দূরত্বের আগে

সবাই-ই যে ভালোবেসে ‘ভালোবাসি’ বলে, তা নয়। কিন্তু হায়! মিথ্যে ‘ভালোবাসি’টাও যে কেউ-কেউ ভালোবেসে গ্রহণ করে, তার কী হবে! সবাই ভালোবেসেই চুমুটা খায় না, স্রেফ চুমু খেতে ভাল লাগে বলেই খায়। তবে কেন এমন কাউকেই চুমুটা খেতে হবে যে ভালোবেসেই চুমুটা গ্রহণ করছে? চুমু খাওয়াটা সুখের, মানছি। তবে কেন সেই সুখ পেতেই হবে যে সুখ অন্য কারও অসুখ বাধিয়ে দেয়? কোন ভালোবাসায় ভালোবাসা নেই, সেটা কেউ জানবে কী করে? ভালোবাসার যে কোনও ব্যাকরণ হয় না!

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। একটা ফোন এল! “হ্যালো! সুমি? আমি মনির। চিনতে পারছ তো?” “জুওলজির মনির ভাই?” “হ্যাঁ হ্যাঁ! তোমাকে সম্পা বলেনি আমি ফোন করব?” “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি সত্যিই আপনি?” “অদ্ভুত তো! হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে!” “আপনাকেও! ভাইয়া, আপনি অনেক সুন্দর গান করেন!” “হাহাহাহা…… ওই একটুআধটু আরকি! স্টেজে উঠিয়ে দিলে ওরকম সবাইই পারে।” এভাবেই চলতে থাকে। প্রথমদিকে মাঝেমাঝে কথা হতো, পরে-পরে প্রায়ই। মোবাইল সেবাদাতা কোম্পানির একনিষ্ঠ ভোক্তা বেড়ে গেল আরেক জোড়া।

একদিন সুমিকে নিয়ে গাজীপুরে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে মনির। সুমি রাজি হয়নি। মুখে It’s OK বললেও ব্যাপারটাতে মনে-মনে খুব বিরক্ত হয় সে। কথা চলতে থাকে। ২ মাস চলল। আরও দুএকবার ঘুরতে যাওয়ার কথায় রাজি না হলে মনির সুমির সাথে যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে সুমির মোবাইল সেটটি চুরি হয়ে যায়। মনিরের নাম্বারটি নতুন সেটে ছিল না। একদিন সন্ধ্যায় একটি মেসেজ আসে। “সুমি, কেমন আছ?” নাম্বার চেনা নেই, তাই সুমি রিপ্লাইও দেয়নি। শুধু মেয়েদের কুশল জানতে চাওয়ার জন্যই কিছু ছেলের জন্ম হয়েছে। ওদেরকে রিপ্লাই দেয়ার কিছু নেই।

এর সপ্তাহখানেক পর মোবাইল গুঁতোগুঁতি করতে-করতে হঠাৎই মেসেজটি চোখে পড়ল সুমির। মেয়েদের মন—অহেতুক কৌতূহলের মহাসমুদ্র। কোনও কারণ ছাড়াই সুমি অন্য একটি নাম্বার থেকে ওই নাম্বারে ফোন দিয়ে বসল। ফোনের ওপাশ থেকে কেউ একজন খুবই অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা শুরু করলে সুমি ভয় পেয়ে ফোনটা রেখে দিল। এরপর খুব রাগ করে মেসেজ পাঠাল। “আপনি এরকম করলেন কেন আমার সাথে? আপনি আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। আপনার নাম্বারটা চিনি না বলে ফোন করলাম শিওর হওয়ার জন্য আপনি কে।” সুমি মেসেজে ওর ওই নাম্বারটি এবং সাথে মেসেজের তারিখসময় উল্লেখ করে দিল। তারপর ওই নাম্বার থেকে বারবার ফোন আসতেই থাকে। সুমি রাগ করে ফোন ধরেনি। এরপর টেক্সট। “আসলে আমি অন্য একটি ব্যাপার নিয়ে অনেক হতাশ ছিলাম, তাই বুঝতে পারিনি যে তুমি ফোন করেছ। আমি সত্যিই সরি। ফোনটা ধর। আমি তোমাকে অনেক-অনেক বেশি মিস করি।” সুমি এরপরেও ফোন ধরেনি। পরদিন সকালে নতুন একটি নাম্বার থেকে ফোন আসে। সুমি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে ওঠে, “আমাকে এইবারের মত ক্ষমা করা যায় না? প্লিজ একবার! প্লিজ!” কথাটি এত বেশি বিনীত মিষ্টি কণ্ঠে ছিল যে কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর সুমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কে বলছেন?” “বলব, আগে বল, তুমি রেগে নেই।” “দেখুন, আমার তো মনে হচ্ছে না যে আমি আপনাকে চিনি। আপনার সাথে রাগ করার কথা আসছে কেন এখানে?” “সোনা, এমন করছ কেন? বল না, তুমি আর রাগ করে নেই এখন?” “মানে? আচ্ছা, ঠিক আছে, বলুন।” “আমি মনির।” “ও আচ্ছা, আপনি? আপনার সাথে রাগ করে থাকব কেন?” “আসলে তুমি আমার কোনও কথাতেই রাজি না হওয়ায় আমি তোমাকে অনেকদিন আর ফোন করিনি। আমি নিজেও কিছু কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আর কালকে তোমাকে ওরকম করে বকা দেয়ার জন্য আমি রিয়েলি সরি।” “না না, ঠিক আছে। আপনি তো আমাকে অন্য কেউ ভেবে কথা বলে যাচ্ছিলেন। তাই হয়তো!” “কিন্তু আমার নাম্বারটা তোমার মোবাইলে সেভ করা নেই? এটা ভাবতেও তো আমার কান্না পাচ্ছে!” “না ছিল, মোবাইল চেঞ্জ করাতে এখন আর নেই।” “আমার নাম্বার যে তোমার হৃদয়ের মধ্যে থাকার কথা! তোমার নাম্বার তো আমার মুখস্থ! তোমাকে সত্যি-সত্যি অনেক মিস করি। আমি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দেয়া যায় না?” এই কথায় সুমির কেমন জানি মায়া লাগল আর নিজের উপরেই একটু রাগ হল। “আসলে আমিই সরি। আপনি কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। এখন থেকে আপনার নাম্বার মনে রাখব।” “তুমি আসলেই অনেক ভাল! সবসময়ই এরকম লক্ষ্মী হয়েই থেকো, কেমন?” কী এক খুশিতে মুহূর্তেই সুমির নাকে ঘাম জমে উঠল, গাল লাল হয়ে উঠল! পৃথিবীর বোকা মেয়েদের মায়া সবসময়ই একটু বেশি থাকে। সেই মায়া ভুল জায়গাতে হুটহাট বেশি করে বের হয়ে পড়ে। একবার বের হতে শুরু করলে চূড়ান্ত সর্বনাশটা না হওয়া পর্যন্ত বের হওয়া আর থামে না।

