দশ আঙুল থেকে পাঁচ

১। লেখালেখির ক্ষেত্রে, আপনার যদি মনে হয়, আপনি একই সাথে দুটো কিংবা ততোধিক বিষয়ে প্যাশনেট এবং প্রত্যেকটিকেই আপনি ভালোবাসেন, কোনওটাই ছাড়তে চান না, তাহলে আমি বলব, আপনি খুবই লাকি একজন মানুষ! অভিনন্দন, মশাই! এবং, একই সাথে, আপনি অনেক বেশি আনলাকি একজন মানুষও বটে! এবার অভিনন্দনটা ফেরত দিন। হা হা হা!


আপনি একাধিক বিষয়ে প্যাশনেট থাকলে আর সবগুলোকেই প্রপারলি আইডেনটিফাই করতে পারলে আপনি সত্যিই লাকি, কেননা যেখানে বেশিরভাগ মানুষ সারাজীবন চেষ্টা করেও নিজের একটা প্যাশনই খুঁজে পায় না, সেখানে আপনি একাধিক পেয়ে গেছেন। আনলাকি কেন? এইজন্য যে, আপনি চাইলেই একজীবনে অনেক কিছু একসাথে করতে পারবেন না, এটা আসলে অবিশ্বাস্য রকমের দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার। সে কারণে আপনি আসলে কোন প্যাশনের উপর টিকে থাকবেন, সেই ডিসিশন নেওয়াটা আপনার জন্য খুব মুশকিল হবে। অনেকেরই এরকম একটা রাস্তা বেছে নিতে গিয়ে পাগল পাগল দশা হয়!


আমি এখানে একটু আগ বাড়িয়ে একটা কথা বলি। সারা পৃথিবীতে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে, একই সাথে সব দিকেই নিখুঁত আর পারদর্শী আসলে একজনই ছিলেন। তিনি হচ্ছেন অতিমানব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উনি বাদে ওরকম আর কাউকেই আমি চিনি না। এবার সিদ্ধান্ত আপনার।


আমার প্রিয় গোয়েন্দাচরিত্র শার্লক হোমসের একটা উক্তি আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। আপনারা জেনে থাকবেন, হোমস গোয়েন্দাগিরি করার খাতিরে বিভিন্ন ধরনের ছদ্মবেশ ধারণ করতেন। সেইসব ছদ্মবেশের সাথে তিনি নিজেকে এতটাই মানিয়ে নিতেন যে, মূল ব্যক্তিটির সাথে তাঁর পার্থক্য করাটাই রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়ত। একবার ছদ্মবেশে এক অপরাধীকে ধরার পরে সেই অপরাধী এতটাই অবাক হয়ে যান যে, তিনি হোমসকে বলেই বসেন, ‘আমি এত বড়ো অভিনেতা আজ অবধি কোনও সিনেমায়ও দেখিনি!’ তখন হোমস খুবই সিরিয়াসলি উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, নাট্যমঞ্চ নিঃসন্দেহে একজন শার্লক হোমসকে মিস করবে!’


২। আমি মনে করি, ওয়ান্স অ্যা বেইমান, অলওয়েজ অ্যা বেইমান! এটা এভাবেও বলা যায়, যার ফ্যামিলিতে বেইমানির ধারা আছে, তার ফ্যামিলির বেশিরভাগ মানুষই এটা কীভাবে যেন রপ্ত করে ফেলে! আপনি জীবনে যা-ই করেন না কেন, কখনও বেইমানের সাথে চলাফেরা করবেন না, তা সে যতই মেধাবী, সফল কিংবা যতই কাছের আত্মীয়ই হোক না কেন। হোক সে আপনার প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা, কাছের যে কেউই; হ্যাঁ, এখনই তাকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিন, যে করেই হোক! ওরা নিজেদের কাজ হাসিলের জন্য যে-কোনও অবস্থায় যে-কোনও কিছুই করতে পারে। আপনাকেই পাপেট বানিয়ে শো দেখাতে পারে, আবার হুট করেই ‘ওকে তো আমি চিনিই না!’ বলে ফেলতে পারে! এ ধরনের কথা বলতে ওদের একসেকেন্ডও লাগে না! তাই পস্তানোর আগেই সাবধান হোন।


