তবুও অপেক্ষা/ শেষ অংশ

 
যা-ই হোক, হুট করে এক শুক্রবার সকালে বলল, আমাকে আমাদের বাসার পাশে ক্লিনিকে নিয়ে যাবে থ্যালাসেমিয়া টেস্ট করানোর জন্য। অনেক দিন ধরেই বলছিল। ওর নিজেরও মাইনর থ্যালাসেমিয়া আছে। ওখানে গেলাম, তারপর টেস্ট করালাম। টেস্ট করিয়ে আমরা ক্যাম্পাসে বসলাম। ও আমাকে আইসক্রিম কিনে দিল। আমরা কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম। ওকে বললাম, সামনের বৈশাখে তুমি যদি ক্যাম্পাসে আসতে, তাহলে আমি সেদিন শাড়ি পরতাম। সে বলল, সে আসতে পারবে না। ছুটি পাবে কি না জানে না, আর পেলেও বাসায় থাকবে। কোথাও বের হবে না। কারণ তার বের হতে ভালো লাগে না। বললাম, বৈশাখে আমার ক্যাম্পাসে আসতে খুব ভালো লাগে। সে বলে, ধানমন্ডির বাসাগুলিতে থাকলে আমার আর বের হতে ইচ্ছে হবে না। ওখানে নাগরিকদের সব সুবিধা আছে। আমাদের এখানে কোথাও ঘোরার জায়গা নাই দেখে আমরা এখানে আসি! তা ছাড়া এসব উন্মুক্ত স্থানে স্টুডেন্টরা আসে, কারণ রেস্টুরেন্টে বসার টাকা তাদের নেই!


ওর কথা শুনে আমি হতবাক! কী করে বোঝাব যে এখানে আসার সাথে পয়সা নয়, আবেগ জড়িত! অবশ্য সে তো আমাদের বটতলাকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, যেখানে একসময় হুমায়ুন ফরীদি, সেলিম আল দীন, এঁদের মতো অভিনেতারা, বড়ো বড়ো লেখকরা আড্ডা দিয়ে দিয়ে এতদূর এসেছেন! আমাদের গল্পগুজব বেশি এগোয় না। সে চুপচাপ থাকে, আমি অনর্গল কথা বলে যাই! একসময় বাসে উঠি। কারণ তার এমআরসিপি-এর কোচিংয়ে যাবার তাড়া আছে। আহা, কে জানত, সেটাই ছিল আমাদের শেষদেখা!


এর মধ্যে ও কেমন জানি নির্জীব হয়ে থাকত। বেশি কথা বলত না। সব আমিই বলতাম। আমার দম বন্ধ লাগত। ও শুধুই ইমোশনাল কথা বলত। ওর আর কোনও কিছুতেই আগ্রহ নেই। কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমি ওকে দুই-একবার বলেছিলাম, আমাকে যদি আগের মতো ভালো না বাসো তো বাদ দাও, হেমা আপুকে কিছু বলব না। উত্তরে সে কিছু বলত না। বৃহস্পতিবার তাকে ফোন দিয়ে বললাম, তুমি শুক্রবারদিন আমার সাথে দেখা করবে? সে বলল, পারবে না, তার পেটব্যথা। পরদিন শুক্রবার ফোন দিয়ে বলল, তুমি যেহেতু দেখা করতে চেয়েছিলে, এখন বলো, তোমার ক্যাম্পাসে আসব কি না। আমি বললাম, হুট করে বললে তো হয় না। আমাকে কাল বললে ওভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিয়ে বলে, দেখা করবে কি না পাঁচ মিনিটের মধ্যে জানাও। আমি আর ওকে ফোন দিতে পারলাম না। কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তারপর ও নিজেই ফোন দিয়ে বলল হ্যাঁ অথবা না বলতে। আমি মানুষকে সরাসরি না করতে পারি না। তার উপর ওকে তো আমি ভালোবাসি, তাই ওকে কোনও কিছুতে না করতে আমার খুব কষ্ট হয়। তাই আমতা আমতা করে বললাম, আমি তো রোজা রেখেছি। তা ছাড়া বাসায় আপু দুলাভাই আছে। রোজ রোজ বের হলে ওরা রাগ করবে। এরপর ও বলল, ঠিক আছে। আমার অনুমতি নিয়ে সে ভিডিও কল দিল। আমি না করতে পারলাম না। ওর আচরণে কিছুটা অস্বস্তি হলো! ও কি আসলেই সাইকো! সেই মুহূর্তে খুউব মায়া হলো মানুষটার জন্য। মনে হলো, ওকে আমি ভালোবাসা দিয়ে সারিয়ে তুলব।


দুপুরের পর ওকে অডিওকল দিলাম। ও পড়তে বসেছিল। অনেক ইমোশোনাল হয়ে গেল টিনএজারদের মতো। আমিও ছিলাম ভীষণ আবেগপ্রবণ। ওকে কথায় কথায় বললাম, ‘বাবুই, বিয়েতে আমি লাল টুকটুকে শাড়ি পরব। আর অনেক সাজব। আমাদের বাসর হবে অন্য কোথাও।’ এটা শুনেই সে হুট করে ক্ষেপে গেল। বলল, ‘তুমি বার বার একই কথা বলছ। তোমার এত ঘোরার শখ কেন আমাকে নিয়ে? ঘুরতে ইচ্ছে করলে তোমার ফ্যামিলিকে নিয়ে যাও, বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে যাও, আমার সাথেই তোমার ঘোরা লাগবে কেন? আমি বার বার বলেছি, আমি অ্যাডভান্স কথা পছন্দ করি না, তারপরও তুমি বলো এসব। তোমার বন্ধু-বান্ধবের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিবে, আমি একটু ওদের জিজ্ঞেস করি, কবে বিয়ে, তারই ঠিক নেই, তার আগেই কেন এত প্ল্যান-প্রোগ্রাম করতে হবে?’ আমি বললাম, ‘একটা মেয়ের সারাজীবনের স্বপ্ন তার বিয়ে। সে শুধু ছয় মাস না, সারাজীবন ধরেই বিয়ের প্ল্যান করতে থাকে। আর আমি তো আমার বন্ধু-বান্ধব ফ্যামিলির সাথে ঘুরতে চাই না, শুধু তোমার সাথে---আমার হাজব্যান্ডের সাথে ঘুরতে চেয়েছি। এই সাধআহ্লাদ কি আমার থাকতে পারে না?’


কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ওকে বললাম, ‘তুমি আমার সাথে আর কক্ষনো এরকম কাটা কাটা কথা বলবে না। আর এসব চ্যাটিংও আমার সাথে করবে না। আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। বিকৃত হয়ে যাচ্ছি। অথচ আমার এমনটা হবার কথা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে অনেক ভালো কিছু বই আমি পড়েছিলাম। আমার জীবনদর্শন পালটে-দেওয়া বই। তুমি ওসব বুঝবে না। আমি সিরিয়াসলি বলছি, তুমি বিয়ের আগে আমার সাথে এ ধরনের কথা একদমই বলবে না। যেহেতু তুমি অ্যাডভান্স কথা পছন্দ করো না, তাই অ্যাডভান্স কাজ কেন করব আমরা?’ এটা বলেই ফোন কেটে দিই। এরপর রাগ করে চারদিন আর ফোন দিইনি। সে-ও দেয়নি। এই চারদিন আমি বুঝেছিলাম, আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসি। খুব মিস করছিলাম। বুকের মাঝে ওর জন্য কষ্ট কোঁকিয়ে উঠত। রাতে ঘুমাতে পারতাম না। ওকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। খুব টেনশন হতো ওর জন্য।


চারদিন পর রাতে দুবার ফোন দিলাম। সে ধরল না। ভোরবেলা দুবার ফোন দিলাম, ধরল না। সকাল সাতটার সময় যখন ফোন দিলাম, ও ফোন ধরেই বলল, আমি এখন বাসে। বিকালে ফোন দিয়ো। বললাম, এতবার ফোন দিলাম ধরলে না কেন? বলল, সে ঘুমে ছিল। বলেই ফোনটা কেটে দিল। সন্ধ্যায় ফোন দিলাম। বলল, বন্ধুর সাথে। এরপর রাতে ফোন দিয়ে বললাম, এতবার ফোন দিলাম, তুমি কোনও ফোন দাওনি কেন? জানো, তোমাকে এ কদিন কতটা মিস করে কেঁদেছি। সে খুব কড়াভাবে বলে, যা বলার, সংক্ষিপ্তভাবে বলো। এত প্যাঁচাল শোনার সময় নাই আমার। বলেই সে আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে দেয়। সে কিন্তু প্রচণ্ড মেধাবী। প্রতিটি কথা পয়েন্ট টু পয়েন্ট তার মনে থাকে। সে পয়েন্টে পয়েন্টে যুক্তি দিয়ে তর্ক দিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করে। আমি খুব বোকা মেয়ে, প্রচণ্ড আবেগী মেয়ে। ভালোবাসার মানুষটি একটু জোরে বকা দিলে কেঁদে ফেলে যে মেয়েটি, আমি সেই মেয়ে। তার যুক্তিতর্কের সাথে আমি পেরে উঠি না। সে সেদিনের ব্যাপার নিয়ে কোনও কথাই বলেনি। আমার সাথে তার সম্পর্কের শুরু থেকে ছত্রে ছত্রে সে আমার দোষগুলি একটা একটা বলতে থাকে যে আমিই হেমা আপুকে বলেছি, একথা আজ পর্যন্ত স্বীকার করি না। আমি বারবার তাকে সাজেকভ্যালি যাবার জন্য প্রেশার দিই। এত টাকা সে কই পাবে?


আমি বললাম, দুজন মানুষ তো এক রকম হয় না। তুমি ঘুরতে পছন্দ করো না, আমি করি। এসব মিলেমিশেই তো সংসার। তা ছাড়া তুমি আমাকে এত দামি মোবাইল কিনে দিতে পারো, আর বেড়াতে-যাওয়া তোমার কাছে বাজেখরচ? সে বলে, তোমার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ, আমার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ না। যে ছেলে তোমার গুরুত্ব বুঝবে, তাকেই তোমার বিয়ে করা উচিত। আমার কাছে মোবাইল প্রয়োজনীয়। আর ঘোরাফেরা বাজেকাজ। ক্যারিয়ার সবার আগে। আমি বললাম, বেশ, আমি আর ঘুরতে চাইব না তোমার সাথে। সে বলল, না, তুমি আমাকে এসব নিয়ে যন্ত্রণা দিবে। তোমাকে আমার আইডি দিয়েছি বিশ্বাস করে, অথচ তুমি আমার আইডি নিয়ে যাচ্ছেতাই খেললে কেন? কেন আমার এক্স-গার্লফ্রেন্ডকে ফলো দিলে, তারপর ওর মেসেজ ডিলিট করলে? এখানে ওর তো কোনও দোষ নাই। তুমি আমার ইমেজ নষ্ট করেছ। তারপর তুমি আমার ব্লকলিস্টের মহিলাদের ব্লক খুলে খুলে সার্চ করে দেখেছ। কেন করলে? তার মানে তুমি আমাকে সন্দেহ করো। এরা তো আমার শত্রু। তুমি জানো, কত কষ্টে এদেরকে খুঁজে বের করে আবার ব্লক করেছি! সে আরও বলল, তুমি যে ব্লক খুলে দেখেছ, এটা আমাকে বলেছ? তার মানে, কাজটা তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে করেছ। তোমাকে বিয়ে করলে আমাকে সব সময়ই এই ধরনের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তুমি আমাকে সন্দেহ করতে করতে মেরেই ফেলবে। সারাক্ষণই মানসিক অশান্তিতে রাখবে। লাগবে না আমার ভালোবাসা, আমি শান্তিতে থাকতে চাই। তোমাকে বিয়ে করলে তুমি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না।


