দেখা না-দেখায় মেশা হে জীবন/ এক

 
পাবনায় গিয়েছিলাম, ঘুরতে। বন্ধু শোয়েবের বাড়িতেই থাকি পাবনায় গেলে। ওর বাড়ির পাশে সুচিত্রা সেনের বাড়ি, তাই থাকি। ও আমাকে নদী দেখাতে নিয়ে যায়, তাই থাকি। ওর বাড়িতে এক ধরনের ভালোবাসা পাই, তাই থাকি। ওর সাথে গল্প করলে এক ধরনের ভালো অনুভূতি হয়, তাই থাকি। তো যা-ই হোক, গতবার (মনে নেই, কখন। আমার বেশিরভাগ ঘটনার সময় মনে থাকে না।) পাবনায় যাওয়ার পর শোয়েবের অনুরোধে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের অডিটোরিয়ামে কিছু মানুষের সামনে কিছু কথা বলেছিলাম। বোধহয় সেদিনই আরও কিছু কথা বলেছিলাম পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। আমার মানুষের সামনে কথা বলতে ভালো লাগে। সেদিনের কথাগুলির কিছু আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। কেউ একজন কিছু কথা রেকর্ড করে রেখেছিলেন। কে, মনে নেই।

: একটা মেয়েকে আমি খুব ভালোবাসতাম। সেও আমাকে ভালোবাসত, এখনও বাসে। মানে আমাদের মধ্যে রিলেশন আছে আরকি! কিন্তু ওকে আমার আর ভালো লাগছে না। ওকে এটাই বোঝাতে পারছি না। ও আমার সাথেই থাকতে চায়। আমি সেটা চাই না। আমি এখন কী করব?
: ওর সাথে থাকতে চাও না, ভালো কথা। ওকে এটা বুঝিয়ে বলো। কারও সাথে থাকতেই হবে, এমন তো নয়। বুঝিয়ে বলার অনেক টেকনিক আছে। আর তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক আছে যেহেতু, সেহেতু ও কিন্তু তোমার কাছ থেকে কিছু না কিছু এক্সপেক্ট করে, এবং এরকমই হওয়ার কথা। তুমি এটা এড়াতে পার না। যদি এড়িয়ে যাও, তবে তুমি হিউম্যান বিইং-ই না আসলে। মেয়েটাকে ইগনোর করলে তোমাকে সাফার করতে হবে। তুমি এটার জবাব পাবেই পাবে। আর একটা কথা। তুমি বললে…ভালোবাসতাম।…এটা কেমন কথা, ভাই? ‘ভালোবাসতাম’ কী আবার? ভালোবাসার কোনও পাস্ট টেন্স হয় না, ভালোবাসা সর্বদাই প্রেজেন্ট টেন্স। যাকে তুমি একবার সত্যিই ভালোবেসে ফেলো, তাকে ভালোবাসা আবার বন্ধ করে দেওয়া যায় নাকি? ভালোবাসার কোনও অফ-অন সুইচ হয় না। যদি এমন হয়, কাউকে তুমি আজকে ভালোবাস, কালকে আর বাসো না, তবে আমি বলব, আজকের ব্যাপারটা আসলে ভালোবাসাই নয়, এটা স্রেফ সম্পর্ক। আমরা সম্পর্ককে ভালোবাসা ভেবে ভুল করি। সম্পর্ক অতীত হয়ে যেতে পারে, ভালোবাসা কখনওই অতীত হয়ে যায় না। কাউকে পাইনি বলেই তার প্রতি ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যায় যদি, তবে সেটা ভালোবাসা নয়, সেটা স্রেফ সম্পর্ক। পেলাম কি পেলাম না, তা বিবেচনা করে ভালোবাসা হয় না। মনে রেখো, যে কারও সাথেই সম্পর্কটা হতে পারে, ভালোবাসা কিছুতেই নয়।

: ভাইয়া, পড়তে ভালো লাগে না। আসলে, আমার কিছুই করতে ভালো লাগে না। আমি কী করব?
