দেখা না-দেখায় মেশা হে জীবন/ দুই

 
: আপনি কি গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলেন? মোট কত দিনের প্রস্তুতি ছিল?
: না, আমার একটা চাকরি করা দরকার, এটা মাথায় আসার পর আমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। প্রথম দিকে আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার কোনও ইচ্ছাই ছিল না। আমি তো বিজনেস করতাম। বিজনেসম্যান হওয়ার ইচ্ছা ছিল। আর বিজনেস করার জন্য তো আর গ্রাজুয়েট হতে হয় না। কোনও এক ঘটনাচক্রে যখন আমার মাথায় এল যে চাকরি করতে হবে, বিসিএস পরীক্ষা দিব, তখন আমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করি। তার পর আমি বিসিএস-এর জন্য পড়াশোনা শুরু করি। তবে আমার একটা সুবিধা ছিল। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এই চারটাতে আমার বেসিক অনেক বেশি ভালো ছিল। সত্যিই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভালো ছিল। তবে সাধারণ জ্ঞানটা একটু বেশি পড়তে হয়েছে। ওটা একেবারে কিছুই পারতাম না। অংক প্রশ্ন দেখে আমার মনে হয়েছে এখন পরীক্ষা দিতে বসলে ৫০-এ ৫০-ই পাব। এটা পড়ার কী আছে? আমাদের সময় গণিতে ৫০ মার্কস ছিল। এখন কত?
: এখনো ৫০ ই আছে। গণিতে ৫০ এবং মানসিক দক্ষতায় ৫০।
: আমাদের সময় পাঁচটা অংক আসত। প্রত্যেকটায় ১০ করে। সহজ ছিল আরকি, ভাই…তো এরকমই মনে হয়েছে। এখন কিন্তু সব কিছু অনেক টাফ হয়ে গেছে। এখন বিসিএস দিলে হয়তো চাকরি পেতেই কষ্ট হয়ে যেত! হা হা হা! ইংরেজি, বিজ্ঞান আমার জন্য খুব সহজ ছিল, স্টুডেন্ট পড়াতাম তো, তাই। নাইন থেকে টোওয়েল্ভ ক্লাসের বইগুলি অন্তত কয়েকশোবার পড়াতে হয়েছে তো! বইয়ের পৃষ্ঠাসহ মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সায়েন্সের সাবজেক্টগুলি অন্তত ৪-৫টা বই থেকে পড়াতাম। ম্যাট্রিক-ইন্টারের ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-ম্যাথসের কোনও বইয়ের তেমন কোনও অঙ্ক বা তত্ত্ব ছিল না, যা আমি পারতাম না। উইকএন্ডে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য ফ্রি-ক্লাস নিতাম। আইবিএ-র বিবিএ অ্যাডমিশন টেস্টের প্রশ্ন সলভ করাতাম। এখন বুঝি সেই সময়ের ফ্রি-ক্লাসগুলি আমাকে টাকা না দিলেও কত কী যে দিয়েছে! আমি নিজে অনার্সে পড়াকালীন জিআরই বিগ বুক এবং অফিশিয়াল জিম্যাট শেষ করে ফেলেছিলাম। কাজটা করতে ভীষণ কষ্ট হলেও যোগেবিয়োগে অনেক লাভ হয়েছিল। গ্রামারের অনেক কঠিন কঠিন ড্রিল করাতাম। আমার কাছে ল্যাংগুয়েজ, ভোকাবুলারি ইত্যাদির উপর প্রায় শ’দুয়েক বিদেশি লেখকদের বই আছে। সেগুলি থেকে শিট তৈরি করে করে স্টুডেন্টদের দিতাম প্রতি ক্লাসেই। কাজটা করতে অনেক কষ্ট করতে হতো, তাই যেকোনও মূল্যে ওদের সেগুলি সলভ করতে বাধ্য করতাম। (প্রয়োজনে বেত দিয়ে পিটাতাম।) ওতে অনেক অনেক লাভ হয়েছে আমার। ইংরেজি লেকচার শিট রেডি করার সময় এমনভাবে রেডি করতাম, যাতে এর চাইতে বড় শিট আর কোথাও না দেয়। এটা ছিল আমার নিজের প্রতি আমার চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি শিটের নিচেই গ্রামার ও ভোকাবুলারির নানান ড্রিল থাকত। তা ছাড়া অনার্সেরও ব্যাচ ছিল। অনেক পড়াশোনা তো করতামই স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়ে। বেসিকে সমস্যা ছিল না। আমার কোচিংটা ছিল ওয়ানম্যান-আর্মি টাইপ কোচিং, কমার্সের সাবজেক্টগুলি বাদে আর সব ক্লাস আমি একাই নিতাম। ম্যাট্রিক-ইন্টারের বাংলা, বাংলা সাহিত্য আমি নিজেই পড়াতাম। এখনও মনে আছে ইন্টারের ব্যাচে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা পড়াতে যাওয়ার আগে নিজে ২২টা বই থেকে সে কবিতা সম্পর্কে পড়াশোনা করে গিয়েছিলাম। ক্লাসে এক একটা কবিতা পড়াতাম প্রায় ২ ঘণ্টা সময় ধরে। জসীম উদ্‌দীনের ‘কবর’ পড়াতে গিয়ে নিজেও কেঁদেছিলাম, স্টুডেন্টদেরও কাঁদিয়েছিলাম। সেই দিনগুলির স্মৃতি বড়ই মধুর! এখনকার স্টুডেন্টদের ১৫ মিনিটের বেশি কবিতা পড়ালে তো মারতে আসবে মনে হয়! গদ্য পড়াতে গিয়ে অসংখ্য রেফারেন্স দিতাম, ওরা খাতায় ক্লাসনোট নিয়েই কুলিয়ে উঠতে পারত না। অনেক ঘাম ঝরিয়ে ছাত্র পড়িয়েছি একসময়। ব্যাকরণ পড়াতাম স্টুডেন্টদেরকে। ওই যে ক্লাস নাইনের একটা বই ছিল না, ‘বাংলাভাষার ব্যাকরণ’, যেহেতু আমি ব্যাচে ব্যাচে স্টুডেন্ট পড়াতাম, আমার নিজেরই কোচিং সেন্টার ছিল, তাই সেটা কয়েকশোবার, মানে সত্যি সত্যি কয়েকশোবার শেষ করেছি। ইন্টারের স্টুডেন্টদের অন্তত ৮-১০টা বই থেকে ব্যাকরণ পড়িয়েছি। ক্লাসে মোটামুটি ৩টা প্রকাশনীর টেস্ট পেপারস সলভ করাতাম। এসব কাজ করতে গেলে তো নিজেকে অনেক তৈরি হতে হয়। তাই আমার ব্যাকরণে কোনও ধরনের সমস্যা ছিল না। ইন্টারের স্টুডেন্টদের গ্রামার পড়াতাম, সাহিত্য পড়াতাম এতে আমার অনেক সুবিধা হয়েছে। ওদের জন্য নোট রেডি করতাম, ফলে নিজেকে অনেক পড়তে হতো। আমি আমার সেসময়ের জীবনটা অমানুষিক পরিশ্রম করে কাটিয়েছি। তখনকার সেই বোকা বোকা সুশান্তকে নিয়ে ভাবলে খুব মায়া হয়! বেচারা কী একটা নিরানন্দ জীবনযাপন করেছে তখন! সে নির্ঘুম রাতগুলির একটা পুরস্কার আমি পেয়েছি। প্রত্যেকটি সিনসিয়ার ও স্লিপলেস জার্নির একটা অ্যাওয়ার্ড আছে।
কিছু মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, মজা পাবে। আমি তো স্টুডেন্টদের পড়া না পারলে পেটাতাম, ওতে অবশ্য গার্ডিয়ানদের একটা নীরব সম্মতি ছিল। সেই সময় স্টুডেন্টদের মারলে ওরা লজ্জিত হতো এবং পরের ক্লাসে যে করেই হোক, পড়াটা রেডি করে আসত। আর এখন? কেউ যদি স্যারের মার খায়, তবে সে লজ্জিত তো হয়ই না, উল্টো তার প্রেস্টিজে লাগে, সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। স্যারকে জায়গামতো পেলেই একদম ‘সাইজ’ করে দেয়। তাই যদি কখনও মাথায় আসে যে আবার আগের মতো স্টুডেন্ট পড়াই, পরমুহূর্তেই ভাবি, কী দরকার যেচে যেচে মার খাওয়ার? মরুক গিয়ে ওরা! লেখাপড়া না শিখুক, মূর্খ হয়ে জীবন কাটাক। আমার কী! কোচিং থেকে কত স্টুডেন্ট বের হয়ে যেত কড়াকড়ি সহ্য করতে না পেরে! আমি যদি ওদের সাথে একটু হেসে হেসে গল্প করে ওদের কথামতোই কোচিং চালাতাম, তবে আমার স্টুডেন্ট হতো অন্তত দেড়গুণ! খুব পড়ুয়া স্টুডেন্ট না হলে আমার সাথে তাল মিলিয়ে পড়াশোনা করাটা অসম্ভব ছিল।
