধায় বান্ধবীকে আমিই বলেছিলাম ওকে রিকোয়েস্ট দিতে।) ততদিনে তার পোস্টে আমি কমেন্ট করতে করতে তার ফেইসবুক ফ্রেন্ডদের কাছেও বেশ পরিচিত হয়েছিলাম। তার মিউচুয়াল অনেক ডাক্তার ফ্রেন্ডও আমাকে রিকোয়েস্ট দেয়। তো, ব্লক করার পরও খেয়াল করলাম, আমার ফ্রেন্ডের পোস্টে তার কমেন্টগুলি পড়তে পারছি। সেখানেও আমরা ঝগড়া করতে শুরু করলাম।


তার সাথে এক মিউচুয়াল ডাক্তার ফ্রেন্ড, তিনিও বিসিএস ডাক্তার, আমাকে প্রায়ই নক দিয়ে সাধারণ জ্ঞান ধরতেন, যেহেতু তাঁকে বলেছিলাম, আমি বিসিএস প্রিপারেশন নিচ্ছি। তিনি বিবাহিত। তাঁকে আমি ভাইয়া বলে ডাকি। তিনি একদিন ওই ছেলের ব্যাপারে আমাকে অনেক তথ্য দিলেন। কিছুটা আমি কৌতূহলী হয়ে জেনে নিলাম, কিছুটা তিনি নিজেই যেচে বললেন। ধরে নিই, ছেলেটার নাম রুমি। রুমি সম্পর্কে ভাইয়া আমাকে বললেন, তাঁদের মূলত ফেইসবুকেই পরিচয়। এরপর তিনিই ওকে অনেক কষ্টে বদলি করিয়ে নিজের কর্মস্থলে নিয়ে আসেন একসাথে পড়াশোনা করার জন্য। রুমি সাইকো-টাইপ। প্রচুর কৃপণ। জমিজমা নিয়ে মাকে সন্দেহ করে যে মা সবই তার ভাইকে দিয়ে দেবেন। ওদের প্রচুর টাকা করেছে। ওষুধ কোম্পানির কাছে মাসে সর্বোচ্চ টাকা নিত এক লাখ করে। বিভিন্ন দালাল থেকে প্রচুর টাকা নিত। রোগীদের অপ্রয়োজনীয় অনেক টেস্ট দিত। এসব কারণে সাংবাদিক তার বিরুদ্ধে অনেকবারই রিপোর্ট করেছে। সেইসব পেপারের কাটিং ভাইয়া আমাকে দেখালেন।


সে যেখানেই কাজ করে, সাইকো হবার কারণে সিনিয়র জুনিয়র সবার সাথেই ঝামেলা বাধে তার। তবে সে খুব মেধাবী আর তার নিজের সেক্টরে খুব ভালো বলে ডাক্তারদের অনেকেই তার কাছে কোর্স সংক্রান্ত নানা কাজে হেল্প নেয়। আচরণগত কারণে পানিশমেন্ট দিয়ে দিয়ে তাকে দূরে বদলি দেওয়া হয়। অথচ আমি তাকে গ্রামের মানুষদের একজন সৎ গরিব ডাক্তার ভেবে তার প্রেমে পড়েছি! অবশ্য এসব তথ্য তার প্রতি আমার দুর্বার আকর্ষণ একটুও কমাতে পারেনি। বরং আরও বেড়েছে! আমার মধ্যে একধরনের ফ্যান্টাসি কাজ করেছে। কাছ থেকে তাকে জানবার কৌতূহল আরও অদম্য হয়েছে। কিন্তু তার কাছে যাবার বা নিজেকে সেভাবে অ্যাপ্রোচ করার সাহসটা আমার ছিল না। একদিন তাকে ইনবক্স করলাম পেপারের কাটিংটা দিয়ে। বললাম, এটা দেখে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি! সে বলল, দোষী আর অভিযুক্ত এক না। সাংবাদিককে টাকা দিয়ে কেউ এগুলি করেছে। এরপর কথায় কথায় আবার তাকে রিকোয়েস্ট দিলাম। সে-ও আট-দশজনের মতো আমার ফ্রেন্ডলিস্টে থেকে গেছে। ইনবক্সে কালেভদ্রে ঈদে শুভেচ্ছাবিনিময় আর পোস্টে মাঝেমধ্যে একে অপরকে পচানো। তাকে কখনও বুঝতে দিইনি তার প্রতি আমার দুর্বলতা। তাকে সব সময়ই নিভৃতে আমার নীরবমন্দিরে রেখে দিয়েছিলাম।