৩। আপনি শুধু বাংলাদেশে থাকলেই জানতে পারবেন যে, বিদেশে থাকাটাও একটা যোগ্যতা। ‘ছেলে কী করে?’ ‘ছেলে অমুক দেশে থাকে।’ বুঝুন অবস্থা! আরেকটা মজার দিক খেয়াল করে দেখলাম। আমাদের দেশের মানুষ যে সাবজেক্ট আর যে জবসেক্টর নিয়ে এটা সেটা হাবিজাবি বলতেই থাকে---না জেনে, না বুঝে, অন্যের কাছ থেকে শুনে, দিনের শেষে কী যেন এক অদ্ভুত কারণে তারাই সেই সাবজেক্ট আর সেই জবকেই সবার আগে জড়িয়ে ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়ে!


এমন দ্বিচারিতার কারণ হিসেবে আমার কাছে যা মনে হয়, তা বলি। উপযুক্ত সাবজেক্ট আর জবসেক্টর সম্পর্কে ক্রমাগত ভুল ধারণা পাওয়া, সেই ভুল ধারণাগুলিতেই থেকে যাওয়া, ওসব সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ওখানে ভালো করতে যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন, সেগুলোর অভাব আর লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট…‘সবাই ট্রল করে বলে আমিও করি, যদিও আমি বুঝে ট্রলটা করিনি!’---এই সুইসাইডাল আচরণটা। এর সাথে আমাদের জাতীয় চরিত্র 'ভণ্ডামি' তো আছেই! আমার এক কাজিন বুয়েটে পড়ার সময় কোনও একটি সমাজতান্ত্রিক দলের খুব উঁচু দায়িত্বশীল পদে ছিলেন, দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে বার বার পুলিশের মার খেয়ে মা-বাবাকে কাঁদিয়ে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তাঁর চেহারা দেখিয়েছেন নিয়মিতই, পুঁজিবাদকে অতি অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে গেছেন ও সকলকে গালাগালি করতে উৎসাহ জুগিয়েছেন...আরও কত কী! এরপর? হ্যাঁ, উনি এখন সপরিবারে আমেরিকায় সেটলড! অনার্সের পর পড়তে গিয়েছিলেন, আর ফেরেননি।


একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছেন? যারা বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিষয় নিয়ে প্রায় সময়ই ট্রল করে, তারা বেশিরভাগই লুজারদের দলে? তারা নিজেরাও জীবনে তেমন কিছু করতে পারে না, অন্য কেউ কিছু করতে পারলে তারা সেটা সহ্যও করতে পারে না।


৪। খুব কাছের কারও মৃত্যুতে কেউ যদি খুবই স্বাভাবিক আচরণ করেন, সেক্ষেত্রে তাঁর বেলায় খুব সম্ভবত তিনটা ঘটনার যে-কোনওটি ঘটে:


এক। তিনি হয়তো খুব বেশি ভেঙে পড়েছেন। মনের অতি অস্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ অনেকসময় প্রয়োজনের চেয়েও বেশি স্বাভাবিক আচরণ করে থাকে।


দুই। কী হয়েছে, সেটা হুট করে বুঝে উঠতে না পারার কারণেও তিনি ওরকম করতে পারেন। এমন একটা ধাক্কা সামলাতে সবাই পারেন না।