আমি যখন পড়াতাম, তখন স্টুডেন্টদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতাম, ফুল মার্কস পাওয়াটাই বড় কথা নয়, তোমার খাতাটাকে সুন্দরভাবে লিখে আসাই বড় কথা। কীরকম? উদাহরণ দিয়ে বলি। এই যেমন ধরো, অঙ্ক করার পর শেষে ‘হ্রস্ব-উ কোলন’ দেওয়া যাবে না, পুরোটা লিখতে হবে, মানে ‘উত্তর, এর পর কোলন চিহ্ন’। তার আগের লাইনে সুতরাং বা অতএব লিখে প্রশ্নে যা চাওয়া হয়েছে, মানে প্রশ্নের শেষ লাইনটা দেখে দেখে পুরোটা লিখে ফলাফলটা লিখতে হবে। সুতরাং-এর পর কমা দেওয়া যাবে না, অতএব-এর পর কমা দিতে হবে। ওই জায়গায় সুতরাং/ অতএব-এর চিহ্ন দেওয়া যাবে না, বানান করে পুরোটা লিখতে হবে। (1) নং লেখা যাবে না, লিখতে হবে (1) নং সমীকরণ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বাক্য)। কেউ একটুও ফাঁকিবাজি করতে গেলেই মার দিতাম। প্রতিবাদ করলে গার্ডিয়ান ডেকে কোচিং থেকে বের করে দিতাম। পরপর তিন ক্লাসে কেউ পড়া রেডি না করে কোচিং-এ এলে পরের ক্লাস থেকে সে আর আসতে পারবে না। সাইড-নোট অবশ্যই অবশ্যই দিতে হবে। একেবারে প্রতিটি সাইড-নোট। কোনওভাবেই নো শর্টকাটস! ভগ্নাংশের কাটাকাটি, একান্তরকরণ, পক্ষান্তর, একেবারে সব কিছু ভেঙে ভেঙে দেখাতেই হবে। সাইড-নোট লিখতে তৃতীয়-বন্ধনীর ভেতরে এবং বন্ধনী শুরুর আগে সেমিকোলন দিতে হবে, কমা নয়। বামপক্ষ সমান ডানপক্ষ লেখার আগে দুইটি পক্ষ পুরো লিখতে হবে, এর পর নিচে সুতরাং চিহ্ন দিয়ে লিখতে হবে ‘বামপক্ষ=ডানপক্ষ’, তার নিচে ডানদিকে প্রথম-বন্ধনীর ভেতরে প্রমাণিত/ দেখানো হলো (যেমনি করে প্রশ্নে চায়)। জ্যামিতিতে সাধারণ নির্বচন, বিশেষ নির্বচন ইত্যাদি লিখতে হবে নীলরঙের কালি দিয়ে, অন্য পৃষ্ঠায় (মানে বাম থেকে ডানে নয়, ডান পৃষ্ঠা থেকে উল্টিয়ে পরের পৃষ্ঠায় যাওয়ার ক্ষেত্রে) লেখা গেলে আবারও প্রাসঙ্গিক চিত্রটি এঁকে দিতে হবে। চিত্রটি নিখুঁত না হলেও চলবে, তবে স্যারকে যেন আগের পৃষ্ঠা উল্টে চিত্র দেখতে না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। বিজ্ঞানের নানান সংজ্ঞা লেখার সময় সরাসরি সংজ্ঞা লেখা যাবে না, তার আগে কিছু ভূমিকা লিখে দিতে হবে। সংজ্ঞার সাথে প্রাসঙ্গিক চিত্র, প্রতীক ও সংকেত, মাত্রা সমীকরণ, সমীকরণ ইত্যাদি লিখে দিতে হবে। একটা উপাদানের বিকল্প-নামটাও লিখে দিতে হবে, যেমন পাইরো-সারফিউরিক এসিডের যে আর এক নাম ধূমায়মান সালফিউরিক এসিড, তা অবশ্যই লিখে দিতে হবে। না লিখলে ভালোই শাস্তি পেতে হবে। এরকম আরও অসংখ্য ‘নির্যাতন’ চলতেই থাকত স্টুডেন্টদের উপর। ইয়োর প্রেজেন্টেশন মাস্ট হ্যাভ ইটস বিউটি! যদি এর কোনও অন্যথায় হতো, তবে নিষ্ঠুরভাবে মার্কস কাটতাম, সাথে বেতের প্রহার তো ছিলই! স্টুডেন্টদের কাছ থেকে আমার চাইতে বেশি মডেল টেস্ট, ক্লাস টেস্ট আর কোথাও নেওয়া হতো বলে আমার জানা নেই। আমি এমনভাবে পড়া দিতাম যেন পড়াগুলি রেডি করতে গিয়ে একজন স্টুডেন্টের পক্ষে ৫-৬ ঘণ্টার বেশি ঘুমানো সম্ভব না হয়। আজকের দিনে ওরকম ভূতের মতো পরিশ্রম করালে তো স্টুডেন্টরা নির্ঘাত ধরে পেটাত আমাকে! কোচিং-এ বসে বসে মশামারা ছাড়া করার মতো আর কোনও কাজ থাকত না। হা হা হা!
তাই বলছি, আমার সাথে নিজেকে মিলিয়ো না। তোমারটা তোমাকে বুঝতে হবে। এখন যদি আমাকে বলা হয়, অঙ্কের প্রিপারেশন নিতে কতক্ষণ লাগে? আমি হয়তো প্রশ্ন ও সিলেবাস দেখলে বলব, ও আচ্ছা, এক ঘণ্টা পড়াশোনা করলে ৫০-এ ৫০ পাব। কিন্তু সেটা তোমার ক্ষেত্রে নাও হতে পারে। আমি যে পরিশ্রম করেছি, তুমি সে পরিশ্রমটা হয়তোবা করোনি। তোমার জন্য সময়টা এক মাস বা এক বছরও হতে পারে। ব্যাপারটা একেক জনের জন্য একেক রকম। প্রিপারেশনের কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নাই আসলে…এটা ডিপেন্ড করছে তোমার বেসিকের উপর।


: আপনি দৈনিক কত ঘণ্টা পড়তেন, দাদা?