২০১৮। আমার জীবনে সবচাইতে বেশি ক্রাইসিস-মোমেন্ট। এরপর থেকে পেয়ে হারিয়েছি অনেক কিছু, আর যা হারিয়েছে তা আর পাইনি কখনও।


৩১ জানুয়ারি ২০১৮। ৩৮তম বিসিএস-এর ঠিক এক মাস পর। আগের দিন রাতে বাবার সাথে বসে টিভি দেখছি, আর বাপ-বেটি খুনসুটি করছি। মা আর বড়ো বোন মারা যাবার পর বাবার সাথে একটু একটু করে দূরত্ব কমছিল কেবলই। আগে আমরা মা মেয়েরা একসাথে আড্ডা দিতাম। বাবা সব সময় দূরে দূরেই থাকতেন। তাই অতটা গল্পকরা বা ফ্রি হয়ে-ওঠা হয়নি তাঁর সাথে। ধীরে ধীরে আমাদের আইসব্রেকিং হচ্ছিল। রাতে টিভি দেখে আমরা ঘুমাতে গেলাম। প্রতিদিন ফজরের নামাজের ওয়াক্তে বাবা প্রথমে আমাদের রুমে এসে সবার আগে আমাকে ডাক দিয়ে মসজিদে যান। কিন্তু সেদিন এমন মরণঘুম ঘুমিয়েছিলাম যে রোজ ভোরের মতো বাবার ডাকটা আর শুনতে পেলাম না। ঘুম ভাঙল ভোর ছটায়, কলাপসিপল গেইটের ধাক্কায়। বাসার দেখাশোনা, রান্না, বাজার-সদাই করেন যে আপা, তিনি দৌড়ে নিচে গেলেন। এক আগন্তুক জানালেন, আপনাদের বাসার মুরুব্বি অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন! একদৌড়ে মেইনরোডে গেলাম আমি আর শাহেদা আপা।


মেইনরোডে এসে আমি শুধু রক্ত খুঁজি, রক্ত! না কোথাও রক্ত নেই। দৌড়ে কাছের হাসপাতালে গেলাম। তারা জানাল, এখানে এনেছিল এক মুরব্বিকে, তাঁকে আর্মির হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বেশি কিছু হয়নি, কোমরে ব্যথা পেয়েছিলেন। তারপর বাসায় এসে কোনওমতে রেডি হয়ে সাতটায় আমি আর শাহেদা আপা সিএমএইচ-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মেজো বোন বাসায় রইল। কিছুদিন আগে পা মচকে প্লাস্টার করেছে ওর পা। সিএমএইচ-এ আইসিউ’তে যন্ত্রণাকাতর বাবাকে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখলাম। মনে বারবার আসছিল, আল্লাহ্‌ কেন তাড়াতাড়ি এই যন্ত্রণা থেকে বাবাকে মুক্তি দিচ্ছেন না! বাবার কপালে হাত রাখলাম। বললাম, তোমার কিচ্ছু হয়নি। বাবার সারাশরীরে কোনও ক্ষত নেই। তিনি শুধু ও আল্লাহ্‌ ও আল্লাহ্‌ বলে বলে প্রলাপ বকছিলেন আর বলছিলেন, রাস্তা পার হবার সময় হাত তুলে একদিক থেকে আসা ট্রাক থামাতে গিয়ে আর-একদিক দিয়ে অন্য ট্রাক এসে ধাক্কা দেয়। তাঁর হাতের উপর দিয়ে ট্রাক চলে যায়। হাতে আর পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা।


