তবুও অপেক্ষা/ পাঁচ

 
এই ঘটনার পর এখনও পর্যন্ত দুলাভাই বলে রেখেছেন, আমার জন্য কোনও পাত্র উনি আর দেখবেন না, আমি যেন নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করে নিই। অথচ দুলাভাইয়ের সার্কেল অনেক বড়ো। জার্মানিতে পিএইচডির অ্যাডমিশন হয়েছে ওঁর। দেশে-বিদেশে কনফারেন্স করে বেড়ান। ভার্সিটিতে নারীবাদ পড়ান! আসলে নারীবাদ নিয়ে কথাবলা আর নারীবাদে বিশ্বাস করা, এই দুটো ভিন্ন জিনিস। আমার দেখা, বেশিরভাগ নারীবাদী মানুষই দ্বিচারী ও ভণ্ড প্রকৃতির। ওদের মুখে এক, মনে আর-এক। প্রচুর নারীবাদী মানুষ আছে, যারা শুধু মেয়েদের কাছাকাছি থাকতেই নিজেকে নারীবাদী হিসেবে দেখান, উপস্থাপন করেন। কিছু নারীবাদী মানুষ চান কেবলই মিডিয়া কভারেজ। আবার নারীবাদী অনেক মহিলা আছেন, যাদের ঘরের বাইরের চেহারা ও ভেতরের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি চেহারা। তবে আমার দুলাভাইয়ের পরনারীপ্রীতি জাতীয় কোনও সমস্যা নেই। ওরকম কোনও চারিত্রিক দুর্বলতা তাঁর মধ্যে কখনও দেখিনি। এমনিতে দুলাভাই মানুষ হিসেবে অনেক ভালো।


যা-ই হোক, ওই সমস্ত দিনে রুমির ভাইয়ের কথা খুব মনে হতো। হেমা আপুকে একদিন কথায় কথায় রুমি ভাইকে ভালো লাগার কথা বললাম। আগের ঘটনা সবকিছু খুলে বললাম। বাসায় প্রপোজাল আসে, আমি পছন্দ করিনি দেখে আমার অনেক কথা শুনতে হয়েছে। অথচ এর আগেও একটা প্রপোজাল এসেছিল। সেটা দুলাভাইয়ের এক বন্ধু তাঁর শ্যালকের জন্য বলেছিলেন। ওরা আমাকে দেখেছিল। আমিও ছেলেটাকে দেখে মোটামুটি পছন্দ করেছিলাম। যদিও প্রফেশন হিসেবে ব্যাংকার ছেলে আমার পছন্দ না। ছেলেটা আমাকে ফোনে কথা বলে রিকোয়েস্ট দিয়েছিল। কিন্তু ফেইসবুকে দেখে সে আমাকে আর পছন্দ করেনি। কারণ আমি হিজাব পরি না। এ কথা সে তার বন্ধুদের বলেছে। তার এক বন্ধু আমার মামাত ভাই, আমি সেভাবেই শুনেছি। আমাদের দেশের অনেক ছেলের ধারণা, হিজাবি মেয়েরা এক-একটা চরিত্রের ডিব্বা। আমি আমার অনেক হিজাবি বান্ধবীকে ভিন্ন চেহারায়ও চিনি, আবার আমি নিজেকেও চিনি। যার চরিত্রে সমস্যা, তাকে হিজাবে কেন, বস্তায় ঢুকিয়ে রাখলেও সমস্যা থাকবেই। থাক, এসব বলেই-বা কী হবে!


অনেকে আমাকে ফেইসবুকে দেখে হয়তো ভয়ও পায় বিয়ে করতে। আমার কাছের বন্ধুরা আমাকে বলে লেখালেখি বন্ধ করতে। ছেলেরা নাকি বেশি বুদ্ধির মেয়ে বিয়ে করতে চায় না। অথচ ওরা আমাকে বাস্তবে জানে, আমি খুবই নরম প্রকৃতির বোকা বোকা টাইপ ইমোশনাল পাগল একটা মেয়ে! অথচ ফেইসবুকে একটা ডাকাবুকো ভাব নিয়ে চলি! ঘটে বুদ্ধির অভাব বলেই নিজেকে বুদ্ধিমান জাহির করি। যে যা-ই বলুক, আমি আমার মতো লিখে যাব, মন যা চায়। কেউ পছন্দ করুক বা না করুক। অবশ্য কাছের বা ভার্চুয়াল অনেকের কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি, যাদের আমার ঠিক মনঃপুত হয় না। এর মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের একটা ছেলে সেই তিন/চার বছর ধরে আমাকে খুব ভালোবাসে। এখনও আমাকে নিয়ে কবিতা লেখে। ও বয়সে আমার চেয়ে দুই/তিন বছরের ছোট। তাতে অবশ্য আমার কোনও সমস্যা নাই। একবার ওর সাথে দেখা হয়েছিল একটা কফিশপে। সে কথা বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। আমি ওকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করি, কাজ হয় না। আমাকে নিয়ে না ভেবে নাকি সে বাঁচতেই পারে না। আমার সত্যিই কষ্ট হয় ওর জন্য, কিন্তু ওর প্রতি আমার ওরকম কোনও অনুভূতি কাজ করে না। সে এখনও আমাকে ভালোবাসে, পাবে না জেনেও নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে। আমার জন্য কবিতা লিখে আমাকে মেইল করে।