: কেউ এটা জিজ্ঞেস করবে আগে জানলে তো হিসেব করে করে পড়তাম। হা হা হা…আর শোনো…আমি কিন্তু ভালোই পড়তাম, যারা পড়াশোনা না করেই চাকরি পেয়েছেন, আমি ওদের দলে নই। যেহেতু ওই সময় আমার খেয়েদেয়ে করার মতো অন্য কোনও কাজ ছিল না, আবার আমার ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দিতে হয় নাই, আমি যথেষ্ট সলভেন্ট ফ্যামিলির সন্তান, তাই আমি খুব লাকি ছিলাম। কিছু বিজনেস করতাম, সেখান থেকে প্রচুর টাকা আসত। সেগুলিও ছেড়ে দিয়েছিলাম। প্রচুর টাকা লস হয়েছে! লস মানে কিন্তু ব্যাপক লস। পরিশ্রম করে আয়-করা অত টাকার লস সহ্য করে পড়াশোনা করা সহজ কথা নয় কিন্তু! তবু আমি তা মেনে নিয়েছিলাম। কেন, জানো? আমি ভাবলাম, এই আমি মাসে কামাই করি আড়াই থেকে তিন লাখের মতো। তো আমি যদি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনা করি ছয় মাস, তা হলে আমার কত টাকা লস হবে? ধরে নিলাম, আঠারো লাখ। (পরে অবশ্য আরও বেশি লস হয়েছিল, ওই যে শেয়ার ধ্বসের শিকার যারা হয়েছিল সে সময়, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।) আমার মনে হলো, একটা চাকরি পাওয়ার জন্য মাত্র আঠারো লাখ টাকার লস মেনে নেওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, আমি বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ওটাতে এতটাই ডুবে গিয়েছিলাম যে বিসিএস’টা না হলে কী করব, তার কোনও প্ল্যান আমার মাথায় ছিল না। মানে নো অলটারনেটিভ প্ল্যানস! হয়তো আবারও স্টুডেন্ট পড়ানোতেই ফিরে যেতাম। ওই কাজটা করতে খুব বেশি ভালো লাগত। যা-ই হোক, তো যেহেতু কোনও কাজটাজ ছিল না, তাই বাসায় বসে পড়াশোনাই করতাম। পড়াশোনা করার সেই সময়টা গড়ে কিছুতেই পনেরো থেকে ষোলো ঘণ্টার কম ছিল না। অনেক অনেক পড়তাম, ভূতের মতো পরিশ্রম করতাম, ঘর থেকে তেমন বের-টের হতাম না। ওইসব আড্ডা-ফাড্ডা মারা জিনিসটা আমার মধ্যে ছিল না। যখন আড্ডা মেরে সময়টা আনন্দে কাটাতে পারতাম, তখনই কোনও দিন আড্ডা মারিনি, আর ওই সময়টা তো ছিল রিয়েলি ক্রুশিয়াল সময়! আমি নিজেকে কখনও ফাঁকি দিইনি, জীবনকে একটুও উপভোগ করিনি। আমার কাজই ছিল আমার জীবন। আমার প্রতিদিন কাটত একটা নির্দিষ্ট ছকে, সে ছক থেকে বের হবার কথা মাথাতেও আনতাম না। নিজেকে অবিশ্বাস্য রকমের ব্যস্ত করে রাখতাম, স্টুডেন্ট পড়ানো, নিজে পড়া, মুভি দেখা, মিউজিক শোনা, টুকটাক লেখালেখি করা এসবের বাইরে কিছুই করতাম না। নিজেকে অসীম কষ্টের মধ্যে রেখেছি বহু বহু দিন। এটা ভুল ছিল হয়তো, তবে আজকের দিনে নিজের দিকে তাকালে সেই পরিশ্রমী তরুণটির প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতাও কাজ করে। আমি জীবনকে ঠকাইনি, জীবনও আমাকে ঠকায়নি। সিম্পল!


: আপনি কি প্রথমবারেই ক্যাডার হয়েছেন?
: হ্যাঁ, আমি লাইফে একটাই চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি। আর কোনও চাকরির পরীক্ষা দিইনি। আমার তো চাকরি করারই ইচ্ছা ছিল না, বিজনেস করার ইচ্ছে ছিল। বিজনেস করতে পারিনি, তাই চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় হয়েও গেছে! আর ভালো কথা, প্রথমবারে চাকরি পেয়েছে, এমন লোকের সংখ্যাই বেশি কিন্তু! তোমরা এটা নিয়ে নিশ্চিত থাকতে পার যে বাংলাদেশে এখনও যে কয়েকটি ফেয়ার জব রিক্রুটমেন্ট পরীক্ষা আছে, সেগুলির মধ্যে বিসিএস একটি। তাই তোমরা যদি সময়টাকে ঠিকভাবে কাজে লাগাও, তবে চাকরি পাবেই পাবে। ফাঁকি দিয়ো না, মধ্যবিত্তের জীবনটা ফাঁকি দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য নয়। ফাঁকি দিলে এর ফল পাবেই পাবে। আমি ফাঁকি না মেরেও যতজনকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেছি, তার চাইতে অনেক অনেক বেশিজনকে দেখেছি ফাঁকি মেরে ধ্বংস হয়ে যেতে। আর ফাঁকি না দিলে যে ভালো কিছু হবেই, তা নয়, তবে নিজের আত্মবিশ্বাসটা নষ্ট হয়ে যাবে না। কখনও এমন কিছু কোরো না যাতে দিনের শেষে নিজেকে ক্ষমা করা না যায়!