তিন। হয়তো এটাই তাঁর আসল রূপ, যা তিনি এতদিন সুনিপুণ দক্ষতার সাথে আড়াল করে রেখেছিলেন! উনি কেবলই মানুষটার মাটি হবার অপেক্ষায় ছিলেন। প্রিয় মানুষের মৃত্যুর চেয়ে মানুষটার রেখে-যাওয়া ছেলে/মেয়ে, জমিজমা, টাকাপয়সা নিয়েই তাঁর আজীবন মাথাব্যথা ছিল, যেটা আদায়ের মোক্ষম সময়ে উনি এখন দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি জেনে অবাক হবেন যে এই মানুষটা এমন কেউ হতে পারেন, যাঁকে আপনি ওই রূপে কখনও কল্পনাও করতে পারেননি। আপনার মায়ের পেটের আপন ভাই কিংবা বোন, চাচা, খালা, মামা, ফুপুও হতে পারেন। বিশ্বাস করুন, কখনও কখনও, একজন মানুষ মরে গিয়ে পরিবারের বাকিদের অন্তরের মুখোশটা খুলে দিয়ে যান, আর সেই চরিত্রটা টেনে বার করে রেখে যান, যেটা এতটাই কুৎসিত আর নোংরা যে, ওই মৃত মানুষটা জীবিত অবস্থায় সেই মানুষগুলোর আসল চেহারা দেখলে কষ্টে কষ্টে আরও অনেক আগেই মারা যেতেন!


৫। হাসিঠাট্টা, বিদ্রূপ, কাউকে পচানি দেওয়া…আর সেন্স অব হিউমার কিন্তু কোনওভাবেই এক জিনিস না। এটা আমরা খুব ভালো করে জানার পরেও ভুল করে ফেলি---ইচ্ছেয়, অনিচ্ছেয়। আমরা হাসিঠাট্টার নামে প্রতিনিয়তই বন্ধুবান্ধবদের বিদ্রূপ করতে থাকি। এমনকি, মজা করার নামে আমরা যে কখন বয়সে কিংবা বুদ্ধিতে ও অবস্থানে বড়ো কাউকে অপমান করে ফেলি, তা টেরই পাই না। আর আজকাল তো দেখি, অন্যকে পচানোটা একরকম আর্টই হয়ে গেছে! মানুষ এমন এমন মানুষকে পচানি-টাইপের কথা ছুড়ে মারে আড়ালে কিংবা সামনেই, দেখলে মনে হয় যেন এই বড়ো মানুষটার সাথে সে প্রাইমারিতে একইসাথে পড়ত, আর ছোটোবেলায় একইসাথে হাফপ্যান্ট পরে মারবেল খেলত! যত্তসব! সবসময়ই মাথায় রাখবেন, আপনার চাইতে অবস্থানে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, শিক্ষায় বড়ো কেউ কোনও কারণ ছাড়াই আপনার প্রতি বড়োজোর ফ্রেন্ডলি হতে পারেন, তবে তিনি আপনার ফ্রেন্ড হতে হলে একটা-না-একটা কারণ লাগবেই লাগবে। ছোটলোকরা ফ্রেন্ডলি আচরণকে ফ্রেন্ডশিপ ধরে নিয়ে ভুল করে। কোনও কারণ ছাড়াই, আপনার হাতটা বড়ো মানুষের বড়োজোর হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, কাঁধ পর্যন্ত কিছুতেই নয়।


তো যেটা বলছিলাম, আপনি হাসিঠাট্টা, মজা-করা এসব জানেন কি জানেন না, সেটা বড়ো কথা না, এসব না-জানলেও চলবে। ওসবের চেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে, আপনার সেন্স অব হিউমার কোন লেভেলের, সেটা। আপনি হাসিঠাট্টা সীমার মধ্যে থেকে করতে জানলে ভালো, না-জানলেও ক্ষতি নেই, করবেনই না প্রয়োজনে। এমন একটা জিনিস, যেটা জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাজে দেয়, সেটা হচ্ছে এই সেন্স অব হিউমার। আইনস্টাইন আর তাঁর ড্রাইভারের ঘটনাটা আমরা সবাই-ই কমবেশি জানি। ভাবুন তো একটু, একটা ড্রাইভারের সেন্স অব হিউমার কোন লেভেলের ছিল! আসলে ড্রাইভারেরও কী কপাল! একজন আইনস্টাইনের আশেপাশে নিজেকে রাখতে পারলেও কত কিছু যে আপনাআপনিই ঘটে যায়! হ্যাঁ, সেই রাখতে জানাটা বিশাল একটা আর্ট, ওটা আয়ত্ত করতে হয়!