যা-ই হোক, হেমা আপুকে বললাম, বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, কিন্তু আমার মন বেশি সায় দেয় না। রুমি ভাইকে আমার ভালো লাগে। কিন্তু সে কি তার নিজের প্রফেশন বাদে আমার মতো সাধারণ একটা মেয়েকে বিয়ে করবে? ডাক্তাররা তো সাধারণত ডাক্তারই বিয়ে করে। বিয়ের ক্ষেত্রে, নিজের প্রফেশনের বাইরে যেতে চায় না ওরা। তখন উনি বললেন, এরকম কিছু তো ও বলেনি কখনও। আমি বললাম, আপনি জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন আমার কথা। যদি আমাকে ওর ভালো লাগে লাগল, না লাগলে বাদ, ব্যস্‌। বললাম, আমার হয়ে ঘটকালি করে দেখতে পারেন। কিন্তু সে যেন কোনওভাবেই না বুঝতে পারে যে আমি ওকে পছন্দ করি। তাহলে আমি খুব লজ্জা পাব। আপনি এমনভাবে বলবেন যেন আপনি নিজে থেকেই বলছেন, আমি কিছু জানি না। উনি বললেন, উনি তাঁর মতো করে অ্যাপ্রোচ করবেন।


এরপর আমি আর হেমা আপুকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। নিজের মতোই চলেছি। একদিন আপু আমাকে নক করে বললেন, রুমি ওঁকে রিকোয়েস্ট দিয়েছে নতুন আইডি খুলে। শুনে আমার ভারি অভিমান হলো। আমি রুমির এতদিনের পুরনো ভার্চুয়াল-বন্ধু, অথচ আমাকে এখনও রিকোয়েস্ট দিল না! খুব ইগোতে লাগল। সিদ্ধান্ত নিলাম, সে রিকোয়েস্ট না দিলে হেমা আপুকে কিছু বলতে বারণ করব। বললাম, রুমি ভাই যেহেতু আমাকে রিকোয়েস্ট দেয়নি, তাই তাকে আর কিছু বলার দরকার নেই। সে হয়তো চায় না আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে। আপু বললেন, রুমিকে উনি অলরেডি আমার কথা বলেছেন। ও রিকোয়েস্ট দিবে আমাকে। ও আমার কথা চিন্তাভাবনা করছে সে।


৩১ জানুয়ারি রিকোয়েস্ট দিল। পরদিন অ্যাক্সেপ্ট করলাম। এই প্রথম আমাকে ইনবক্সে নক দিয়ে এতদিন পর সেধে সেধে কথাবলা শুরু করল। এরপর আমার পোস্টেও লাইক দিল। একদিন ছবি পোস্ট করলাম। ক্যাম্পাসে গিয়েছি বন্ধুদের সাথে। সে কমেন্ট করল। এক জায়গায় দুষ্টুমি করে আমি আমার দুই বান্ধবীর কথা লিখেছি এভাবে ‘একজন ভবিষ্যত বিসিএস ক্যাডার, আর-একজন খুব ভালো রান্না পারে।’ সে আমার সিঙ্গেল একটা ছবিতে কমেন্ট করল, ‘উনি কী কী রান্না পারেন? আমি আগ্রহী। ঢাকায় পোস্টিং হতে আমার মাত্র ছয় মাস লাগবে।’ তখনও তার অ্যাপ্রোচগুলি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। মনে করেছি, আমার সাথে ফ্লার্ট বা করছে না তো! এরপর ইনবক্সে সরাসরি ওর নিজের ছবি পাঠিয়ে বলল, সে নাকি অনেক ওয়েট গেইন করেছে। শেইপে আসতে ছয় মাস লাগতে পারে। আমি আরও ছবি চাইলে সে পাঠাবে। ওর কাণ্ডকারখানা আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমনও হতে পারে, আমার ইজি হতে খুব লজ্জা লাগছিল। তখন পিজিতে আমার একটা টেস্ট করানোর ব্যাপারে খুব দৌড়াদৌড়িতে ছিলাম। রাতে ফ্রি হয়ে ওকে নক দিলাম। এ-কথা সে-কথা বললাম। আসল কথা তুলতে খুব লজ্জা হচ্ছিল।


শেষমেশ সে-ই বলল, আমার মনে হয়, কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি যা ভাবছি, তা হয়তো না। আপনাকে গত দুদিন ধরে একটা ব্যাপারে বোল্ডলি অ্যাপ্রোচ করছি। হয়তো ভুলটা আমারই। তখন আমি তাকে চক্ষুলজ্জা ভেঙে বললাম, ‘হেমা আপুর সাথে একদিন কথায় কথায় আপনার কথা ওঠায় উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, রুমিকে তোমার কেমন লাগে? আমি বললাম, ভালো লাগে। তিনি বললেন, রুমিকে তোমার কথা বলব নাকি? আমি বললাম, হ্যাঁ, বলতে পারেন।’ এসব শুনে রুমি সব অস্বীকার করে বসল। বলল, ‘ম্যাডামের সাথে এসব নিয়ে কোনও কথাই হয়নি। এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকুন।’ আমি থতমত খেলাম। সেদিনের মতো ওখানেই ইস্তফা হলো। এরপর সাথে সাথে সবকিছুর স্ক্রিনশট দেখালাম হেমা আপুকে। তিনি বললেন, আশ্চর্য! আমার কথা বলেছ কেন? আরও বললেন, সরাসরি ওকে আই লাভ ইউ বলে দাও। আমি বললাম, বুক ফাটলেও এ কথাটা সরাসরি বলতে পারব না। একটা মানুষকে এভাবে ‘আই লাভ ইউ’ বলে দেওয়া যায় নাকি? পরে তিনি রুমির কাছে সরাসরি আমার কথা জানতে চাইলেন। রুমি বলল, আমি নাকি সরাসরি কিছুই বলি না। আপু তার কাছে আমার কথা উল্লেখ করতেই সে নাকি ঘাবড়ে যায়।


এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম, যা বলার, আমিই তাকে বলব। সে প্রায়ই পোস্ট দিত, তার বউয়ের এসব রান্না জানা থাকতে হবে। কিংবা তার বউ তাকে এসব রেঁধে খাওয়াবে। কিংবা সে তার বউকে ইউটিউব দেখে দেখে এই রান্না সেই রান্না শিখে তার জন্য রাঁধতে বলবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। তাকে আমি সেভাবেই অ্যাপ্রোচ করলাম। বললাম, ‘আমি এটা এটা এটা রাঁধতে পারি। চলবে কি না দেখেন!’ সে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, চলবে। কিন্তু তার আগে আমার সাথে দেখা করেন। দেখা করলে আমাকে ভালো না-ও লাগতে পারে। আমি বাস্তবে দেখতে ফেসবুকের ছবির মতো না।’ এরপর ফোনে এক-দুইদিন কথা হলো।


এভাবে কথা বলার ফাঁকে একদিন আমার আইডি কী একটা কারণে ডিজঅ্যাবেলড হয়ে গেল। ওইদিন রাতে সে আমাকে ইমোতে নক দিল। কথাবার্তা চলল। শুরুতেই সে বলল, ‘আপনি ভুল করছেন। ঠকবেন। আমার চাইতে অনেক ভালো ছেলে পাবেন। ফেইসবুকে আমাকে দেখে একটা ফলস পারসেপশন আপনার মধ্যে কাজ করছে।’ উল্লেখ্য, ফেইসবুকে ওর শুধু প্রোফাইল পিকচার দেওয়া। সে আমাকে ছবি পাঠাতে লাগল। বলল, ‘দেখেন, আমি কত কুৎসিত।’ কিন্তু আমি তেমন কিছু পেলাম না, শুধু মাথায় একটু চুল কম ছাড়া। মাথায় কম চুল তো অনেক ছেলেরই থাকে, টাক তো আর না! সে বলল, সে নাকি বাস্তবে দেখতে ইনঅ্যাট্রাক্টিভ। আমি বললাম, ‘সমস্যা নেই। যাকে ভালো লাগে, তার সবই ভালো লাগে।’ এবার সে তার কিছু সমস্যার কথা বলল।
এক, ধানমন্ডিতে তাদের ফ্ল্যাটে তার রুমটা খুব ছোট। আর সে খুব হোমসিক। কোথাও বের হয় না, সারাক্ষণই রুমে থাকে। এতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে নাকি!
দুই, সে আমাকে বিয়েতে সাথে সাথেই দেনমোহর দিবে, কিন্তু বিয়েতে কোনও আয়োজন করতে পারবে না। কারণ এখন আয়োজন করা তার পক্ষে সম্ভব না। একেবারে ঘরোয়াভাবে বিয়ে করবে।
তিন, ছয় মাস পর সে আমাকে বিয়ে করবে। এর আগে সে বিয়ে করতে পারবে না।


আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম! ছয় মাসের গ্যারান্টি কী? আর সব মেয়েরই সারাজীবনের সাধআহ্লাদ থাকে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে, গায়েহলুদ করবে। আমি একটু ভুল বুঝেছিলাম। আমি মনে করেছি, এখন তার অনুষ্ঠান করার সামর্থ্য নাই, টাকা জমিয়ে ছয় মাস পর সে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করবে। তাই সব মেনে নিয়েছিলাম। পরে বুঝেছি, এসব ক্ষেত্রে নিজে নিজে অনুমান করে না নিয়ে সরাসরিই জিজ্ঞেস করে জেনে নেওয়া ভালো। প্রকৃত ঘটনা তো আমার ধারণামতো না-ও হতে পারে!


একদিন ইমোতে নক করে সে আমাকে ইংরেজিতে বলল, তুমি কি আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে আপত্তি করছ? আমি বললাম, না। তোমার সাথে দেখা করার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। সে বলল, আমিও করছি। আরও বলল, তাকে দেখে আমার একটুও পছন্দ হবে না। আমি বললাম, ভালোবাসার কাছে ফিজিক্যাল অ্যাপিয়ারেন্স কিছুই না। এসব বলে বলে কেন আমাকে পরীক্ষা করতে চাইছ? এরপর তাকে জন ডানের সেই বিখ্যাত লাইনটি বললাম… For God's sake hold your tongue, and let me love…পরদিন ভোরে উঠে সে প্রত্যুত্তরে বলল, ‘উঠেছ? আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ আমিও লিখলাম, ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি।’


আমার হৃদয়ে প্রেমের এক ফল্গুধারা বয়ে গেল! গল্পটা এখানে শেষ হলেও সুন্দর একটা গল্প হতো! কিন্তু জীবন সুন্দর গল্পের ধার ধারে না! জীবনের গল্পের মতো নয়, জীবন জীবনের মতো। এই পৃথিবীর সবচাইতে সুলিখিত ফিকশনটিও জীবনের প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ।