: ঢং কম করো। আড্ডা দিতে, ঘুরে বেড়াতে তো ভালো ঠিকই লাগে। এই যে তুমি আড্ডা দিচ্ছ, দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছ, ইটস ওকে, ফাইন! কিন্তু দেখো, যারা সময়মতো সব কিছু না করে, সময় হারিয়ে গেলে তাদের কিন্তু পস্তাতে হয়। এই সব সেকেলে বুকিশ কথাবার্তা, তবু আজও সত্যি। একটা সময় আসে যখন মানুষের ধৈর্য ও বেশি পরিশ্রম করার মানসিকতা, দুইই কমে যায়। তখন কাজটা, হতে পারে সেটা পড়াশোনা কিংবা অন্য কোনও জরুরি কাজ, করা তোমার জন্য কঠিন হবে, দিনে দিনে আরও কঠিন হবে। কারণ কী, জানো? কারণ হলো, তোমার যারা প্রতিযোগী, যারা তোমার সাথে কমপিট করবে, তারা এখন অনেক সেয়ানা। লোকজন এখন বোকা না, খুব চালাকচতুর হয়ে গেছে, বুদ্ধিমান হয়ে গেছে, কেউই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে না, কিছু না কিছু করে, তো তুমিও করো কিছু না কিছু। চেষ্টা করো কিছু না কিছু করার জন্য…টিউশনি করো, বই পড়ো, অঙ্ক-ইংরেজির বেসিক ঠিক করো, নিজেকে ক্রমাগত আরও উন্নত করে তুলো। তুমি আরাম করে রাস্তায়-ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াবে, মনের সুখে প্রেম করে বেড়াবে, স্টুপিডের মতো শুয়ে-বসে সময় কাটাবে, আর ভূতে এসে তোমাকে চাকরি দিয়ে যাবে…ফাজলামো পেয়েছ, না? তুমি যখন আরামে আছ, তখন তোমার কোনও না কোনও বন্ধু নিজেকে তৈরি করছে। ফলে পাস করার পর চাকরিটা সে-ই তোমার আগে পাবে, আর তুমি আরও কয়েক বছর ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবে, কপাল চাপড়াবে…এটাই তো স্বাভাবিক। প্রতিদিন তুমি তোমার বন্ধুর চাইতে তিন ঘণ্টা বেশি পড়ো, তবে তুমি তার চেয়ে তিন বছর আগে চাকরিটা পাবে। এমনটা হবেই, তা বলছি না, তবে এটা মাথায় রাখলে নিজেকে গুছিয়ে নিতে সুবিধে হবে। এ-ই আরকি, বোঝ তো সবই, তবু নিজেকে অথর্ব বানিয়ে রাখছ। অনেক বেশি কথা বলে ফেললাম, তাই না? সরি, কেমন?
: না না না…ভালো লাগছে।
: বলো, তোমাদের আরও কিছু জানার বা শোনার থাকলে বলো। আমার জন্য কোনও পরামর্শ থাকলে বা তোমার মনের কোনও কথা শেয়ার করার থাকলে তাও বলো।

: দাদা, আপনার পছন্দের কিছু নন-ফিকশন বইয়ের নাম যদি বলতেন…
: নন-ফিকশন বইগুলোর মধ্যে আমার সবচাইতে পছন্দের হচ্ছে মোটিভেশনাল বই। আমি প্রচুর মোটিভেশনাল বই পড়তাম। এখন পড়ি না খুব একটা, চাকরি সংসার লেখালেখি করে বইপড়ার সময় পাই না, শুধু কিনে কিনে ফেলে রাখি। তবে হ্যাঁ, একটা সময় পড়তাম প্রচুর। আর প্রবন্ধ পড়তে ভালো লাগে, সহজ গদ্য ভালো লাগে, কবিতা ভালো লাগে, ফিল্ম নিয়ে লেখা ভালো লাগে। এরকম আরও কিছু আছে। ভালো কথা, সাক্ষাৎকার পড়তে ও শুনতে আমার দারুণ লাগে। আমি সায়েন্স ফিকশন পড়ি না---বিরক্ত লাগে, রাজনীতি নিয়ে লেখা কোনও কিছুই আমি পড়ি না---অতিবিরক্ত লাগে। অ্যাকচুয়েলি, দিজ আর নট মাই কাপ অব টি। তার পর…বায়োগ্রাফি খুব ভালো লাগে। গ্রেটম্যানদের বায়োগ্রাফি পড়ার জন্য আমার কোনও একটা লেখায় বলেছিলাম। এটা পড়তেও খুব ভালো লাগে এবং ভীষণ কাজেওদেয়। আর বায়োগ্রাফি পড়ার সময় একটা জিনিস করতে আমার খুব ভালো লাগে, সেটা হলো, ওঁরা যে কাজটা করে গ্রেট হয়েছে, সে কাজের সেই