এরপর ওরা নিয়মিতই দেখা করতে থাকে। টিএসসিতে, ভার্সিটির মাঠে, সব জায়গাতেই। মনিরের ব্যাপারে সুমি অনেক কিছুই জানত। মনিরের চাচাত ভাই ছিল সুমির বেস্ট ফ্রেন্ডের বয়ফ্রেন্ড। মনির বালামার দলের সক্রিয় কর্মী ছিল। সুমি এটাও জানত। কিন্তু ওকে কখনও কিছুই বলেনি। মনিরের সাথে আগের মত প্রতিদিনই ফোনে কথা হতে লাগল। সম্পর্ক আপনি থেকে তুমি’তে গেল। একদিন নানান কথার ফাঁকে সুমি জিজ্ঞেস করে ফেলল, “আচ্ছা, তুমি কি বালামার কর? সত্যি কথা বলবে।” কিছু সময় চুপ করে থেকে ও উত্তর দিল, “না, আমি অপোগণ্ড পার্টি করি।” “কিন্তু আমি যে শুনলাম………” “তুমি শোনাকথা বেশি বিশ্বাস কর, নাকি আমার মুখের কথা?” সুমি আর কিছুই বলেনি। ভালোবাসার শুরু হয় কম কথায়, কিংবা লুকিয়েথাকা কথায়। ভালোবাসা মানুষকে সকল প্রকারের মিথ্যে বিশ্বাস করিয়ে ফেলতে পারে।

সেদিন বিকেলে মনির সুমিকে স্ট্যানলি হলের মাঠে দেখা করতে বলে। যথাসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে মনির নিজের জীবনের অনেক কথাই সুমির সাথে শেয়ার করল। কখনও কখনও চোখের পানিও কায়দা করে এনে ফেলল। “তোমার কথা ঠিক, আমি বালামারের মতাদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু সবাই জানে, আমি অপোগণ্ড করি। সামনে আমাদের কমিটির পুনর্গঠন হবে। আমি একটা পোস্ট পাবো। তুমি এটা কখনওই কাউকে বোলো না প্লিজ! তোমার মাথায় হাত দিয়ে আমি প্রমিজ করছি, আমার নিজের সাথে যখনই যা-ই হোক না কেন, আমি আজীবন তোমার পাশে থাকব। আমাকে কোনওদিনই ছেড়ে যেও না প্লিজ!” মনিরের চোখের দিকে তাকিয়ে সুমির বুকের ভেতর থেকে কেমন জানি এক ধরনের কান্না আসতে থাকে। অনেক মায়া জন্মে যায় মনিরের জন্য। মেয়েদের মধ্যে এই মায়া জন্মানোকেই ভালোবাসা বলে—মেয়েলি ভালোবাসা। খুব কৌশলে এটা একবার করতে পারলেই একটা মেয়ের কাছে এমন কিছুই থাকে না, যা সে চাইলে ছেলেটাকে দিতে পারে, কিন্তু দেবে না। সুমি নিজের সাথেই প্রমিজ করে বসল, জীবনে যা কিছুই আসুক না কেন, পুরো পৃথিবীটাকে অস্বীকার করে হলেও মনিরের পাশে সবসময়ই থেকে যাবে।

আগে যেখানে মনির দিনে দুএকবার ফোন দিত, সেদিনের পর থেকে সুমিই ওকে প্রতি মুহূর্তেই ফোন করে-করে অতিষ্ঠ করে তুলতে লাগল। সময় মত খেয়েছে কি না, ক্লাসে গেছে কি না, কোথায় আছে, কী করছে, আরও কত কী! প্রায়ই ওকে ফোনে পেত না। মনির বলতো, পড়াশোনা করতে হয় তো, তাই ফোনটা অফ করে রাখি। অনেকেই সুমিকে বলত, “মনিরের অনেকগুলি সিম। ও বাকিগুলি দিয়ে অনেকের সাথেই কথা বলে।” এসব কথা সুমি কোনওদিনই বিশ্বাস করেনি। মনিরের এক বিবাহিতা কাজিন সুমির বান্ধবীর মাধ্যমে মনিরের সাথে ওর খুব ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি সুমিকে দেখায়। সুমি বান্ধবীকে বলেছিল, “সব ফটোশপ! আমি বিশ্বাস করি না। মনির কিছুতেই ওরকম নয়!” প্রমীলা মহাবিদ্যালয়ের এক মেয়ে সুমিকে ফোন করে বলেছিল মনির কীভাবে বিয়ে করার ওয়াদা করে ওর সাথে দিনের পর দিন শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল। আরও ৫ জন মেয়ের কথাও বলেছিল যাদেরকে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে মনির নিয়মিত ব্যবহার করতো। এসব শুনে সুমি ওই মেয়েকে মুখে যা এসেছে, তা-ই শুনিয়ে দিয়েছিল। মনির খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারত, কথাবার্তায় আচারআচরণে অনেক বিনয়ী ছিল, সবসময়ই হাসিমুখে কথা বলতো। আর ছিল ওর অসাধারণ গানের গলা। ভার্সিটির বিভিন্ন প্রোগ্রামে ওর গান শুনে মেয়েরা পাগল হয়ে যেত। অনেকেই সুমিকে মনিরের সম্পর্কে অনেক কিছুই বলত। মনিরকে এসব নিয়ে বিন্দুমাত্রও কিছু জিজ্ঞেস করলে মনির সুমিকে আদর করে বলত, “সুমি, সবাই আমাকে হিংসা করে এসব বলে বেড়ায়। তুমি শুধু আমার কথা বিশ্বাস করবে। পুরো পৃথিবীর সবাই ভিন্ন কথা বললেও আমি শুধু তোমার কথাই সত্য বলে ধরে নিই। আমি তোমাকে এতটা বিশ্বাস করতে পারলে তুমি কেন পারবে না?” মেয়েরা যাকে একবার ভালোবেসে ফেলে, তাকে আর কিছুতেই ঘৃণ্য ভাবতে পারে না। ভালোবাসায় কোনও সত্যও থাকে না, মিথ্যেও থাকে না। ভালোবাসায় থাকে শুধুই ভালোবাসার মানুষটির সবকিছুর প্রতিই একরাশ মুগ্ধতা ও সমর্থন। সে অসীম মুগ্ধতায় পৃথিবীর সবচাইতে বড় সত্যিগুলিও মিথ্যে হয়ে যায় এক মুহূর্তেই, যদি সেগুলি ভালোবাসার মানুষটির অনুকূলে না থাকে। সুমির কাছেও পৃথিবীর সবচাইতে বড় সত্যের চাইতেও বড় সত্য ছিল মনির নিজেই।