যেদিন আমাকে প্রথম সে ভালোবাসার কথা জানাল, এবং তুমি করে সম্বোধন করল, দিনটা বোধ করি ৯ ফেব্রুয়ারি ছিল। আমার জীবনের একটা স্মরণীয় দিন। এই বুকে দ্রিম দ্রিম ডঙ্কা! আর চোখে চিক চিক জল। এতটা পথ কষ্ট করে একা একা পাড়ি দিয়েছি, এতটা সবুর করেছি, কষ্টসহিষ্ণু থেকেছি, এখন সময় এসেছে আমার সুখের! আর কোনও দিনই অতীতের দিকে ফিরেও তাকাব না। সমস্ত আস্থা নির্ভরতাসমেত তার কাঁধে মাথা রেখে একফুঁৎকারেই সব উড়িয়ে দিব। সামনে আমার শুধু সুখ আর সুখ। সুখের বড়ো লোভ আমার। বড়োই স্বার্থপর আমি। স্রষ্টা নাকি মানুষকে দুঃখের পর সুখ দেন। কিন্তু আমার বেলায় কেন বারবার দুঃখের পর দুঃখ আসবে? কেন সুখ আসবে না? ফেইসবুকে যখন আমার বন্ধুদের দিনের পর দিন শুধুই উত্থান দেখি, মা-বাবা-স্বামী-সন্তান নিয়ে ওদের সুখী পরিবারের ছবি দেখি, তখন আমার বুকটা ব্যথায় কোঁকিয়ে ওঠে! গলার কাছে একরাশ বেয়াড়া কষ্ট এসে এসে দলা পাকায়। আমি কি ঈর্ষাকাতর তবে? পরশ্রীকাতর? আমার তো আল্লাহ্‌র রহমতে খাওয়া-পরার এত অভাব বা চিন্তা নাই, তারপরও আমি নিজেকে এত দুঃখী, এত একা ভাবি কেন?


স্কুলজীবন থেকে এখন পর্যন্ত আমার দুই বেস্টফ্রেন্ড আছে। চৈতি, শিরীন। চৈতি যাকে ভালোবেসেছে, তাকেই বিয়ে করতে পেরেছে। বাবা, মা, দুই ছোট বোন, বোনদের জামাই নিয়ে একেবারে সুখী পরিবার যাকে বলে। অপূর্ণতা নেই যে, তা না। শুধু এখনও ওর চাকরিটা হলো না। আর শিরীন প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে এমবিএ করে সাথে সাথেই সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ঢুকেছে। এর পরপরই বিয়ে করেছে। একটা পুত্রের, এখন আবার একটা কন্যার জন্ম দিয়েছে। হাজব্যান্ড ব্যাংকার। এ বয়সেই ভাইয়া দোতলা বাড়ি পর্যন্ত করে ফেলেছেন। পরিপূর্ণতায় ভরা সংসার ওর। হ্যাঁ, ওরও খুঁত আছে, একটা চোখ কিছুটা ট্যারা, ডানহাতের তর্জনীর মাথা ছোটবেলায় কেটে গিয়েছিল। ওদের সাথে যদি তুলনা করি, যদিও তুলনা করা খুব খারাপ, তবুও করি যদি, আমি বলব, অনেক কষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আল্লাহ্‌র কৃপায় একটা চাকরি আমি পেয়েছি, আল্লাহ্‌ আমাকে তেমন খুঁতও দেননি। তবে? আমি কেন এরকম অসহায়বোধ করি? কেন মনের মধ্যে এত সংশয় এসে জমে যায়?


হ্যাঁ, আমি একটা বিশাল রাক্ষসসমান একাকিত্ব বোধ করি। একটা পরিবারের অভাব খুব বোধ করি। কাউকে ভালোবেসে বাঁচতে চাই খুব। আমি খুব করে চাই, একজন মানুষ আমাকে অনেক ভালোবাসুক। আমি অনেক অনেক ভালোবাসা নিতে ও দিতে পারি। আমি কাউকে ভালোবেসে তাকে এই পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষটি করে দিতে পারি। আমি, আমৃত্যুই, একজন মানুষের কাছে, দরকার পড়লে নিজের জীবনের বিনিময়েও, বিশ্বস্ত থেকে যেতে পারি। আল্লাহ্‌ আমাকে ভালোবাসার অসীম ক্ষমতা দিয়েছেন। আচ্ছা, বাঁচতে হলে কাউকে ভালোবাসতেই হবে বা কারও ভালোবাসা পেলেই তবে বাঁচব, এমন কোনও কথা আছে? তবুও বেহায়া মন শুধুই থিতু হতে চায় কোথাও। কারও হাত ধরে বহুদূর হেঁটে যেতে ইচ্ছে হয়। কাউকে নিয়ে পাহাড়-সমুদ্র দেখতে ইচ্ছে হয়। একা একা বা বন্ধু-বান্ধব নিয়েও না, শুধু যাকে ভালোবাসতে পারব, তাকে নিয়ে। আমি তো আট-দশজনের মতো সাধারণ গৃহস্থ জীবন চেয়েছিলাম খোদার কাছে। কোনও বিত্ত লাগবে না, কোনও স্বাচ্ছন্দ্য লাগবে না, কেবল মনের মতো একজন মানুষকে লাগবে। একেবারে সাধারণ, গরিব একটা মানুষ হলেও চলবে। আমাকে সে অনেক ভালোবাসবে, আমিও তাকে অনেক ভালোবাসব। আমাদের কুঁড়েঘরে মুঠোয় মুঠোয় সুখ ছড়ানো থাকবে। আমি তার বুকে মাথা রেখে এই ছোট্ট জীবনটা হাসতে হাসতে কাটিয়ে দেবো। মাত্র এইটুকুই চাওয়া! খোদা তা-ও দিচ্ছেন না। আমি জানি না, তবে কি তিনি আমাকে অসাধারণ কোনও জীবন দিতে চান?


