তাসের বসতি

 
আমি রেহানা। নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়ে। বলতে গেলে, অনেক কষ্টে যদিও বড়ো হয়েছি, তবু বাবা-মা কখনও তা আমাকে বুঝতে দেয়নি। ওরা অনেক ভালোবাসে আমাকে। আমার জীবনের গল্পটা ওদের জানালে ওরা হয়তো অসুস্থই হয়ে যাবে, আবার এদিকে কাউকে না-বলে আমি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না, তাই আপনাদের বলা। দুঃখ শেয়ার করলে নাকি কমে, এমনই শুনেছি।


আমি বিবাহিতা। ছোটোবেলা থেকেই আমি একটা স্বপ্ন দেখি, তা হলো, আমি অসহায় মানুষের মুখে হাসি দেখব আর সে হাসির কারণটা আমিই হব। যখন রাস্তায় দেখি, কোনও মুরুব্বি বা ছোটো বাচ্চা রিকশা চালায়, মজুরের কাজ করে, আমার তা দেখে খুব কষ্ট হয়। রাস্তায় যখন পঙ্গু মানুষকে দেখি, তখন খুব ইচ্ছে হয়, এমন মানুষের জন্য কিছু করি। ওদের জন্য কিছু করতে হবে, এটা মাথায় রেখেই চেষ্টা করতাম অনেক মন দিয়ে পড়াশোনা করতে।


আমার ইচ্ছে ছিল, নিজের একটা পরিচয় তৈরি করব, তারপর বিয়ে করব। অনার্স থার্ডইয়ারে পড়ার সময় একটা ছেলের সাথে আমার প্রেম হয়। সেই ছেলে আমার সাথে এইচএসসি’তে পড়ত। ওর সাথে কথা বলতে বলতে আমাদের মধ্যে প্রেমের সৃষ্টি হয়।


আমি মেসে থাকতাম। আমার রুমমেট, কিছু কিছু বান্ধবী আর পরিচিত অনেকের প্রেম দেখলে আমার প্রচণ্ড ঘেন্না হতো। ওরা একসাথে অনেকের সাথেই প্রেমের অভিনয় করত, কথা চালিয়ে যেত অনায়াসেই। দেখে আমি ভাবতাম, এসব কী! এইসব কারণে জামিলকে বিশ্বাস করতে আমার অনেক সময় লাগে। যখন আমি নিশ্চিত হলাম যে সে আমাকে ঠকাচ্ছে না, সত্যিই সে আমাকে ভালোবাসে, আমি কেবল তখনই ওর সাথে রিলেশনে যেতে রাজি হয়ে যাই। ও আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। দেখাশোনার পর ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখ আমাদের বিয়ে হয়। আমি অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। বিয়ের আগে আমাদের মাত্র একবার দেখা হয়েছে। সেদিন ছিলাম আমি, আমার বান্ধবী আর জামিল।


আমি ওকে অনেক ভালোবেসে ফেলি। ওকে ভালোলাগার সবচাইতে বড়ো কারণ ছিল, ও আমার সাথে একদিনও এমনভাবে কথা বলেনি, যেভাবে কথা বললে আমার খারাপ লাগতে পারে কিংবা আমি লজ্জা পেতে পারি। খুবই ভদ্র স্বভাবের ছেলে জামিল। গত বছর ঈদ-উল-ফিতরের সময় ওর মা, বড়ো ভাই, ছোটো ভাইসহ সে আমাদের বাড়িতে এসেছিল আমাকে পারিবারিকভাবে দেখতে। এরপর ওরা জানায় যে আমাকে ওদের পছন্দ হয়েছে। ঈদ-উল-আজহার সময় ওদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে ফোন করে বলে যে আমাদের বাড়ির লোকজন গিয়ে যেন ওদের বাড়িঘর দেখে আসে। ওদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমাদের বাড়ি থেকে আমার বাবা, দুলাভাই, চাচাত ভাই আর ফুপাত ভাই ওদের বাড়ি দেখে আসে। ছেলেকে দেখেও আমাদের লোকজন পছন্দ করে। ওদের বাড়ির অবস্থাও মোটামুটি ভালোই। আমার বাবা বাড়িতে ফিরে বলে, ছেলেটাকে দেখে খুবই ভদ্র ও ধার্মিক মনে হলো। যা-ই হোক, সবারই পছন্দ হয় ছেলের পরিবারকে।


ওরা তিন ভাই, বোন নেই। এদিকে আমরা দুই বোন, ভাই নেই। আমার বড়ো বোনের বিয়ে হয়েছে আমাদের গ্রামেই। আমার বাবার ছেলেসন্তান নেই, তাই নিজ গ্রামেই বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল। যা-ই হোক, ওরা ভালো আছে। আমার যে জামিলের সাথে রিলেশন ছিল, এটা আমার দুলাভাই আর আপু ছাড়া কেউ জানে না। আসলে আমিই ইচ্ছে করে আমার বাবা-মাকে এই বিষয়টা জানাইনি। বাবা-মা আমাকে নিয়ে খুব গর্ব করে। ওরা বলে, ‘আমার মেয়েটা অন্য দশটা মেয়ের মতো না। আমার মেয়ের সাথে কোনও ছেলের সম্পর্ক থাকতেই পারে না।’ বাবা-মা আমার সাথে সব সময়ই বন্ধুর মতো মিশে এসেছে। ওরা বিশ্বাস করে, আমি কোনওভাবেই প্রেম করতে পারি না। তাই আমিও ওদের লজ্জায় কিছু বলতে পারিনি।


বাবা-মা আমাদের প্রেমের ব্যাপারে কিছু জানত না, তাই জামিল যখন আমার বাসায় ফোন করে, তখন আমার মা ওকে ফোনে বলেছিল, ‘দেখো বাবা, আমার মেয়েটা কিন্তু কালো, দেখতেও তেমন ভালো না, তুমি একটু ভেবে দেখো ভালো করে। পরে কিন্তু আমার মেয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারবে না। এখনও সময় আছে, ভেবে দেখো। আমার মেয়েকে পছন্দ না হলে বিয়েটা কোরো না। আমার অনেক আদরের মেয়ে!’ জামিল উত্তরে বলেছিল, ‘আন্টি আমি রেহানাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করি, আর ওর সম্পর্কে আমি সব ধরনের খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি। আমি ওকেই বিয়ে করব। আমার কোনও আপত্তি নেই।’


