তালস্খলন

 
ওরা এখানে এসে ভুলে গেছে বিবেক দেখতে কেমন হয়।
আমার মুখের সাথে মুষ্টি ঠেকিয়ে টানা চিৎকার করে,
এক বিষণ্ণ সন্ধের খয়েরি গাউনটা টেনে দিয়ে,
জপমালা-ঝোলানো ডানবাহু প্রসারিত রেখে,
আমাকে একা পেয়ে সরীসৃপের মতো মেঘমেঘে
টিমেতালে জ্বলা তারার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
ওরা যেখানে আশ্রয় নিলো, সেখানে কেউ ওদের দেখতে পেলো না।


স্তব্ধতার প্রাচীর বেয়ে অদ্ভুতুড়ে কিছু আগন্তুক এসে
আমার কাঁধে আটকেথাকা পাথরভারি ঘ্রাণের উৎস খুঁজতে চায়।
প্রথমে আমি ওদের মৃদুকণ্ঠে অভিশাপ দিই,
তারপরে জোরে ভর্ৎসনা করি, ওদের কানে কিছুই ঢোকে না।
এবং আরও পরে, একাকিত্বের ভয়াবহ শঙ্কায় দৌড়ে একটু দূরে এসে
চিৎকার করতে থাকি………
- শুনছেন? কেউ কি শুনছেন? এখানে আসুন, এখুনিই আসুন! এই ঝরাপাতার বাগানে এলেই আমাকে পাবেন! বিশ্বাস করুন, আমি একজন মানুষ। দুইহাত, দুইটি পেশি আপনারই মতো পৈতৃকসূত্রে পাওয়া। দেখুন না, তামাটে এই মুখে একজোড়া থ্যাবড়া ঠোঁট কেমন ঝুলে আছে! আমার কব্জি আরও কিছু সুন্দর বর্ণের সমুদ্রে ভাসবে, এমন দুরাশায় আমি আপনার সাহায্য প্রার্থনা করছি। মিনতি করে বলছি, এখানে আপনি একা এবং আরও কয়েকজন আসুন, ওদের ঘিরে ফেলুন, কোলাহল করুন। ওদের কাছে কবিতা চেয়ে দেখুন, রক্ত ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। ওরা আপনাকে প্রচুর অর্থ দেবে, ভালভাল গরম খাবার দেবে, মদ ও ভালোবাসবার নারী দেবে। জীবনকে চুমু খাবেন, মিথ্যেকে ভালোবাসবেন! ………এবং আমার ডাক শুনে আমার কাছে এসে আমাকেই ভুলে যাবেন! আমি জানি, পৃথিবীতে আমি একা নই, আমার মতো করে আরও অনেকেই বেঁচে আছে। ভাল লোকেরা আজ খুব সহজেই অজ্ঞান কিংবা নির্বিকার হয়ে যেতে শিখে গেছেন। দোহাই লাগে, আমার কবিতাকে কখনও অল্পবয়েসিদের ঠোঁট অবধি যেতে দেবেন না; ওরা খুব সহজেই অভিশাপ দিয়ে ফেলে। কিতাবপড়া ভাল লোকেরা, শুনে রাখুন! আমার কান্নার জবাবে বরং গালিগালাজই করতে থাকুন, তবু এই দূরে এইখানে থেকে, কুঁচকানো ভুরুতে অমর সংগীতের গলিত শরীরটাকে আপনাদের অশ্লীল নষ্ট ছাঁচে ঢেলে দেবেন না। আমার কানে হতাশার ডানা ঝাপটানোর শব্দ ভেসে আসে। ধ্রুপদী নৃত্যের তালস্খলন দেখলেই চেনা যায়; অতএব, চিনে ফেলি আর ক্লান্তচোখে দেখে যাই, বড়ো ঝড়ের শেষে শান্তির বদলে আরও একটি বড়ো ঝড় আসে। এইসব আসলে কিছু নয়। প্রকৃত ঘটনা হলো: ওই লোকালয়ের হাজার ঘরের একটিতে বিয়ে হচ্ছিল। ওরা সেখানে গিয়েছিল, প্রত্যেকে সেখানে গিয়েছিল, পুরো বিশ্ব সেখানে গিয়েছিল। শুধু আমিই এখানে ভুলে থেকে গিয়েছিলাম।