একবার মনিরের খুব দাঁতে ব্যথা হয়। সারাক্ষণ সুমি ফোন করে ওর খবরাখবর নিয়েছে। ওষুধ খেতে মনে করিয়ে দিয়েছে। রাতে ব্যথা একটু কমলে মনির সুমিকে ফোন করে বলে, “তুমি আমার যতটা কেয়ার করেছ, এই পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কেউই কোনওদিনই আমার এতটা কেয়ার করেনি। আমার পাশে সারাজীবন থেকে এমনি করেই কেয়ার করো, কেমন? আমার হাত কোনওদিনই ছেড়ে দিয়ো না। আমি সত্যিই তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।” এটা শুনে সুমি কাঁদতে থাকে। বলে, “কোনওদিনই তোমাকে ছেড়ে যাবো না, কোনওদিনই না। মরে গেলেও না!” প্রায় রাতই ওরা ফোনে কথা বলত। কখনও-কখনও মনিরকে ফোনে পাওয়া যেত না। জিজ্ঞেস করলে বলত, পরীক্ষার পড়া পড়ছে বলে ফোন অফ করে রেখেছে। সুমি তা-ই বিশ্বাস করত। আসলে তখন ও কথা বলতো ভিকারুন্নেসায় ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়া ওর স্টুডেন্টের সাথে, নিপা নামে বদরুন্নেসার একটা মেয়ের সাথে, ওর ভার্সিটির এক লেকচারার ম্যাডামের সাথে, ওর এক ভাবীর সাথে, এরকম আরও অনেকের সাথেই। ওদের বেশিরভাগের সাথেই মনিরের শারীরিক সম্পর্ক ছিল। সুমি এসবের কিছুই জানত না। নামাজ পড়ে দোয়া করত, যাতে ও পরীক্ষার ভাল করে। মনির এতগুলি টিউশনি করেও পড়াশোনা করে যাচ্ছে রাত জেগে, এটা ভাবতেই ওর মনিরের জন্য খুব কান্না পেত, মায়া লাগত। মায়া ভালোবাসা বড় অদ্ভুত রহস্যময় জিনিস। জগতের সবচাইতে স্বাভাবিক সত্যিটাকেও সুবিধে মত মিথ্যে বলে বিশ্বাস করিয়ে দেয়!

একদিন অনেক রাতে সুমিকে ফোন করে বলে, “তুমি একা ঘুমাচ্ছ? আমার যে তোমাকে ছাড়া ঘুমই আসে না। সারাক্ষণ তোমার কথাই ভাবি। আমার সবকিছুকেই এলোমেলো লাগে। এই দেখ, আমি হলের বাইরে একা-একা হাঁটছি আর তোমার চোখজোড়া ভাবছি।” এরপর সে সুমিকে “কখনও জানতে চেয়ো না কী আমার সুখ, কী আমার বেদনা…..” গানটা শোনাল। মনিরের কণ্ঠের যাদুতে সুমির সমস্ত চেতনায় কী এক শিহরণ খেলা করে গেল! মনির বলতে লাগল, “সুমি, আমি আর পারছি না। আমি যেদিকেই তাকাই, তোমাকেই দেখি। রাস্তায় হাঁটার সময় অন্য মেয়েদেরকে তুমি বলে ভুল করি। আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি! আমি এভাবে না ঘুমালে পরীক্ষা নির্ঘাত খারাপ হবে।” “তুমি এমন করলে আমিও যে পাগল হয়ে যাব, বাবু। তোমাকে অনেক বড় হতে হবে। তোমার জন্য যা যা করতে হয়, আমি করব। তবুও তুমি এরকম করো না।” মনির এটাই চাইছিল মনে-মনে!

মনির কখনওই পড়াশোনা করত না। কাজের মধ্যে যা যা করতো, সেগুলি হল, টিউশনি করা, রাজনীতি করা, দল বেঁধে সাধারণ ছাত্রদের পিটানো, অসংখ্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখা, ইভটিজিং করা, রাজনৈতিক নেতাদের চামচামি করা, মিটিংমিছিল করা, আর ক্যাম্পাসে দোকানে-দোকানে বাকিতে খাওয়া। মাঝেমধ্যে ওর সাথে সুমির খুব ঝগড়া হতো, কারণ ও প্রায়ই কোনও কারণ ছাড়াই পরীক্ষা দিত না। একবার সুমি অনেক কষ্ট চেপেও অভিমান করে এক সপ্তাহ কথা বলেনি। সেসময় মনির হোয়াটসঅ্যাপে একটা গান রেকর্ড করে পাঠায়। “তোমারই জন্যে হৃদয় অরণ্যে ঝরে শুধু অঝোর শ্রাবণ…….” গানটা শুনে সুমির ভালও লাগে, আবার রাগও হয় খুব। সেদিন ওকে ফোন করে অনেক বকাবকি করে বলে, “আমাকে আর ফোন করো না কখনও!” ও বলেছিল, “আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আমি এটা কিছুতেই পারব না। মরে গেলেও না!” শুনে সুমি খুশিতে ডগমগ! বলে, “তাহলে ঠিক মত পড়াশোনা কর। তুমি শুধু পড়াশোনা কর, আমার আর কিছুই লাগবে না।” ও বলে, “তুমি আমার পাশে থেকো। তাহলেই আমার সব ঠিক মত হবে।” “তুমি যা চাইবে, তা-ই হবে!” একবার ভালোবাসিয়ে ফেলতে পারলে, মেয়েদের কাছ থেকে ছেলেরা সবচাইতে বড় যে জিনিসটি দাবি করে, সেটি মেয়েদের কাছে খুব সহজ একটি ব্যাপার মনে হয়, কারণ মেয়েরা সেটিকেও ভালোবাসারই একটি অংশ মনে করে, আলাদা করে কোনওকিছু ভাবে না। ছেলেদের কাছে যা নিছকই যৌনতৃপ্তি, মেয়েদের কাছে তা-ই অমূল্য ভালোবাসা। সেদিনের পর থেকে মনিরের পরীক্ষার সময়গুলিতে ওরা মনিরের এক বড় ভাইয়ের বাসায় প্রায়ই একসাথে থাকত। উনি বিবাহিত ছিলেন, উনার স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকত, কখনও-কখনও ঢাকায় আসত। সুমির পীড়াপীড়িতে মনির টিউশনি ছেড়ে দিল। সুমি এর আগে কখনওই টিউশনি করেনি। শুধু মনিরের জন্যই ২টা টিউশনি করা শুরু করে। টিউশনির ৫০০০ টাকার পুরোটাই মনিরের হাতে মাসের শেষে তুলে দিত, আর ওর বাসা থেকে যে টাকাটা আসত, তা দিয়ে হাতখরচ চালাত। মনির আগের চাইতে আরও বেশি মুক্ত হয়ে পড়াশোনা বাদে জগতের সকল অকাজগুলি আরও বেশি করে করতে শুরু করল।