আমি আমার লাইফে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত তেমন পড়াশোনাই করিনি। কিন্তু আমি যখন ক্লাস সিক্সে উঠি, তখন আমি অনেক পারিবারিক সমস্যা, কষ্ট এসব ফেইস করতে থাকি, তখন একটু একটু করে অন্তত এটা বুঝতে থাকি, জীবনে কিছু একটা করতে হবে, যার মাধ্যমে আমি আমার বাবা, মা, পরিবার, আত্মীয়স্বজন, গরিব - অসহায় মানুষ, এবং আমার নিজের জন্য কিছু করতে পারব। ওদের মুখের হাসিটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি ওদের হাসির কারণ হতে চাই। আমি এখনও তো চাকরি করি না, তবু আমার টিউশনির টাকা থেকে আর আমার হাতখরচের কিছু কিছু টাকা জমিয়ে, আবার মাঝে মাঝে মাস খানেক প্রাইভেট বন্ধ রেখে ওই টাকা দিয়ে যাদের সাহায্যের দরকার, তাদের সাহায্য করি বা করার চেষ্টা করি। এটা আমি বাবা-মাকেও কখনও বলিনি। ওদের বললে যদি ওরা আমার আবেগটা না বোঝে, মানুষকে সাহায্য করতে নিষেধ করে, তখন আমার খারাপ লাগবে।


যা-ই হোক, যা বলছিলাম। যখন আমার ছোটো মাথায় শুধু এইটুকু চিন্তা ঢুকে যায় যে আমার এই স্বপ্নটা পূরণ করতে হলে আমাকে ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে, তখন আমি পড়ার প্রতি সিরিয়াস হই। সে সময়কার দুই-একটা ঘটনা বলি। আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে ছোটো ক্লাসগুলিতে পরীক্ষা দিতাম, তখন আমার সামনের বেঞ্চে যে বসত, আমি ওর খাতা থেকে দেখে দেখে লিখতাম। ও যদি কিছু ভুল লেখার পর কেটে দিত, আমি তো অত কিছু বুঝতাম না, তাই ওর খাতা দেখে আমিও ভাবতাম, আমাকেও ওটাই করতে হবে, মানে ওটা লিখে কেটে দিতে হবে। আমিও তাই হুবহু ওর মতো করে খাতায় লিখে আবার কেটে দিতাম। এ-ই ছিল আমার পড়াশোনার দৌড়!


আর-একটা ঘটনা বলি। একদিন আমি পড়া রেডি না করে ক্লাসে যাওয়ার অপরাধে স্যার আমাকে কানে ধরিয়ে হাইবেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। কীভাবে, জানেন? নামাজ পড়ার সময় যেভাবে রুকু করতে হয়, ঠিক ওইভাবে। এখন কাহিনি হচ্ছে, আমাদের স্কুলটা ছিল আমাদের ক্ষেতের দিকে, তাই আমার বাবা ক্লাসের জানালা দিয়ে দেখে ফেলে যে আমি ওভাবে করে হাইবেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে আছি। এরপর আমি বাড়ি ফিরলে বাবা আমাকে কোলে বসিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ রে মা, তুই পড়াশোনা কিছু করিস না?’ আমি বললাম, ‘করি তো, বাবা। কেন?’ তখন বাবা আমাকে কী অবস্থায় দেখেছিল, সেটা বলল। সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বাবা আমাকে একটুও না বকে উলটো আদর দিয়ে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছিল মন দিয়ে পড়াশোনা করতে। সে ঘটনা আমার মনে গভীর রেখাপাত করে। তারপর থেকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করি। ক্লাস সেভেনে আমার রোল হয় ২৭, ক্লাসের ৭৬ জনের মধ্যে। আমার জন্য এটা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের ভালো রেজাল্ট।


সেদিন বাবার কষ্ট দেখে খুব খারাপ লেগেছিল বলে পড়ায় অনেক বেশিই মন দিয়েছিলাম। ক্লাস এইটে আমার রোল হলো ৪, ক্লাস নাইনে ২, টেনে ১। এভাবে এগোতে লাগলাম। অন্যদের তুলনায় আমাকে অনেক বেশিই পড়া লাগত। আমার মেধা একটু কম ছিল মনে হয়। বুঝেও পড়তাম, আবার অনেক কিছুই না বুঝেও মুখস্থ করে ফেলতাম। পড়া মুখস্থ করতে গিয়ে কত রাত যে নির্ঘুম কেটেছে, তার কোনও ঠিক নেই। কত রাত যে আমার মা আমাকে লবণ ও কাঁচামরিচ দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছে, তার কোনও হিসেব নেই। আমি ক্লাস নাইনে আর্টসে ভর্তি হয়েছি। এসএসসি’তে রেজাল্ট আসে ৪.০০, এইচএসসি’তে ভর্তি হই কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। টেস্ট পরীক্ষায় ইংরেজিতে ফেইল করেছিলাম, তারপর ফাইনালে পাই ৪.৮০। এরপর আবার কুষ্টিয়া সরকারি কলেজেই ভর্তি হই। অর্থনীতিতে। ফার্স্টইয়ারে রেজাল্ট আসে ২.৯০।


পড়াশোনা চলছিল ভালোই। আবার এদিকে শুরু হলো নতুন জীবন। আগেই বলেছি, সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ আমার বিয়ে হয়। সেদিন থেকেই আমার জীবনে শুরু হয় মানসিক কষ্ট ও যন্ত্রণার এক অধ্যায়। যে ছেলেটাকে এত বিশ্বাস করলাম, ভালোবাসলাম, তার কাছ থেকে বিয়ের প্রথম রাতে যে উপহার পেলাম, তা রীতিমতো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো কিছু একটা। আমি এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে আমি কথাই বলতে পারছিলাম না, গা হাত পা কাঁপা শুরু করেছিল, চোখ দিয়ে টপটপ জল পড়ছিল।


রাতে যখন আমরা কথা বলছিলাম, তখন আমি ওকে মজা করে বললাম, ‘অ্যাই, তুমি ফোনে কী করছ? কার সাথে প্রেম করছ? যে চ্যাটিংটা করছ, তাড়াতাড়ি সেটা ডিলিট করো, নইলে আমি দেখে ফেলতে পারি।’ সেই মুহূর্তে ওর মুখে কী একটা হাসি দেখলাম, রীতিমতো শব্দ-করা হাসি! সে হা হা হো হো শব্দে হাসছিল, আর তখনও মেসেঞ্জারেই ছিল। আমি দুষ্টুমি করে ওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিতে চাইলাম। ও ধরে রাখতে চায়, আমি নিতে চাই, এভাবে কাড়াকাড়ির একপর্যায়ে ফোনটা নিতে পারলাম। তখন আমি দেখতে শুরু করি ওর চ্যাটিং। রুপা নামের একটা মেয়ে আছে, ওর আত্মীয় হয়। দেখলাম, ওর সাথে আমার স্বামীর রিলেশন চলছে। ওকে সে আই লাভ ইউ, বাবু, জানবাচ্চা, সোনাপাখি ইত্যাদি সম্বোধনে কথা বলে। আরও দেখলাম, ওকে সে বউ, রুপামণি আরও কী কী নামে যেন ডাকে। সেখানে আরও লেখা, ‘তোমার সাথে কথা না বললে আমার ভালো লাগে না। তুমি এটা জানো না?’