: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জব রিক্রুটমেন্টে ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্টদের জন্য সুযোগসুবিধা কতটুকু? কোন সেক্টরটাতে এদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত? ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার সম্পর্কে কিছু বলুন।
: প্রথম কথা হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার সম্পর্কে আমার তেমন কোনও আইডিয়া নাই। কারণ, আমি তো ওই ক্যারিয়ারে যাইনি, আমার বন্ধুরা গিয়েছে। যারা গিয়েছে তাদেরকে দেখছি, তারা খুব ভালো আছে, সত্যিই ভালো আছে। আমাদের বন্ধুবান্ধব যারা সিএসই-তে ছিল, তারা অনেকেই এখন স্যালারি ড্র করে সিক্স-ফিগারের। অন্যরাও বেশ ভালোই আছে। সিক্স-ফিগার বোঝ তো? (অনেকেই বোঝে না, জানাল।) সিক্স-ফিগার তো বুঝতে হবে। সিক্স-ফিগার মানে কী? মিনিমাম এক লাখ টাকা বা তার চেয়ে বেশি বেতন আরকি। তো অনেকেই সিক্স-ফিগার ড্র করে, অনেকে বিজনেস করে, নিজেরা কিছু না কিছু করে অনেকেই সিক্স-ফিগার কামাই করে। সো ওরা খারাপ আছে, আমার তো মনে হয় না। আর যারা দেশের বাইরে চলে গেছে, তাদের তো বিশাল অবস্থা। আমার এক বন্ধু মাসে ১৭ লক্ষ টাকা স্যালারি পায়। সে অস্ট্রেলিয়ায় একটা ব্যাংকে চাকরি করে। ১৭ লক্ষ টাকা! ভুল শোনোনি, ঠিকই শুনেছ। ও বুয়েটে পড়ত। কী কী জানি প্রফেশনাল ডিগ্রি নিয়েছে সে। আমরা যারা দেশে বসে আছি তারা বলি না, ওরা অনেক খারাপ আছে, ওদের অনেক কষ্ট করতে হয়, এসব কথাবার্তা হচ্ছে বেকুবের আত্মতুষ্টি, আর কিছু নয়। যারা যেতে পারে না সামর্থ্য বা সুযোগের অভাবে, তারাই এসব বেশি বলে। আমি যতটুকু জানি, ওরা কেউ খুব একটা খারাপ নাই। যে যেভাবে করে থাকে, ভালোই থাকে। আবার অনেকের পক্ষেই বিদেশে যাওয়া সম্ভব নয়। হয়তো ফ্যামিলিকে দেখতে হবে তাকে, তার বাবাটা অসুস্থ, তাঁর পাশে থাকতে হবে। কিচ্ছু করার নাই। এটা ডিপেন্ড করে যার যার ইচ্ছা, সুবিধা, সামর্থ্য, সুযোগ এগুলোর উপর।
আর একটা বলি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেই ওই লাইনেই যেতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। গ্রাজুয়েশন করলে আমরা একটা সার্টিফিকেট পাই, সে সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরির পরীক্ষায় বসা যায়। ভার্সিটি বা কলেজ হচ্ছে জাস্ট অ্যা গ্রুমিং-গ্রাউন্ড, এর বেশি আর কিছুই নয়। ডাক্তারি পড়লেই ডাক্তারি করতে হবে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেই ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এসব চিন্তাভাবনার দিন শেষ। যে যেভাবে চললে ভালো থাকে, কিছুটা সন্তুষ্টি নিয়ে বাঁচতে পারে, সেভাবে চললেই ভালো। কে কী বলল, ওতে কিছুই এসে যায় না। যার যার জীবন তার তার। সুখী কে? কেউই না আসলে। খোঁজ নিয়ে দেখো। তবু এর পরেও কথা থাকে। সুখ না মিলুক, কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আর তৃপ্তি থাক জীবনে। এটার জন্য যা যা করা দরকার, তা তা করতে হবে। শোনো বলি, পৃথিবীকে বদলে দেয় যারা, তেমন মানুষ প্রতি ৫ বছরে ১০ জন আসে বলে যদি ধরে নিই, তবে এটা তো শিওর যে তুমি আমি সেই ১০ জনের মধ্যে নেই। তো আমাদের এত টেনশন কীসের? কীসের এত পিছুটান? আমরা কেউ এত অপরিহার্য কিছু না। সো, নো টেনশন। নিজের মতো করে বাঁচো!


: তারপর দাদা, আপনার ফিলসফি কী? নিজেকে জানা?
: নিজেকে জানাটা আসলে সারাজীবনেও সম্ভব হয় না। আমরা কি জানি আমরা কী? ওটা যদি জানতাম তবে আমরা বারুদ হতাম, বুঝলে…বারুদ! আমরা জানিই না আমরা যে কী। তুমি জানোই না তুমি কী! তুমি জানো না তোমার ক্যাপাসিটি কতটুকু। আমরা হয় নিজেকে ওভারএস্টিমেট করি অথবা আন্ডারএস্টিমেট করি। প্রোপারলি নিজেকে এস্টিমেট করার সুযোগ হয় না আমাদের। অত বুদ্ধি বা জ্ঞানও নেই আমাদের। নিজেকে জানাটা খুব টাফ! আমরা মুখে বলি, আমি দেখায়ে দিব। দেখিস, একদিন আমি দেখায়ে দিব। আরে ভাই, দেখায়ে দিতে হলে কাজ করে হয়। কাজ করো। ওই কাজটাজ আর করা হয় না। মুখে কিছু একটা বড় কথা বলেই খালাস, এমন হলে হবে না। জেদ এটাকে বলে না। জেদের মধ্যে---ভালো হয় মুখটা না থাকলে। মুখটা ভেতরে থাক। তোমার কাজ বলে দিবে তুমি কী করতে পার কী করতে পার না। তোমার কাজকে তোমার কথা বলতে দাও। মুখে বলে কী হবে রে ভাই? মুখে তো বলাই যায়, দুম্‌ করে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দেওয়াই যায়, তাই না? এই দুনিয়ায় যার কিছু নাই, তারও একটা ফেসবুক আইডি থাকে, সেখান থেকে সে ইচ্ছামতো রাজা-উজির মারতে পারে। কী ভাই, তোমার বাসার কাজের বুয়ার ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নাই? তিনিও স্ট্যাটাস মারেন না…সবারই একটা অতীত থাকে…ফিলিং অসাম! সেদিন একটা টিভিসি দেখছিলাম, ওখানে খুব সুন্দর একটা কথা ছিল, ‘তোমরা যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানো না, দেশ সম্পর্কে জানো না, ওই চেতনা ধারণ কর না, কিন্তু যদি এখন আর একটা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তবে তোমরা কী করবে? ফেসবুকে বড় বড় স্ট্যাটাস দিবে…এই মুক্তিযুদ্ধ আমরা চাই না…এই সেই, হ্যানত্যান বা এই যুদ্ধ আমরা চাই না, আমরা শান্তি চাই…মুখে যে যা-ই বল না কেন, আসলে মার তো খেতে হবে ঠিকই। ওই সময়ের প্রিপারেশন থাকতে হবে। এই যাহ্‌!
