তবুও মুখোশ জেতে

আমার এক গল্প আছে, যা কেবল আমিই জানি। অবশ্য, এমন গল্প অজানাই থেকে যায়। বলেই বা কী হবে? তবু অনেকদিনই তো চেপে রাখলাম! প্রকাশ করতে না পারার অপ্রাপ্য শাস্তিটাও পেয়ে চলেছি যেন যুগের পর যুগ! আর কত? লিখে ফেলতে ইচ্ছে করছে মনের যত কথা, আবার ভয়ও করছে। সে ভয়টা কীসের, জানি না। পরক্ষণেই মাথায় আসছে, কী-ই বা এমন হবে সব সংকোচ ভেঙে ফেললে? আমার বিধাতা জানেন, আমি নির্দোষ। আজ অবধি কারও সাথেই এই ব্যাপারটা কখনও শেয়ার করতে পারিনি। তবু আর কতকাল লুকিয়ে রাখা যায়? আমারও যে সবকিছু বলে ফেলে হাল্কা হতে ইচ্ছে করে খুউব! বলতে না পারার কষ্ট পেতেপেতে আজ আমি বড় ক্লান্ত!

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের খুব সাধারণ একটা মেয়ে আমি। আমাদের পরিবারের মেয়েদের খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পড়াশোনা করার তীব্র ইচ্ছে আর অসীম সাহসকে পুঁজি করে পরিবারের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধের পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত একটা কলেজে বাংলায় ভর্তি হই। আমার পাশে আমার বাবা ছাড়া আর কেউই ছিলেন না। মেসে এসে উঠি ২০০৭-এ। প্রথম দিকে মাসেমাসে আমার বড় ভাই আমাকে ১০০০ টাকা করে দিতেন, যা দিয়ে আমার মেস-জীবনটা চালানো ভীষণ কঠিন ছিল, তবু কোনওমতে মানিয়ে নিচ্ছিলাম। ক্লাসে বরাবরই মনোযোগী ছিলাম। রেজাল্টও ভাল হচ্ছিল। অনার্সে ভর্তি হওয়ার অপরাধে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন আর এলাকার লোকজন আমার বাবাকে অনেক বড়বড় কথা শুনিয়েছেন। মায়ের সাথে বাবার নিয়মিতই ঝগড়া হত আমার পড়াশোনা নিয়ে। বাবা একটু শান্ত স্বভাবের মানুষ বলে আমার মামারাও অনেক অপমান করেছেন বাবাকে। বাবা কাউকে কিছুই বলতেন না, ভরসন্ধ্যায় বারান্দার এক কোণায় রাখা ইজি চেয়ারটাতে বসে নীরবে চোখের জল ঝরাতেন। আমি অনেকদিনই দূর থেকে বাবাকে কাঁদতে দেখেছি। কাছে গেলেই অশ্রু লুকিয়ে হাসিমুখে আমার মাথায় হাত রেখে কথা বলতেন। আমাকে নিয়ে বাবার কত স্বপ্ন! বাবার পায়ের কাছে বসে চুপ করে শুনে যেতাম আর নিজের অবচেতনেই হয়ত দুয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ত—বাবার চোখ লুকিয়ে। আমি বুঝতে পারতাম, বাবা যেন বুঝেও কিছু বুঝতেন না। বাবা-মেয়ের এ অভিনয়ের সাক্ষী ছিল কেবল নিঃশব্দ সন্ধেটা। তখনই আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দেবো। বিসিএস ক্যাডার হয়ে পরিবারের ও এলাকার সবার মুখ বন্ধ করে দেবো। আমাকে নিয়ে আমার বাবা গর্ব করতে পারবেন, সবার সামনে আমি বাবার মাথা উঁচু করে দেবোই! আমি স্টুডেন্ট হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিলাম না। বাবা আর আমার স্যাররা বিশ্বাস করতেন, আমি চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই ভাল কিছু করতে পারব।

কিন্তু হায়, আশা—সে তো কেবলই মরীচিকা!

