তোমাদের দৃষ্টিসীমার আড়ালে

বড্ড যে জ্বালাই, সে আমিও বুঝি,
অযথাই দেনা-পাওনার হিসেব করি,
তোমার অভাব, তোমার প্রতি রাগ, অভিযোগ,
...এসব আছেই এমন নিয়ম করে,
তোমাকে ভেঙে টুকরো করি,
আঘাতে পোড়াই, কষ্টে কাঁদাই…সেও তুমি ভালোই বোঝো!
বোঝো না শুধু, এরই মাঝে না পাওয়ার ব্যথা
কতটা আমায়...ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে মারে;
বেদনাদের জঞ্জালে পুড়ে যদিও আমি জানাই না কিছুই,
তবু ব্যথার তীরটা ঠিকই ছুড়ি অন্য তলে---নিজের বোধে।


নিজেকেই আহত করি, ক্ষত-বিক্ষত করি, অবিরতই,
…তোমাকেও সাথে!
জানি, ভুল করি,
জানি, ব্যথা দিয়ে যাই,
জানি, ভালোবাসলে এসব করতেই নেই…
তবু হৃদয়ের দাবি কী দিয়ে মেটাই বলো, এক হৃদয় ছাড়া?
আমাকে যে কাঁদলে বড়ো বেমানান লাগে,
আমার রাগ দেখানোই বারণ ভীষণ,
আমাকে তোমার হতে গেলে সবটা কিছু সহ্য করা
সবার আগে শিখতে হবে,---
আমার বেলায় এসবই নিয়ম!


তোমাকে আমার চাইতে মানা,
যখন তখন তোমার কাছে যেতেও বারণ,
তোমার কণ্ঠ ইচ্ছেখুশি বেলা-অবেলায় শোনা যাবে না,
সবাই যখন বিকেল হলেই চায়ের কাপে প্রিয়জনকে পাশে রেখে গল্প জুড়ে,
তোমার আমার বিকেল বলে কিছুই যে নেই, এটিই তখন মনে পড়ে!


আমার বড্ড বেশিই চাওয়া…ভালো যে বাসে, তার এত কিছু যে
চাইতেই নেই…সে তুমি আমাকে আঙুল তুলে বুঝিয়ে দিলে সেদিন যখন,
তখন থেকেই নিয়েছি শপথ, শক্ত হব,
প্রয়োজনে হব নিথর পাথর;
তবু চাইব না ভুলেও সীমানা ছিঁড়ে,
দিয়ে যাব কেবল যতটা পারি, সবটুকু সুখ উজাড় করে!


এই বুকের ভেতর, ভীষণ একটা চলছে ভাঙন,
জানো সে কথা?
দেখো তো কেবল হয় রাগটুকুনই, নয় অভিমান,
ক্ষোভ কিংবা…অথচ ভেতরের যে আগুন-ছটা,
তার তুমি কী-ইবা জানো!…ভালোবাসলে কেবল
দিয়ে যেতে হয়, নয়তো সে যে ভালোবাসাই নয়!


এই জীবনে যখন সুখের ছলে তুমি এলে,
দুঃখ কী আর সুখই কিবা, দেখালে সবই,
জানলে না শুধু, হৃদয়ের দামে বাঁচার নামে…
যখন দুঃখ কিনে নিলাম আমি…!
যে পায়, ওসব তাকে বুঝতে যে নেই, সে আমি বেশ জেনেছি!
তোমার যে আকাশ ভরা কোটি কোটি তারার মেলায়,
সেখান থেকে একটি দুটি ঝরলে তারা, কী-ইবা তোমার আসবে যাবে!
কিন্তু আমার কাছে তুমিই যে সব…তুমি ফুরোলে কার এতটা যাবে,
যতটা বেশি আমার যাবে?


তোমার সন্তান হবে পিতৃহারা,
বাবা-মা হবেন সন্তানহারা,
আর আমি…হা হা হা! আমার আবার কী-ই হারাবে
উঠোনের ধুলো যে আমি, সে আবার মূল্য কী বোঝে!
কেউ কখনও জানবেই তো না, আমার হারিয়ে গেল সবটা এবার,
সবাই কাঁদবে দু-চার বেলা, এর পর চোখ জ্বলবে যখন,
সবাই যাবে নিজের কাজে ভীষণ ডুবে!
ঠিকই তো আছে! লাভ কী কেঁদে! মৃতেরা কি আর এত দেখে!


আমারই কেবল কী হারাল, জানবে না কেউ,
আমার যে সে অধিকারও নেই বুকটা ফেটে কান্না করার!
অমন করে কান্না এলে,
ঘরের দরজা বন্ধ রেখে অন্ধকারে পুড়বে দুচোখ…জানবে না কেউ!
ভালোবাসলে যে জানাতেই মানা!
আমার নালিশটুকু নালিশ হয়েই রইবে পড়ে মনের কোণে,
নালিশ যারে করব সে যে বেঁচেই গেছে পালিয়ে গিয়ে আগেভাগেই!


লোকে এক ভালোবাসাকে অন্য একটা ভালোবাসার সাথে তুলনা করে যখন,
তখন ভীষণ হাসি পেয়ে যায়…
মায়ের ভালোবাসা যে মা ছাড়া আর কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভবই নয়!
ওটা কেউ দিতে চাইলে তাকে যে শুধু মা-ই হতে হবে!
তেমনি সব ভালোবাসাতেই যার অবস্থান, তারই মতন…ভিন্ন রকম!
সেখানে কোনও প্রশ্নই যে নেই! ভালোবাসাকে তুলনা করা, সে যে পাপের সমান!