হ্যাঁ, এটা ঠিক, এরপর থেকে মনির পড়াশোনাটা একটু বাড়িয়েই করত, কিন্তু মনে-মনে এটা ঠিক করে রেখেছিল, সুমির সাথে আর থাকা যাবে না। ছেলেরা ভালোবাসা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে, ভালোবাসার কড়া শাসন শুরু হলেই বিকল্প খুঁজতে শুরু করে। মনির নিজের মধ্যেই এই যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলল যে, সুমি ওকে অপমান করে যাচ্ছে। সুমির কথা মেনে তাকে কখনও-কখনও সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, যেটা ওর সাথে যায় না। ওর ভালর জন্য সুমি কিছু বললেই ওর মনে হতো, সুমি ইচ্ছে করে ওকে ছোট করার জন্যই ওসব বলে। ওদের ব্যাপারটা দুইজনের বাসায়ই জানত। একদিন সুমির চাচা মনিরকে বলেছিলেন, “তুমি তো এখন ফোর্থ ইয়ারের শেষের দিকে। কোথাও চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিলে আমাকে আগে থেকে বোলো। আমি ফোন করে বলে দেবো।” এই কথায় ওর মনে হয়েছে, সুমির পরিবার ওকে ছোট করেছে। সবচাইতে বড় কথা, সুমির কাছ থেকে ওর যা যা প্রয়োজন ছিল, তার প্রায় সবকিছুই ও পেয়ে যাচ্ছিলো না চাইতেই! টাকাপয়সা, মেন্টাল সাপোর্ট, সেক্স, কেয়ার—সব! সবকিছু পেয়ে গেলে ছেলেরা দূরে সরে যাওয়ার অন্তত ১০০ অজুহাত আবিষ্কার করে ফেলতে পারে! এই প্রতিভা পুরুষমানুষমাত্রেরই জন্মগত। এরপর থেকে যা কিছুই হত, তার সবই ছিল মনিরের জন্য অভিনয় আর সুমির জন্য ভালোবাসা।

সেসময় মনির সীমা নামের একটি মেয়ের সাথে মাঝেমধ্যে থাকত। সীমাকেও বলেছিল, বিয়ে করবে, ওকে ছাড়া বাঁচবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। সুমির কথা ওকে কিছুই বলেনি। ওর সাথে যখন থাকত, তখন সুমির ফোন এলে সীমাকে বলত, সুমি ওর কাজিন। সীমার সাথে রিলেশনের ব্যাপারটা সুমির কাছে ধরা পড়ে গেলে মনির বলে, “আরে ও কিছুই না। জাস্ট একঘেয়েমি কাটাতে মাঝেমাঝে কথা বলি। ওর তো বয়ফ্রেন্ড আছে।” সুমি ভেবেছিল, “আচ্ছা বলুক না! কী হবে? মনির তো আমারই আছে!” যে রাতে মনির সীমার সাথে থাকত, সে রাতে সুমিকে বলত, চাচাত ভাইদের পরীক্ষা চলছে, তাই চাচা বলেছেন ওদেরকে পড়ানোর জন্য বাসায় থেকে যেতে। সুমি শুধু এইটুকু ভেবেই খুশি থাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, “মনির তো আমারই আছে!” মেয়েরা যেটা বিশ্বাস করতে চায়, সেটাকে নিয়ে পৃথিবীর সবচাইতে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা নিজের মাথায় বানিয়ে ফেলতে পারে এবং সেটা থেকে বের না হয়ে দিনের পর দিন দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে। মনির ওর এক ছাত্রী দোলার বাসায়ও প্রায়ই যেত। দোলার বাবা-মা দুইজনই চাকরিজীবী হওয়ায় দোলা বাসায় একাই থাকত আর মনির সে সুযোগটা কাজে লাগাত। সুমি শুধু এইটুকু জানত, মনির মাঝেমাঝে বিভিন্ন মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলে। আর কিছুই না। এর বাইরে কোনওকিছু সুমি কখনও বিশ্বাস করতেও চাইত না। বিভিন্ন পলিটিকাল জুনিয়র মেয়ের সাথে মনিরের ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল মোটামুটি ওপেন সিক্রেট, কিন্তু কেউ সুমিকে ওরকম কিছু বললে বরং ওকেই খারাপ মনে করতো। মনিরকে বলত, “তুমি এত মেয়ের সাথে কথা বল কেন? আমি ওদেরকে সহ্য করতে পারি না, আমার ওদের কথা ভাবলেই মেজাজ খারাপ হয়। সবাই তোমাকে নিয়ে নানান কথা বলে, আমার ভাল লাগে না।” মনির সুমিকে বোঝাত, “আহা! তুমি এত রাগ কর কেন সোনাপাখি? ওরা তো আমাকে কোনওদিনই পাবে না। আমি শুধু তোমারই! আমি অনার্সটা শেষ করলেই একটা চাকরি জুটিয়ে তোমাকে বিয়ে করে ফেলবো! তখন দেখবে তোমাকে দেখে ওরা ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরবে। আর ফালতু লোকের মিথ্যা কথা ধরে নিজে কষ্ট পাচ্ছ কেন? তুমি কষ্ট পেলে আমার খুব খারাপ লাগে।” মেয়েরা যদি স্রেফ কল্পনাও করে যে, তার ভালোবাসার মানুষটিকে তার পাশে দেখে অন্য মেয়েরা ঈর্ষায় জ্বলছে, তখন সে রীতিমত অর্গাজমের সুখ অনুভব করে! অবশ্য এক্ষেত্রে ছেলেরা এর ঠিক উল্টোভাবে ভাবে! সুমি নিজের মনে কী এক খুশিতে হেসে উঠল।