সালটা দুইহাজার আট কি নয়। আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে। ডিসেম্বরে একজনের সাথে পরিচয়। সে আবার আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়। পরিচয়টা ফোনে। তার আগে আমি ভালই ছিলাম। পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রতি মুহূর্তে লড়াই করতাম। পড়াশোনা বাদে অন্য কোনও টেনশন মাথায় ছিল না। আমরা ফোনে কথা বলতে থাকি। কথা বলতেবলতে আমাদের পরস্পরকে ভাল লেগে যায়। তখন আমরা জানতে পারি, আমরা আত্মীয়। প্রথমে কথা হয়েছিল অপরিচিত হিসেবেই। পরে পরিচয় পাওয়ার পর বুঝতে পারি, আমরা রিলেশনে গেলেও কোনও সমস্যা হবে না। জানুয়ারি মাসে আমাদের প্রায় সারাক্ষণই কথা হয়েছে ফোনে। ও আমাকে জানুয়ারির শেষের দিকে প্রপোজ করে। আমার ইচ্ছে থাকলেও সায় দিইনি। ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র ঠিক দুইদিন আগে ও আবারও প্রপোজ করে, আমি দুইদিন পর অ্যাক্সেপ্ট করি।

আমাদের সম্পর্কটা ভালই চলছিল। ও খুব ভাল স্টুডেন্ট ছিল। ওরা ছিল দুইভাই, কোনও বোন ছিল না। ও পড়াশোনা করতো শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, এগ্রিকালচার বিভাগে। আমাদের বয়সের গ্যাপ এক বছরের; আমি সেকেন্ড ইয়ারে, ও থার্ড-এ। আমাদের মধ্যে খুব সুন্দর বোঝাপড়া ছিল। শুধু ভালোবাসাই ছিল না, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর অগাধ বিশ্বাসও ছিল। সেসময় আমাদের বাসায় প্রায় সবসময়ই বিয়ের প্রপোজাল আসত। আগেই বলেছি, আমাদের পরিবারে মেয়েদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়া হত। তাই আমার বাবা-মা’র উপরও আমার বিয়ের ব্যাপারে চাপ ছিল। এ সমাজের নিয়ম, সবাই মিলে ধরেবেঁধে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই যেন দায়মুক্ত হয়! বিয়ের পর মেয়েটা মরল কি বাঁচল, সে মাথাব্যথা কিংবা দায়িত্ব কারও নেই। যা-ই হোক, ওকে আমার বিয়ের প্রপোজাল আসার কথা বললে ও খুবই মনখারাপ করতো, এমনকি কান্নাকাটিও করতো। পরে আমি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও ও ওর বাসায় জানিয়ে দেয় যে বিয়ে করলে সে আমাকেই বিয়ে করবে। ওর বাসা থেকে ওকে জানানো হয়, পড়াশোনা শেষ করে ও একটা জব পেলেই আমার সাথে ওকে বিয়ে দিয়ে দেবে। মুখে বারণ করলেও ওর এই কাজটায় আমি মনেমনে খুব খুশি হই। ওর প্রতি ভালোবাসা আর আস্থা আরও বেড়ে যায়।

ফলে ব্যাপারটা দুই পরিবারেই জানাজানি হয়। এতে অনেকেই সায় দেয়, আবার অনেকেই দেয় না। ও আমাকে জানিয়ে দেয়, আমরা যেহেতু দুজন দুজনকে ছাড়া বাঁচব না, সেহেতু আমরা অন্য কাউকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না! তুমি তোমার ফ্যামিলিকে মানাও, আমিও আমার ফ্যামিলিকে মানাচ্ছি। আমি তার কথামত বাসায় জানিয়ে দিই, আমি ওকে ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করব না। আমি আগে পড়াশোনা শেষ করি, এরপর আমরা বিয়ে করব, এটাও বাসায় বলি। এরপরও আমার পরিবার আমাকে বিয়ে দেয়ার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমি সেটা হতে দিইনি। বারবারই বলেছি, এ দেহে প্রাণ থাকতে বিয়ে করলে ওকেই করব, নইলে কখনওই বিয়ে করব না।………আমি আমার কথা রেখেছি।