আমার জীবনের ফিলসফি কী, সেটা নিয়ে বলতে গেলে রাত পার হয়ে যাবে। অল্প কথায় বলি, কেমন? এই ধরো, যদি আমার মৃত্যুর পর আমার সমাধি বা কবরের গায়ে কোনও কিছু লেখা থাকে, তবে নিচের কথাগুলির যেকোনওটিই লেখা থাকতে পারে, অন্তত আমি তা চাই---
১. এ মানুষটি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত একজন মানুষেরও ক্ষতি করেনি।
২. এই মানুষটি খুব ধনী ছিল না, কিন্তু খুব মানবিক ছিল।
৩. এ মানুষটির নিজের জীবন গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, সেখান থেকে নিজের চেষ্টায় উঠে এসে সে লাখো মানুষকে সাহসী হওয়ার ও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে।
৪. এ মানুষটি তার স্বপ্নের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল। মরতে মরতেও সে কখনও হার মানেনি।
৫. এ মানুষটি তার মৃত্যুর সময়ও, সে যাদেরকে ভালবেসেছে, তাদেরকে দেখতে চায়নি, বরং যারা এই মানুষটির অনেক ভুলকে ক্ষমা করে, তার সমস্ত অক্ষমতাকে মেনে নিয়ে তাকে ভালোবেসেছে, তাদেরকেই দেখতে চেয়েছে।
৬. মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই মানুষটি যাদের উপকার করার সুযোগ পেয়েছে, উপকার করার পর, তাদের সাথে আর কোনও দিনই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি।
৭. মৃত্যুর আগে এই মানুষটি তার জীবনে আসা অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করেছে যারা তার অনেক ক্ষতি করেছে।
৮. মৃত্যুর পর এই মানুষটির কাছ থেকে পৃথিবীর একজন মানুষেরও একটি টাকাও পাওনা ছিল না।
৯. বেঁচে থাকার সময় এই মানুষটি কোনও দিন কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করেনি এবং কোনও না-পাওয়া নিয়ে কোনও দিন আফসোস করেনি। পৃথিবীর কোনও ব্যক্তির কোনও কিছুর উপরেই এই মানুষটার কোনও লোভ ছিল না।
১০. মরে যেতে যেতে সে তার চোখ দুটি রেখে গেছে কোনও অন্ধের জন্য।
…আমি আমাকে এভাবেই জানি, এ ভাবনাগুলোর সাথেই আমি বাঁচি। আপাতত এগুলিই আমার স্বপ্ন।


: আপনার তো কোচিং ছিল, তা হলে পড়াশোনার সময় কীভাবে বের করেছেন?
: আরে পড়াশোনা করতাম নাকি? পড়াশোনা করলে কি আর ২.৭৪ সিজিপিএ হয় আমার! ওই রেজাল্ট করা তো টাফ, অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা না করে বসে থাকতে হয় ওটা পেতে চাইলে। হা হা হা! সিএসই’তে কিন্তু ৩ পাওয়া কোনও ব্যাপারই না। আমি পড়ি নাই, তাই পাই নাই। যা পেয়েছি, সেটাই বেশি। বোঝ না আমি কী করেছি? পড়িনি, পড়িয়েছি শুধু…স্টুডেন্ট পড়িয়েছি। আর স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়ে নিজের বেসিকটা শক্ত হয়ে গিয়েছিল। জবের জন্য ম্যাট্রিক-ইন্টারের বেসিকটা খুব কাজে লাগে। তো ওটা আমার খুবই ভালো ছিল। আমি অনেক কিছু পারতাম না, তবে যা আমার পারা দরকার, তা পারতাম, ভালোই পারতাম। তাই সমস্যা হয়নি। তখন তো মনে হতো, কী যে করছি, জীবনটাকে নিজের হাতে ধ্বংস করছি! সবাই বলত, তোমার কত ব্রাইট একটা ক্যারিয়ার, স্টুডেন্ট পড়িয়ে পড়িয়ে নষ্ট করে দিচ্ছ! আমার নিজেরও এক এক সময় মনে আসত, সত্যিই ভুল করছি বোধহয়। আজ বুঝতে পারি, জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা…


: জবের জন্য কী করেছেন?