সুমির সাথে যখন থাকত, তখন মনির ওর সাথে খুব আদর করে করে কথা বলত। সুমি যা-ই বলত, তা-ই ওর কাছে মনে হত, মধুর মতন—অন্তত ওরকমই অভিনয় করত। অন্য মেয়েদের নিয়ে বাজে কথা বলত, সুমি ওসব শুনলে খুশি হয়ে উঠত। মেয়েরা সব বুঝেশুনেও অবুঝের মত নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। সুমিও তা-ই করত। একসাথে থাকার পরের কয়েক দিন ও একেবারেই বদলে যেত। সুমি বেশি কেয়ার করলে ও বলত, “ওসব ভালোবাসাটালোবাসা সব থার্ডক্লাস জিনিস! তোমার এই আদিখ্যেতা আর ভাল লাগে না। আমি মুক্তি চাই।” সুমি ভয়ে চুপ হয়ে যেত। যদি মনির ওকে ছেড়ে চলে যায়! ও তো মনিরকে ছাড়া বাঁচতেই ভুলে গেছে! ভাবত, থাক, মেনে নিই! সুমির কোনও কথাই ওর সহ্য হত না। সুমি নীরবে ওর সব কথাই মেনে নিত। মনির কোনও ভুল করলেও সুমি সেটাকে নিজের ভুল বলে মেনে নিত। মনিরের প্রতিটি পরীক্ষার দিন সুমি রোজা রাখত। তাহাজ্জতের নামাজও পড়েছে রাতের পর রাত। অনেক দিনই রোজা রেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, মনিরকে কোনওদিনই কিছুই জানায়নি। পরীক্ষা খারাপ হলে মনির বলত, “তোমার জন্য পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। সারাদিন আমাকে ফোন করে বিরক্ত করলে আমি পড়ব কখন?” সুমি ফোন করা কমিয়ে দিত। কষ্ট হত, তবুও ভাবত, ও ভাল থাক। কিন্তু এরপর কখনও একদিন মনির হুট করে বলে বসত, “আমার সাথে কথা বলবে কেন? নতুন কার সাথে রিলেশন হয়েছে? নতুন বয়ফ্রেন্ডের সাথে কয়দিন থেকেছ? আমার চাইতেও বেশি মজা, তাই না? বেশি সুখ দেয়, তাই আমার সাথে কথা বল না। আমাকে তো আর তোমার দরকার নেই।” আহা! বোকা মেয়েগুলি এই জাতীয় কথাতেও ধরতে পারে না, ছেলেটি আসলে শুধুই কী চায়! সুমিও পারেনি। শুধুই কাঁদত!

একবার সুমির বাসায় বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে আমেরিকায় পিএইচডি করতে গেছে। বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে আছে। সুমি ইন্টারে পড়ার সময় ওকে বাসায় এসে পড়াত। কখনওই ওকে বলেনি, পছন্দ করে। কিন্তু বাসায় মাকে জানিয়েছিল। আমেরিকায় যাওয়ার কিছুদিন পর যখন সিফাতের মা সুমিদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন, তখন সুমির বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন, কারণ সিফাতকে উনি ছেলে হিসেবে খুবই পছন্দ করতেন। সুমি এটা মনিরকে জানাতেই মনির চিৎকার করে বলেছিল, “আমি তো জানতাম, তুমি এরকম! বেটার অপশন পেলেই আমাকে ছেড়ে দেবে!” সুমি বাসায় অনেক প্রতিবাদ করার পরেও ওরা সিফাতের মতন একটা ভাল ছেলে হাতছাড়া করতে রাজি হয়নি। তখন মনিরের পরামর্শে সিফাতকে স্কাইপে ফোন করে অনেক কান্নাকাটি করে বুঝিয়ে বলল, “আমি একজনকে ভালোবাসি। ওকে না পেলে আমি বিয়ের আগেই আত্মহত্যা করবো! আপনি আমাকে ছোটবোন ভেবে একটু হেল্প করুন, ভাইয়া।” বেচারা সিফাত জানত না সুমির মত বোকা মেয়েরা জীবনে অনেকবারই আত্মহত্যা করে। সে বাসায় মাকে বুঝিয়ে বলে যাতে সুমির বাবা-মা’কে ওরা নিষেধ করে দেয়। এ ঘটনার পর মনির সুমিকে পুরোপুরিই for granted হিসেবে ভেবে নেয় এবং আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সুমির সাথে আগে অতটা দুর্ব্যবহার করত না, কিন্তু এরপর থেকে মনির খুব বাজেভাবে কথা বলতো সুমির সাথে। কখনও-কখনও গায়েও হাত তুলত। সুমিকে স্রেফ একটি sex-toy হিসেবেই treat করতো মনির। সুমি তখনও ভাবত, ভালোবাসলে অমন হয়!

মনির কারাতে শিখত। কারাতে স্কুলে অনেক মেয়ের সাথেই ওর পরিচয় ছিল। ওই বিদ্যে শেখার প্রয়োজনেই মেয়েদের হাত-পা স্পর্শ হয়ে যেত। মেয়েদের মধ্যে ডালিয়া নামে একটি মেয়ের সাথে মনির প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করত। সে মেয়ে দেখতে অনেক সুন্দরী ছিল। আরও দুএকজন ছেলের সাথেও ওর রিলেশন ছিল বলে মেয়েটা ওসবে তেমনকিছুই মনে করত না। একদিন সুমির মনিরের কারাতে স্কুলে গিয়ে হাজির হয়ে সেশনছুটির পর সেই মেয়ের সাথে নিজ থেকেই কথা বলে। ওকে অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে অনুরোধ করার পর সে মেয়ে মনিরের সাথে আর কখনওই কথা বলেনি। এতে মনির ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সুমির ওপর প্রতিশোধ নিতে ওদের কারাতের শিক্ষিকার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং উনার বাসায় কয়েক রাত কাটায়। ওই ভদ্রমহিলার সাথে উনার স্বামীর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল। সুমিকে মানসিকভাবে আঘাত করতে মনির বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিওক্লিপ দেখায়। সুমি কাঁদতে থাকে। তখন মনির বলে, “আমাকে আমার মত থাকতে না দিলে আমি যা ইচ্ছা তা-ই করব।” আরও বলে, “তোমার কোনও গুণই নাই আমার বউ হওয়ার। তুমি দেখতেও অতো ভাল না। পড় ফিলসফিতে, ওটা দিয়ে তো কোনও চাকরিও তো পাবে না। তোমাকে ভালোবাসার কিছু নাই। তারপরেও তো আমি ভালোবেসেছি। তুমিই বল, কী দেখে আমি তোমার সাথে থাকব?” সুমি বলল, “এতদিন পর এসব কথা বলছ কেন? আগে ভেবে দেখনি?” উত্তর এল, “আগে তো অবুঝ ছিলাম। তোমার কথায় ভুলে গিয়েছিলাম।”