ফার্স্ট ইয়ারে আমার ভাই খরচ দিত, সেকেন্ড ইয়ারে দেয়া বন্ধ করে দেয়। আমার বাবা একটা ছোটখাটো সরকারি চাকরি করেন। পরিবারের সকল ব্যয় নির্বাহ করে আমাকে প্রতিমাসে ১৫০০ টাকা করে দিতেন। আমি আগে থেকেই দুইটা টিউশনি করে ১৩০০ টাকা পেতাম। এই টাকার মধ্যেই আমাকে এ-টু-জেড সব খরচ চালাতে হত। আমার বই, খাতাকলম, শিট-ফটোকপি, পোশাক, কসমেটিক্স, সবই ওই টাকার মধ্যে ম্যানেজ করতে হত। আবার তার মধ্যে কিছু টাকা বাঁচিয়ে ওর জন্য কিছু না কিছু কিনে পাঠাতে না পারলে আমি স্বস্তি পেতাম না। সব খরচ করে, মেসের খরচ মিটিয়ে হাতে যা টাকা থাকত, তা-ই দিয়ে ওর সাথে ফোনে কথা বলতাম, আর বাকিটা দিয়ে ওকে প্রতিমাসে খুব কম দামের মধ্যে হলেও কিছু একটা কিনে দিতাম। ও মাঝেমধ্যে এটা নিয়ে রাগ করতো, কিন্তু ওকে গিফট দিতে পারলে আমার খুব শান্তি লাগত। সব মিলিয়ে ভালই চলছিল। ও যখন অসুস্থ হত, তখন কেবল কান্নাকাটি করতো আর আমাকে দেখতে চাইত। আমি অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে ওকে শান্ত করতাম। ও অনেকদিনই আমাকে বলেছিল ওর ভার্সিটিতে বেড়াতে যেতে। ওর এক বান্ধবী ছিল। ও নিজেই সে মেয়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে মেয়েটাও ওকে বলতো, তুমি সোনমকে বেড়াতে নিয়ে আসো, ও আমার কাছে থাকবে, কোনও সমস্যা হবে না। সুযোগ হয়ে ওঠেনি বলে কখনও যাওয়া হয়নি। ও অনেক আবেগি ছিল, পাগলামি করতো খুব। আমাদের মধ্যে একটু ভুল বোঝাবুঝি হলেই ও হাত কাটতো, ঘুমের ট্যাবলেট খেত। অনেক কান্নাকাটি করতো, কাঁদতে-কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়ত। ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারতাম না।

একদিন হঠাৎ রাতের বেলা আমাদের ঝগড়া হয়। ও যথারীতি অনেক চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, কয়েকটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলে। একসময় আমরা দুজনই বুঝতে পারি, আমাদের অনেকদিন দেখা হয়নি বলে হয়ত এমন হচ্ছে। ওর তখন থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা চলছিল। ও আমাকে বলল, আমি কালকেই তোমাকে দেখতে চাই, যে করেই হোক! আমরা দুজন যে দুটো শহরে থাকতাম, সে দুই শহরের মাঝামাঝি এক শহরে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই দুজন মিলে। কথা ছিল, আমি ওর সাথে দেখা করেই চলে আসব, কিন্তু………

দেখা হওয়ার কথা বগুড়ায়। আমি দিনাজপুর থেকে গেলাম, ও এলো ঢাকা থেকে। আমরা দুজন একটা রেস্টুরেন্টে বসে ঘণ্টা দুয়েক গল্প করি, দুপুরের খাবার খাই। এরপর আমি ওকে বলি, ঠিক আছে, আমি ৩টার বাসে ফিরব। এটা শুনে ও আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, আজ তোমাকে আমার সাথে থাকতে হবে। আমি বলি, মানে? কোথায় থাকতে হবে? উত্তর আসে, হোটেলে। শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই! আমার এখনও মনে আছে, আমি কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারিনি। কেবলই ঘামছিলাম। এ কী শুনলাম আমি! জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা কর? যদি করে থাকো, আমি সরি। এরপর কিছু সময়ের নীরবতা। সে-ই নীরবতা ভাঙল। আমি অতকিছু বুঝি না, তুমি থাকবে কি না, বলো। জাস্ট ইয়েস অর নো! ওর কথা শুনে আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। একদিকে আমার ভালোবাসা, আরেকদিকে আমার বিবেক। অনেক ভেবে ওকে বলি, ঠিক আছে, আমি থাকব, তবে এক শর্তে। ও শর্তটা শুনতে চায়। আমি বলি, চলো, আগে বিয়েটা করে নিই, এরপর হোটেলে যাই। ও বলে, বিয়ে করার মত টাকা এখন কোথায় পাব? কাজী সাহেব কি ফ্রি’তে বিয়ে পড়াবেন নাকি? সত্যিই ওর কাছে তখন অতো টাকা ছিল না। (তবে থাকলেও যে সেদিন সে আমাকে বিয়ে করতো না, তা আজ বুঝতে পারি।) অনেক কথা কাটাকাটির পর ও একসময় জেদ ধরে বলে, আমি যদি না থাকি, তবে ও পরশুর একজামটা দেবে না। ওকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসতাম। তাই ওর কোনও ক্ষতি আমি কিছুতেই মানতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত আমি ওকে শর্ত দিলাম: থাকব, তবে কোনওভাবেই তুমি আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। ও আমার শর্তে রাজি হয়। দুপুর পিছলে বিকেলে গড়ায়। আমরা একসাথে একটা পার্কে ঘোরাঘুরি করি। সন্ধে নামলে দুজন মিলে এক হোটেলে উঠি। ও ফ্রেশ হয়, আমিও হই। এর আগে আমার কখনওই ওকে ভয় করতো না, সেদিন খুব ভয় করছিল। ওকে এতটা ভালোবাসি, অথচ সেদিন আমার বুকের ভেতরটা কেবলই কেঁপেকেঁপে উঠছিল। আমার সেই কাঁপুনিটা আজও থামেনি! এই যে এখন লিখছি, এখনও আমার হাত কাঁপছে। আমি বলে বোঝাতে পারব না, কীসের মধ্যে যে নিজেকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন!