তার এসব কথা শুনে আমি হতভম্ব। কোনও কাউন্টার যুক্তি দাঁড় করাতে পারিনি কিংবা দাঁড় করাতে চাইনি। বললাম, আমি যখন এসব করেছি, তখন এত কিছু বললে না কেন! এসব তো অনেক আগের কথা! কেন এরপরও আমার সাথে কথা চালিয়ে গেলে? সে বলে, তোমাকে বলতে হবে কেন? তুমি নিজে থেকেই কেন বুঝবে না? আমি একটা বিচক্ষণ মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। তুমি স্বপ্নবিলাসী, অপরিণত মেয়ে। আমি এসব পছন্দ করি না।…আমি ওকে সরি বললাম। মাফ চাইলাম। বললাম, সত্যিই তোমার আইডিতে ঢুকে ব্লকলিস্ট খুলে আমি অন্যায় করেছি। আমাকে মাফ করো, প্লিজ।…সে বলে, সরি বলে কিছু হবে না, কারণ এটা তোমার স্বভাব। এটা কখনও চেঞ্জ হবে না। সে বলল, আমার ফ্যামিলির কথা, হাবিজাবি এতকিছু জিজ্ঞেস করো কেন? আমার যে এত বড়ো একটা পরিচয় আছে, সেটা ইমপর্টেন্ট কিছু না তোমার কাছে? আমি এসব অহেতুক কৌতূহল পছন্দ করি না। সে বলে, তুমি বার বার বলছ, আমার সাথে আর যোগাযোগ করবে না। তারপরও যোগাযোগ করেছ। রাস্তায় পর্যন্ত চেঁচামেচি করেছ যে এই ছয় মাস আর যোগাযোগ করবে না, তবু কথা বলেছ। এরপর বলে, তুমি আমার কাছে বারবার ছয় মাসের গ্যারান্টি চাইছ। কেন বারবার, ছয় মাস পর বিয়ে করব কি করব না, এটা নিয়ে নেগোশিয়েট করবে? বলে, তুমি চাকরিতে জয়েন করো। তারপর সময় নিয়ে আমাকে তোমার সিদ্ধান্ত জানাও।…এরপর ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি, তুমি কি আমার সাথে ব্রেকআপ করতে চাও? সে খুব শান্তস্বরে উত্তর দিল, হ্যাঁ।


ওর কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। অনেক কান্নাকাটি, অনুনয় বিনয় করলাম। বললাম, আমাকে আর-একবার সুযোগ দাও, প্লিজ। আমার ভালোবাসাকে অমর্যাদা কোরো না, প্লিজ। তা-ই যদি হয়, তবে কেন আমার মন নিয়ে খেললে? নতুন করে স্বপ্ন কেন দেখালে? কেন তোমার এত প্রেম উবে গেল এত তাড়াতাড়িই? সত্যিকার ভালোবাসা এত অল্পতেই ভেঙে যায় না। সে বলে, তোমার প্রতি আমার মন উঠে গেছে। আমি চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। যন্ত্রণা পাবার থেকে একা থাকা ভালো। আমি তোমাকে আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলাম। তোমাকে উপহার দিয়েছিলাম আন্তরিকভাবেই। শুনে বললাম, তোমার মোবাইল আর আমাকে দেওয়া টাকা কীভাবে ফেরত দিব? সে বলল, ওগুলি দিতে হবে না। পানিতে ফেলে দাও। বললাম, ওগুলি যদি রাখতে হয়, আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে। আর না হলে ওগুলি ফেরত নাও। দেখা করে নিয়ে যাও। সে বলে, না, দেখা করতে গেলে তুমি রাস্তায় কান্নাকাটি করে সিনক্রিয়েট করবে। ফেরত দিতে ইচ্ছে করলে বরং ক্যুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়ো। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য আমি যে-কোনও শর্তেই রাজি।


সে নানান কারণে এখন প্যানিকড। দেশের পরিস্থিতি ভালো না, সে বাঁচে কি মরে, ঠিক নেই। তার উপর তার পেটে তীব্র ব্যথা কতদিন যাবত! এর মধ্যে আমি তাকে পেইন দিই। এ কারণে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন আর বিয়ে করবে না। দুবছর পর করবে। এতদিন তো আর আমি অপেক্ষা করব না। অতএব, আমি অন্য কোথাও যেন বিয়ে করে ফেলি। আমাদের আর কথা হলো না। পরদিন ফোন দিয়ে শুধু বলেছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ক্যুরিয়ারে সব পাঠিয়ে দিব। একটু দেরি হবে। সে শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ বলে গেল, আর কিছু বলল না। আমি আবারও প্রচণ্ডভাবে ভেঙে গেলাম। সারাক্ষণই কাঁদতে লাগলাম। জীবনের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা তৈরি হলো। মনে হতে লাগল, কেন এখনও বেঁচে আছি? এসব সহ্য করতে?