নাজিয়া নামের একটা মেয়েকে লিখেছে, জীবনে আমি চরম ভুল করেছি। রুপাকে বিয়ে করাই আমার বড়ো ভুল ছিল। এরকম আরও অনেক মেয়েকেই সে বিয়ে করবে, সে তার জন্য অপেক্ষা করছে, তাকে ছেড়ে থাকতে পারছে না, সারাক্ষণই ওর কথা মনে হয়, এরকম অজস্র চ্যাট-হিস্ট্রি। তখন আমার যে কেমন লাগছিল, তা লিখে বোঝাতে পারব না। জামিল এইচএসসি পরীক্ষার পর চাকরিতে ঢুকে গিয়েছিল। সে তখন আমাকে বলে, ঢাকায় গিয়ে নাকি কী একটা ঝামেলায় পড়ে রুপার কাছ থেকে হেল্প নিতে হয়, তাই রুপা তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চায়। সে নিজেকে বাঁচাতে ওর সাথে অভিনয় করে যাচ্ছে। এরকম হাজারো অজুহাত। আমি সব মেনে নিই চুপচাপ। বিয়ে যেহেতু করে ফেলেছি, মেনে না নিয়ে কী করব! আমি প্রচণ্ড রকমের ধার্মিক একটা মেয়ে, আর আমার ধর্মে একজন নারীর জীবনে তার স্বামীর স্থান অনেক ঊর্ধ্বে।


ও আমাকে সরি বলে, মাফ চায়। আমিও মাফ করে দিই। তার ৫-৭ দিন পর ওর ফোনে মেসেজ আসে রাত প্রায় দেড়টার দিকে। ওর ফোনও দুইটা। একটা স্মার্ট ফোন, আর-একটা নরমাল ফোন। সেই নরমাল ফোনে টেক্সট আসে। ও মেসেজ দেখে রিপ্লাই করতে যাচ্ছে, এমন সময় আমি দেখে ফেলি। সে আমাকে দেখেই সাথে সাথে ফোন লুকিয়ে ফেলে। আমি ওকে বলি, ‘আমি দেখলে কি সমস্যা?’ ও বলে, ‘হ্যাঁ, সমস্যা।’ আমি বলি, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ মুখে ‘আচ্ছা’ বললেও আমি হুট করে ওর কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিই।


দেখলাম, আর-একটা মেয়ের মেসেজ। ওর নাম লিলি। ঢাকায় বাসা। সে বড়োলোক বাবা-মার একমাত্র আদুরে সন্তান। আমি ওকে বলি, ‘তুমি ওকে রিপ্লাই দিয়ো না। এত রাতে তোমার সাথে ওর কীসের কথা?’ এটা নিয়ে ওর সাথে আমার ঝামেলা হয়। সে বলে, ‘আমি আসলে ওর সাথে কিছু দিন প্রেম প্রেম খেলছি। লিলি বয়সে অনেক ছোটো। ইমোশন বেশি, তাই ওর সাথে কথা কন্টিনিউ করে যেতে হবে। না হলে ও মনে অনেক কষ্ট পাবে।’ আমি বললাম, ‘ও ছোটো, ঠিক আছে। কিন্তু তুমি তো ম্যাচিউরড একটা ছেলে। তুমি তো বিয়েও করেছ। আগে যা করেছ, করেছ। এখন তো আমি আছি, এখন এসব বাদ দিয়ে দাও। ও নাহয় ছোটো, কিছু বোঝে না, কিন্তু তুমি তো বোঝো। তুমি তো নিজে জানো যে তুমি ভুল করছ। তুমি ওর সাথে আর কথা বোলো না। শুধু শুধু অনুভূতি ছাড়া কথা বলা কি ভালোবাসা, বলো? আগাছা ছোটো থাকতেই উপড়ে ফেলে দিতে হয়, নইলে বড়ো হয়ে গেলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আর মনে রেখো, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা থেকেই কিন্তু পর্বত আর বিন্দু বিন্দু জল দিয়েই মহাসিন্ধুর সৃষ্টি হয়। তাই সবকিছু বাদ দিয়ে দাও।’ ও আমার কথা খুব মন দিয়ে শুনছিল।


আমি আরও বললাম, ‘দেখো, আমি আর তুমি যেভাবে প্রেম করছি, এভাবে প্রেম মানুষ খুব কমই করে। তুমি তো নিজেও প্রায়ই বলো, এতদিনের প্রেমে আমাদের মাত্র একবার দেখা হয়েছে। এই পর্যন্ত আমি ‘আই লাভ ইউ’র উত্তরেও মুখে কিছুই বলতে পারিনি লজ্জায়। আর আজে বাজে কোনও কথা তোমাকে বলার চান্সই তুমি কখনওই দাওনি। সুযোগ হয়ওনি। তোমাকে আমি সব সময়ই খুব রিজার্ভড একটা ছেলে হিসেবে জেনে এসেছি। এটাই আমার সবচাইতে বেশি ভালো লেগেছে। এমনও হয়েছে যে তোমার সাথে আমার সাত দিন পরও কথা হয়েছে। তবুও একটা বারের জন্যও কখনও আমাদের মধ্যে ঝামেলা হয়নি। একটা কথা বলি, শোনো। তোমাকে আমি ততটাই বিশ্বাস করি, যতটা আমি নিজেকে বিশ্বাস করি। আর তুমি এটা কী করছ!’ ও সেদিনও অনেক করে সরি বলে। আর আমিও ওকে ক্ষমা করে দিই।


আসলে ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। Actually, I mean that the meaning of love is only one. It means sacrifice but the colour of love is of different types, such as love for God, love for parents, friends, relatives, helpless people, nature etc. আমি ওকে বুঝিয়ে বলি, ‘দেখো, আমি কিন্তু এখনও নরম কাদার মতোই আছি। এখন তুমি আমাকে যে আকার দেবে আমি সেই আকারই ধারণ করব। তোমার প্রতি অনুরোধ, তুমি আমাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে শক্ত করে ফেলো না, তাহলে তাতে যত পানিই ঢালো না কেন, তা শুধু শক্তই হবে। তখন আমাদের দুজনের মাঝখানে একটা দেয়াল তৈরি হয়ে যাবে। এখন তুমি দেখো, তুমি কী চাও। আজকের ভুলটা তোমার দ্বিতীয় ভুল। একই ভুল তুমি তৃতীয়বার আর কোরো না, প্লিজ।’ ও আমাকে ছুঁয়ে কথা দেয় যে এরকম ভুল ও আর কখনওই করবে না। কিন্তু হায়…