: আমার তো জব করারই ইচ্ছে ছিল না। বিজনেস করতাম। ভালোই ছিলাম নিজের মতো করে। আমি কিন্তু গরীব ছিলাম না, ভাই। অনেক টাকা কামাই হতো বিজনেস থেকে। আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার কম না প্রতি মাসে। কিন্তু আমার যে সমস্যাটা ছিল সেটা হচ্ছে, কেউ আমাকে পাত্তা দিত না, ভাই। আইডেনটিটি ক্রাইসিস যেটাকে বলে আরকি, মানে পোশাকি ভাষায় ‘পরিচয়ের সংকট’, ওটা আমার ছিল। আসলে কারও কাছ থেকে পাত্তা না পাওয়া খুব বিশ্রী একটা ব্যাপার। যারা কারও কাছ থেকে পাত্তা না পেয়েও দিব্যি ভালো আছে, তারা আসলে বেঁচে থাকাটাকে কোনও না কোনওভাবে ম্যানেজ করে বেঁচে আছে। সহজ নয় ব্যাপারটা। তুমি বলতে পার, আরে ভাই, আমাকে পাত্তা না দিলে কী হয়েছে, আমার তো টাকা আছে। কিন্তু ভাবো তো, তোমার জন্য তোমার মা-বাবাও কষ্ট পাচ্ছে, এটা দেখাটা খুব কষ্টের। খুবই কষ্টের! যদি ওদের ভালোবেসে থাকো, তোমার খুব কষ্ট হবে। ওরা তো কিছু এক্সপেক্ট করে তোমার কাছ থেকে। এটাই স্বাভাবিক। যদি তোমার শরীরে মানুষের রক্ত প্রবাহিত হয়, তা হলে ওরা তোমাকে পূরণ করতে হবে। যদি তা না পারো, তবে তুমি মানুষই না! যেমন আমার হয়েছিল কী, তখন আমি অনার্স কমপ্লিট করছি না। বাবা বলছে, মা বলছে কিন্তু আমি কারও কথাই শুনছি না। অনার্স কমপ্লিট করবই না, সত্যিই আমার ইচ্ছাই ছিল না করার। মানে আমার আসলে এত দিনে ইন্টারমেডিয়েট-পাস হওয়ার কথা। হা হা হা! পড়াশোনা ওখানেই থেমে যাওয়ার কথা, অন্তত আমার ওরকমই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু দেখো! সেই আমি মাস্টার্সও পাস করে ফেলেছি। আমার তো এগুলো করার কথা ছিল না। তো ওই সময়টাতে এগুলো কাজ করত আমার মধ্যে। মানে আমি আমার সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করতাম না, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, ভার্সিটিতে ফেল করা খুব কষ্টের, চাইলেও সহজে ফেল করা যায় না। পরীক্ষা দিলে স্যাররা সি অথবা ডি দিয়ে দেয় আরকি, ভাবেন, বেচারা পরীক্ষা দিয়েছে কষ্ট করে, আচ্ছা কিছু একটা দিয়ে দিই। এই ধরো, আমাকে যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করে এরকমভাবে যে---তুমি যে ২.৭৪ পেয়েছ, এটা কি তুমি আর্ন করছ? আমি বলব, নো নো নো…আমাকে দয়া করে দেওয়া হয়েছে এটা! আমার কাছে মনে হয়, স্যাররা খুবই ভালো আসলে। আমি পড়াশোনা করি নাই, তাই ২.৭৪ পেয়েছি, কিন্তু আমার এর চেয়ে ভালো পাওয়ার ক্ষমতা ছিল। আমি অ্যাডমিশন টেস্টে খুব ভালো করেছিলাম, সেকেন্ড হয়েছিলাম। পরে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি। আবার যখন বেরোচ্ছি তখনও সেকেন্ড ছিলাম, পেছন দিক থেকে আরকি। হা হা হা! এটাই ছিল কাহিনি, তবে এটার কারণও ছিল। সেটা হচ্ছে, আমি পড়াশোনা করি নাই। কেউ কেউ পড়াশোনা করেও আশানুরূপ ফলাফল করতে পারে না, আর আমি পড়াশোনা না করেও আশাতীত ফলাফল করেছি। স্যাররা মহান!
আর একটা কথা। চাকরি-বাকরি পাওয়ার জন্য মাথায় কিছু থাকা লাগে। আমার এক বন্ধু আছে, সে একটা লিডিং পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে ওদের ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া ছাত্র। সে কিন্তু দুইবার প্রিলি দিয়ে ফেল করেছে। কারণটা কী ছিল, জানো? সে এক ম্যাথ ছাড়া আর কিছুই পারত না…একেবারে নাথিং। শুদ্ধভাবে ইংরেজি লিখতে পারত না, আর ইংরেজি একেবারেই না পারলে চাকরি পাওয়া সহজ নয়। এক ম্যাথ নিয়ে তো আর চাকরি হবে না, তাই না? আমার অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার হাল ছিল বেহাল, তবে চাকরির জন্য দরকারি পড়াশোনা যা, তা কিন্তু জানতাম। গ্রামার পারতাম, ভোকাবুলারি পারতাম, ম্যাথ পারতাম, বিজ্ঞান পারতাম, বাংলা পারতাম। লেখালেখি করতাম তো, তাই ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিং-এ বেশ ভালো ছিলাম। মানে, চাকরির পরীক্ষায় যেগুলো লাগে সেগুলো আমি পারতাম। তখন লিখতে পারতাম রে ভাই, একদম ফাটায়ে লিখতে পারতাম। যেমন ধরো, এই সামনের গাছটা নিয়ে লিখতে বললে…আমি হয়তো এই গাছের নামই জানি না, কিন্তু অনায়াসেই বিশ পেইজ লিখে ফেলতে পারব। এখন এই মুহূর্তে পারব, থামতে না বলা পর্যন্ত লিখতে পারব। কোনও অসুবিধা হবে না, ওই ক্যাপাসিটি আমার তখনও ছিল। এটা কাজে লাগে এবং আমার খুব কাজে লেগেছে এটা। এজন্য তোমাদের বলি, তোমরা টুকটাক ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিং করো, ভোকাবুলারিটা একটু বাড়াও, গ্রামারটা বোঝার চেষ্টা করো, ম্যাথের বেসিকটা স্ট্রং করার চেষ্টা করো। দরকার হলে বিনে পয়সায় স্টুডেন্ট পড়াও, এটা খুব কাজে লাগবে, খুব। স্কলারশিপগুলো কীভাবে হয়, জানার চেষ্টা করো। কারণ একটাসময় যখন দেখবে সবাই অ্যাপ্লাই করা শুরু করেছে, তখন কাজে লাগবে। তোমার যে বন্ধুটা বুয়েটে পড়ে, সে কিন্তু সেকেন্ডইয়ার থেকে জানে কীভাবে জিআরই, জিম্যাট, আইইএলটিএস পরীক্ষা দিতে হয়, কিন্তু তুমি জানো না। ফোর্থইয়ার শেষে যখন সবাই বের হবে, তখন পিছিয়ে থাকবে তো, ভাই…আচ্ছা, তোমাদের তো সেশনজ্যাম নাই, তাই না?