হৃদয়ের পাঁজরগুলি পর্যন্ত ভেঙে গেল। নিজের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস সবই হারালাম। কেন বারবার ভুল মানুষকে ভালোবেসে কষ্ট কুড়াই, আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই? কেন নিজহাতেই নিজের কষ্ট ডেকে আনি? একটা মানুষ কয়বার ভুল করতে পারে? আমি এমন বোকা কেন? আমার প্রতি ওর ভালোবাসা ছিল কি না, জানি না। তবে আমি ওর মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম। ওকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আজ সকালেও ওকে স্বপ্নে দেখি। কেন আমার দুচোখে সে এত স্বপ্ন দেখাল? ভালোবেসে বাঁচার স্বপ্ন দেখাল! ভালোবাসা কি এত ঠুনকো, এত সস্তা যে দ্রুত ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়, আবার দ্রুতই ভেঙে দেওয়া যায় একেবারেই সিলি সিলি কারণ দেখিয়েই! কেবলই নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে, আমার দোষেই রিলেশনটা ভেঙে গেল। আমার আরও কৌশলী হওয়া উচিত ছিল। প্রচণ্ড অনুশোচনা হচ্ছে। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে, আমি এমন ইমম্যাচিউরড ভুল না করলে সম্পর্কটা টিকে যেত।


আমি কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছি না। এর মধ্যে ওর সম্পর্কে আরও বুঝতে ও জানতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। এক নির্বোধের নির্বুদ্ধিতার কিছু ব্যর্থপ্রয়াস আরকি! সাইকোপ্যাথ, প্যারানর্মাল, সিজোফ্রেনিয়া…এসবের লক্ষণ দিয়ে গুগলে সার্চ দিলাম ওর সাথে কিছু মিলে কি না দেখতে। ওকে নিয়ে জানবার ও বুঝবার ব্যর্থ কিছু গোয়েন্দাগিরি চালালাম! জানলাম অনেক কিছু, এবং জেনে কোনও লাভই হলো না। একদিন হুট করে আমার ফেইক আইডি দিয়ে ওর সেই শত্রু, সেই ভাইকে পেয়ে গেলাম। নক করে পরিচয় গোপন করে কৌশলে রুমির ব্যাপারে সবকিছু জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, তিনি সব জানেন। আমাকে ওঁর নাম্বার দিয়ে ফোন দিতে বললেন। এই ভাইয়ের নাম শওকত। আদর্শগত কিছু কারণে তাদের দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়েছিল। তো সেই শওকত ভাইকে বললাম, আমার এক বান্ধবীর সাথে রুমি ভাইয়ের বিয়ের কথা হচ্ছে। তাদের পরিচয় ফেইসবুকে। আপনার কথা শুনেছি যে কোনওভাবে আপনি তাকে চিনেন। তিনি বললেন, আমার সাথে রুমি এক বছর ছিল দুই বছর আগে। এই দুইবছর আমি রুমির আর কোনও আপডেট জানি না।


শওকত ভাই বলতে থাকলেন…রুমির প্রথম পোস্টিং সাতক্ষীরায়। ওখান থেকে কোনওভাবেই ঢাকায় আসতে পারছিল না। কারণ তার কলিগরা তাকে আটকে রাখে। সে সেখানকার সিনিয়র জুনিয়র সবার সাথে ঝামেলা করেছে। এই ভাইয়ের সাথে তার ফেইসবুকে পরিচয়। অনেক কষ্টে এই ভাই ওকে নোয়াখালীতে পোস্টিং করে নিয়ে আসেন। নোয়াখালীতে এসে রুমি প্রচুর ইনকাম করতে থাকে। ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে সর্বোচ্চ টাকা নিত সে। মাসে এক লাখ করে ইনকাম তার। বিভিন্ন দালাল ধরে অনর্থক অনেক টেস্ট দিত রোগীদের। তার ব্যাংকে আছে ৩১ লক্ষ টাকা। এই টাকা থেকে লব্ধ ইন্টারেস্ট আবার আর-এক ব্যাংকে রাখে সুদ পাবার জন্য। নোয়াখালীতে এক বছর ছিল। এরপর ওর আচরণগত সমস্যার কারণে ওকে পানিশমেন্ট দিয়ে কক্সবাজার পাঠানো হয়। সেখান থেকে এখন অনেক কষ্টে ঢাকা মেডিকেলে দুবছরের জন্য আসতে পেরেছে। অনকোলজি বিষয়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েট করার জন্য চান্স পেয়েছে।


রুমি খুবই কৃপণ প্রকৃতির লোক। বিয়ে, বেড়ানো এসব তার কাছে বাজেখরচ। সে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। সময় সময় কুল, সময় সময় ডেসট্রাক্টিভ। সে রাত জেগে থাকে। রাতে দুঘণ্টার বেশি সে ঘুমায় না। ঘুমের মধ্যে কথা বলে। একা একা হাসে। তার ধারণা, তার মা তাকে জমিজমা দিবে না। বড়ো ভাই পরিবারের গাড়িটা বিক্রি করেছে বলে সে তাকে পুলিশে দিতে চায়। সে জাতে মাতাল, তালে ঠিক। তার কাছে সবকিছুর স্ক্রিনশট থাকে, সব কথার রেকর্ড থাকে। তবে সে খুবই মেধাবী, ধুরন্ধর, বুদ্ধিমান। ডাক্তারিবিদ্যায় সে খুবই ভালো। সবাইকে এ ব্যাপারে সে খুব হেল্প করে। তার একাধিক ফেইক আইডি। এগুলি দিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্টে উলটাপালটা কমেন্ট করে সে মজা পায়। ভাইয়া আমাকে বললেন, যার সাথে রুমির বিয়ের কথা চলছে, সে কি সাইকো নাকি? এমন একটা সাইকো ছেলেকে বিয়ে করতে চায় কেন সে? তাকে বাঁচান। সে গর্তে পড়তে যাচ্ছে। তবে রুমির চরিত্রের কথা তিনি কিছু বলতে পারলেন না, যেটা শোনা আমার সবচেয়ে জরুরি ছিল!


আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলাম না, ও কীভাবে সাইকো হয়! অথবা ওকে বুঝবার মতো পরিপক্বতা আল্লাহ্‌ আমার মাথায় দেননি। আমি বাইপোলার ডিসঅর্ডার সিনড্রোমের সাথে ওর মিল খোঁজার চেষ্টা করেছি। যেমন ওর অনেক ইনসমনিয়ার প্রবলেম। ফোর্স বা প্রেশার ও নিতে পারে না। কেউ ওকে জাজ করতে গেলে ও প্রচণ্ড ক্ষেপে যায়। একলাঘরে থাকতে সে পছন্দ করে। ইনসিকিউরড ফিল করে। সব সময় জমিজমা নিয়ে সবাইকে সন্দেহ করে। এবং একমাত্র সম্পদের মাঝেই নিজের সকল নিরাপত্তা খোঁজে। কিছুটা হাইপার-সেক্সুয়াল, তবে কোনওভাবেই অ্যাগ্রেসিভ নয়। কিন্তু এইসব সিনড্রোম তো স্বাভাবিক মানুষেরও হতে পারে। তবে হ্যাঁ, ওর ছবিতে ওর চোখদুটো জানি কেমন অস্বাভাবিক, ঠিক বোঝাতে পারব না। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না বেশিক্ষণ, কেমন জানি ভয় লাগে।


আমার কেন জানি মনে হয়, ও মেয়েদের সাথে বেশিদিন সম্পর্কে স্টে করতে পারে না, অথবা মেয়েদের ও বেশিদিন সহ্য করতে পারে না। ওর প্রাক্তনের সাথে মাত্র দুমাস টিকেছিল। সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ হবার পর এত তাড়াতাড়ি ওই মেয়ের সাথে সবকিছু নিষ্ঠুরভাবে ভেঙে ফেলল সে। আমার সাথে এক-দেড় মাস টিকেছিল। যদিও ওকে আমি ভার্চুয়ালে আজ থেকে ৩/৪ বছর ধরে পছন্দ করি। ওর প্রতিটি পোস্ট, প্রতিটি কমেন্ট আমি নিয়ম করে করে দেখতাম। কোনও দিন ইনবক্সে দরকারি কথা ছাড়া অন্য কিছু বলিনি। কোনও দিন ওকে মনের কথা বলা হতো না, যদি না আমার পরিচিত প্রতিবেশি হেমা আপুর সাথে সে পরিচিত না হতো। আমি ভাবতেও পারিনি, ও আমাকে রেসপন্স করবে। কারণ ভার্চুয়াল রিলেশনে আমি খুব একটা বিশ্বাসী না। তাই ওর কথা মন থেকে বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে চাইলাম, কিন্তু ও-ই পরে আমাকে অ্যাপ্রোচ করে। একতরফা ভালোবাসায় কোনও কষ্ট নেই। কিন্তু যে ভালোবাসায় দুজন দুজনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে একজন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, সেটা অনেক কষ্টের। যে প্রতারণা করে, তার কোনও কষ্ট নেই, যে প্রতারিত হয়, শুধু তারই কষ্ট হয়। এমন প্রতারণার ভালোবাসার চাইতে অনেক অনেক ভালো কাউকে একতরফা ভালোবেসে যাওয়া, ওকে জানতে না দিয়েই।


শওকত ভাইয়ের এসব কথা যদি সত্যও হয়ে থাকে, তবুও ওর প্রতি আমার মায়া একরত্তিও কমেনি, বরং ও খুব মেধাবী বলে ওর প্রতি আমি বেশি আকৃষ্ট হয়েছি। যার যে জিনিসের অভাব, সে সেটা অন্যের মধ্যে দেখতে পেলে তার প্রতি দুর্বল হয়। নিজের এই বুদ্ধিজনিত অভাব পূরণের জন্য, যার প্রবল বুদ্ধি, তাকে পাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জন্মে, বাসনা হয়। আমারও ওর প্রতি এই কারণে দুর্বার আকর্ষণ, আকাঙ্ক্ষা! হয়তো ওর আমার প্রতি শুধু ফিজিক্যাল অ্যাটাচমেন্ট ছিল, আর আমার ওর প্রতি মেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট, এই বৈপরীত্যের জন্যই আমাকে ও মনে রাখেনি আর ওকে আমি ভুলতে পারি না। ওকে মনে পড়ে বিধায় আমি ভালো নেই। ব্রেকআপের দিন ওকে বলেছিলাম, তোমার ভালো-খারাপ সব মিলিয়েই আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি কেন আমার ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমাকে ভালোবাসতে পারলে না?


ব্রেকআপের পর ওর আইডির পাসওয়ার্ড ও চেঞ্জ করে ফেলে। এমনকি আইডি ডিঅ্যাকটিভেট করে ফেলে। আমি অন্য আইডি দিয়ে ঢুকেও ওকে এখন আর পাই না। ইমোতে ছিলাম ওর সাথে। ব্রেকআপের পর আমিই ইমোতে ওকে ব্লক করে রাখি। ওর ছবি, টেক্সট…এসবের প্রমাণ না রাখার জন্য। হ্যাঁ, মোবাইল নম্বরটা রেখেছি ক্যুরিয়ারে ওর জিনিসগুলি ওকে ফিরিয়ে দেবার সময় শুধু একবার নিশ্চিত হবার জন্য ফোন দিব…জিনিসগুলি পেয়েছে কি না জানতে। এ ছাড়া ওর কাছে পৌঁছানোর এখন আর কোনও মাধ্যম নেই আমার কাছে। আর থাকলেও ওকে যেচে বিরক্ত করতে যাব না আমি। অতটা বেহায়া আমি নই।


ব্রেকআপের দিনটি ১৯ মার্চ। ২৬ মার্চ একদিন আমার এই ফেইক আইডি দিয়ে একটা ফেইক আইডিতে রিকোয়েস্ট দিই। আইডিটা আমার মেসেঞ্জারে ‘পিপল ইউ মে নো’-তে হঠাৎ করে দেখতে পাই। নামটা ওরই। তবে রুমি ইসলাম নামে খুলেনি। মোহাম্মদ রুমি নামে খুলেছে। কাকতালীয়ভাবে একেবারে কিছুক্ষণ আগে আইডিটা খুলেছে। শুধু প্রোফাইলে একটুকরো মেঘের ছবি। আর কিছুই নেই। রিকোয়েস্ট দেবার সাথে সাথে অ্যাক্সেপ্ট করল। আমাকে অবাক করে দিয়ে হাই জানাল। আমিও জানালাম। আমি শিওর হবার চেষ্টা করলাম এটা ও কি না। ওর লেখার স্টাইল দেখে ৮০% শিওর হয়ে গেলাম। এরপর আরও কিছু সিনড্রোম দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম, এটা ও-ই। প্রথমে বুঝতে পারলাম না, ও আমাকে চিনতে পেরেছে। চেয়েছিলাম, একটু বাজিয়ে দেখব অন্য মেয়ে সেজে। কিন্তু ও অনেক বুদ্ধিমান, কাজেই পরে ওই রিস্কে গেলাম না। ওই আইডিতে সে আমার সাথে ৪/৫ দিন অ্যাড-হওয়া ছিল।


এই চার-পাঁচ দিনে প্রথমে ওর পরিচয় ফ্যামিলি-বিজনেস দিলেও পরে স্বীকার করে, সে একজন ডাক্তার। মিথ্যাকথা শুধু এটুকু বলে---ও ফেইসবুক ওর স্ত্রী চালালে বিরক্ত হয় দেখে ও ফেইক আইডি খুলেছে। আর আমাকেও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে। আমিও সবগুলি ভুল ইনফরমেশন দিই। তারপরও আমার লেখার স্টাইলে কোনও রাখঢাক করিনি, কাজেই ও বুঝে ফেলে, এটা আমি। মজার ব্যাপার হলো, দুজনেই দুজনকে চিনতে পেরেছি। চিনে না চিনার ভান করে দুজনেই দুজনের ফেইক আইডি দিয়ে কথা বলেছি। একদিন মাইডে’তে ইংরেজিতে একটা কথা লিখলাম---There is no greater agony than bearing an untold story inside you. সেখানে সে লাইক রিঅ্যাক্ট দিল। হঠাৎ করেই দুপুরে আমাকে নক দিল। আমাদের বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল। এমনিই নর্মাল কথাবার্তা। রাতে সে তার মাইডে’তে আর ওয়ালে পোস্ট করল---জ্বর।


আমার বুঝতে বাকি রইল না। এটা সে আমার দৃষ্টিআকর্ষণের জন্যই করেছে, কেননা এটা তার ফেইক আইডি, আর আমি ছাড়া আর কেউ তার বন্ধুলিস্টে ছিল না। আর কেউ যে বন্ধুলিস্টে নেই, সেটা বোঝাতে সে ওয়ালে পোস্ট করেছে ইচ্ছে করেই, যেখানে কেউ কোনও রিঅ্যাক্ট করেনি। আমি অস্থির হয়ে গেলাম। দুঃখের রিঅ্যাক্ট দিলাম প্রথমে। নক দেবার সাহস পেলাম না। সে-ই নক করে বলল, ধন্যবাদ। আমি বললাম, কীভাবে কখন কতখানি জ্বর এসেছে? খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ওর কপাল ছুঁয়ে দেখি। বললাম, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন। সে বলল, সে জেগে থাকবে, তার ঘুম এখন আসবে না। বললাম, আপনি যতক্ষণ জেগে থাকেন, আমিও জেগে থাকব। এই মুহূর্তে এত দূর থেকে আপনার জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া কিছুই আর করার নেই। আমি অসহায়। আপনি রোগী মানুষ, যতক্ষণ জেগে থাকেন, ততক্ষণ দূরে থেকেই সঙ্গ দিতে চাই। সে বলল, অসুবিধা নাই। এরপর তাকে গল্প বলতে শুরু করলাম। তারপর আমাকে সে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা শুরু করল। বিয়ে করিনি কেন, বিসিএস দিব কি না, এসব। বললাম, বিয়ে করার আর ইচ্ছে নাই, পুরুষের উপর থেকে মন উঠে গেছে। সে বলে, কেন? প্রতারিত হয়েছেন? বললাম, এক, পুরুষমানুষ নিজের স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা অপেক্ষা অন্য নারীর সাথে কথা বলতে বেশি পছন্দ করে। দুই, পুরুষমানুষের নারীর প্রতি ভালোবাসা শুধুই শরীরী, মানসিক কিছু না।


সে বলে, আপনার মতো সাহিত্যের ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না, তাই বলে কি আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি না? বললাম, এই যে আপনি আমার সাথে কথা বলছেন, এটাও তো অনৈতিক! আপনার স্ত্রী জানলে এটা পছন্দ করবেন না। তবে আমি আপনার সাথে কথা বলছি নৈতিকভাবেই, কারণ আপনার জ্বর এসেছে। সে আমাকে বলল, আমার জ্বর এলে সেটা আমার ব্যাপার, কিন্তু এটা নিয়ে আপনি এত অস্থির কেন? আপনার কি অলক্ষে আমার স্ত্রী হতে ইচ্ছে করছে? হলে বলতে পারেন। আমি এই প্রশ্ন এড়িয়ে গেলাম। সে আবার বলল, আমি এখন আমার স্ত্রীর পাশে। এই মুহূর্তে আমার নিঃসঙ্গ লাগছে, স্ত্রীকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে। ধরুন, আমার স্ত্রীর স্থানে আপনি। এখন আমার কী করা উচিত? আপনি যা বলবেন, তাই করব। আমি এর উত্তরে লিখলাম, ‘আমি অন্তর্যামী নই যে এই মুহূর্তে আপনার কী করা উচিত বা আপনি কী চান, তা বলে দেবো। আর আমি বললেও-বা সেটা করা আপনার উচিত হবে কেন? আমি আপনার কে? আপনার স্ত্রীর স্থানে আপনি আমাকেই-বা বসাতে চাইছেন কেন? সবকিছু নিয়ে প্রহসন বা তামাশা চলে না।’


আরও বললাম, ‘কেউ আমাকে অপমান করল বা আমার সাথে চরম দুর্ব্যবহার করল, আমি এরপরও তার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকব, এটা কী করে হয়? আর আমি কি মাটির পুতুল যে আমার হাত-পা কেউ ভেঙে দিল, আবার জোড়া লাগিয়ে দিল, অমনিই সব ঠিকঠাক? কারও খারাপ ব্যবহারে আমারও কষ্ট হয়, আমারও দলায় দলায় কান্না আটকে গলা ধরে আসে। চোখ ঝাপসা হয়। তখন এ ধরনের কথাবার্তা আমার কাছে স্রেফ উপহাসের মতো লাগে। কারও প্রতিই আমার কোনও ঘৃণা বা বিদ্বেষ নেই। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি দৈবে। যা হয়েছে, ভালো হয়েছে। সামনে যা হবে, ভালোই হবে। চাইলে আমাকে ব্লক বা আনফ্রেন্ড করে দিতে পারেন। ভালো থাকেন।’ এরপর লিখলাম, ‘And, anyone can spoil my dream. After burning, I can be a spark in the ashes. I didn’t make any mistake. My love was pure but he was not worthy of containing that love. God never neglects the teardrops of pure love.’


তখন রাত তিনটা বাজে। এগারোটার দিকে কনভারসেশন শুরু করেছিলাম। নেট অফ করে শুয়ে পড়লাম। ওর উপর কিছুটা অভিমান, সাথে পুরনো প্রেমটা উথলে উঠল। বুকের মধ্যে ওর জন্য ভালোবাসার আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল। শুয়েছি ঠিকই, কিন্তু ঘুমাতে পারিনি। ভোর পর্যন্ত মাথার বালিশটা জড়িয়ে ধরে পড়ে পড়ে কাঁদলাম শুধু। পরদিনও কোনও রিপ্লাই দিলাম না, শুধু রাতে জিজ্ঞেস করলাম, জ্বর কমেছে কি না। সে শুধু ‘হ্যাঁ’ বলল। আর কোনও কথা হয়নি। আমার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কাঁদতে কাঁদতে অনেক রাতে সেই হ্যাঁ-র রিপ্লাই দিলাম। বললাম, চাইলে আমাকে ব্লক বা আনফ্রেন্ড করে দিতে পারেন। সকালে উঠে দেখলাম, সে তার নিজের আইডিই ডিলিট করে দিয়েছে। ফেইক আইডিতে তার রেসপন্স পেয়ে ভেবেছিলাম, আবার তাকে ফিরে পেয়েছি! বিশেষ করে তার লাস্ট লেখাগুলি দেখে আমি উতলা হয়ে গিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম, এখনও সে আমাকে ভালোবাসে, এখনও সে আমাকে ভুলতে পারেনি। তার সাথে আমার ফেইক আইডির কিছু কথোপকথন কয়েকবার পড়ে আমার মনে হয়েছিল, সে আমাকে স্ত্রী হিসেবে ভাবে? না কি মজা করছে আমার সাথে! হায়, সত্যিই আমি বোকা! আচ্ছা, আমি কি বোকামি করছি? না কি আমি ওকে ভালোবাসি? কোনটা আসলে?


রুমিকে আমি ভালোবেসেছি আমার জীবনের এত উত্থানপতনের পর। এটা ইল্যুশন কিংবা ইনফ্যাচুয়েশন কি না জানি না। ও আদৌ সাইকোপ্যাথ কি না, সেটা বারেবারে পরখ করতে চেয়েছি। অবজারভেশন করার চেষ্টা করেছি। এমনকি ও আমাকে বলেছিল, ‘তুমি কথা দাও, কোনও দিনই আমাকে ছেড়ে যাবে না।’ একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি কখনও তোমার আমার ঝগড়া হয়, তুমি কী করবে? সে বলল, তোমার পা ধরে মাফ চাইব, সরি বলব। ওর এতটাই এক্সেসিভ ইমোশন! প্রথমদিন রুমি ওই বেশে আসায় আমি ভেবেছিলাম, সে স্রোতে গা না ভাসিয়ে ভিন্ন কায়দায় আমাকে ইমপ্রেসড করতে চেয়েছে! সে একদিন আমাকে বলেছিল, আমি তোমাকে কোনও ফলস-অ্যাপিয়ারেন্স দেখাতে চাইনি বলেই ওভাবে গিয়েছিলাম দেখা করতে। পরদিনও যখন একই বেশে আসে, আমি বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। পরে শুনেছি, সে ওসব পরে মূলত মানুষের সিমপ্যাথি পাবার জন্য।


সে হেমা আপুকে বলেছিল, ‘আনিকা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত।’ যেদিন সে আমাকে মোবাইল কিনে দিল, সেদিন ফুডকোর্টে আমার হাত ধরে বলেছিল, এটা মন থেকেই দিয়েছি, এর জন্য কোনও প্রতিদান আমি চাই না। আমি যখন শর্ত দিলাম, এই মোবাইলের টাকা বেতন পেয়ে তোমাকে দিয়ে দিব, তখন সে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, আমরা একটা ল্যাপটপ কিনব, সেখানে তুমি অর্ধেক টাকা পে কোরো। আমাকে ওর মোবাইল দেবার উদ্দেশ্য তখন বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছি। কারণ আমার পুরান মোবাইলে ছবি ঝাপসা আসত। নতুন মোবাইলে ছবি ভালো আসবে। আমি মোবাইলটা ইউজ করি না দেখে সে খুব বিরক্ত হতো। অনেক কষ্টে বিরক্তি চেপে রাখত। তবে আমার সিক্সথসেনস বলছিল, মোবাইলটা আমি ইউজ করব না, কেননা এই সম্পর্কের কোনও ভিত্তি নেই। আমার মধ্যে সব সময়ই কেমন জানি একটা গাট-ফিলিং কাজ করত। আমি কি ভুল করছি, এমন জাতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতাম। সচরাচর সব পুরুষকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখি, পুরোপুরি কোনও পুরুষকেই বিশ্বাস করি না। সে-ও এর বাইরে ছিল না, যদিও অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণদের মতো ‘ওথেলো সিনড্রোম’ ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই।


ও আমাকে বলেছিল, ‘ম্যামের কাছে যখন শুনি, তুমি ভালো ফ্যামিলির মেয়ে, তখন তোমার সম্পর্কে আর কিছুই জানতে চাইনি। আমি তো একটা ভালো ফ্যামিলির মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছি সব সময়।’ ওর কাছে যে ডাক্তার-মেয়েটা সিভি চেয়েছিল, সে নাকি আমার ধারে কাছেও ছিল না। এবড়ো থেবড়ো দাঁত, দেখতেও কুচকুচে কালো। তবুও রুমি রাজি ছিল। মেয়েটাই নাকি ভীষণ বদরাগী, রুমির সাথে দুর্ব্যবহার করেছিল। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে, আমাকে রুমি যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবে পায়নি বলেই সরে পড়েছে। কিন্তু আমার কেবলই অনুশোচনা হয় এই ভেবে যে, ওর ব্যক্তিগত আইডিতে আমি কেন অন্য মেয়েদের ব্লক খুলে দেখলাম! এরপর যখন ওকে বললাম, আমার সাথে কোনও রকম ওই ধরনের খোলামেলা আচরণ করবে না, তারপরই সে আমাকে ব্লক করে দিল আমার ওই ব্লক-খোলার ইস্যু নিয়ে। এতে নাকি সে খুব আহত হয়েছিল। সামান্য ব্লক খুলে দেওয়ায় কেউ এমন করতে পারে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে?


আমি ওর যে সমস্ত বিবরণ দিয়েছি, তাতে কি আপনাদের ওকে সাইকোপ্যাথ মনে হয়েছে? যে ছেলেরা সাইকোপ্যাথ, ওরা সবাই-ই এমন করে কি না, আমি জানি না। আমি আসলে ছেলেদের সাইকোলজি একদমই বুঝি না। বাসায় বাবা ছিলেন, তা-ও বাবার সাথে খুব কম মিশতাম। ছেলেবন্ধু আমার আছে কিছু, কিন্তু বেশিরভাগকেই আমার কনজারভেটিভ মনে হয়। যে আমি ছেলেদের মনমানসিকতাই ঠিকভাবে বুঝি না, সে আমার ভাগ্যেই কিনা রুমির মতো একটা ছেলে এসে জুটেছিল! এর নাম কি ভাগ্য? না কি বিধাতার প্রহসন?


এখনও আমার হৃদয়ের ক্ষত গভীর ও কাঁচা। অনেক কিছুই এখনও শুকায়নি। সেই ক্ষতের কষ্ট যন্ত্রণা কিছুটা প্রশমনের জন্যই আমার জীবনের গল্পটা এতখানি লেখা। অনেক বড়ো বড়ো বেদনা মানুষকে দুঃখ দিতে পারে না, কিন্তু অনেক ছোট ছোট বেদনার কষ্ট মানুষ ভুলতে পারে না। এই রোজার মাসে আমি নামাজ পড়ে আল্লাহ্‌র কাছে চাইব দুঃখ ভুলে থাকতে, যেমন করে আমি ভালো থাকি, তা-ই চাইব। তিনি যদি আমাকে কিছু না-ও দেন, অন্তত দুঃখভোলার তৌফিক যেন দেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাকে আমি ক্যুরিয়ারে করে তার সাড়ে একত্রিশ হাজার টাকা দামের মোবাইল, আমাকে দেওয়া তিন হাজার টাকা, জুতা কিনে দেবার এক হাজার টাকা, আর সাথে একটা চিঠি দিব। তবে চিঠিতে তাকে পাবার কণামাত্রও আকুতি কোনওভাবেই জানাতে চাই না, অথবা ঘৃণাও ছুড়তে চাই না। ওসব যা জানাবার, কেবলই আমার স্রষ্টাকে জানাব।


চিঠিতে তাকে শুধু আমার মনের কিছু কথা, তাকে দেখার আগে এবং দেখার পরে আমার যা যা মনে হয়েছে অথবা আবোলতাবোল যা লিখতে ইচ্ছে হয়, তা লিখে একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি দিব। সেখানে তার জিনিসগুলি ক্যুরিয়ার করে পাঠাতে বিলম্ব হওয়ায় আন্তরিকভাবে দুঃখিত হবার কথা বলব। আর সাথে একটা লেখা দিব। ব্রেকআপের দুদিন আগে তাকে নিয়ে লেখাটা লিখেছি। আমাদের প্রথম দেখা-হওয়ার বর্ণনা। যাকে নিয়ে লিখেছি, সে পড়ুক বা না পড়ুক, তাকে না দিলে আমার লেখাটা সার্থক হবে না। আমার রিয়েল আইডিতেও গল্পটা পোস্ট করতে চাই।


এইসব নানান কথা মাথায় আসছে। হঠাৎ হেমা আপুর ফোন।


: হ্যালো…
: আনিকা, রুমির খবর শুনেছ?
: না। কী হয়েছে?
: রুমির করোনা-পজিটিভ ধরা পড়েছে।
: মানে?! কখন?! কীভাবে?!
: ওর হসপিটালে দুইদিন আগে বুকে ব্যথা নিয়ে এক পেশেন্ট এসেছিল। লোকটার শরীরে করোনা ছিল, আগে বলেনি। তুমি জানো না কিছু?
(আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। দোতলায় বারান্দার রেলিং ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।)
: হ্যালো আনিকা…শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো…!


আজান দিচ্ছে। জিনিসগুলি ক্যুরিয়ারে ফেরত-দেবার অপেক্ষাটা ক্রমেই আরও তীব্র হচ্ছে…