ও আবারও রুপার সাথে প্রেমালাপ করে। রুপা কিন্তু জানে যে জামিল বিয়ে করেছে। লিলিও জানে। আমি ভাবি, এখন আমি কাকে কী বলব? লিলি নাহয় এসএসসি পরীক্ষার্থী, কিন্তু রুপা তো অনার্স সেকেন্ডইয়ারে পড়ে, সে তো আর ছোটো নয়। সবাই তো নিজের ভালো মন্দটা বোঝে, তাহলে এমন করার কী দরকার?


আবার কয়েকদিন পর ওর ফোনে রুপার চ্যাটিং দেখি। অনেক অনেক কথা হয়েছে রুপার সাথে। সেদিন ওর সাথে আমার আবারও অনেক ঝগড়া হয়। আমি বললাম, ‘তোমাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’ ও বলল, ‘হ্যাঁ, করো।’ আমি বলি, ‘আমি তোমাকে একদম ঠান্ডা মাথায় বলছি, তুমিও ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে উত্তর দাও।’ ও বলে, ‘হ্যাঁ, বলো।’ আমি বললাম, ‘তুমি যদি অন্য কাউকে ভালোবাস, কিংবা অন্য কাউকে তোমার জীবনে চাও, তাহলে সেটা আমাকে পরিষ্কারভাবে বলে দাও। আমি চলে যাব। আমি ধোঁয়াশা বা অস্পষ্টতা পছন্দ করি না। আমি যা বলার, তা পরিষ্কারভাবে বলতে পছন্দ করি। আমাকে ভালো না লাগলে বলে দাও। তুমি যদি অন্য কাউকে নিয়ে সুখে থাকতে চাও, তাহলে তা-ই থাকো।’


তখন ও বলে, ‘না, আমি তোমার সাথেই সারাজীবন সুখে থাকতে চাই। আমি তো তোমাকেই ভালোবেসে বিয়ে করেছি। রুপাকে বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে আমি রুপাকেই বিয়ে করতাম, তোমাকে তো করতাম না। রুপার প্রতি আমার বিয়ে করার মতো কোনও অনুভূতি কখনও হয়নি, যেটা তোমার প্রতি হয়েছে। আর আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’ আমি তখন ওকে বললাম, ‘তাহলে ওর সাথে এসব কথা কেন বলো? রুপা তোমাকে ব্লক করে দিল, আর তুমি ওকে রিকোয়েস্ট করে বলছ, ‘রুপা ব্লক খোলো। আজকের মধ্যে ব্লক না খুললে তোমার যা ছবি আমার কাছে আছে, তা ফেইসবুকে ছেড়ে দিব।’ তুমি ওকে থ্রেট দিচ্ছ কেন? আমি তো এখন দেখছি, রুপার সাথে কথা বলার জন্য তোমারই আগ্রহ বেশি। দেখো, আবারও বলছি, আগে যা করেছ, করেছ। এখন বিয়ে থা করেছ, এখন এসব বাদ দাও।’ ও শুধু বলে, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’


এরপর একদিন ওর কাকার মেয়ে আমার কাছে এসে বলে, ‘ভাবি, আপনার সাথে আমার কিছু কথা বলার আছে।’ ওর কাকার মেয়েটা গত বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। একটা সমস্যার কারণে এইবার আবার দিচ্ছে। ওর বয়স, ক্লাস-অনুপাতে যত হবার কথা, তার চেয়ে বেশি। আমি ওকে বললাম, ‘হ্যাঁ, কী কথা, বলো।’ ও বলল, ‘জামিল ভাইয়ার ব্যাপারে।’ আমি বললাম, ‘আমি এখন তো কাজ করছি, পরে শুনি?’ ও পরে আবারও আসে। এসে আমাকে বলে, ‘একটা ভিডিও দেখবে জামিল ভাইয়ের?’ ও যখন বলল একটা ভিডিও দেখাবে, তা-ও আবার জামিলের, তখন আমার মনে হলো, ওর কাছে নিশ্চয়ই এমন কোনও ভিডিও আছে, যেটা দেখলে ঝামেলা লাগতে পারে। তাই আমি ঝামেলা এড়ানোর জন্য বললাম, ‘না, আমি দেখব না।’ পরে জামিলকে সেটা বললে জামিল আমার এই কাজটার জন্য অনেক খুশি হয়েছিল। কিন্তু ওর সামনে যখন ওর কাকাত বোনটা বলছিল, ‘ভাবিকে বলে দিই সব? সেই ভিডিওটা দেখাব? রেকর্ডিং শোনাব?’, তখন আমি ওকে চুপসে যেতে দেখেছিলাম।


গেল সেদিনের ঘটনা। তার কয়েকদিন পর সেই মেয়ে আবার আসে আমার কাছে। এসে বলে, ‘ভাবি, জামিল ভাইয়া আমার ফোন নিয়ে গেছে। ফোনটা দিয়ে দিতে বলবেন।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন নিয়েছে?’ ও বলল, ‘ভাইয়া আমাকে কল করেছিল, ওয়েটিং-এ পেয়েছে, তাই ফোনটা নিয়ে গেছে।’ জামিল বাসায় ফিরলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি বিন্তির ফোনটা কেন নিয়েছ?’ ও বলে, ‘কই, না তো! আমি বিন্তির ফোন নিইনি।’ আমি তখন ওকে বললাম, ‘তুমি নাকি বিন্তিকে ফোন করে ওয়েটিং-এ পেয়েছ, তাই ওর ফোনটা নিয়ে ফেলেছ?’ ও তখন বলে, ‘আরে নাহ্‌! বিন্তি মিথ্যাকথা বলেছে তোমাকে।’ আসল কথা হলো, জামিল ঠিকই বিন্তির ফোনটা নিয়ে নিয়েছিল। ওই ফোনটা জামিলই কিনে দিয়েছিল বিন্তিকে। সেই ফোন আমি আবার জামিলের কাছ থেকে নিয়ে বিন্তিকে ফেরত দিয়ে দিয়েছিলাম।