ভেতরেভেতরে কাঁপছিলাম, কিন্তু ওকে কিছুই বুঝতে দিইনি। আমরা গল্প করছিলাম। ওর কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখেই গল্প করছিলাম। রাতে খাওয়ার পর ১১টার দিকে দুই বেডে দুইজন শুয়ে পড়ি। ও আমার সাথে কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল একটু পরপরই, আমি পাত্তা দিইনি ব্যাপারটাকে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ও আমার বেডে চলে আসে। জোর করতে থাকে। আমি ওকে প্রচণ্ড বাধা দিই। ও আমাকে বলে, আজ যে আমায় কিছু দেয় না, সে যে কখনও আমার হবে, এটা আমি কীকরে বিশ্বাস করি? অনেক চেষ্টার পর ও আমার সকল বাধা অতিক্রম করতে সমর্থ হয়। আমি ওকে প্রমিজ করাই যে সেই তারিখের পরের মাসে ঠিক একই দিনে সে আমায় বিয়ে করবে। ও রাজি হয়। ভালোবাসার কাছে আমি আমার বিবেক ও সতীত্বকে জলাঞ্জলি দিলাম। ও সেদিন ওর মায়ের নামে শপথ করে বলেছিল যে ও আমাকে বিয়ে করবে। ও মিথ্যে বললে যেন ওর মায়ের মৃত্যু হয়। মাকে সে খুব ভালোবাসত। আমি ওর কথায় পুরোপুরি আশ্বস্ত হই। আজ বুঝি, ওই বিশেষ মুহূর্তে ছেলেরা যে শপথই করুক না কেন, তার কানাকড়িও দাম নেই।

পরের মাসে একই তারিখে ও আমাকে দেখা করতে আগের জায়গায় আসতে বলে। আসার পর সে আমায় বলে, আমি তো কাজী অফিসের টাকা যোগাড় করতে পারিনি। আর শোনো, বিয়ে তো আমি তোমাকে করবই, যেহেতু আমাদের দুজনের পরিবারই আমাদের ব্যাপারটা জানে। একটা চাকরি পাওয়ার আগে বিয়ে করলে তো আমাদের দুজনের জীবনই ধ্বংস হয়ে যাবে। সে আমাকে স্বপ্ন দেখায়, পাস করার পর একটা চাকরি পেলেই প্রথম মাসের বেতন দিয়ে সে আমায় বিয়ে করে ঘরে তুলে নেবে। ও আমায় এতটা ভালোবাসত যে ওর প্রতিটি কথাই আমি অন্ধভাবে বিশ্বাস করতাম। আমি আর ওকে বিয়ের ব্যাপারে জোর করিনি। ভাবলাম, এইতো আর বছর দুয়েক! দেখতে-দেখতেই কেটে যাবে। এখন যদি ওকে বিয়ের জন্য চাপাচাপি করি, তাহলে তো ওর ক্যারিয়ারের ক্ষতি হয়ে যাবে। আমাদের মধ্যে কথা ছিল, ও বাইরে চাকরি করবে আর আমি ঘর সামলাব। আমি ভাবলাম, আমি যদি ও চাকরি পাওয়ার আগেই ওকে বিয়ের জন্য এমন বিরক্ত করি, তবে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে কীকরে?

যা-ই হোক, এক বছরের মধ্যে আমাদের এভাবে ১২ থেকে ১৫ বার দেখা হল হোটেলে। ও অনার্স কমপ্লিট করার পর বিসিএস পরীক্ষা দেয়। প্রথমবারে প্রিলিতে হল না। ও তখন মাস্টার্সে। আমি থার্ড ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ারে উঠলাম। থার্ড ইয়ারের একজাম দিয়ে একমাসের ছুটিতে বাসায় চলে যাই। এ সময় ও আমায় ফোন করা কমিয়ে দিল। আমাদের খুব কম কথা হত, কিন্তু যোগাযোগ ছিল। আমি ফিরে আসি মেসে। হঠাৎ দেখি, ও আর আগের মত নেই। অনেক বদলে গেছে। ওকে আমি আর চিনতে পারতাম না। যে মানুষটা আমাকে ছাড়া আর কোনও কিছুই ভাবতে পারতো না, সে কিনা আমায় বলে সামনের এক বছর আমার সাথে কথা বলবে না! বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেবে। আমি ভেবেছি, হয়ত মজা করে এসব বলছে। পরে দেখি, ঠিক তা-ই। আমার ফোন রিসিভ করলেও দুইএক মিনিটের মধ্যেই কেটে দেয়। আবার পরক্ষণেই কল করলে দেখি ওয়েটিং………জিজ্ঞেস করলে বলতো, পড়াশোনার ব্যাপারে বন্ধুর সাথে কথা বলছে। আমি ওর সব কথাই বিশ্বাস করতাম।