আমি জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাই। হিসেব করে দেখলাম, আমার স্বাভাবিক মৃত্যু হলে আরও অন্তত ৩০/৪০ বছর জীবনের বোঝা আমাকে টেনে বেড়াতে হবে। এত বড়ো জীবন দিয়ে আমি কী করব? আমি একফুঁৎকারে জীবনটা পার করতে চাই। আমার জীবনের অর্ধেক বয়সও পার করতে পারিনি, অথচ এ সময়ের মধ্যেই আমি আমার পরিবারের অর্ধেকের বেশি সবচেয়ে কাছের মানুষদের হারিয়েছি। খুব অভিমান হয় স্রষ্টার উপর। আল্লাহ্‌/স্রষ্টা/ঈশ্বর কি সত্যিই আছেন? না কি আমার পাপমোচনের জন্য এমনটা হচ্ছে, জানি না। মনে হচ্ছে, পাপের ফল পেতে পেতে পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে যাব! আবার এমনও মনে হয়, আমার আশেপাশের আট-দশটা বন্ধুদের আল্লাহ্‌ যেমন সাধারণ জীবন দিয়েছেন, হয়তো আমাকে তা না দিয়ে অসাধারণ একটা জীবন দিতে চান তিনি। আমি আর কোনও দুঃখ, কোনও কষ্টকেই ভয় পাই না। একটাই তো জীবন, আর কত দুঃখ দিতে পারবে? আমি আমার নিয়তি বলেই মেনে নিব সব। আল্লাহ্‌ যদি আরও দুঃখ দিতে চান তো দিক। আমি তার সবই বুক পেতে নিব।


ইদানীং আর কিছু ভালো লাগছে না, দীর্ঘদিনের গৃহবন্দিত্ব আমার শরীরে মনে সংক্রমিত। আমি নিজের উপর সমস্ত আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। থেকে থেকে শুধুই কষ্টের স্মৃতি মনে আসে। নিজেকে ব্যর্থ ও দুঃখী মনে হয়। আমার জীবনের শেষগল্পটাই ইদানীং আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে। কষ্ট ভুলতে চাই, পারি না। আমি করোনাতে মরে গেলেও আফসোস নেই। শুধু একটাই ইচ্ছে---মরার আগে আমি ঈমান নিয়ে মরতে চাই।


মাঝে মাঝে আমার জঙ্গি হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটা করে জঙ্গি হবার জন্য নয়, পুলিশের গুলি খেয়ে মরার জন্য। আমি এইটুকু জীবনে ইতোমধ্যেই বুঝে গেছি, জীবনে সুখী হওয়াটা বড়ো কিছু নয়, টিকে থাকাই বড়ো কথা, মানে শক্তিমত্তার সাথে টিকে থাকা। এ সমাজে যার টাকা আর যোগ্যতা সবচেয়ে বেশি, সে সবচেয়ে সম্মানিত। গরিব মানুষ জন্ম নেয় অপমান আর অবজ্ঞা সইবার জন্য। আমি সেই জীবন চাই না। মুখে অনেকে অনেক কিছুই বলবে, কিন্তু গরিব এবং অযোগ্য মানুষের এ সমাজে কোনও দাম নেই, এটাই সত্য। বারনার্ড শ’র একটা কথা খুব ভালো লাগে---There are two tragedies in life. One is to lose your heart's desire. The other is to gain it. আমার ক্ষেত্রে দুইটাই ঘটল। প্রথমে পেলাম, এরপর পেয়ে হারালাম! এই জীবনে যা যা চাইনি, এমনকি সেগুলি যে আমার সাথে হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি, ঠিক তা-ই তা-ই আল্লাহ্‌ আমাকে দিয়ে দিলেন!


রুমির সাথে কথোপকথন চালাতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম যে মানুষটা ফেইসবুকে এত পোস্ট করে, সে বাস্তবে হ্যাঁ না ছাড়া বাড়তি কোনও কথাই বলে না! আর আমি? একেবারে বাচাল মেয়ে যাকে বলে! সারাক্ষণই পকপক পকপক করতেই থাকি। যা-ই হোক, কথাবার্তায় জানলাম, সে নাকি এতদিন আমাকে আনফলো করে রেখেছিল। কারণ সুন্দরী মেয়েদের দেখলে তার আকাঙ্ক্ষা হয়! যেহেতু যোগাযোগটা ভার্চুয়াল, আমাকে কোনও দিনই কাছে পাবে না, তাই শুধু শুধু আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে কী লাভ? তার নাকি প্ল্যান ছিল সে আরও দুবছর পর বিয়ে করবে। এমআরসিপি পরীক্ষা দিবে। বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে কোনও প্রবাসী মেয়েকে বিয়ে করে বিদেশ চলে যাবে। কিন্তু তার অনেক বড়ো ভাই বিয়ের প্রয়োজনীয়তা বোঝালে সে ছয় মাস পর বিয়ে করবে, এমন সিদ্ধান্ত নেয়। তখনই ম্যাডাম তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন আমার জন্য। সে সবকিছুই পছন্দ করেছে, শুধু একটা বিষয়ে তার আপত্তি ছিল। সে তার চেয়ে ৪/৫ বছরের ছোট মেয়ে বিয়ে করবে না। তার ইচ্ছে সমবয়সি অথবা তার চাইতে সিনিয়র কাউকে বিয়ে করা।…পরে কথায় কথায় জেনেছে, আমি তার মাত্র এক বছরের ছোট। সে এটা জানতে পেরে, দেখলাম, খুব খুশি।


একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন সে ছয় মাস দেরি করতে চাও? সে বলে, এর কোনও কারণ সে আমাকে বলতে পারবে না। কারণ তার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ, আমার কাছে তা না-ও হতে পারে। হতে পারে, সামনে তার পরীক্ষা আছে। সে একসাথে একাধিক প্রেশার নিতে পারে না। আমি যেন তাকে এসব ব্যাপারে ফোর্স না করি। সে বলল, ফেইসবুকে অনেক মেয়েই তাকে সিভি দিয়েছিল, সে তাদের সময় দিতে পারেনি বলে কোনও সম্পর্কই পরিণতির দিকে যায়নি। এর মধ্যে এক ডাক্তার মেয়ে তার সিভি চায়। সে তিন মাস সময় চেয়েছিল। তিন মাসের আগে সে সিভি দিতে পারেনি বলে হয়নি। সে অ্যাডভান্স কথা পছন্দ করে না। আমি যেন আমাদের সম্পর্কের কথা বাসায়, বন্ধুদের…কারও কাছে না বলি। না হলে গার্ডিয়ান বিয়ে দেবার জন্য প্রেশার দিবে। এদিকে আমি ছয় মাসের ভরসা পাচ্ছিলাম না। এখন আমার সেটল্ড হবার সময়। ছয় মাসের মধ্যে যদি ব্রেকআপ হয়ে যায়, আর এদিকে আমি অন্য সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই, তাহলে কীভাবে কী!


আমি তাকে অনুরোধ করলাম, ঈদের পর তুমি শুধু বাসায় এসে কবুল বলবে। তোমার কোনও অনুষ্ঠান করা লাগবে না। এরপর যখন খুশি, তখন তুলে নিয়ো। কিন্তু সে তাতেও রাজি না। সে কথা দিয়েছে, ঠিক ছয় মাস পর সে আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিবে। তা-ও কোনও অনুষ্ঠান করার সামর্থ্য তার নেই। জাস্ট ঘরোয়াভাবে তুলে নিবে। আমি কোনও ভরসা পাচ্ছিলাম না। সে বলে, ঠিক আছে, তুমি চাইলে এই ছয় মাস তোমাকে একদমই নক করব না। ছয় মাস পর বিয়ের জন্য নক করব। আর আরও বলে, এর মধ্যে ভালো ছেলে পেলে আমি যেন বিয়ে করে ফেলি। এরপর আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলে সে ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে নানা বিষয় নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করল। আমিই নাকি হেমা আপুকে বলেছি, এখন আমিই অস্বীকার করছি। তিনি এত বড়ো চাকরি করেন, তিনি কেন ওকে আমার জন্য বিয়ের কথা বলতে যাবে। এখানে একটা কথা বলে রাখি। হেমা আপু আমার সাথে বেঈমানি করেছেন। তিনি আমার সব কথা রুমিকে স্ক্রিনশট দিয়ে পাঠিয়েছেন। অবশ্য, এসব তিনি করেছেন আমাদের প্রেমের জন্যই, যাতে রুমি আমাকে সিরিয়াসলি নেয়। উনি ভেবেছেন, আমার আকুলতাটা রুমিকে বোঝালে রুমি আমার ব্যাপারে সিরিয়াস হবে।


কিন্তু এটা নিয়ে রুমি আমাকে খোঁটা দেয়। এমনকি সে তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয় নিয়েও আমার সাথে ঝগড়া করে। আমি তার পরিবারের ব্যাপারে জানতে চেয়েছি কেন? তার বাসায় গাছ দিয়ে সাজাতে চেয়েছি, বাগান করতে চেয়েছি, অথচ তার বাসায় জায়গাই নেই! তার সাথে ক্যাম্পাসে দেখা করতে চেয়েছি, কিন্তু তার দামি রেস্টুরেন্টে বসার ইচ্ছে। আমার ক্যাম্পাসে আসার কোনও ইচ্ছে তার নাই। এসব হাস্যকর বিষয়। শেষে সে বলে, তুমি চিন্তাভাবনা করো, সম্পর্ক কন্টিনিউ করবে, না দেখা করে সিদ্ধান্ত নিবে। যা করার, একঘণ্টার মধ্যেই যেন তাকে সব জানাই। আমি কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ওর ব্যবহারে প্রচণ্ড কষ্ট পেলাম। ফেইসবুকে গতবছর আমার ক্যাম্পাসের আইবিএর এক বড়ো ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। সে ভাই একজন কবি। খুবই নিরীহ সজ্জন মেধাবী ভালো মানুষ। নিজেকে তিনি হিমু ভাবেন। ফেইসবুকের হতাশাগ্রস্ত বন্ধুদের কষ্ট নিজের ঘাড়ে করে নিয়ে বয়ে নিয়ে বেড়ান। কাকতালীয়ভাবে ওঁর সাথে যখন পরিচয়, তখন আমি প্রচণ্ড ডিপ্রেসড। ওঁর অনেক স্টুডেন্ট। ওদের বয়স ১৮ থেকে ৫০-এর মধ্যে। ওদের উনি বিভিন্ন ধরনের পড়া পড়ান। জীবনের নানান দর্শন বোঝান। ওদের হতাশা কাটানোর চেষ্টা করেন।