তার কয়েকদিন পর। আমি জামিলের সাথে ফোনে কথা বলছি। ও তখন ঢাকায়, আর আমি ওদের বাড়িতে। হঠাৎ সে আমাকে বলে, ‘তাহলে তুমি ফোনটা একটু রাখো, আমি পরে কথা বলছি।’ কিন্তু আমি সেদিন ফোনটা কেন জানি রাখিনি। কেন যে রাখলাম না, এক আল্লাহ্‌ই জানেন। ওদিকে সে ভেবেছে, আমি ফোন কেটে দিয়েছি। এটা ভেবে সে ফোনটা পাশে রেখে রুমমেটদের সাথে গল্প করতে শুরু করে, আর আমি এদিকে শুনতে থাকি। একজন বলছিল, ‘এখনও ওর জন্য আমার রাতে বালিশ ভিজে যায়।’ অন্য একজন বলল, ‘হ্যাঁ, এটাই প্রকৃত ভালোবাসা।’ জামিল তখন বলল, ‘আর আমার যে সবার জন্যই মন কাঁদে, তাহলে এটা কী?’ অন্য একজন বলল, ‘তুমি যে এখনও রুপার সাথে কথা বলো, তোমার বউ কি এটা জানে?’ আর-একজন বলে, ‘আরে, এটা তো পরকীয়া!’


তখন জামিল বলে, ‘রুপার বিষয়টা আমার বউ জানে, কিন্তু এখনও যে কথা বলি, এটা জানে না।’ তারপর নানা প্রসঙ্গে জামিল আবার বলল, ‘ইডেনে পড়া যে মেয়েটার সাথে আমার রিলেশন, সে তো এখনও জানেই না যে আমি বিয়ে করেছি। বইমেলায় যাবার জন্য কয়েকবার বায়না ধরেছে, কিন্তু আমি এখনও নিয়ে যাইনি। ভাবছি, এর মধ্যে নিয়ে যাব। ওর সাথে রিলেশনটা রাখতে হবে।’ এভাবে কথা বলতে বলতে হঠাৎ জামিল বলে ওঠে, ‘হায় হায়, আমার বউ আবার লাইনে আছে নাকি? আমি তো তখন না দেখেই ফোনটা রেখে দিয়েছি। যদি আমার কথা শুনে ফেলে, তাহলে তো কাজ হয়েছে!’ এটা বলে সে ফোন দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়! আমি তখন ২-৩টা মেসেজ দিয়ে নেট কানেকশন অফ করে দিই।


এরপর ও আমাকে অনেকবার ফোন করে, আমি কথা বলি না। তারপর আমি ফোন ধরলে ও অনেক কান্না করে। আমি তখন ওকে বলি, ‘তুমি এখনও রুপার সাথে প্রেম করো? আজকে তোমাকে বলতেই হবে, তুমি আমাকে চাও, না কি ওদের কাউকে চাও! যে-কোনও একদিক তোমাকে বেছে নিতে হবে। এত নৌকায় একসাথে পা দিয়ে তুমি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে পারো না।’ ও বলে, ‘আমি তোমার পায়ে ধরি, একথা বোলো না। আমি শুধু তোমাকেই চাই, ওদের কাউকেই চাই না।’ এরপর ও আমাকে অনেক অনুনয় করে কথা দেয় যে, আজকের পর থেকে ও আর কোনও মেয়ের সাথেই কথা বলবে না। আমি সেদিন আবারও ওকে ক্ষমা করে দিই।


আবার কিছুদিন পর ও যখন বাড়িতে এল, তখন ওর ফোনে দেখি, একটাও মেয়ের সাথে কোনও চ্যাট-হিস্ট্রি নেই, সবই ডিলিট-করা। আসলে ও ঠিকই কথা বলত তখনও, কিন্তু ফোন নিয়ে বাড়িতে আসার সময় সবকিছু ডিলিট করেই আসত। এটা বুঝতে পেরেছিলাম ওর একটা স্ক্রিনশট দেখে। সেখানে দেখলাম যে রুপা লিখেছে, ‘আজান দিচ্ছে, আমি নামাজ পড়ব, আপনিও পড়েন।’ আর সে লিখেছে, ‘তুমি পড়ো। আমি কাল থেকে পড়ব, সোনা।’ এরপর ‘আমার ফোনে চার্জ নেই।’ এটা লিখে স্ক্রিনশট দিয়ে রুপাকে পাঠায় ওকে বিশ্বাস করানোর জন্য যে আসলেই ওর ফোনে চার্জ নেই। কিন্তু ভুলবশত সে স্ক্রিনশটটা ডিলিট না করায় ওটা ফোনের গ্যালারিতেই থেকে যায়, যা আমি ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখে ফেলি।


আমি স্ক্রিনশটের তারিখটা দেখি, আর ওকে বলি, ‘তুমি আমাকে কথা দেবার পরও ওর সাথে যে কথা বলেছ, এটাই তার প্রমাণ।’ আরও বললাম, ‘আচ্ছা জামিল, বলো তো, তুমি আসলে কী চাও? তোমার চাওয়ার উপরই আমি সব ছেড়ে দিলাম। তুমি যা চাও, তা-ই হবে। আমার এই এক বিষয় নিয়ে প্রতিবার তুমি বাড়ি এলে ঝগড়া করতে ভালো লাগে না।’ সে আবারও আগের মতো কাকুতি মিনতি করে আর বলে, ‘আমি শুধু তোমাকেই চাই।’ এরপর সে আমার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘আমি শপথ করে বলছি, আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, আর তোমার সাথেই সারাজীবন থাকতে চাই।’ ও যথারীতি অনেক হাতে পায়ে ধরে সরি বলে, আমি ওকে আবারও ক্ষমা করে দিই।


এদিকে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলাম ক্রমেই। তার উপর আমার পড়াশোনা দিন দিন একেবারে লাটে উঠে গেল। মন যদি ভালো না থাকে, যদি এতবার নিজের হাজব্যান্ডের কাছে ঠকতে থাকি, তখন কেমন যে লাগে, তা এক ভুক্তভোগী বাদে আর কেউ অনুমানও করতে পারবে না! আমি কী করব, কোথায় যাব, তার কিছুই ভেবে পাই না। প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে শুরু করি। আর ওর এসব কাজের কারণে ওর উপর বিশ্বাস একটু একটু করে কমতে থাকে, সন্দেহ বাড়তে থাকে। বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসা টিকে থাকতে পারে না, এটা তো সবাই জানে। কিন্তু একটা মানুষের বিশ্বাস কেউ যদি এতবার ভাঙে, তা-ও সেই মানুষটাই ভাঙে, যাকে কিনা নিজেকে যতটা বিশ্বাস করি, ঠিক ততটাই বিশ্বাস করতাম, তখন কেমন করে বেঁচে থাকা যায়---তা-ও আবার বিয়ের রাত থেকেই যদি ওটা হতে থাকে? আমি মনপ্রাণ দিয়ে আল্লাহ্‌কে ডাকতে থাকি। বলি, ‘আল্লাহ্‌, জামিল কী করছে, তা সে নিজেই জানে না। তুমি ওকে সুবুদ্ধি দাও, ওকে সঠিক পথে ফেরাও।’