আমি ধীরেধীরে বুঝতে পারি, ও আমাকে ইগ্নোর করতে শুরু করেছে। মাঝেমধ্যে সুন্দরী মেয়েদের ছবি পাঠায় আমাকে। বলে, দেখ তো, কেমন দেখতে? আমি বলি, ভাল। শুনে ও হাসে। যেদিন প্রথম ওর সাথে হোটেলে ছিলাম, সেদিনের পর থেকে আমি আর ভাল থাকতে পারিনি। সারাক্ষণই আমার বিবেক আমাকে তাড়া করে বেড়াত। পড়াশোনা করতে পারতাম না। কিন্তু ওকে কখনও তা বুঝতে দিতাম না। আরেকটা বিষয় আমাকে সবসময়ই ভাবাত: ও যদি এখন আমায় আর বিয়ে না করে, তখন আমার কী হবে? একদিন সহ্য করতে না পেরে ওকে বলেই ফেললাম, যদি তুমি আমায় ভুলে যাও কখনও, তবে আমি হয় আত্মহত্যা করব, নয়ত সারাজীবনই একা থাকব। ও আমাকে বলতো, পাগলি আমার, সোনা আমার, বাবুইটা আমার, টেনশন কোরো না, আমি তো আছিই! চাকরিটা একবার হতে দাও! এরপর দেখোই না আমি কী করি!……শুনে আমি আবারও আশায় আর স্বপ্নে বুক বাঁধতাম।

মুখে যা-ই বলুক না কেন, ও আস্তেআস্তে আমাদের রিলেশনটা নষ্ট করে দিতে লাগল। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ও যখন বিসিএস প্রিলি পাস করল, তখন সে খবরটা আমাকেই প্রথম জানিয়েছিল। বলেছিল, এইবার আমরা বিয়ে করব, দেখো তুমি! শুনে আমি খুবই খুশি হয়ে উঠলাম। ও বিসিএস রিটেনের জন্য পড়াশোনা শুরু করল। এরপরই সম্পর্কের চরম টানাপড়েন শুরু। আমাদের এই ভাঙাচোরা সম্পর্ক চলাকালীন বিসিএস রিটেনের রেজাল্ট দিল। ও পাস করল। আমাকে আবারও আশ্বস্ত করল, তুমি ভেবো না, আমরা বিয়ে করবই। তবে আমি বুঝে নিয়েছিলাম, ও আসলে আমাকে বিয়ে করবে না। রিটেনের রেজাল্ট ওকে অনেক বদলে দিল। তখন ও এমন ভাব করতো, যেন ও চাকরিটা পেয়েই গেছে! আমার ভেতর থেকে কে যেন আমাকে বারবারই সতর্ক করে দিচ্ছিল, ও যা বলছে, মিথ্যে বলছে। ভালোবাসার মানুষটি সত্যি বলছে কি মিথ্যে বলছে, সিক্সথ সেন্স কিন্তু ঠিকই বলে দেয়! কিন্তু হায়, নারীর মন—সে কি কখনও কবর চিনতে পারে মরার আগ পর্যন্ত! আমার মনকে আমি কেবলই বলাচ্ছিলাম, রাহুল যা বলছে, সত্যি বলছে!