ডাক্তার এলেন। এক্সরে করলেন। বার বার আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, তোমার কে কে আছে? আর গার্ডিয়ান নাই? ভাই আছে? মুখটাকে প্রচণ্ড শক্ত করে বললাম, না! জিজ্ঞেস করলেন, মা আছেন? বললাম, ‘না। দুই বোন ছিল, এখন এক বোন আছে।’ কর্নেল হাফিজ বললেন, বাবার বুকের চার/পাঁচটা রিব ভেঙে গেছে। কোমরেও ফ্র্যাকচার। মাথায় ইনারব্লিডিং হয়ে থাকতে পারে। ডায়বেটিসের কারণে বুকের ব্যথা টের না পেয়ে হাতের ব্যথা বলছেন। আমি শক্ত মুখে শুধু শুনলাম। শক্ত চোয়ালে ডাক্তারের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার বাবা কি বাঁচবেন? কতক্ষণ এভাবে বাঁচবেন?’ এর উত্তরে উনি বললেন, ‘রক্ত জোগাড় করো। ৪/৫ ব্যাগ লাগতে পারে।’ বন্ধুদের ফোন দিলাম। নিজেও এক ব্যাগ দিলাম জোর করে। আমার হিমোগ্লোবিন কম থাকায় ডাক্তাররা কিছুতেই নিবেন না, তাই জোর করেই দিলাম। রক্ত দিয়ে আবার বাবার কাছে ফিরে গেলাম। বাবা তখনও প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করছেন। ওরা বেশিক্ষণ আমাকে থাকতে দিল না ওখানে, বের করে দিল। বাইরে অপেক্ষমাণ অ্যাম্বুলেন্সটি ঢাকায় নিয়ে যাবার জন্য রেডি হচ্ছে।


কতক্ষণ পর দেখলাম, সেটাও ফিরে যাচ্ছে। আইসিউ’র দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ ডাক্তার নার্সরা সব দৌড়ে এসে বাবার চারপাশে ঘিরে ধরল। আমি দূর থেকে দেখলাম। সকাল দশটার দিকে ঠিক যে-ই বেডে আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল, একই বেডে বাবাও চলে গেলেন। ফুপুরা, আত্মীয়রা এল। লাশ ওখানেই গোসল করানো হবে। সেজো ফুপু কাঁদতে কাঁদতে বারবার ফিট হয়ে আমার কাঁধে পড়ছিলেন। তাঁকে সামলে ধরলাম। বড়ো ফুপু চিৎকার করে কাঁদছেন। তাঁকে বার বার শান্ত থাকার অনুরোধ করছি। সবাই কাঁদছে, সবাই! শুধু আমি কাঁদছি না। আমার মধ্যে মৃত্যু সম্পর্কিত কোনও বোধ কাজ করছে না। মানুষ অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর হয়। আমি পাথর হয়ে গেলাম। এবং জানতাম, এ আমার মহাকালের অমোঘ নিয়তি। আমি এর জন্যই জন্মেছিলাম। আশেপাশের মানুষ দেখে বলছে, ওরে একটু কাঁদান, ওরে একটু কাঁদান! মেয়েটা বুক ফাইটা মইরা যাইব তো। দুজন লেডি-ডাক্তার হেঁটে যাচ্ছিলেন আমার পাশ দিয়ে, ওঁরা আমাকে ততটা খেয়াল করেননি, নিজেদের মধ্যে বলছিলেন, মেয়েটা মেন্টালি কী স্ট্রং! কী স্ট্রং!


আমার মাথার উপর থেকে শেষছায়াটাও চলে গেল। এতিম হবারও একটা লিমিট আছে! পরিবারের আপনমানুষ মরারও একটা লিমিট আছে! আমার বেলায় এতটা হতে হলো! আমি কী অপরাধ করেছি? আমি এখন কার বুকে মাথা রেখে কাঁদব? কাকে জড়িয়ে কাঁদব? মা থাকলে তিনি সান্ত্বনা দিতেন, দুজনের একজন বেঁচে থাকলে আর-একজনকে আঁকড়ে ধরে সান্ত্বনা খুঁজতাম। বড়ো বোনটা, যে মানুষ ছিল না, উনমানুষ ছিল, ওকেও তো জড়িয়ে ধরে অন্তত সান্ত্বনাটুকু পাবার চেষ্টা করতে পারতাম। সে-ও যে নেই! আমাকে ভালোবাসে, এমন কেউ নেই আমার সামনে। এরকম একটা অবস্থায়ও আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। মানুষকে যে কীসের কীসের মধ্যেও বেঁচে থাকতে হয়!