২ ডিসেম্বর ওর জন্মদিন। ও সেদিন ঢাকায় ছিল। ভেবেছিলাম, ওইদিন একটু আগে ওকে ফোন করে বেশি সময় নিয়ে ওর সাথে কথা বলব। আমি ১২টা বাজার অপেক্ষায় বসে আছি। ১২টা যে-ই মাত্র বাজল, আমি ওকে মেসেজ পাঠিয়ে কল দিচ্ছি, দেখি, আমার নাম্বার সে ব্ল্যাকলিস্টে রেখে দিয়েছে। সারারাতই তাকে বিজি পাই। ওকে পরদিন ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমার নাম্বার তুমি ব্ল্যাকলিস্টে রেখে দিয়েছ কেন?’ ও বলল, ‘ভুল করে চাপ পড়ে চলে গিয়েছিল।’ আমি ভাবলাম, ‘সত্যিই যদি ভুল করে যেত, সে কি একবারও টের পেত না? রাতে কি একবারও ওর মনে হলো না যে আমার সাথে কথা বলতে হবে? বিয়ের পর একদিনও ঘুমানোর আগে কথা না বলে, ‘শুভ রাত্রি’ না বলে তো সে ঘুমায়নি! আর এমন একটা দিনেই কিনা সে আমাকে ভুলে গেল!’ সেদিন অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তখন আমি রুমের দরোজা বন্ধ করে ফ্যানের সাথে কাপড়ও ঝুলিয়েছিলাম সুইসাইড করব বলে, তখন হঠাৎ মনে হলো, ‘বেঁচে থেকে দেখিই না কী হয়!’, আবার আল্লাহ্‌কে ভয় করি বলে এই নিষিদ্ধ কাজটা করতে মন সায় দিচ্ছিল না। তাই সেদিন চোখের জল মুছে ফেলি, আর ওকে কিছুই বলি না।


করোনার কারণে তো এখন সবাই বাড়িতে। তো সেও বাড়িতে, আমিও বাড়িতে। ওর ড্রয়ারের মধ্যে কী যেন একটা রাখা আছে। একটা ডায়েরিও আছে। একদিন আমি পাশের রুমে বসে বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ দেখি, ও ড্রয়ারটা খুলে ডায়েরিটা বের করে ওটা পড়ছে। তখন আমি ওটা দেখার চেষ্টা করিনি, কারণ আমি জানি, আমি যদি তখন ওটা দেখতে যাই, তাহলে ও তো ওটা দেখাবেই না, বরং চাবিটাও কোথাও লুকিয়ে রাখবে, আমি সেটা আর খুঁজেও পাবো না। তাই চুপ করে থাকলাম। ও যখন গোসলে গেল, তখন আমি চুপি চুপি ওর ড্রয়ারটা খুলে ডায়েরিটা নিলাম। যা যা দেখলাম, সেগুলির ছবি তুলে রেখে ড্রয়ার লক করে ডায়েরিটা আবার রেখে দিলাম।


আমি জানতে পারলাম, ও আগেও দুইটা বিয়ে করেছিল। সেই দুইটা বিয়ের মধ্যে আবার একটা ছিল জালিয়াতির বিয়ে। ও যাদের সাথে প্রেম করেছে, সেসব মেয়ের নামও ছিল ডায়েরিতে। আমি তখন ওর কাছে জানতে চাইলাম, ‘এগুলি কী?’ ও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। আরও বলেছিলাম, ‘জামিল, তোমার কাছে আমি এই পর্যন্ত কখনও কিছু চাইনি। আজ একটা জিনিস চাইলে দেবে?’ ও বলে, ‘কী?’ আমি বললাম, ‘দেবে কি না বলো। যদি না দাও, তবে আর কোনও দিনই কিছুই চাইব না তোমার কাছে।’ ও বলল, ‘হ্যাঁ, বলো। আমি দেবো।’


তখন আমি বললাম, ‘তোমার ফোনে সাতটা লকার আছে। তুমি তোমার ফোনে কী কী ছবি আর ভিডিও রেখেছ, আমি সেগুলি দেখতে চাই।’ ও বলল, ‘না, আমি দিতে পারব না পাসওয়ার্ড।’ আমি আবারও মনে করিয়ে দিলাম, ‘আমি কিন্তু সারাজীবনে তাহলে আর কিছুই চাইব না, মনে রেখো।’ ও বলল, ‘ঠিক আছে, চেয়ো না। আমি তবুও তোমাকে পাসওয়ার্ড দিতে পারব না।’ আমি তখন বলি, ‘আমি তো তোমার স্ত্রী। আল্লাহ্‌র পর যদি কাউকে সেজদা দিতে হয়, তবে সেটা তোমার পায়ে। তোমার শরীরের অর্ধেক অংশও আমি। তাহলে কেন পারবে না দিতে? ওখানে কী এমন জিনিস আছে, যা নিজের স্ত্রীকে দেখাতে পারবে না?’ এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক ঝামেলা হয়, সে আবারও সরি বলে অনেক করে, কিন্তু পাসওয়ার্ড দিতে কিছুতেই রাজি হয় না।


সে তার ছোটো কি-প্যাড ফোনে সারাক্ষণই কাকে যেন মেসেজ পাঠায়। পাসওয়ার্ডটা আমাকে বলে না। একদিন অনেক কষ্টে লুকিয়ে লুকিয়ে পাসওয়ার্ডটা দেখে নিয়েছিলাম, কিন্তু ফোন হাতে নিতেই দেখি পাসওয়ার্ডটা চেঞ্জ করে ফেলেছে আগেই। দ্বিতীয়বার অনেক দিন ধরে অনেক কষ্ট করে পাসওয়ার্ডটা জানতে পারি। ও গোসলে ঢুকলে আমি ওর ফোনটা হাতে নিয়ে ট্রাই করে দেখি, ফোনটা খুলে গেল! আমার সে কী খুশি! কিন্তু ঠিক সে মুহূর্তেই সে বাথরুম থেকে চলে আসে গোসল সেরে। আমিও ফোনটা তাড়াহুড়া করে রেখে দিই। সে ফোনটা হাতে নিয়ে সাথে সাথেই পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে ফেলে। এরপর থেকে সে বাথরুমে ঢুকেই কি-প্যাডের ফোনটা হাতে নিয়ে। এখন গোসল করতে গেলেও ফোন নিয়ে যায় সাথে করে। ঘুমানোর সময়ও পকেটে রেখে ঘুমায়।