বিসিএস ভাইভার আগে ও আমার সাথে সকল ধরনের যোগাযোগ পুরোপুরিই বন্ধ করে দেয়। সেই দিনগুলির প্রতিটি মুহূর্ত যে কীভাবে কাটিয়েছি, সেকথা একমাত্র বিধাতাই জানেন। তাকে আমি প্রতিদিনই কল করতাম, সে আমার কল কেটে দিত বা আমার নাম্বার ব্ল্যাকলিস্টে রেখে দিয়েছিল। এর ঠিক ৪ মাস পর সে একদিন রাত আড়াইটায় আমাকে কল করল। ও কল করার আগের মুহূর্তেও আমি তার কথাই ভাবছিলাম! ও বলল, চাকরির পরীক্ষার জন্য দৌড়াদৌড়ির মধ্যে ছিল বলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। অনেক সরিটরিও বলল। সতেরো দিন কথা হল। সে কদিন আমার সাথে খুবই চমৎকার ব্যবহার করল। এরপর সে বলল দেখা করতে। আমিও সবকিছু ভুলে ঢাকায় গিয়ে ওর সাথে দেখা করি।

সেইবার সে আমায় বলল, সোনম, তোমার কাছে একটা জিনিস চাইলে দেবে? বললাম, নিশ্চয়ই দেবো! বলো, কী চাও! সে আমার কাছ থেকে একটা সন্তান চাইল। বলল, আর কিছুদিন পরই তো আমাদের রেজাল্ট দেবে। আমার একজাম অনেক ভাল হয়েছে। আমি কনফিডেন্ট যে আমি চাকরিটা পাচ্ছি। এরপরই তোমাকে বিয়ে করব। এইতো ধরো, খুব বেশি হলে আর একমাস পরেই আমরা বিয়ে করছি। তাহলে তো সন্তান নিতে আর কোনও বাধা নেই। বরং আমাদের বন্ধনটা আর শক্ত হবে! জানো, আমার মেয়ের খুব শখ। তোমারও তো মেয়ে পছন্দ। আমি কিন্তু আমাদের মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছি—মেহেলিকা। ‘মেহেলিকা’ অর্থ জানো তো? চাঁদের মত। সুন্দর নাম না, বলো? আমার মনে হচ্ছিল, এর চাইতে সুন্দর কথা আমাকে কেউ কোনওদিন বলেনি! আমি যেন স্বপ্ন দেখছি! সবকিছু স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগছিল। ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, ওকে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা, নিজেকে খুবই লাকি মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, আহা, আমি কত সুখী! কতই না সুখে ওর হাত ধরে জীবনটা কাটবে! ও আমাকে যা করতে বলল, আমি তা-ই করলাম।

এরপর কিছুদিন আমাদের সম্পর্কটা খুব মধুর ছিল। ওর বিসিএস-এর রেজাল্ট বের হয়। ও প্রাধিকার কোটা সুবিধায় এগ্রিকালচার অফিসার হয়। ফোনে পাচ্ছিলাম না বলে ওকে টেক্সট পাঠিয়ে অভিনন্দন জানাই। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আবারও আমি তার ব্ল্যাকলিস্টে! ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছিলাম একটু কথা বলার জন্য। কিন্তু কিছুতেই ওকে পাচ্ছিলাম না। আমার নাম্বার তো ব্ল্যাকলিস্টে, অন্য কোনও নাম্বার থেকে কল করলেও আমার ভয়েস শোনামাত্রই কেটে দিয়ে সে নাম্বারটাও ব্লক করে দিচ্ছিল। আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না, এটা কী হচ্ছে!………হায়, ওটাই ছিল বাস্তবতা! আমরা মেনে নিই বা না নিই, বাস্তবতা তো বাস্তবতাই!

সে কখনও ভুলেও আমার নাম্বার আনব্লক করতো না। আমি প্রতি মুহূর্তেই চেষ্টা করে যেতাম ওর সাথে একটু কথা বলার। আমি তারপরও ওর জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। ভাবতাম, একদিন না একদিন সে তার ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে ফিরে আসবেই! আমার চাইতে বেশি তো ওকে কেউই কখনও ভালোবাসতে পারবে না। আমার ভালোবাসা ছাড়া ও কীকরে বাঁচবে? সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে তো আমি চিনি! ও কখনওই এরকম নয়! আমাদের বিয়েটা হবেই হবে! আমার প্রেম যদি সত্য হয়, তবে আমি ওকে পাবোই পাবো! তীব্র বিশ্বাস থেকে আমি আমার অনাগত সন্তানের ভ্রূণটা পর্যন্ত নষ্ট করিনি! বারবারই মনে হত, ও তো কথা দিয়েছে, চাকরি পাওয়ার পর আমাকে ঘরে তুলে নেবে। আমার জন্য না হোক, মেহেলিকার জন্য হলেও ও আমাকে বিয়ে করবেই! আমি যে ওর চোখে মেহেলিকার জন্য ভালোবাসা দেখেছি! আমার ভুল হতে পারে না! মেহেলিকাকে হত্যা করলে ও আমাকে কখনওই ক্ষমা করবে না!………এমন আরও অনেককিছুই ভাবতাম, বিশ্বাস করতাম। আমাদের যে রিলেশন নেই, এটা আমি আমার বাসায় বলিনি। বাসায় জানত যে সবই ঠিক আছে।