সেই ভাইকে ফোন করলাম। সব খুলে বললাম। ওঁর বউ আমার সাথে কথা বললেন। বললেন, আমি যেন আগে রুমির সাথে দেখা করি। এরপর ছয় মাস ওর সাথে কোনও যোগাযোগ না রাখি। এই ছয় মাসের মধ্যে যদি ভালো প্রস্তাব পাই, তাহলে যেন রাজি হয়ে যাই। ছয় মাস কথা না বলার যুক্তি আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু এর মধ্যে প্রস্তাব পেলে বিয়ে করে ফেলব, এটা মানতে পারিনি। কেননা আমি কারও সাথে বেঈমানি করব না। কথা দিলে কথা রাখার চেষ্টা করব। সে ঠকালে ঠকাবে, আমি ঠকাব না। কারণ যাকে ভালোবাসি, তাকে সমস্ত আবেগ দিয়েই ভালোবাসি, যুক্তি দিয়ে নয়। আমি আর ওকে ফোন দিইনি। ও-ই রাত দশটার পর ফোন দিয়ে মাফ চাইল। ওর কথায় আমি গলে গেলাম। সব ভুলে গেলাম। উলটা আমিই ওকে বললাম, ‘আমার মাথা হঠাৎ হঠাৎ গরম হয়ে যায়। তখন উলটাপালটা বকি। রাগ করে ব্লক করি মানুষকে। আমি কোনও ভুল করলে তুমি আমাকে সাথে সাথে বকে দিয়ো। আমার ভুল ধরিয়ে দিয়ো। আমি একটু কম বুঝি। আমি কোনও কিছু ভুল করলে তুমি আমাকে বুঝিয়ে বলবে। তবে আমাকে রেগে কিছু বলা যাবে না।’ আর বললাম, ‘আমার রাগ বেশিক্ষণ থাকে না। একেবারে পানি হয়ে যায়। আমাকে আদর করে কথা বললে তুমি যা দশমিনিটে বোঝাতে পারবে, আমার সাথে রেগে রেগে দুইঘণ্টা কথা বলেও তা বোঝাতে পারবে না। আমি যে তোমাকে ভালোবাসি!’ সিদ্ধান্ত নিলাম, অতিসত্তর আমরা দেখা করব।


প্রিয় পাঠক, আমি এসব লিখছি আর কাঁদছি। তাই বলে আমাকে ছিঁচকাঁদুনে ভেবে বসবেন না যেন আবার! আমার আবেগ একটু বেশি। প্রাসঙ্গিক লেখা লিখতে গিয়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক লেখাও চলে আসে। যে মানুষ লিখতে গিয়ে কাঁদে না, সে লেখক নয়, সে সাংবাদিক। এটা আমার ধারণা। আজ আমার মনটা খুব ভালো। কেন জানি নিজেকে খুব ব্লেসড মনে হচ্ছে। কী অনায়াসে আমি ভাত খেতে পারছি! ভাতের একটা দানাও নষ্ট করতে কষ্ট হচ্ছে। আমার পা খোঁড়াও না, আমি তোতলাও না। আমি একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। একটা মেয়ের গল্প শুনেছি, মেয়েটা খোঁড়া, তোতলা। তার তুলনায় অনেক ভালো তো আছি আমি। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি এলোমেলো কথা বলছি। আমি আসলে জানি না, এখন কী বললে তা শুনতে এলোমেলো শোনাবে না।


আমার ডিপার্টমেন্টের এক বড়ো ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। উনি পুলিশের এসপি। আমাকে ছোট বোনের মতো স্নেহ করেন, মাঝে মাঝে ফোন করেন। উনার মনে খুব খেদ, কেন পুলিশ হলেন! তাঁর চেয়ে একজন সবজিওয়ালাও অনেক সুখী। কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আমার মনে হয়, গরিব মানুষদের কোনও দুঃখবোধ নেই। আমাদের মতো খেয়েদেয়ে দুঃখ খুঁজে বেড়ানোর মতো দুঃখবিলাস করার অত সময় ওদের কোথায়? ওরা অল্পেই খুশি! যে যত অল্পে খুশি, সে তত ভাগ্যবান। আমাদের জীবনে অনেক জিনিসই অপ্রয়োজনীয়। এমনকি একজন ভিক্ষুকেরও বাড়তি জিনিস থাকে। ধরা যাক, তার কাছে ভিক্ষা করার জন্য একটা থালাও আছে, একটা বাটিও আছে। এখন সে ভিক্ষায় বের হবার সময় থালাটা নিয়ে বের হবে, না কি বাটিটা নিয়ে বের হবে, এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাবে। এ ধরনের দ্বিধা তাকে কিছু সময়ের জন্য হলেও উদ্‌বিগ্ন করে রাখে, অতএব ওই অল্প সময়টা সে অসুখী অবস্থায় কাটাবে। আর আমাদের বাড়তি জিনিস তো অনেক অনেক বেশি। তাই আমাদের অসুখী হওয়ার পরিমাণও অনেক বেশি। যার যত বাড়তি জিনিস, তার তত কম সুখ। এইসব বাড়তি জিনিস আমাদের সারাক্ষণই অসুখী করে রাখতে যথেষ্ট। বাড়তি জিনিসগুলি আমাদের জন্য অপরিহার্য কিছু নয়, কিন্তু সেগুলি আমাদের আত্মাকে ক্রমশই ক্ষয় করে দেয়।