এরপর সুমি আরও শান্ত হয়ে যায়, আর কিছুই বলত না ওকে। কখনও ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বললে মনির বলত, “সময় হোক, আমি নিজেই প্রস্তাব পাঠাবো। আমাকে সময় দিতে হবে, আমি নিজের পায়ে দাঁড়াই আগে। এর আগ পর্যন্ত তুমি বাসায় ম্যানেজ করে রাখবে।” সুমি ওতেও রাজি হয়। এরপর অনেকদিন ভালই চলছিল সবকিছু। হঠাৎ সুমি আবিষ্কার করল, অনন্যা নামে ক্লাস এইটের এক মেয়ের সাথে ও প্রায়ই ফোনে কথা বলে। জিজ্ঞেস করলে বলত, “আরে তুমি শুধু-শুধু সন্দেহ কর। বাচ্চা মেয়ে, আমার সাথে পড়াশোনা নিয়ে কথা বলে।” অথচ ও অনন্যার সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত। ওকে নানান ধরনের গিফট কিনে দিত। বিভিন্ন বন্ধুর ফ্ল্যাটে নিয়ে যেত। সুমি সবকিছু বুঝেও চুপচাপ সহ্য করত শুধু এই কারণে, যাতে মনির ওকে ছেড়ে না যায়। মনিরকে ছাড়া অন্য কারও সাথে ঘর করবে, এ কথা সুমি কল্পনাতেও আনতে পারত না। সুমি দেখা করতে বললে বলত ওর সময় নেই, বিসিএস পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছে, অথচ সুমির টিউশনির টাকায় অন্য মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াত। অনার্স শেষ করে যখন মাস্টার্সের জন্য ফিনল্যান্ডে একটা স্কলারশিপ পেয়ে যায়, তখন ও মোটামুটি এটা ঠিক করে ফেলে যে, সুমির সাথে ও আর থাকবে না, অথচ বিভিন্ন ভার্সিটিতে স্কলারশিপের জন্য অ্যাপ্লাই-করা সংক্রান্ত সব টাকাই সুমিই দিয়েছে। একদিন ওর বাসায় ওর ল্যাপটপে বসে সুমি আবিষ্কার করল, ওর মোবাইলে ভিডিওকরা বিভিন্ন মেয়ের সাথে ওর নানান অপকীর্তির অসংখ্য ক্লিপ। সুমি নিজে ল্যাপটপ কিনবে বলে বাসা থেকে টাকা নিয়ে মনিরকে সে টাকা দিয়ে ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিল, আর মনির সেই ল্যাপটপে বসে-বসে অন্য মেয়েদের দেখে—এটা ভাবতেই সুমির নিজের প্রতিই প্রচণ্ড ঘেন্না হল। একদিন স্নেহা নামে এক মেয়ের জন্য মনির সুমির কাছে এসে অনেক কান্নাকাটি করে। বলে, “ওর পরীক্ষার ফরম ফিলআপ করার টাকা নেই, তুমি কিছু টাকা দাও।” ওর কান্না দেখে সুমির অনেক মায়া হল। টাকাটা দেয়ার পর মনে-মনে ঠিক করল, আর কোনওদিনই ওর সাথে কোনও ধরনের যোগাযোগ করবে না। কিন্তু হায়! মেয়েমানুষের শতাব্দীপ্রাচীন বেহায়া মন! কোনওভাবেই নিজেকে বোঝাতে পারেনি। সেদিনই সন্ধ্যায় বাসায় এসে মনিরকে আবারও ফোন দিয়ে বসে। ওয়েটিং! টানা দেড় ঘণ্টা ওয়েটিং! এরপর রাগে দুঃখে ক্ষোভে কষ্টে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, সুমি সেটা নিজেও জানে না। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালে। ৩ দিন সেখানে থাকতে হয়েছিল।

হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে আবার মনিরকে ফোন করলে ও উত্তর পায়, “তুমি! আবারও? আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেছ। আবার এসেছ কী করতে?” “প্লিজ, এভাবে বলো না, আমি মরে যাচ্ছি। আমি সত্যিই আর বাঁচব না। আমাকে বাঁচাও।” “তোমার নাটক এখনও শেষ হয়নি? হাসপাতালে গেলে, বাসার সবার সামনে আমাকে ছোট করলে, অনেক নাটক করলে। আর কত? আমাকে মেরে ফেললে তোমার শান্তি হবে? আমাকে আমার মত থাকতে দাও। অনেক হয়েছে! এনাফ ইজ এনাফ!” “তুমি আমার সাথে এমন করে কথা বলছ কেন? আমার কী দোষ? আমি তো তোমাকে ভালোবেসেছি। শুধু তোমাকেই চেয়েছি। আর কিছুই তো চাইনি জীবনে!” “এসব বলে কোনও লাভ নেই। তোমাকে আর আমার লাগবে না।” “তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো?” “বাসি না, তবে তোমার সাথে থাকা আর সম্ভব নয়।” “যদি কখনও অন্য কারও প্রেমে পড়ে যাও, তবে সেদিন আমাকে বোলো, আমি অনেকদূরে চলে যাবো, আর জ্বালাব না তোমাকে। প্লিজ মনির, প্লিজ!” “তুমি একটা চিটার! তুমি অসুস্থ! তোমার সাথে কোনও সুস্থ মানুষ থাকতে পারবে না।” “কিন্তু তুমি আমাকে প্রমিজ করেছিলে সারাজীবন আমার পাশে থাকবে।” “আরে ধুর্!! তুমি একটা গাধা! সব ছেলেই রিলেশন করার সময় ওসব কথা বলে। আগে তোমাকে ভালোবাসতাম, তোমার সাথে ছিলাম। এখন আর বাসি না, থাকব না। সিম্পল! এটাও বোঝো না?” “তাহলে এতকিছু কেন করলে? কেন আমার বিশ্বাস নিয়ে পুতুল খেললে? কেন?” “ও আচ্ছা, এই কথা! সেক্স করেছি তো কী হয়েছে? ওটা সবাই করে। আমিও করেছি। জোর করে তো আর করিনি। সেক্স করলেই কি বিয়ে করতে হবে নাকি? কোথায় লেখা আছে এই কথা? ফ্রি ফ্রি পেলে কে না করে? আর আমি ভেবে দেখলাম, তুমি খুব একটা ভাল মেয়ে না। যে মেয়ে বিয়ের আগেই সেক্স করে ফেলে, সে মেয়ে ভাল না। তোমাকে বিয়ে করলে আমার সন্তানরাও তোমার মতোই খারাপ হবে।” “তবে কেন বলেছিলে, বিয়ে করবে আমাকে? কেন স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলে? কেন…………” কথা শেষ হওয়ার আগেই মনির ফোনটা কেটে অফ করে দিল। বারবার ফোন করেও আর ওকে পাওয়া গেল না।