বাসায় তখন জানাতে বাধ্য হই, যখন ও চাকরি পাওয়ার আড়াইমাসের মধ্যেই বিয়ে করে ফেলে। জানতে পারি, সে মেয়ের সাথে তার সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক। মেয়েটা সোনালি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার।

আমার গর্ভের ভ্রূণের বয়স তখন ১৬ সপ্তাহ চলছে। সেসময় আমি ভীষণ অসুস্থ। একটু হাঁটতে পর্যন্ত কষ্ট হয়, মানসিকভাবেও একেবারেই ভেঙে পড়ি। অ্যাবরশন করানোর টাকা হাতে ছিল না। বাধ্য হয়ে বাসায় সব জানাতে হল। বাবাকেই ফোন করে সব খুলে বলি। বাবা আমাকে কিছুই বলতে পারেননি। শুধু বলেছিলেন, ঠিক আছে। ফোন রাখার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাবা হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। বাবার মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে মা স্ট্রোক করেন। মায়ের বাঁপাশ পুরোপুরি প্যারালাইজড হয়ে যায়। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকেন, আর সবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন শুধু।

এরপর থেকে বাসায় আমাকে আর সহ্যই করতে পারে না। সবাই আমার উপর দোষারোপ করে। করবেই, স্বাভাবিক। ওর বিয়ের চার বছর হয়ে গেছে। ওরা দুজন খুব ভাল আছে। ফেসবুকে কত ছবি আপলোড করে, আমি লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখি। প্রতিটি মুহূর্তেই ওর প্রোফাইলে পড়ে থাকি। কেন যে এমন করি, আমি নিজেই জানি না। আমি এখনও বিশ্বাস করি, ও আমার কাছে ফিরে আসবে। ও অনুতপ্ত হবেই! সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমার মাস্টার্স শেষ হয় ২০১৫ সালে। আমি এখনও প্রতীক্ষায় আছি। কীসের প্রতীক্ষায়, আমি জানি না। বাবার চাইতেও ওর কথা আমার বেশি মনে পড়ে। এমনও ঘটছে! আমি সত্যিই এর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না! হয়ত আমি মানুষের পর্যায়েই পড়ি না! এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা!

ওর বিয়ের দিন ওর সাথে একটু কথা বলার জন্য আমি পাগলের মত ওকে টানা ফোন করেছি। কোনওভাবেই ওকে ফোনে পাইনি। মাটিতে গড়াগড়ি খেতেখেতে হাউমাউ করে এতই কাঁদছিলাম যে, মনে হচ্ছিল, কাঁদতে-কাঁদতে আমি অন্ধ হয়ে যাব! সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আর কখনওই ওকে একটা ফোনও করিনি। কেন করিনি? অভিমানে? হাহাহাহা………অভিমান! ওকে ভুলতে পারি না, কিছুতেই ওকে ভালোবাসা থামাতে পারি না। ও ছাড়া আমার জীবনে আর কোনও ছেলের অস্তিত্ব কল্পনাতেও আনতে পারি না।

অনেক দিন হয়ে গেল, টিউশনি করে নিজে চলছি। চাকরির জন্য অ্যাপ্লিকেশন করা হয়, কিন্তু একজাম দিতে ঢাকায় যাওয়া হয় না। আমার আর কিছু ভাল লাগে না। পরিবার থেকে আমাকে কোনও সাপোর্ট দেয় না। কারও কাছেই আমার কোনও দাম নেই। মনে আছে, সব ভুলে গিয়ে ২০১৫ সালে চাকরির জন্য অনেক পড়াশোনা করেছিলাম, কিন্তু একজাম দিতে গিয়ে কিছুই মনে থাকে না। অথচ আমার কোচিং-এর স্যাররা আমাকে নিয়ে বারবারই চ্যালেঞ্জ করেন, এবং উনারা বারবারই হেরে যান। আমার নিয়তিই উনাদের হারিয়ে দেয়। একসময় ২০১৬ সালের প্রথম দিকে চাকরির জন্য পড়াশোনা করা একেবারেই ছেড়ে দিই। এখন আমার অবস্থা এতটাই শোচনীয়, আমি যে একবার উঠে দাঁড়াবো, সে শক্তিই আমার আর নেই। ২০০২ সালে এসএসসি পাস করেও বয়স লুকিয়ে অনেকের চাকরিতে আবেদন করার বয়স আছে, অথচ আমার এসএসসি ২০০৪ সালে হওয়া সত্ত্বেও আমার চাকরিতে আবেদন করার বয়স এ বছরেই শেষ হয়ে যাবে।