: একটু আছে।
: আচ্ছা, এটা কোনও ব্যাপার না! বুয়েটেও হালকা-পাতলা আছে। বেশি আছে কি না আমি জানি না। যখন তোমরা একসাথে পাস করে বের হবে, তখন কিন্তু দেখবে, সে তোমার চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। যে সময়টা তুমি নষ্ট করেছ, তার খেসারত তোমাকে দিতে হবে। ওটা একটু মাথায় রেখো। যাতে খেসারত দিতে না হয়, সেই ব্যবস্থাগুলো করো, কাজে লাগবে খুব। জীবনে আনন্দ তো করবেই, কিন্ত অসময়ে আনন্দ করলে সময়ে কষ্ট পেতে হয়। যখন কষ্ট করার সময়, তখন মজা করবে, ফুর্তি করবে, ঘুমাবে আরাম করে, আর তার জন্য পরে লাথিটা খাবে না, তা তো হয় না, ভাই! এটা একটু মাথায় রেখো। তোমাদের কিন্তু এখন ফাইট করার সময়। তোমরা হয়তো বলতে পার, ভাই আপনি কি ফাইট করছেন? না, আমি ওই সময় ফাইট করছি হুদা-কামে। পরে দেখলাম, ওগুলোই আমার খুব কাজে লেগেছে। আমি কিন্তু তোমাদের বয়সে আড্ডা দিয়ে, ঘোরাঘুরি করে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় পার করিনি, এটা পূর্ণসততা নিয়ে বলতে পারি। টিউশন করিয়েছি, ব্যাচের পর ব্যাচ পড়িয়েছি, সীমাহীন পরিশ্রম করেছি, আমার বেসিকটা খুব ভালো ছিল। আমার সাথে যারা পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের অনেকের চাইতেই ভালো ছিল। আমি পারতাম না কেবল সাধারণ জ্ঞানটা। ওটার পেছনে অনেক সময় ও শ্রম দিতে হয়েছে। আর টিউশনটা কাজে লেগেছে। আমি ওটাকে খুব কাজে লাগিয়েছি। আমার ভালো হয়েছে ওটা করে। তোমরা ভেবে দেখো, তোমরা কী করবে। তোমাদের সামনে অনেক অনেক ট্র্যাক খোলা আছে। ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে আমার অভিধানে উচিত বা অনুচিত বলে কিছু নেই। আমার এক বন্ধুর কথাই বলি। ঢাকায় একটা প্রতিষ্ঠান আছে, কী জানি নাম, ধানমন্ডিতে। ওরা এসিসিএ পড়ায়, আইইএলটিএস পড়ায়, জিআরই-জিম্যাট পড়ায়, ইংলিশ মিডিয়ামের ব্যাচ-ট্যাচ পড়ায়, এগুলোই পড়ায়। আমার সেই বন্ধুটা ওখানকার টিচার। বাসায় ব্যাচ পড়ায় ইংলিশ মিডিয়ামের, এসিসিএ-এর স্টুডেন্ট পড়ায়, এসবই করে। সে মাসে কামাই করে বারো লাখ টাকা। ও বিসিএস দিয়েছে তিনবার, কিছুই হয় নাই, মানে প্রিলিই পাস করতে পারেনি। ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়েছে, চাকরি হয় নাই। পরে ঠিক করল, মাস্টারিই করবে সে এবং ওই লাইনে তার ক্যারিয়ারটা তৈরি করল। সে খুব ভালো আছে। বছরে তিন মাস বিদেশে ঘুরে, নয় মাস কাজ করে। বছরে কামাই করে এক কোটি টাকার উপর। পয়সা খরচ করার মতো কোনও স্কোপই পায় না সে। কত আর পয়সা খরচ করা যায়! সে নিয়মিত ট্যাক্সও দেয়। রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে ওয়েটারকে বকশিস দেয় টোটাল বিলের পনেরো পার্সেন্ট! একেবারে থাম্বরুলের মতো ফলো করে সে ব্যাপারটা। তোমাদের এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, ষ্ট্যাণ্ডার্ড প্র্যাকটিস হলো, যদি কোনও রেস্টুরেন্টে সার্ভিস-চার্জ আলাদা করে না ধরে, তবে টোটাল বিলের টেন পার্সেন্ট বকশিস দেওয়া। এটা কিন্তু একটা অলিখিত নিয়ম। বাইরের দেশে এটা খুব ফলো করা হয়। তো এজন্যই বললাম, কার ক্যারিয়ার কোন দিকে হবে, এটা কেউ বলতে পারে না। কে কোন কাজটা করে ভালো থাকবে, সচ্ছল জীবনযাপন করবে, এটা কিন্তু জানি না আমরা। এটা একটু ভাবো, এটা খুব মন দিয়ে ভাববার মতো একটা ব্যাপার।