ধরনটা, মানে ওঁদের ধরনটা আমি অনুকরণ করার চেষ্টা করি। অনুসরণ নয় কিন্তু, একেবারে অনুকরণ করার চেষ্টা করি। কপি-পেস্ট আরকি! মানে হলো, নিজের সকল বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতাকে ভেঙে ওঁদের মতো করে নিজেকে কাস্টমাইজ করে নিই। কাজটা কঠিন, আমি জানি। এও জানি, জীবনের জরুরি কাজগুলির প্রায় সবকটাই ভীষণ কঠিন। ওঁদের লাইফের কিছু ডার্ক-সাইড থাকে, প্রত্যেকটা মানুষেরই লাইফের কিছু ডার্ক-সাইড থাকেই। ওই জিনিসগুলো নিয়ে মাতামাতি করতে আমার কোনও দিনই ভালো লাগেনি, এখনও লাগে না। বরং ওঁদের আলোকিত দিক যেগুলো, সেগুলো নিয়ে আমি ভাবি। চেষ্টা করি ওঁদের মনের মধ্যে ঢুকে পড়তে, ওঁদের মতো করে ভাবতে, ওঁদের অনুকরণ করতে। তো এটা করে দেখতে পার, ভালো লাগবে। আর মোটিভেশনাল বই খুবই হেল্প করে। কারণ আমরা তো আসলে জাতিগতভাবেই হতাশ, জাতিগতভাবেই বিমর্ষ ও বিষণ্ণ। আমরা যেদিকেই তাকাই, সেদিকেই অন্ধকার দেখতে পাই। তাই আলো দেখতে চাইলে সবার আগে নিজের মনের ভেতরের আলোটা জ্বালাতে হবে। তোমাকে কেউ আলো জ্বালিয়ে দেবে না, কারণ আলো জ্বালানোর মতো কেউ নেই তো! আলোর জন্য কারও কাছে ধরনা দিয়ো না…আরে ভাই, ওর নিজেরই তো আলো নাই, তোমারটা জ্বালাবে কোথা থেকে? এজন্যই আলোটা ভেতর থেকে জ্বালাতে হবে। আর ভেতর থেকে আলো জ্বালাতে হলে ভেতরটাকে আগে জাগাতে হবে। ওই জাগানোর জন্যই বই পড়তে হবে, ভালো কিছু লেকচার শুনতে হবে। Ted Talks দেখতে পার। এটা খুব ভালো জিনিস। তোমাদের মধ্যে কেউ দেখ কি না আমি জানি না। এই তো! আর এর পর বলো, তোমাদের কাছ থেকে শুনি।

: আমি একজনকে ভালোবাসি। অনেক বেশিই ভালোবাসি। কিন্তু সে আমাকে এখন আর ভালোবাসে না। সে চায় ব্রেকআপ করে ফেলতে। অতীত ভুলে সামনের দিকে হাঁটতে চায়। আমার পক্ষে এটা করার চাইতে মরে যাওয়াও ভালো। আমি কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। আমি কী করব?
: মরতে ইচ্ছা করলে মরে যাও। এটার সাথে তোমার রিলেশনকে জড়িয়ো না। মৃত্যু নিজেই খুব রোম্যান্টিক ও মহৎ একটা ব্যাপার। স্বেচ্ছামৃত্যুর সাথে প্রেম-ভালোবাসার কোনও সম্পর্ক নেই, ইচ্ছে-অনিচ্ছের সম্পর্ক আছে। আর কাউকে ভালোবাসলে তার সাথে থেকে যেতেই হবে, এই অদ্ভুত থিওরি তুমি কোথায় পেলে? সে তোমায় ভালোবাসে না, এটা তো মনে হয় বুঝতে পেরেছ, তাই না? তো তাকে অযথা পেইন দেওয়ার কী মানে? কিছু সম্পর্ক তৈরিই হয় ভেঙে যাওয়ার জন্য। মেনে নাও এটা। এই সম্পর্ক থেকে তুমি এক কষ্ট বাদে আর কী পাবে? তুমি যে জোর করে তাকে ধরে রাখতে চাইছ, সেও ব্যাপারটা নিয়ে বিরক্ত, তুমি বুঝতে পারছ না এটা? লজ্জা করে না ওকে দিনের পর দিন বিরক্ত করতে? তোমার আত্মসম্মানবোধ নাই? কাউকে কিন্তু তার পাশে না থেকেও ভালোবেসে যাওয়া যায়। ভালোবাসায় শান্তি আছে, শক্তি আছে, স্বস্তি আছে। আফসোস, সে তা বুঝল না। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি আসলে তার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইছ। ধরো, সে যদি এখন আবার ভালোবাসার অভিনয় শুরু করে দেয়, তা হলে তুমি সব কিছু ভুলে পটে-মটে একেবারে ছারখার হয়ে যাবে! হা হা হা! কোনও মানে হয়, বলো? একবারের সম্পর্ক আজীবনের সম্পর্ক নাও হতে পারে, তবে একবারের ভালোবাসার মানেই আজীবনের জন্য ভালোবাসা। একটা বুদ্ধি দিই, দুষ্ট বুদ্ধি। অন্য কারও সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে দেখতে পার। জীবন এতটা তুচ্ছ জিনিস নয় যে একজনের কথা ভেবে তাকে নষ্ট করে দেওয়া যায়। সে থাকুক না তোমার মনে, অসুবিধেটা কোথায়? আর অন্য কাউকে রাখো তোমার জীবনে। এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যাদের মনে একজন, জীবনে আর একজন। এটা কোনও ব্যাপারই না! স্বস্তিতে থাকাটাই বড় কথা। কারও সাথে থাকতে গিয়ে যদি তা নষ্ট হয়, তবে একা থাকাই অনেক অনেক অনেক ভালো।

: দাদা, আটত্রিশতম বিসিএস-এর আর মাত্র দুই দিন বাকি। এটা নিয়ে কিছু যদি বলেন, ভালো হয়।
: আর মাত্র দুই দিন বাকি! তো তুমি এখানে কী কর? দুই দিন পর পরীক্ষা, আর তুমি এসেছ মোটিভেশনের ট্যাবলেট খেতে! এই সময় তো ইচ্ছে করুক না করুক, শুধুই পড়তে হবে। পড়াশোনা করতে মোটিভেশনের চাইতে অভ্যেস আর তাগিদটা বেশি কাজে দেয়।…আর শোনো…ভালো কথা, যাদের দুই দিন পর পরীক্ষা তারা প্রথম কাজ যেটা করবে না সেটা হলো, কোনও পণ্ডিত ব্যক্তির ফোন রিসিভ করবে না। কারণ, কে কী পড়ে ফাটিয়ে ফেলছে, এটা তোমার জানার দরকার নাই আসলে। কে কী পারে বা পারে না, এটা দিয়ে তোমার কী এসে যায়? তুমি ফাটাতে পারলে কি পারলে না, কেবল এটাই তোমার দরকার। সো, এর ওর কথা শুনবে, মেজাজ খারাপ হবে, মনে হবে তুমি একটা ছাগল, বাকিরা সব পারে আর তুমি কিছু পার না, এতে তোমার প্রিপারেশন খারাপ হবে এবং পরীক্ষা খারাপ হবে। এ ব্যাপারে একদম শিওর থাকতে পার। পরীক্ষার আগে ভাবতে হয় কী, জানো? ভাবতে হয়, আই অ্যাম দ্য বেস্ট! আমার চাইতে ভালো প্রস্তুতি আর কারও নাই। এই সময় প্রস্তুতির চাইতে আত্মবিশ্বাসটাই বেশি জরুরি। মোবাইল ফোনটা একদম অফ রাখবে। অন রাখলেও নিজের পরিবারের বাইরে কারও ফোন ধরবে না। ফেসবুকে তো কোনও অবস্থাতেই যাবে না। ‘আমার চেয়ে ভালো জিনিস এই দুনিয়ায় এখনও আসে নাই’ ফেসবুকে এমন টাইপের কথাবার্তা এই কয়েকদিন না লিখলে তুমি মরে যাবে না। আর আগে যেগুলো পড়েছ পারলে ওগুলো রিভাইজ করো। মনে রাখবে, এখন নতুন কিছু পড়ে মাথা খারাপ করার কোনও দরকার নাই, সিরিয়াসলি। নতুন যা পড়বে, তা আসবে কি আসবে না, সেটা তো তুমি জানো না। যা পড়েছ, তাও তো না আসতে পারে। বিসিএস পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন এল কি এল না, সেটা বড় কথা না, তোমাকে ফুল-আনসার করে আসতেই হবে। যে করেই হোক, যেকোনও মূল্যেই হোক। আর এ সময় ঘুমটা ঠিক রাখো, ভাই, ঘুমটা ঠিক রাখতেই হবে। ঠিকমতো ঘুমাতে না পারলে ব্রেইন ঠিকভাবে কাজ করে না। আর নতুন কিছু দেখবে না, একেবারেই না! আগে যা পড়েছসেটাই দেখো বেশি করে। আর পড়ার সময় তো নিশ্চয়ই দাগিয়ে পড়েছ, ওগুলো একটু দেখো। পড়ার সময় দাগিয়ে না পড়লে আসলে পড়াই হয় না ঠিকমতো, কেননা পরের বার পড়ার সময় তো আর পুরোটা পড়ার কোনও দরকার নেই। তো এখন দাগানোগুলো একটু দেখো। খুব দ্রুত পড়বে। এই সময় পড়া মনে রাখার চেষ্টাও করবে না, শুধু পড়ে যাবে। এই দুই দিনে মনে হয় তুমি এর চাইতে বেশি কিছু চাইলেও করতে পারবে না। আর এই সময় বিসিএস নিয়ে কারওসাথেই কোনও কথা বলবে না। এই পরামর্শটা একদম খুব স্ট্রিক্টলি ফলো করবে। এটা খুব কাজে দিবে, খুউব।