৩৬তম বিসিএস-এর তিন মাস আগে হঠাৎ করে মা মারা গেলেন, ৩৮তম-এর ছয় মাস আগে বড়ো বোন আর এক মাস পর বাবা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন। মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে পরিবারের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষগুলি পরপর চলে গেল। বন্ধু-বান্ধব সান্ত্বনা দেবার ভাষাটাও খুঁজে পেল না। ওরা প্রায়ই বলে, আল্লাহ্‌ তোদের উপর অবিচার করেছেন! ওদের ধারণা, আমি নাকি অনেক স্ট্রং, অনেক শক্ত। ওরা আমার জায়গায় হলে পাগল হয়ে যেত। উত্তরে আমি কিছু বলি না, শুধু শুনে যাই। বলে আর কী হবে! এদিকে দিনের পর দিন বিসিএস দিয়েই যাচ্ছি। আমার হচ্ছে না। বন্ধুরা বলে, আমি মেধাবী, কিন্তু মেধাটাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারছি না। ওদের ধারণা, আমি যে-কোনও কিছু ভালো লিখতে পারি। কাজেই কোনওমতে প্রিলি পাস করতে পারলে রিটেন পাস-করা আমার জন্য সহজ। কিন্তু আমার জন্য প্রিলির বৈতরণী পার হওয়াই দুরূহ! একে তে ম্যাথ পারি না। সায়েন্স-রিলেটেড সাবজেক্টও অত পারি না। যা পারি, তা হলো মুখস্থকরা- বা পুঁথিগতবিদ্যা। প্রয়োগিক কিছু আমার মাথায় ঢুকে না। তার উপর ভুল-দাগানোর লোভ সামলাতে পারি না। ওদিকে সায়েন্সের ছেলেমেয়েরা ম্যাথে সায়েন্সে ছাক্কা নম্বর তুলতে পারে। আমি ওদের সাথে কম্পিটিশনে ওই জায়গায় গিয়ে ধরা খাই।


যা-ই হোক, বাবা মারা যাবার মাত্র দুইদিন পর ডিফেন্সের ভালো একটা স্কুলে পরীক্ষা ছিল। খণ্ডকালীন একটাই পদ। ক্যান্ডিডেট ৩২ জন। আমার ডিপার্টমেন্টের অনেকেই ছিল। কিছুদিন পর আল্লাহ্‌র রহমতে কীভাবে যেন আমার রিটেনে হয়ে গেল। ভাইভাতে ডাক পড়ল। ভাইভা-ক্যান্ডিডেট তিন জন। আমার ভাইভা ভালো হলো। টিকে গেলাম। জয়েন করব কি করব না, দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে জয়েন করে ফেললাম। বেশ ভালোই যাচ্ছিল সবকিছু। সমস্যা একটাই, শাড়ি পরে ক্লাস নিতে হবে। প্রতিদিন এত দূর থেকে শাড়ি পরে যাওয়া-আসা কষ্ট, তার উপর প্রাইভেট জবে অনেক ধরনের কড়াকড়ি। খুব ইচ্ছে ছিল, কলেজের লেকচারার হব। এরপর এমফিল, পিএইচডি করব। আমার এলাকায় সব কলেজে খোঁজ করলাম। কোথাও হিস্ট্রি নেই। কলেজগুলিতে হিস্ট্রি সাবজেক্টটা খুব রেয়ার। সবখানেই ইসলামের ইতিহাস। পুরান ঢাকার একটা ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল।


ওরা নতুন ইতিহাস-বিভাগ খুলেছে। নিবে ছয়জন। অ্যাপ্লাই করলাম। রিটেনে টিকলাম। ভাইভাতে ঢাবি’র মেজবাহ স্যার ছিলেন। ছয়জন সিলেক্টেড হলাম। ফোন দিয়ে কাগজপত্র নিয়ে যেতে বলল। গেলাম। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। প্রিন্সিপাল ম্যাম বললেন, নতুন বিভাগ, তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেতে দেরি হবে। আপাতত তারা দুজন নিবে। অপেক্ষা করছি তো করছিই। বছর ঘুরে আসে তবু খবর নেই। হঠাৎ প্রিন্সিপাল ম্যাম ফোন দিলেন। বললেন, তাঁর পিএস হিসেবে তিনি আমাকে নিতে চান। আমি বললাম, আপনার প্রস্তাব আমি ভেবে দেখব। তখনও ওই স্কুলে আমি জব করতাম।