মেয়েদের মন বড়ই বিচিত্র! বোঝে সবই, মানতে চায় না কিছুই! পরেরদিন সুমির হঠাৎ করে মনে হল, গত সন্ধ্যায় যা হয়েছে, সব কিছুই ভুল। সে ফোনে যা শুনেছে, সবই ভুল শুনেছে। সবই হ্যালুসিনেশন! এখন ফোন করলে মনির নিশ্চয়ই সরি বলবে। সে ফোন করতেই থাকল, করতেই থাকল। মনির ফোন ধরল না। এরপর মনিরের রুমমেটকে ফোন করে জানতে পারল, মনির স্ট্যানলি হলের মাঠে কোন এক মেয়ের সাথে দেখা করতে গেছে। সুমি পাগলের মত ছুটে গেল ওখানে! গিয়ে দেখে, মনির এক মেয়ের কোলে শুয়ে-শুয়ে গল্প করছে। ও সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই খুব ভদ্রভাবে সেই মেয়েকে বিদায় করে দিয়ে ওকে পুকুরপাড়ে নিয়ে গেল আর গালাগালি করতে-করতে একটা পর্যায়ে বাম কানের উপর জোরে থাপ্পড় মারল। সুমি থাপ্পড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ওর কান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। এরপর একটা রুমাল দিয়ে কান চেপে ধরে রিকশায় করে বাসায় ফিরে যাওয়ার সময়েই মনির রুমে গিয়ে সুমির বাবাকে ফোন করে বলল, “আঙ্কেল, আপনার মেয়ে আমাকে খুব বিরক্ত করছে। একটু আগেও আমার হলের সামনে এসে আমাকে অপমান করে গেছে। আমার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওর জন্য। এরকম বেহায়া মেয়ের বাবা আপনি! আপনার লজ্জা হওয়া উচিত! নিজের মেয়েকে সামলান!” এরপর ওর নিজের মাকে ফোন করে অনেক আজেবাজে কথা বলল সুমির নামে। ওর মা সুমিকে ফোন করে খুব বকাঝকা করে বললেন, যাতে আর কোনওদিনও ও মনিরকে ডিস্টার্ব না করে।

সেদিন রাতে মনির পুরো পরিস্থিতির উপর খুব রাগ করে নিজের শরীর থেকে ৩ সিরিঞ্জ রক্ত বের করে, ওর ফ্রেন্ড এটা সুমিকে টেক্সট পাঠিয়ে জানায়। সুমি কাঁদতে-কাঁদতে মনিরকে আবারও ফোন করতে থাকে। মনির ফোন না ধরায় ওর রুমমেটকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, “মনির এখন কেমন আছে? ওর যদি কিছু হয়ে যায় তবে আমি আর বাঁচব না, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরে যাব।” “না না, তেমনকিছু হয়নি। ও তো এখন মোবাইলে গেমস খেলছে!” মেয়েদের মন, মানে না কিছুতেই! একটুপর লুকিয়ে-লুকিয়ে ছাদে গিয়ে কাঁদতে থাকে সুমি। তখনই মনিরের ফোন আসে। “তুমি তো দেখছি জন্মের বেহায়া! কফিলকে ফোন দিলে কেন? সেক্স করতে ইচ্ছে করে নাকি ওর সাথে?” এরপর আরও অসংখ্য বিশ্রী-বিশ্রী গালি দিতে লাগল। সুমি তখন কান্না করে করে বলল, “তুমি শরীর থেকে রক্ত বের করলে কেন?” “এর কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে নাকি? আমরা পলিটিক্স-করা ছেলে। দুয়েক ব্যাগ রক্তও শরীর থেকে বের হয়ে গেলে আমাদের কিছুই হবে না। আর তুমি এত রাস্তার মেয়েদের মতন চেঁচাচ্ছ কেন? মাগী কোথাকার!” “যত খুশি গালি দাও আমাকে, শুধু কখনও ছেড়ে যেও না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।” সুমির মাকে জড়িয়ে খুবই বাজে একটা গালি দিয়ে ফোনটা রেখে দেয় মনির।

সে রাতে আর ওকে পাওয়া গেল না। ওর যে ৩টি নাম্বার সুমির কাছে ছিল, সেগুলির সবকটাই অফ করে রাখল সে। দুইদিন পর ফোন করে বলল, “সুমি, আই অ্যাম রিয়েলি সরি। আমি স্কলারশিপ নিয়ে এমনিতেই অনেক ঝামেলায় আছি, তার উপর তুমি যদি এরকম কর, তাহলে কীভাবে হবে, বলো? সবই তো তোমার জন্যই করছি, তাই না? আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও সোনা, একটু গুছিয়ে নিই, এরপর তোমাকে বিয়ে করে তবেই ফ্লাই করবো। প্রমিজ! আমি তো জানি, তুমি আমাকে না পেলে মরেই যাবে। আমি কীভাবে সেটা হতে দেবো, বলো?” সেদিন এসব বলে ক্ষমা চেয়ে অনেকদিন পর সুমিকে I love you বলল। সুমির চোখে পানি এসে গেল। নিজের উপর ভীষণ রাগ হল। মনে হতে লাগল, সবকিছুর জন্য ও নিজেই দায়ী। “বুড়ি, আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি রে! ভীষঅঅঅঅঅণ………….!!” সুমি পুরোনো দিনের মত করে সুখ অনুভব করল। ওর চোখ বেয়ে পানির ধারা নামল বহুদিন পর। আনন্দের অশ্রুর শিহরণে ওর সমস্ত শরীরমন কাঁপতে লাগল।

ফোনে কথা চলল এক সপ্তাহ। মনির বলেছিল, ও এখন ভীষণ ব্যস্ত, স্কলারশিপের ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে নিলেই ওর সাথে দেখা করবে। সুমির মনে হত, এমন মানুষের জন্য সারাজীবনও অপেক্ষা করে থাকা যায়। এর মধ্যে নিজের কিছু অলংকার বিক্রি করে আর ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে ধার করে মনিরের প্লেনের টিকেটের টাকাটা ম্যানেজ করে পাঠাল, ওর জন্য ৮টি জ্যাকেট আর কিছু কাপড় কিনে পাঠাল যাতে বিদেশে গিয়ে ঠাণ্ডা না লাগে। অনেক শুকনো খাবার কিনে দিল। নবম দিনে ফোন এল, Everything is OK! সুমির মনে হল, এই মুহূর্তে এই পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষটির নাম সুমি! মনিরের সাথে দেখা করতে দৌড়ে চলে গেল! স্ট্যানলি হলের পুকুরপাড়ে বসে গল্প করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামল। হঠাৎ মনির জিজ্ঞেস করল, “তুমি দুপুরে কিছু খেয়েছ?” কিছু না খেলেও হাসিমুখে বলল, “আমি খেয়েছি। তুমি খেয়েছ?” “আমি লাঞ্চ করেছি, কিন্তু তোমাকে নিয়ে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। চলো না একসাথে খাই। কতদিন একসাথে খাই না!” খাওয়ার অতটা ইচ্ছে সুমির ছিল না, মনিরকে দেখতেই ওর ভাল লাগছিল, আর কিছু না। মনে হচ্ছিল, আর কিছু নয়, এই মানুষটির দিকে স্রেফ তাকিয়ে-তাকিয়েই একটা জীবন সে কাটিয়ে দিতে পারবে! মনিরের কথা রাখতে সে একটা রেস্টুরেন্টে গেল। মনির তেহারি খেল, ও খেল এক গ্লাস লাচ্ছি। প্রেমে আর ভালোবাসায় একটা বিকেল ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। অনেকদিন পর!

এরপর মনির কোন এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে গেল আর সুমি বাসায় ফিরে এল। রাতে মনির ফোন করে মেজাজ খারাপ করে কথা বলতে লাগল। “সবাই আমাকে এত হেল্প করল, আর তুমি কী করেছ আমার জন্য? যে টাকা দিয়েছ, সে টাকায় কী হয়? ফকিরের গুষ্ঠি তোমরা! মানুষকে সাহায্য করতে জানো না। আমি মাস্টার্স করে এলে তোমার মতন এক ডজন চাকরানি রাখতে পারবো। তখন নাহয় সব টাকা শোধ করে দিতাম। সাহায্য তো করলেই না, উল্টো আমার টাকা সব শেষ করেছ!” “তুমি কী বলছ এসব? আমি তোমার টাকা শেষ করলাম কোথায়? আর তোমার আর কত লাগবে, আমাকে বল প্লিজ! আমি চেষ্টা করে দেখি!” “কেন? কিছুই মনে নেই, না? আজকে তোমার পেছনে কত টাকা গেছে, হিসেব আছে? তুমি আজকে আমার সাথে দেখা করতে না এলে আমাকে রেস্টুরেন্টে বসতে হত না। টাকাটাও হাতে থাকত। ওই টাকা দিয়ে আমি আরও দুইদিন ভাল মত চলতে পারতাম। সেই শুরু থেকে আমার কত টাকা লস করেছ, সে খেয়াল আছে তোমার? লাত্থি দিলেও সর না। ভেবেছ, আমি কিছু বুঝি না, না? আমি বুঝি তো কেন আমার পেছনে কুত্তার মতন লেগে আছো! আমি বিদেশ থেকে ফিরলেই তো শুধু ডলার আর ডলার! স্বপ্নে ওই ডলারই দেখ শুধু! বাজে মেয়ে কোথাকার! আর কক্ষনো আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।”

সুমি কখনওই এটা জানত না যে, এরকম করেও কেউ কথা বলতে পারে। এক গ্লাস লাচ্ছির খোঁটা এতটা জঘন্য হতে পারে! ওর মনে হচ্ছিল, বমি করে সব ফেলে দেয়………ও ওর জীবনে এতটা অপমানিত কোনওদিনই হয়নি। ও যদি সুমিকে কয়েকটা থাপ্পড়ও দিত, তাতেও এতটা কষ্ট হত না। মনিরের পুরো দুই বছরের হাতখরচ ও দিয়েছে। বাসায় না জানিয়ে টিউশনি করেছে, নিজের যা অলংকার ছিল, সব বিক্রি করে দিয়েছে, ওর সব ধরনের শপিং করে দিত সুমি। বিভিন্ন পরীক্ষার ফরমের টাকা দিয়েছে। বইপত্র কিনে দিয়েছে, নোট যোগাড় করে দিয়েছে। বিদেশে যাওয়ার জন্য সব মিলিয়ে যে খরচটা গেছে, সেটার সিংহভাগ দিয়েছে ও। প্রিয় মানুষের জন্য উপহার কিনে দেয়ার সময়, খরচ করার সময় কেউই মাথায় রাখে না কত টাকা চলে গেল, এর বিনিময়ে ও কী পাচ্ছে। কোনও কিছুরই আশায় কেউ প্রিয় মানুষকে কিছু দেয় না। মনের অবচেতন কোণে শুধু একটা চাওয়াই উঁকি দেয়: প্রিয় মানুষটি ওকে একটু ভালোবাসুক, আর কিছুই না!

সুমির সবচাইতে প্রিয় বান্ধবী, যাকে সুমি নিজের চাইতে বেশি বিশ্বাস করে বসত কখনও-কখনও, যার সাথে সুমি সকল গোপন কষ্ট শেয়ার করে নিজেকে হাল্কা করে নিত, মনিরকে নিয়ে যত অনুযোগ, যাকে প্রাণখুলে বলে সুমি স্বস্তি পেত, সেই রত্নাকে মনির বিদেশে যাওয়ার আগে আংটি পরিয়ে দিয়ে গেছে। সুমি কোনওদিনই কিছুই বুঝতে পারেনি। মনির-রত্নার সম্পর্ক ছিল অনেকদিনের। অনেক কষ্টে সুমি একদিন রত্নাকে শুধু এইটুকু টেক্সট পাঠাতে পেরেছিল, “মনির কেন বিদেশে যাওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে আমার সাথে অমন ভাল ব্যবহার করেছিল?” উত্তর এল, “ওর স্কলারশিপ নিয়ে হঠাৎ করেই কিছু ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছিল। ওদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যার তো তোর বড়মামার বন্ধু, তাই ও ভেবেছিল, হয়তো তুই বড়মামাকে দিয়ে কোনও ঝামেলা পাকাতে পারিস। এতে যদি ওর স্কলারশিপটা ক্যানসেল হয়ে যায়! তাই ও তোকে খ্যাপাতে চায়নি। এই আরকি বান্ধবী!”