সেহরি করার জন্য যখন ওঠে, তখন মেসেজ দেয়। খাবার পর মেসেজ দেয়। সেহরি করার এক-দেড় ঘণ্টা পর সে রুমে আসে। ও বাথরুমে যাবার সময়ও আমাকে বাইরে থেকে দরোজা লক করে রেখে যায়। সেহরি শেষ করার এক-দেড় ঘণ্টা পর রুমে এসে মেসেজ লেখে, বাংলা মেসেজ। আমার কাছ থেকে ফোনটা লুকানোর চেষ্টা করে, তবে আমি সেদিন দূর থেকে লুকিয়ে দেখে ফেলেছিলাম। সে লিখেছে, ‘ঘুমাতে যাচ্ছি।’ ও যে বাংলায় এত দ্রুত টাইপ করতে পারে, আমি সেটাই জানতাম না। আমি তো দেখে অবাক! জামিল আমাকে এই পর্যন্ত মাত্র চারটা মেসেজ বাংলায় লিখে পাঠিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করাতে বলেছে, ওর অফিসেও নাকি বাংলায় কিছু লেখা লাগে না। ও সারাদিনই এত বেশি ফোনের বাটন চাপে যে ফোনের বাটনের উপরের লেখাগুলি পর্যন্ত উঠে গেছে!


ও আসলে কাকে এত মেসেজ পাঠায়? একেবারে রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টাই? আমি ওর কাছে থাকলেও লেখে, দূরে থাকলেও লেখে। সারাদিনই চলতে থাকে, আমার দৃষ্টিসীমানা থেকে ফোনটা একটু দূরে রেখে। আমি যাতে কিছু দেখতে না পারি, সেদিকে তার সব সময়ই সতর্ক নজর থাকে, ফোনটা মনে করে সরিয়ে রাখেই রাখে! আমি হঠাৎ দেখে ফেললে কোনওভাবে, তখন তাড়াতাড়ি করে ফোনের ক্যানসেল বাটনে প্রেস করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে দেরি না করে।


ওকে আমি প্রায়ই বলি, ‘জামিল, তোমার কারও সাথে কিছু থাকলে আমাকে বলে দাও।’ ও বলে, ‘নেই কারও সাথে কিছু।’ ওর ফোনে ব্যস্ত-থাকা নিয়ে কিছু বললে ও জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকে, আর আমার মুখ চেপে ধরে রাখে। ঝগড়া করে-টরে সে ঠিকই কিছুক্ষণ মোবাইল টিপে ঘুমিয়ে পড়ে, এদিকে আমার পড়াও হয় না, ঘুমও হয় না। আমি সারারাত কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। জেগেও থেকেছি বহু রাত। এদিকে অবশ্য তার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। আগে অনেক হাতেনাতে ধরতে পারলেও এখন আর পারি না। সে এখন অনেক সতর্ক হয়ে গেছে আগের চাইতে। কিন্তু আমি সবই বুঝতে পারি।


ওর বড়ো ভাইয়ের সাথে সেদিন ঝামেলা লেগে গিয়েছিল ওর। বড়ো ভাই ওকে আস্তে আস্তে বলে, ‘তুই যে বিন্তির সাথে ৩৬বার থেকেছিস, আমি যদি এখন সেটা তোর বউকে বলে দিই, তখন কী হবে? তুই সাদিয়ার ঘরে ঢুকেছিলি কীভাবে, সেটা সাদিয়া আমাকে বলেছে। তুই যদি বুদ্ধিমান হয়ে থাকিস, তাহলে চুপ করে থাক। আর কথা বাড়াস না।’ তখন জামিল চুপ হয়ে যায়, আর একটা কথাও বলে না। আমি পাশের ঘর থেকে দেয়ালে কান পেতে কথাগুলি শুনছিলাম।


২-৩ দিন পর ওর মুড অফ দেখলাম। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে তোমার? মন খারাপ?’ ও বলল, ‘না। কিছু হয়নি।’ আমি পড়তে বসে গেলাম। তারপর দেখি, সে নিজে নিজেই বলছে, ‘আমার লক-করা ছবিগুলি ডিলিট হয়ে গেছে। কী যে করি আমি! আমি তো একদম পঙ্গু হয়ে গেলাম!’ তার কিছুক্ষণ পর সে ফোন দুইটা নিয়ে রুমের বাইরে চলে যায়। তখন রাত আটটা কি নয়টা বাজে। রাত এগারোটার দিকে আমি দরোজায় নক-করার শদ পাই। তখন আমি বলি, ‘দাঁড়াও, আমি আসছি।’ আমি গিয়ে দরোজা খুলে দিয়ে আবার পড়তে বসে যাই। কিন্তু দেখি, কেউ ঘরে ঢোকেনি। আমি তাকালাম দরোজার দিকে। তাকিয়ে দেখি, জামিল না, বিন্তি দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়।


ওকে দেখে বললাম, ‘কী ব্যাপার? এত রাতে?’ ও রুমে ঢুকল। ওর সেই ফোনটার পেছনের কাভার আর পার্টটা আমার বিছানার উপর রাখল। দেখলাম, কাভারটা ভালো আছে, কিন্তু পেছনের পার্টটা ভাঙা। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে?’ সে বলে, ‘আমি বাথরুমের ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, তখন জামিল ভাইয়া আমাকে কল দেয়, আর আমার কাছে গিয়ে আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে যায়। এরপর আমরা দুইজন ফোনটা কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে আমার হাত কেটে গেছে, আর সে ফোন নিয়ে চলে গেছে।’


বিন্তির বর্ণনা অনুযায়ী, সে যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, সে জায়গাটা ঝোপঝাড়ের মতো, তার উপর অমন গা ছম ছম করা অন্ধকার, ঠিক পাশেই একটা বড়ো খাদ আছে। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাত এগারোটার সময় একটা মেয়ে কীভাবে কথা বলতে পারে, আমার তো মাথায় আসে না। আর জামিলের ওখান থেকে কাড়াকাড়ি করে ফোনটা বিন্তির কাছ থেকে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার, তা তো বুঝলাম না! আমার কাছে সবকিছু রহস্য রহস্য লাগছিল।