কালো ও নীল রাতের আকাশ অসময়ে জেগে ওঠে।
গুল্মের সারি রাস্তাপাহারা দেয়। তখন দেখা যায়, ওই দূরে কুকুরের মতো সজাগ
গাছগুলির শৃঙ্খলাবদ্ধ ছায়ার স্রোত চারপাশে ঝুলছে।
পৃথিবীর সবচাইতে বড়ো ফুলের ঘোরানো পেয়ালায় জীবন
মুক্তোরঙের মদের মতো জ্বলছে। হতাশ স্বর্গদূতগণ
আলগোছে ছুটে আসছেন। এদিকে, আজকের চাঁদটাও দেখি
বিগতের চেয়ে ছোট, হালকা। যাক, ভালই হল!


গতকাল থেকে লক্ষ্য করছি, আমার চোখ থেকে
সামান্য আলো চুরি হয়ে গেছে। প্রকৃতির বিচার
নাকি প্রায়ই নিজের চোখে দেখে ফেলা যায়! আমি
জলপাই রঙের টিলার একটি পাথরের উপর বসে আছি
অনায়াসে, শান্ত হয়ে। ইদানীং আমি কেবল
কবরস্থান দেখলেই অশান্ত হয়ে উঠি!


আমি সংকুচিত হতেহতে একটি ছোট চারাগাছ
হয়ে উঠি, যে কিনা ঘরের সামনেও বেড়ে উঠতে গিয়ে হোঁচট খায়,
যার মেরুদণ্ড ক্লান্ত, বাঁকানো, শুকনো!
সন্ধে নামলে যখন কেউ আমাকে খেয়াল না করে
আমার অন্ধকূপটি পেরিয়ে যায়, তখন হঠাৎই দেখি,
আমি তার পাশে হাঁটছি।
স্যাঁতসেঁতে বাতাসের পিঠে চড়ে,
পাতার ঝাঁকুনিদলের লংমার্চ সহ্য করে
প্রতিবেশীদের ঝগড়া দেখতে গিয়ে দেখি,
ওদের রান্নাঘরের তেতোধোঁয়া গ্রীষ্মকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।


দূর থেকে এইসব দেখে মনে হল, আমরা সবাই
অদ্ভুত রকমের সূক্ষ্ম অনেকগুলি কালো দীর্ঘশ্বাসের
এক প্রাচীন সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছি।
এখানে কিছু মৃত জ্যান্ত, কিছু জীবিত মরা।


আকাশে আমার হাসি ছড়িয়ে যাচ্ছে,
উষ্ণ, তাজা হাওয়া ভেসে আসছে,
সাথে নামছে জাফরানি সন্ধে এবং দমবন্ধ শব্দ।
আকাশে ধূসর মেঘের কিছু অভিমান জমেছে।
যৌবনদগ্ধ ও লাজুক কুমারী মেয়েগুলি বিছানায় শুয়েশুয়ে
মেঘের মধ্যে নৈরাশ্যকে বিদায় জানিয়ে কাঁপাচোখে স্বপ্ন এঁকে চলে।
তা দেখে আমার এলোমেলো অহেতুক হাসিটুকু উড়ে পালিয়ে গেছে।
নির্বিকার মাঠের এককোণে প্রার্থনা করবো বলে যখন আমি
ঘণ্টা বাঁধছি, ঠিক তখনই আকাশটাকে ধীরেধীরে ভেঙে পড়তে দেখলাম।