জয়েনিং-এর ছয় মাস পর স্থায়ী নিয়োগের জন্য আবার রিটেন পরীক্ষা দিলাম। টিকলাম। ভাইভাতে একেবারে সবার প্রথমে ছিল আমার ভাইভা। একটু ঘাবড়ে গেলাম। ভাইভা ভালো হলো না। বাদ পড়লাম। ওদিকে ওই কলেজে পিএস হতে সবাই মানা করল। লেকচার পদে আবেদন করেছি, কিন্তু পিএস পদে যোগ দিব কেন? একদিন গেলাম সেই কলেজে। প্রিন্সিপাল ম্যাম আমাকে দেখে চূড়ান্ত অপমান করলেন। তিনি আমাকে দয়া বা করুণা দেখাতে চেয়েছিলেন, যেহেতু আমার মা, বাবা নেই, আনম্যারিড মেয়ে আমি! কিন্তু আমি তাঁর দাক্ষিণ্য গ্রহণ করলাম না কেন, সে অপরাধে তিনি আমাকে লেকচারার পদের সিলেকশন-লিস্ট থেকেই বাদ দিলেন। প্রচণ্ড ভেঙে পড়লাম। এক বছর ধরে এই কলেজের লেকচারার হবার আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। পরে শুনেছিলাম, অন্যান্য ক্যান্ডিডেটের কাছ থেকে মোটাঅংকের টাকা নিয়েছেন সদ্য হজ্জ্ব-করা ওই প্রিন্সিপ্যাল ভদ্রমহিলা।


এদিকে বাবা মারা যাবার পর আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন মানুষের চাপে পড়ে বিয়ে করতে বাধ্য হলো মেজো আপু। ওর স্কুলের কলিগের দেবরের বন্ধুকে। ভাইয়া একটা বেসরকারি ইউনিভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার। আমাদের বাসাতেই থাকেন আপু-দুলাভাই, যেহেতু আমার কেউ নেই।


চাকরিটা চলে যাবার পর আমি প্রচণ্ড ডিপ্রেসড হয়ে পড়ি। আপু দুলাভাই সকাল হলেই যার যার কাজে চলে যেত। বাসার যে বাজার-করার আপা, তিনি প্রায়ই বাইরে বাইরে থাকতেন। আর এত বড়ো বাসায় আমি একা। কথা বলারও কোনও মানুষ নেই। পড়ার টেবিলে বিসিএস-এর বই সামনে রেখে চেঁচিয়ে কাঁদতাম। কেউ দেখত না, কেউ শুনত না। কারও সাথে কথা বলতে না পাড়ার সে যে এক কী নিদারুণ যন্ত্রণা, বলে বোঝানো যাবে না। যার কথাবলার কেউ নেই, তার পক্ষে সুস্থথাকাটা অনেক কঠিন। সেই থেকে আমার একটা মানসিক সমস্যা হয়ে গেছে। আমি প্রচুর কথা বলি। বন্ধু-বান্ধব যাকেই সামনে পাই, হরহর করে কথা বলে যাই, কাউকেই কোনও ফ্লোর দিই না। নিজেই অনর্গল বলে যাই। কী বলি না বলি, অনেক সময় নিজেও বুঝি না। অপরপ্রান্তের মানুষের কথা শুনি না, বুঝি না। বোঝার চেষ্টাও করি না। যখন কারও সাথে কথা বলতে পারি না, আমার প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। অস্থির লাগে। তখন আমি লিখি। লেখালেখি আমার অনুভূতিগুলিকে মুক্তি দেয়। আমার ব্যথার উপশম করে। তাই ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে আমার একটা জগত তৈরি করে নিয়েছি। যখন যা মন চায়, লিখি। বেশিরভাগই হাস্যরসাত্মক লেখা। দুঃখের লেখা লিখতে পছন্দ করি না। বন্ধুরা আমার কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত। আবার এ-ও বলে, আমি নাকি কথা বলি বলেই বেঁচে আছি। কথা বলতে না পারলে বুকে চাপাকষ্টে দম বন্ধ হয়ে মারা যেতাম। বাবা মারা যাবার পর আমার দুঃখগুলি অন্যদিকে বাঁক নেয়। আমার জীবনের সেই হাহাকার, তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে বাইরের কেউ তেমন একটা জানে না। আসলে কারও যন্ত্রণাটা আসলে কেমন, এটা এক সে নিজে বাদে পৃথিবীর আর কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। ওরা তার যন্ত্রণা নিয়ে যা বলে কিংবা ভাবে, তার পুরোটাই অনুমাননির্ভর মতামত বা ধারণা।