যারা আমাকে ভালোবাসেন, তারা আমার বাকি জীবনটা নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন। আমি কীভাবে কী করব, আমার জীবনটা কীভাবে যাবে, এসব আমি নিজেই জানি না, ওরা কীকরে জানবে! ও চলে গেছে আমার জীবন থেকে, সাথে করে নিয়ে গেছে আমার জীবনের সব রঙ। যারা আঘাত করে, ওরা যদি একবার বুঝত কতটা আহত করে দেয় ওরা! কী গভীর এক ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছি আমি! আমি জানি না, আমার কী হবে! মায়ের জন্য বড্ড কষ্ট হয়। মায়ের তো কোনও দোষ ছিল না! আমার জন্যই তো মা সব হারালেন! মা কাউকেই কিছু বলেন না, আমি সামনে গেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। আঁকড়ে ধরেই রাখেন, ছাড়েন না। সেসময় মায়ের চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, মা আমাকে হারাতে চান না, তাই অমন শক্ত করে আটকে রাখেন! মায়ের চোখের জলে আমি পুড়তে থাকি অনবরত।

প্রায়ই মনে হয়, আমাকে দিয়ে তো কিছুই হল না, আমার আর বেঁচে থাকারই বা কী দরকার? কখনও সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলি যে নিজেকে শেষ করে দেবো, তবু মায়ের নিথর পবিত্র মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলে আবারও জীবনে ফিরে আসি। আমি চলে গেলে মাকে কে দেখবে? খুব ইচ্ছে ছিল, ভাল একটা চাকরি করব, বাবা-মা’কে একটু হলেও ভাল রাখব, আমার বাবা যে স্বপ্ন নিয়ে পুরো সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন, তা পূরণ করব।…….সেই আমি বাবাকে খুন করলাম, মাকে পঙ্গু করে দিলাম, নিজের অস্তিত্বের প্রতি চরম অবিচার করলাম। এখন আর কিছুতেই কিছু হবার নয়।

তবুও ভাবি, সে সুখী হোক, ভাল থাকুক। ও ভাল আছে জানতে পারলে আমি শান্তি পাব। এইটুকু সান্ত্বনা নিয়েই তো বেঁচে আছি! আমি এখনও তার জন্য প্রার্থনা করি! কেন করি! একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তাই এর উত্তরটা জানেন।

জানি, এমন কাহিনি অহরহই ঘটে। প্রেমের জন্য জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়ার আখ্যান অভিনব কিছু নয়। হয়তো ভালোবাসা জিনিসটাই বড় সস্তা! হায়, এই সস্তা জিনিসটাই আমার জীবনটাকে পুরোপুরি শেষ করে দিয়েছে! আমি যখন যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে মরছি, তখন আমার পাশে কাউকেই পাইনি যে আমায় একটু সান্ত্বনা দেবে, একটু দয়া দেখাবে, এগিয়ে যাওয়ার একটু উৎসাহ দেবে আর সাহায্যের হাতটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলবে, তোমার কিচ্ছু শেষ হয় যায়নি। ওঠো, ছোটো! জীবন শেষ হয়ে যাবে কী, বোকা, জীবন তো এখনও শুরুই হয়নি তোমার! কাউকেই পাইনি! কষ্টের সময়ে কেউই পাশে থাকে না।

আমার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে করে—যারা দেশের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা, তারাই যদি এমন স্বার্থপর, নির্দয় আর প্রতারক হয়, তবে এ দেশের উন্নতি হবে কীকরে?

বিসিএস-এ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিয়োগ দেয়া হয়, কর্মকর্তার মানসিকতার পরীক্ষা করা হয় না কেন?

আমার এই সস্তা গল্পে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি ব্যবহার করতে ভুলে গেছি। আমাদের সমাজে রাহুলরাই তো সবচাইতে বড় ধর্ষক! ওরা আমাদের মত মেয়েদের আবেগকে ধর্ষণ করে, সকল অনুভূতিকে ক্রমেই গ্রাস করে ফেলে, একসময় সুস্থ মানুষটাকেই খুন করে। গোটা এক জ্যান্ত জীবনকে কী নিমিষেই খুন করে হাসিমুখে বেঁচে থাকে ওরা! এমন কাজ যদি ধর্ষণ না হয়, তবে আমি জোর দাবি জানাই—ধর্ষণকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করা হোক!

আমি আজও ভাবতে থাকি…………‘ঠিক আছে’ কথাটা দিয়ে বাবা আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন!