দশের পিঠে

১। ফেইসবুকে বড়ো বড়ো মানুষদের নিয়ে ছোটোলোকেরা বড়ো বড়ো বাজে কথা লিখে বা বলে থাকে, যা কখনও ওসব বড়ো মানুষের চোখেই পড়ে না, অথবা কোনও কারণে পড়ে গেলেও ওসব কথা তাঁরা হেসে হেসেই উড়িয়ে দেন, এবং উলটো এই ফেইসবুকেই সেই ছোটো ছোটো মানুষদের অনেকে বিশাল বিশাল প্রশংসাবাক্যে দিন-রাত ডুবিয়ে রাখেন। আর ওই স্তুতিগুলি ওরা দিব্যি শরীরে মনে মেখে ঘুরে বেড়ায়, আর ওসব ভুলপ্রশংসা নিয়েই জীবনটা দিব্যি কাটিয়ে দেয়। ওদের বলতে ইচ্ছে করে, ভাই, কিছুদিনের জন্য ওয়াইফাই কানেকশনটা বন্ধ করে দেখবেন কি, কী যে ভুলে ভুলে জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছেন?


২। লকডাউনের সময় অনেক মানুষই এরকম করে ভাবছেন যে, আহারে, অমুকের সাথে ওইদিন তর্কটা না-করলেও পারতাম; তমুকের সাথে আর কখনও যদি দেখা করার সুযোগই না পাই, তবে তাকে যে আমি ভালোবাসি, সেটাও তো আর বলা হবে না! যে দু-একজন জন মানুষ আমার কাছে টাকা পায়, সেগুলো কী করে ফেরত দেবো, ফেরত না দিয়ে তো মরতেও পারব না! এই পরিস্থিতিটা কেটে গেলে, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আর যা-ই হোক, অন্তত ভালো একজন মানুষ হবার চেষ্টা করব। আর কেউ কেউ এরকম করেও ভাবছেন, এমন একটা সময়ে আবার ভালোবাসার মানুষের খোঁজ করব? ঠ্যাকা পড়েছে? নিজে বাঁচলে বাপের নাম! যা যা টাকা ধার করেছি, করোনার অজুহাতে সেগুলো তো অন্তত এখন দিতে হচ্ছে না, এটা একটা বিশাল আনন্দের ব্যাপার। এমন নির্লজ্জ বাজে লোকের সংখ্যা কম নয় কিন্তু! আবার আরেকটা দল আছে, যারা ভাবছে, এই পরিস্থিতিটা যাক শুধু, অমুক তমুক আমার কাছে ক্ষমা চাইবে না আবার! ওদের ঘাড় চাইবে। প্রয়োজনে নাকে খত দেওয়াব সবার সামনে। (হ্যাঁ, এমন লোকজন ধরেই নিয়েছেন, করোনায় উনি মারা যেতে পারেনই না!) শুধু যাক একবার এই পরিস্থিতিটা, দেখিয়ে দেবো, আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হতে পারে না!


৩। তার সাথে প্রেম কিংবা বন্ধুত্ব করুন, যার কাছে আপনার গোপনীয়তা পুরোপুরি গোপন ও নিরাপদ থাকে। তার সাথেই সম্পর্ক রাখুন, যার কোলে মাথা রেখে ভুলটা বলতে ভয় করবে না, আর যার কাঁধে হাত রেখেও আপনি আপনার ব্যক্তিগত বিরাট গোপন বিষয়টাও নির্দ্বিধায় বলে ফেলতে পারেন। এ কারণেই সম্পর্ক করতে হয় এমন কারও সাথে, যার মনের বয়স শরীরের বয়সের চাইতে বেশি। কাউকে ভালোবাসতে পারার চাইতে বিশ্বাস করতে পারাটা বেশি জরুরি। যাঁকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন না, কিংবা যিনি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারেন না, তাঁর সাথে সম্পর্কে থাকার মানেই হচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্তেই জীবনে অশান্তি ডেকে আনা। ভালোবাসা অল্প, শান্তি বেশি---এমন রিলেশনে দিব্যি টিকে থাকা যায়; কিন্তু ভালোবাসা বেশি, অশান্তিও বেশি---এমন রিলেশনে থাকার চাইতে সময় কাটানোর জন্য বরং মুরগিপালাও অনেক ভালো, মাঝেমধ্যে, আর কিছু হোক না হোক, ডিম তো অন্তত পাবেন!


৪। যে মানুষটির মধ্যে হিংসা নেই, সেই মানুষটিই দিনের শেষে সবচাইতে বেশি সার্থক, আর মানসিক শান্তির অধিকারী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা জানিই না যে, আমাদের মধ্যে কত ছোট্ট ছোট্ট হিংসা লুকিয়ে থাকে, যা প্রকাশ পাবার পরে মনে হয়, আরে, ওর সাফল্যে কিংবা সৌন্দর্যে আমার কেন হিংসে হচ্ছে? হা হা…এমন ঘটনা রোজ রোজ ঘটে গেলেও আমরা স্বীকার করি না যে আমাদের মনে হিংসে আছে, আর স্বীকার করে নিয়ে খুঁজে বার করে ওগুলোর মোকাবিলা করে কীভাবে তা দূর করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবি না, ফলে হিংসাগুলি জাতগুষ্ঠি বাড়িয়েই যেতে থাকে, আর আমরা মনে মনে বলতেই থাকি, আশ্চর্য, এরকম খুশির একটা ব্যাপারে আমার আনন্দ হচ্ছে না কেন?


৫। অমুক কথাটা তমুককে বলিস না যেন---এটা আপনার যাকে বলতে হয়, নিশ্চিত থাকুন, আপনারা আর যা-ই হোন, কোনওভাবেই পরস্পরের বন্ধু হন না। আপনি তাকে বিশ্বাস করেন না, এবং সেও আপনাকে বিশ্বাস করে না; যদিও আপনারা দুজনই একটা বিশ্বস্ত সম্পর্কে থেকে যেতে চাইছেন।


৬। আপনি শক্তসমর্থ থাকা অবস্থায়, আর যথেষ্ট সময় হাতে থাকার পরেও যখন নিজের কাপড়ধোয়া, ইস্ত্রিকরা, প্লেট- গ্লাসধোয়া, ঘর ঝাড়ু দেওয়া কিংবা অন্যান্য ছোটোখাটো কাজ, যেগুলো আপনার নিজেরই করার কথা, সেগুলো অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নেন, তবে জেনে রাখুন, শেষবয়সটা আসার অনেক আগেই শারীরিকভাবে কারও-না-কারও উপর আপনি পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন।


৭। খাবার নষ্ট করা, এটা হচ্ছে একধরনের নেশাজাতীয় স্বভাব। যে খাবার নষ্ট করে, খেয়াল করে দেখবেন, সে এই কাজটা প্রতিদিনই করব না করব না করেও প্রতিদিনই করে। আরেক শ্রেণির মানুষ পাবেন, যারা ভাবে, আমার টাকায় কেনা খাবার আমি নষ্ট করছি, এতে কার কী! ওদের বলতে ইচ্ছে করে, টাকাটা আপনার হতে পারে, কিন্তু খাবারটা আপনার নয়, অনেকেরই। কেননা পকেটের পয়সা খরচ করে আপনার নষ্ট-করা খাবারটি কেউ-না-কেউ খেতে পারবেন, যা আপনি নষ্ট করে ফেললে তিনি আর পাবেন না। টাকা আপনার হতে পারে, কিন্তু রিসোর্স আপনার নয়। এটা মাথায় রাখলে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অনেক জিনিসের অপচয় কমে যেত।


৮। আমরা বাঙালিরা অন্তত যে পাঁচটি কারণে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে আছি, সেগুলির মধ্যে, 'আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, তাই আমি সব জানি।', এমন মানসিকতা অন্যতম। এটা আমাদের পরস্পরকে কাদা ছোড়াছুড়িতে উৎসাহ দেয়। অথচ, নিজের কাজের ব্যাপারে তুলনা চলে একমাত্র নিজের বা নিজের সমজাতীয় কারও সাথেই। আমরা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ডাক্তারের কাজের ভুল ধরি, ডাক্তার হয়ে আইনজীবীর কাজ নিয়ে কথা বলি, আর আইনজীবী হয়ে শিক্ষকতা নিয়ে মতামত দিই। অথচ আমরা নিজের কাজটাই ঠিকমতো করি না, আর অন্যের এমন কাজ সম্পর্কে মাথা ঘামাতে যাই, যেটার ব্যাপারে আমাদের বিন্দু পরিমাণ ধারণাও নেই।


৯। বাবা-মা দুনিয়ার সবচেয়ে অদ্ভুত মানুষ হয়ে থাকেন। তাঁরা সন্তানের আজকের কাজকর্ম দেখে যদি এই ভবিষ্যতটি সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হয়েও যান যে---‘আমার এই অপদার্থ সন্তানকে দিয়ে কিছুই হবে না।', তবুও তাঁরা শেষঅবধি সন্তানের পাশে থেকে যান। উদাহরণ দিয়ে বলি। কোনও ছেলে হয়তো সারা দিন তাস খেলে নয়তো আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়, অথবা কোনও মেয়ে যদি সারা দিন শুয়ে বসে ফ্রেন্ডদের সাথে চ্যাটিং করে নয়তো কোনও কাজ ছাড়াই এর ওর সাথে ঘুরে ফিরে, প্রেম-টেম করে, সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেয়, তবুও সেইসব সন্তানের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ বাবা মা কী ভাবে, জানেন? তাঁরা ভাবেন, ‘ও একদিন ঠিকই সব বুঝতে পারবে, আর একজন যথার্থ মানুষ হয়ে উঠবে।’ আর এসব বাবা-মায়েরই সন্তানদের মধ্য থেকে, কেউ কেউ, যথার্থ মানুষ হওয়া তো অনেক দূরের কথা, ওদের কাছ থেকেই অপমান সহ্য করে কিংবা কখনও মার খেয়েও অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে বাধ্য হন! প্রায়ই দেখা যায়, সাপের বাচ্চা মানুষ না হলেও, মানুষের বাচ্চা কখনও-সখনও সাপ হয়ে বেড়ে ওঠে।


১০। যে মানুষ চুরি করে, তার মধ্যেও নাকি একটা হলেও ভালো গুণ থাকে, একটা-না-একটা নীতি অন্তত থাকে। আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষই আছেন, যাঁদের কোনও নীতিই নেই। সময়ের প্রয়োজনে তাঁরা পৃথিবীর যে-কোনও নীতিই গ্রহণ কিংবা বর্জন করতে পারেন। তাঁদের অনেক কাজই চুরি করার চেয়েও জঘন্য খারাপ কাজ। তবুও, ভদ্রতাবশত, আমরা তাঁদের বরাহশাবক না-ডেকে মানুষ ডাকতেই বাধ্য হই। (দেখুনই না, বেঁচে থাকতে হলে কত কী-ই না মেনে চলতে হয়। যাকে ভাবলেই মনের মধ্য থেকে বরাহশাবক গালিটা আপনাআপনিই চলে আসে, তার সম্পর্কে লিখতে গিয়েও সর্বনামপদে পদে পদে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করে ফেললাম! আহা জীবন আহা জীবন! শুয়োরের বাচ্চাকে সম্মান দেখিয়ে বাঁচতে হয়!)