আমাদের সমাজে আমার বয়সি বেকার ছেলেদের সব সময় একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে দুটো! আমি নিজের ডিপার্টমেন্টে যাই না ভয়ে। তখন মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রশ্নটি হলো, যখন পরিচিত শিক্ষকেরা দেখা হলে জিজ্ঞেস করেন---‘এখন কী করছ?’ উত্তর যখন হবে, ‘কিছু করছি না, স্যার।’, তখন দ্বিতীয় প্রশ্ন---‘বিয়ে হয়নি?’ (মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রশ্নটা এভাবেই ছুড়ে দেওয়া হয়, ভাবখানা এমন যেন ছেলেরা চাইলেই বিয়ে করতে পারে যখন তখন, আর মেয়েদের বিয়ে হয়! হ্যাঁ,…হয়! কখন হয়? যখন কোনও ছেলে দয়াপরবশ হয়ে মেয়েটাকে বিয়ে করে, তখনই মেয়েটার বিয়ে হয়!) সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, আত্মীয়স্বজনও এর থেকে বাইরে নয়। ‘এখনও চাকরি হচ্ছে না কেন?’ ‘বয়স হয়ে যাচ্ছে, বিয়ে হয় না কেন?’ সমাজের মানুষের এসব ছুড়ে-দেওয়া প্রশ্নে তখন অসহায় পর্যুদস্ত মানসিকভাবে ভেঙেপড়া আমার মতো একটা মেয়ের মনে হয়, বিয়েটাই বুঝি সব! বিয়েটাই একমাত্র মুক্তি! সকল সমস্যার সমাধান। মানুষের মুখ বন্ধ করার মোক্ষমঅস্ত্র। যে মেয়ের বিয়ে হয়নি, সে মেয়ের দায়িত্ব গোটা সমাজের কটূক্তি হজম করে করে বেঁচেথাকা। সে কারও না খাক, না পরুক, তা-ও তাকে লোকজনের বক্রচাহনি সহ্য করতে হবে! অথচ সে মেয়ে কখনও কোনও বিপদে পড়লে, তখন সমাজের সেই মানুষগুলিকে তার পাশে পাবে না।


মা বলতেন, ‘অতি বড়ো ঘরনি না পায় ঘর, অতি বড়ো সুন্দরী না পায় বর!’ আমার মা ঘর পাননি, আর মেজো বোন বাবা মারা যাবার পর আফটার-ফরটিতে বিয়ে করেছে। আর আমার জীবন তো এখনও অনিশ্চিত। বিয়ে নিয়ে আমার নিজস্ব একটা দর্শন আছে, যেটা শেয়ার করতে চাই। সব সময় ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছি। অ্যারেঞ্জড-ম্যারেজ করার ব্যাপারে আমার কখনওই ইচ্ছে নেই। আমার খুব ইচ্ছে, সমমনা, প্রায় সমবয়সি কাউকে জীবনে খুঁজে নিতে, যে আমার বর হবে না, বন্ধু-বর হবে! দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ভার্সিটির পুরো সময়টাই একটা অপাত্রে ঢেলেছিলাম, যে মানুষটা দীর্ঘদিন যাবত তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরিবার সম্পর্কে তথ্য গোপন করে আমার সাথে সম্পর্ক করেছে। পরবর্তীতে আমার যে কজন বন্ধু এসেছে, তাদের প্রতি আমার সে রকম কোনও অনুভূতি ছিল না, তাদেরও ছিল না। যারা আমাকে সেভাবে অ্যাপ্রোচ করেছে, তাদের সাথে মনমানসিকতায় আমার মিলেনি। সত্যি কথা বলতে, একদম অচেনা অজানা মানুষকে বিয়ে করতে ভয় হয়। সারাজীবনই নিজের পছন্দে বিয়ে করতে চেয়েছি। বিয়ে নিয়ে আমার দুইটা পারসেপশন আমাকে খুব প্রভাবিত করে।
এক, শরৎচন্দ্রের ভাষায়, ‘যাকে তাকে গছিয়ে দেওয়ার নামই বিবাহ নয়! মনের মিল না হলে বিবাহ করাই ভুল।’ দুই, ক্লাস নাইন-টেনে সমরেশের সাতকাহন পড়েছিলাম মায়ের অনুরোধে। ওখানে একজায়গায় দীপাবলিকে তার হোস্টেলের বিদেশি নিগ্রো বান্ধবী বলে, তোমরা বাঙালিদের বিয়েটা একটা বিশ্রী রীতি! তোমরা প্রথমে শরীরে প্রবেশ করো, পরে মনে। আর আমরা আগে যাকে ভালোবেসে মন দিই, তারপর তাকে শরীর দিই।
…এই কথাগুলি আমার খুব দাগ কাটে।


বাবা মারা যাবার ৪/৫ মাস পর যখন আমি চাকরিবাকরি, একাকিত্ব সবকিছু নিয়ে ভীষণ ডিপ্রেসড, ঠিক সেই সময় মেজো বোনের বান্ধবী তার খালাত ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব আনে। একদিন হুট করে ছেলেটাকে সে বাসায় নিয়ে আসে। ছোটোখাটো অল্পবয়সি একটা ছেলে। কোনও একটা কোম্পানির ডিরেকটর। দেখলে মনে হয় না যে এখনও ঠিকমতো দাড়ি উঠেছে, দেখতে একেবারেই বাচ্চা বাচ্চা টাইপ। প্রথম দেখায় তাকে আমার ঠিক ম্যানলি লাগেনি, তবে বন্ধুসুলভ লেগেছে। কিছুদিন পর ফেইসবুকে রিকোয়েস্ট দেয়। নক দেয়। টুকটাক রেসপন্স করি। কথা বলতে বলতে জানলাম, এই ছেলেটা সাহিত্যপ্রেমী। প্রচুর বই পড়তে পছন্দ করে, আর ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। আমার চেয়ে এক বছরের বড়ো। মোটামুটি আমি যেমন চাই, তেমনই। কিন্তু বাসায় রাজি হচ্ছিল না। ছেলের বাবা পিডিবি’র চিফ-ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সে তুলনায় ছেলে তেমন যোগ্য নয়। একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে এমবিএ করে বাবার দেওয়া কোটি টাকায় রিয়েল এস্টেট কোম্পানির শেয়ার কিনেছে। সে হিসেবে নিজের আয় রোজগার হয়তো নেই, স্বাধীনতা নেই। বাবার উপর নির্ভরশীল। তা ছাড়া বর্তমানে ডেভেলাপার কোম্পানিগুলি লসে আছে।


ধীরে ধীরে ছেলেটার মুখের স্তুতিবাচক কথাবার্তায় মুগ্ধ হই। অতীতের দুঃখ ভুলে যেতে থাকি। কাউকে আঁকড়ে বাঁচার, ভালোবাসার স্বপ্ন দেখতে থাকি। এ বাড়িতে সব সময়ই মৃত্যুর উৎসব হয়েছে। কখনও বিয়ের উৎসব হয়নি। বউ সাজতে বড়ো লোভ হয়। চোখের কোণে লটকে থাকে---লালশাড়ি আর হাতভর্তি মেহেদি। সব হারিয়ে নতুন করে সংসার-সাজানোর স্বপ্ন দেখি। আমার তো আর পিছুটান নেই, কাউকে হারাবার ভয়ও নেই। যাকে পাব এ জীবনে, তাকেই জীবনের সমস্ত সঞ্চিত ভালোবাসা দেবো। বড্ড ইচ্ছে, যাকে ভালোবাসব, তাকে জড়িয়ে ধরে একদিন খুব কাঁদব। একসমুদ্র কান্না বুকে জমিয়ে রেখেছি। আমার একজন মানুষ লাগবে, যাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করা যায়। তার দুঃখগুলি আমি নিতে চাই, আর আমার দুঃখগুলি তাকে দিতে চাই। এ পৃথিবীতে সুখের ভাগীদার তো অনেককেই পাওয়া যায়, কিন্তু দুঃখের ভাগটা কেউ নিতে চায় না। অবশ্য, যাকে তাকে দুঃখ ভাগ করতে চাওয়াটাও অনেক বড়ো একটা বোকামি। তাই আমি দুঃখকে গোপন রাখতেই ভালোবাসি।


ছেলেটা আমার চোখের প্রশংসা করত খুব! ‘বড়ো বড়ো কাজলকালো একজোড়া আর্দ্র গভীর চোখ! চোখে যেন কীসের হাহাকার আছে!’ এই কথাটা বলত। সে ঘুরতে ভীষণ পছন্দ করে। বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে প্রায় ৬০/৬২টা জেলা ঘোরা হয়েছে তার। সে আমার চোখে ঘোরার স্বপ্ন বুনে দেয়। আমি কোনও দিন বাংলাদেশের আনাচেকানাচে ঘুরতে পারিনি। স্বপ্ন দেখি, বরের সাথে বরের হাত ধরে সমস্ত বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াব। এই ছেলেটা আমাকে সাজেকে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখায়। পাহাড়ের অনেক উপরে মেঘের খুব কাছে সে যাবে। তবে একা নয়, তার স্ত্রীকে নিয়ে যাবে একান্তে নিরিবিলি গল্প করবে বলে! আমার চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে উঠে। আমার মনে হতে থাকে, শুধু সাজেকে যাবার জন্য হলেও এই ছেলেকে বিয়ে করা উচিত। ওদের আধুনিক উদার পরিবার। ছেলের মা নেই। একদিন সে তার বাবাকে নিয়ে আমাদের বাসায় এল। সাথে খালাত ভাই আর ভাবি। আমার মামারাও ছিলেন। বিয়ের কথা কিছুই আলোচনা হলো না। শুধু দেখাদেখি হলো।


পরদিন ছেলের বাবা জানালেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে তাদের। সন্ধ্যার পর ছেলের খালাত ভাবি ফোন দিলেন। বেশ প্রগতিশীল মহিলা। কপালে বড়ো টিপ পরেন। শান্তি নিকেতনে গানের উপর পড়াশোনা। এখন আর গান করেন না। চাকরিও করেন না। কারণ স্বামী বারণ করেছেন। আমাকে প্রথমকথাই বললেন, রান্না পারি কি না! তাদের দরকার একটা সংসারী ঘরোয়া মেয়ে। তাঁর মুখ থেকে, ছেলের বাবা আমাকে যা বলতে বলেছেন, তা শুনে শুরুতেই ধাক্কা খেলাম! তাদের টাকাপয়সার অভাব নেই, তাই চাকরি না করলেও চলবে। যদি একান্তই করতে ইচ্ছে হয়, তবে ওরা আমাকে একটা স্কুলে ঢুকিয়ে দিবে। আমি অবাক হয়ে গেলাম এহেন প্রগতিশীল শিক্ষিত লোকজনের আচরণে! আসলে তারা বউ চায় না, চায় কাজের মেয়ে! আমি বললাম, না, আমি চাকরি করতে চাই। এত কষ্টে পড়াশোনা শেষ করেছি ঘরে বসে থাকার জন্য নয়। চাকরির চেষ্টা করছি, বাকিটা আল্লাহ্‌ ভরসা!


এরপর অনেকদিন তারা আর যোগাযোগ করে না। অথচ ছেলে ঠিকই ফেইসবুকে যোগাযোগ রাখত। আমি এভাবে অনেকদিন ঝুলে ছিলাম। এদিকে অন্যখানেও বিয়ের প্রস্তাব এলে বাসা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হতো, যেহেতু এক জায়গায় কথাবার্তা চলছে। অনেকদিন পর ছেলের বাবা ছেলের সেই ভাবিকে দিয়ে আমাকে আবার ফোন করিয়ে বলেন, আমি যেহেতু তাদের বউ হয়ে যাচ্ছি, সেহেতু সংসারের সমস্ত দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। যদি চাকরি করি, অফিস থেকে এসে কোনওমতে কাপড় ছেড়ে রান্নাঘরে যেতে হবে। রাতে সব কাজ শেষে যখন সময় পাব, ওই সময়টাতে চাইলে লেখালেখি করতে পারব, বই পড়তে পারব! আবার যদি সরকারি চাকরি করি, তাহলে তো দূরে পোস্টিং হবে। তখন সংসার করব কীভাবে? তাই সরকারি চাকরি করা যাবে না। এরকম হাজারটা শর্ত! আমি বললাম, আমাকে সময় দিন। এক মাস পর সামনে ৪০তম বিসিএস। আমি এরপর জানাব। এতে তারা ভীষণ অসন্তুষ্ট হলো। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। অপরদিকে ছেলেটার মনভোলানো সাহিত্যিক কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে ওকে বাদও দিতে পারছিলাম না! যথারীতি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ছেলের সাথে আমিই যোগাযোগ করে দেখা করলাম। বললাম, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব। তবে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিব, এমন কোনও কথা দিতে পারব না।


(চলবে…)