আমি যখন ওভারব্রিজে প্রতিদিন একটা মহিলার কোলে বিশাল মাথাওয়ালা টিউমার-আক্রান্ত বাচ্চামেয়েটাকে দেখতাম, আমার খুব মানসিক যন্ত্রণা হতো! মরে যেতে ইচ্ছে করত! এই যে লোকে বলে, আল্লাহ্‌র গজব পড়ছে, আমি তো দেখি, ফিলিস্তিন-কাশ্মীরের বাচ্চাদের উপর বেশি গজব পড়ছে! তখন কেন জানি অবিশ্বাস জন্মে মনে…আল্লাহ্‌ কি সত্যিই আছেন? থাকেনই যদি, তবে নির্দোষ নিষ্পাপ মানুষকেই কেন যুগে যুগে কষ্ট দেন? এরা তো সুবিচার পায় না কখনওই! আমি কোনও উত্তর খুঁজে পাই না এর! কী জানি! আমার হয়তো বোধের অনেক ঘাটতি আছে! শেক্সপিয়ারের একটা উক্তি আমার মনে খুব দাগ কেটেছে: Some rise by sin, some by virtue fall! কারও হয় পাপে উত্থান, কারওবা পতন হয় পুণ্যে। জগতে এর চাইতে সত্য আর কী আছে! কেউ পাপ কাজ করে করে উন্নতির শিখরে উঠে যায়, কেউবা ভালো কাজ করে বলেই তার যত যন্ত্রণা! এটা যখন মাথায় আসে, তখন সৃষ্টিকর্তার দিকে আবারও তাকাই; এরপর ভাবি, না, ঠিক আছে, আমি বুঝতে…পারিনি।


যা-ই হোক, আমি আমার গল্পে ফিরে আসি। সিদ্ধান্ত হলো, আমি আর রুমি দেখা করব। সে কাজল, লিপস্টিক পছন্দ করে না। আর এদিকে আমি কাজল পরতে ভালোবাসি। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি কাজল, লিপস্টিক কিছুই দিব না। শুধু কপালে ছোট্ট একটা টিপ। সে বলে, আমার কপাল নাকি সুন্দর। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন রঙের টিপ পরব? উত্তরে বলল, কালো। এক ফাঁকে তাকেও বলেছিলাম, কালো শার্ট পরে আসতে। কালো আমার খুবই প্রিয় রং।


আমি ভীষণ উদ্‌বেলিত, উৎসাহিত। আমার পানসে জীবনে দীর্ঘদিন পর আবার কেউ এসেছে। যাকে আমি ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছি। হাজার সংকোচ ভেঙে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ বলে ফেলেছি স্পষ্টতই! আমার কাছে এটা বলার অর্থ অনেক বড়ো কিছু। আমি যদিও ‘ভালোবাসি’ কথাটা মুখে বলতে খুব একটা অভ্যস্ত ছিলাম না, এটা অনুভবের ব্যাপার, উপলদ্ধির বিষয়, উন্মুক্তের কিছু নয়। তার সাথে আমার প্রথমদেখা হতে যাচ্ছে! প্রথমদিনের স্মৃতি হিসেবে আমি তাকে কী দেব? এক সপ্তাহ আগে থেকেই চিন্তায় পড়ে গেলাম! ছেলেদের গিফট সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। তার গায়ের মাপও জানি না। সেদিন আমি জ্বর-কাশি নিয়েই বেরিয়ে গেলাম। ক্যাম্পাসের সবগুলি গিফটশপ ঘুরলাম। কিছুই পছন্দ হলো না। ওখান থেকে ক্যাম্পাসের স্মৃতিসৌধের বিপরীত দিকে মৃৎ ও কুটিরশিল্প সংস্থার মার্কেটে গেলাম। আমার মাটির সৌখিন জিনিস খুব পছন্দ। ঠিক করলাম, আমি তাকে তা-ই উপহার দিব। সবগুলি দোকান ঘুরে ঘুরে দুটো কলমদানি, একটি মাটির মাছ, কাঠবিড়ালি, খরগোশ, বিড়াল, হাতি…সব কিনলাম। পরদিন আবার গেলাম ক্যাম্পাসে সুন্দর লালরঙের শপিংব্যাগ আর কালারড-পেপার কিনতে। প্রতিটি আইটেম কালারড-পেপার দিয়ে মুড়িয়ে এক-একটাতে ওর নামের অক্ষরগুলি লিখলাম অনেক যত্ন করে। খেয়াল করে দেখলাম, ওর জন্য খরচ করতে আমার অনেক ভালো লাগছে!


(চলবে…)