সেই রাতে বিন্তি আমাকে যা-কিছু বলে, আমি তার সবকিছু কৌশলে মোবাইলে রেকর্ড করে রাখি। এটা আর কেউ জানত না, শুধু আমি জানতাম। বিন্তি আমাকে বলে, ‘আপনাদের ঘরের শোকেসের গ্লাস ভাঙা কেন, তা জানেন?’ আমি বললাম, ‘না, জানি না। কেন?’ সে বলল, ‘আপনাদের বিয়ের কিছুদিন আগে জামিল ভাইয়া রাত সাড়ে বারোটা কি একটার দিকে আমার ঘরের মধ্যে বসে ছিল। আমার ছোটো বোন ভাইয়াকে দেখে চিৎকার করে উঠলে আমি ওর মুখ চেপে ধরেছিলাম।’ আব্বা এ কারণেই রাগ করে এই ঘরের শোকেসের গ্লাস ভেঙে ফেলেছিল আর কারেন্টের তার-টার ছিঁড়ে ফেলেছিল। বাকিটা আপনি বুঝে নেন।’


জামিল যখন রুমে ঢুকল, তখনও বিন্তি রুমে বসেছিল। জামিল এলে ও ফোনের কথা বলল। জামিল বলল, ‘ফোন তো আমার কাছে নেই, তুমি নিজেও জানো এটা।’ জামিলকে সব সময়ই দেখেছি বিন্তির সাথে তুই তুই করে কথা বলতে, সেদিনই প্রথম দেখলাম, তুমি তুমি করে কথা বলছে। জামিলকে দেখতে কেমন যেন আনইজি আনইজি লাগছিল বিন্তির সামনে। তখন বিন্তি বলে, ‘আজ আমি সবাইকে ডাকব। জড়ো করব সবাইকে। আমি সবকিছু বলে দেবো আজকে। তাতে হয়তো আমার বিয়েটা আর হবে না। না হলে না হোক, আজ আমি সব ফাঁস করে দেবো।’ আমি জীবনে সেদিনই প্রথম বুঝতে পারলাম, পুরুষমানুষ বেকায়দায় পড়লে বিন্তির মতো একটা বোকাসোকা মেয়ের কাছেও কতটা অসহায় হয়ে পড়ে, আর তখন কত অনায়াসেই ‘তুই’ হয়ে যায় ‘তুমি’,---প্রয়োজনে ‘আপনি’ পর্যন্ত!


আমি দেখলাম, জামিল ওকে বলে, ‘বিন্তি, তুমি আস্তে কথা বলো।’ তখন বিন্তি কেমন একটা অধিকার অধিকার গলায় বলল, ‘তাহলে আমার ওই ফোনটা পাওয়া না গেলে আমাকে একটা নতুন ফোন কিনে দিতে হবে।’ তখন জামিল বলল, ‘আচ্ছা সোনা, তোমাকে আমি নতুন একটা ফোন কিনে দেবো।’ বিন্তি আবারও বলল, ‘আমার নতুন ফোনই লাগবে কিন্তু।’ জামিল বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, তোমাকে আমি নতুন ফোনই কিনে দেবো। এবার থামো, প্লিজ!’


আমি তখন বললাম, ‘আমি তোমাকে বিন্তিকে ফোন কিনে দিতে দেবো না।’ তখন জামিল আমাকে বলে, ‘তুই চুপ কর!’ আমি খুব কষ্ট পেয়ে জামিলকে বললাম, ‘তুমি বিন্তিকে বলছ তুমি করে, আর আমাকে বলছ তুই? ভালো!’ বিন্তি সেসময় আমার দিকে তাকিয়ে কীরকম যেন তাচ্ছিল্যমাখা একটা বিজয়ীর হাসি ছুড়ে দিল। আমি কিছুই বলতে পারলাম না, শুধুই অসহায়ের মতো একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম।


সেই রাতের ঝামেলাটা জামিল কোনওমতে ম্যানেজ করল। আর এদিকে বাটন-ফোনের মেসেজিং তো চলতেই থাকে…আমি নিরুপায় হয়ে তাকিয়ে থাকি, আর আল্লাহ্‌কে ডাকি। আমার সত্যিই খুব কষ্ট হয়। আমি কান্না করলেও ওর সমস্যা, আমাকে কান্নার কৈফিয়ত ওর কাছে দিতে হয়। আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। কয়েকবার সুইসাইড-লেটার লিখে লিখে ছিঁড়ে ফেলেছি। কারও সাথে এই কষ্টের কথা শেয়ার করে নিজেকে একটু হালকা করব, সে উপায়ও নেই।


ও আমার ফেসবুক পাসওয়ার্ড জানে। আমার মেসেঞ্জার, ফোন সবকিছুই চেক করে। প্রতিমুহূর্তেই। কিছুই পায় না, তা-ও চেক করতেই থাকে। অথচ ওর কোনও কিছুই আমি ধরতে পারি না। আমার ওর ফোনে হাত দেওয়া নিষেধ। আমি ওর কোনও পাসওয়ার্ডই জানি না। ওর ইমেইল অ্যাড্রেস আমার ফোনে সেট করে রেখেছিল। আমার ফোনের পুরো কন্টাক্ট-লিস্ট ওর জানা। ইমো’তে কীভাবে জানি কোড দিয়ে অ্যাড করে রেখেছে। আমি কার কার সাথে ইমো’তে অ্যাড আছি, তা-ও সে নিয়মিত চেক করে। অথচ ও বিয়ের আগে বলেছিল, বিয়ের পর, তোমার যেমন ইচ্ছে, তেমন করেই চোলো। আর এখন? ওর এত এত খুঁত আমি হাতেনাতে ধরেছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত ও আমার একটাও সামান্যতম খুঁতও ধরতে পারেনি।


বাঁচতে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে, খুউব। আমার স্বপ্নগুলির কী হবে? আমি নিজেকেই তো কখনও ভালো রাখতে পারব না, সমাজের মানুষকে ভালো রাখব কী করে? আমার জীবনটা কেমন যে হয়ে যাচ্ছে, নিজেই কিছু বুঝতে পারি না! আমার কী ভুল ছিল? কী অন্যায় করেছিলাম আমি? আমি তো কখনও আল্লাহ্‌র কোনও নির্দেশ অমান্য করিনি, তবে কেন তিনি আমাকে এমন কঠিন পরীক্ষায় ফেললেন? কী করব, কোথায় যাব, সামনে কী হবে, আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কিছুই ভালো লাগে না। বিয়ের আগে একটা মানুষ নিজেকে এতটা লুকিয়ে রাখে কীভাবে! এতটা অসহ্য রকমের গাধা আর দুর্ভাগা কেন আমি?