প্রেয়সীর চুমু আর মায়ের চুমু, দুইটি পুরোই ভিন্ন ব্যাপার,
পরম প্রাপ্তি দুই-ই, ভিন্ন দুই ভালোবাসা-প্রেমের।
যে মানুষ এ দুয়ের মাঝে তুলনা খোঁজে,
তার কাছে যে ভালোবাসার অর্থই মিছে!
একুশ বছরের সন্তানের লাশ দেখার পরও,
যদি কোনও মা তৃপ্তি নিয়ে ভাত খেতে পারে,
তবে পৃথিবীতে অন্য সবকিছুই সম্ভব বটে হেসে খেলেই!
অথচ যে প্রিয়তমা কেবল একসাথে ঘরবাঁধার স্বপ্নে বিভোর,
দীর্ঘ চৌদ্দ বছর প্রতীক্ষা শেষে, সেই মানুষটিকে নিয়ে
সংসারটা করার আগেই ওপারে সে পাড়ি জমাল ফাঁকি মেরে,
তার কষ্ট যত, তা-ও বলো, কম কি অত?


আহা আহা…কী নষ্ট ভালোবাসা!
ভালোবাসা, তুমি পচে গেছো আজ!
যখন মায়ের ভালোবাসার সাথে বাবার ভালোবাসার তুলনাটা করেই ফেলো,
বাবাদেরও বিবেকে তখন কম কি বাধে?
যে বাবা তার দুদিনের সন্তানকে বুকে নিয়ে মায়ের প্রস্থানে
বাকি জীবনটা একাই কাটায়,
সেও কি তার সন্তানকে ভালোবাসে কম?
তোমার লজ্জা হয় না,…
ভালোবাসা নিয়ে এত যে এমন টানাটানি করো!
যে মা তার দু-বছরের নিষ্পাপ শিশুকে ফেলে,
সুখের খোঁজে অন্যের হাতটা ধরে ঠিকই চলে যায়,
সে কি তার সন্তানটাকে ভালোবাসেনি তবে?
হয় না এমন? বলো, তার উত্তর কী দেবে?


তোমরা যখন প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসাটারও হিসেব করো,
তখন বলতে ভীষণ লজ্জাই হয়…‘ভালোবাসি খুব!’,
এই ভয়ে যে, না জানি তখন এ ভালোবাসাটার
কী এক অর্থ আবার খুঁজেই ফেলো!
যায় যদি তো, আমারই যাবে, কার কী তাতে?
আমার কানের কাছে এসে ‘পাখি’ ডাকবার মানুষটা যে হারিয়ে যাবে,
অভিমান ভাঙানোর দাবিটুকু ঠাঁই নেবে না আর কারও কাছে!
যে হারায়, কেবল সে-ই জানে, হারিয়ে ফেলার কী যে জ্বালা!
কেউ হারালে শুধুই হারায় না সে, তার সাথে সাথে
সেই মানুষটার সাথে কাটানো প্রতিমুহূর্তের অভ্যেস হারায়!
তবু মানুষ স্বেচ্ছায় হারিয়েই ফেলে কষ্টকে ভোলার দায়ে,
ক্ষতের চিহ্ন লুকাবার দায়ে…


যে মা তার নিজের সন্তানকে আঘাত করে,
এক সে-ই তো জানে, এ যে তারই সন্তান!
আর যে তার ভালোবাসার মানুষটিকে
অযথাই রাগিয়ে তোলে, টেনে ছিঁড়ে
আহত করে, কষ্টে পোড়ায়, সেও জানে ঠিকই,
দিনের শেষে এ যে আমার থেকেই যাবে…
মা তার সন্তানকে হারায়ও যদি, তাকে
আজীবনই ভোলে না তা-ও, সত্যিই তাকে যায় না ভোলা!
কেবল ভুলে থাকার চেষ্টাই করে প্রতিমুহূর্ততে!
প্রেয়সীও, ঠিক তেমনি, ভুলে থাকার চেষ্টাই করে…
স্মৃতিতে ধুলো জমে ঠিকই, তবু স্মৃতি কি কখনও সত্যিই মরে?
ভালোবাসি যাকে, সে কি আদৌ হারায় কোথাও?


হে ভালোবাসা আমার!
আমি তোমাকে আরও কিছুকাল ভালোবেসে বেসে,
আঘাতে পুড়িয়ে, কষ্ট দিয়ে…থাকব বেঁচে, এটুকই চাওয়া!
আমাকে দেবে সেই সৌভাগ্যটুকু?
নাহয় এইবেলাটা কষ্ট করে আরও কিছুটা ক্লান্তি নিয়ে
আমার জন্যে হলেও চেষ্টা করে বেঁচেই থেকো?
আমাকে নাহয় আরও কিছুদিন তোমাকে আঘাত করতেই বাঁচিয়ে রেখো?
তুমি চলে গেলে আমাকে আমার শূন্যতা সব ছিঁড়ে কুঁড়ে খাবে…
সেদিন হয়তো নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাও স্রেফ বিলাসিতা হবে!