: দাদা, অমুক কোচিং থেকে একটা আপডেটেড শিট দিয়েছে। ওখানে অনেক কিছু নতুন দেখছি। ওটা কি পড়ব, না বাদ দিয়ে দিব।
: আমি তো আসলে জানি না এটা সম্পর্কে। কী দিয়েছে, না দেখে বলাটা মুশকিল। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে, কোচিং-এর বেশিরভাগ শিটই কোনও কাজে লাগে না। মনে রাখবে, কোচিং সেন্টারের শিট মূলত তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্য তৈরি করা হয়, আর কিছু নয়। পরীক্ষায় ভালো করতে হলে প্রশ্নকর্তার মনে কী আছে কী নেই, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

: আমি কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-এর বিগত সংখ্যাগুলো পড়েছি। সব সময়ই পড়ার চেষ্টা করি। এটা কতটা ইফেক্টিভ?
: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বা এই জাতীয় বইগুলো তো বিসিএস-এ খুব একটা কাজে লাগে না। ভাইভাতে কিছুটা কাজে লাগলেও প্রিলি আর রিটেনে তেমন কাজে লাগে না। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-এ যে আপডেটেড তথ্যগুলো দেওয়া থাকে, ওগুলো বিসিএস-এ যে খুব একটা আসে, তা কিন্তু না। কোয়েশ্চেন দেখো, তা হলে দেখবে দুইশোটা কোয়েশ্চেনের মধ্যে একেবারেই সাম্প্রতিক বিষয় থেকে আসে খুব বেশি হলে সাত থেকে আটটা…আচ্ছা, দশটাই ধরলাম, মানে ফাইভ পার্সেন্ট। ওটা তেমন কিছু না। ওটার জন্য কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়ার ও মনে রাখার লোড নেওয়ার দরকার নেই। আমি দেখেছি, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ও এ ধরনের বই পড়লে বিসিএস পরীক্ষা যতটা কঠিন, তার চাইতে কঠিন মনে হয়। কেননা ওগুলো পড়ার সময় মাথায় বারবার আসতে থাকে, এসবের কিছুই তো মনে থাকবে না, আমার কী হবে! বেশিরভাগ ক্যান্ডিডেট কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়ে কেন, জানো? ওগুলো পড়ার সময় নিজের মধ্যে কেমন জানি ‘অনেক পড়ছি অনেক পড়ছি’ অনুভূতি কাজ করে। এটা অতি উচ্চপর্যায়ের ফাঁকিবাজি ছাড়া আর কী? অনুভূতির কোনও দাম নাই, কেবল রেজাল্টের দাম আছে। অন্য সময় না করলেও বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় আমরা দুটো কাজ অবশ্যই করি: এক, পেপার পড়ি; দুই, টিভির খবর শুনি। সেখান থেকেই তো দশটার মধ্যে অন্তত দুটো প্রশ্ন কমন পাওয়ার কথা, তাই না? বাকি আটটার মধ্যে হয়তো বড়জোর ছয়টা কমন পাবে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, কারেন্ট নিউজ, কারেন্ট ওয়ার্ল্ড, আজকের বিশ্ব, নতুন বিশ্ব টাইপের বইগুলো থেকে। এই ছয় নম্বরের জন্য তোমাকে যে শ্রমটা দিতে হচ্ছে, সে শ্রমটা যদি বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান, মানসিক দক্ষতার পেছনে দাও, তবে তোমার নম্বর বেড়ে যাবে অন্তত ৩০! এখন তুমিই বলো লাভ কোথায় বেশি! সাধারণ জ্ঞানের জন্য ওসব না পড়ে গাইড, প্রশ্নব্যাংক, মডেল টেস্টের বই, যা সচরাচর সবাই পড়ে আরকি…এসব দেখো, তা হলেই হবে। বিসিএস অন্ধের মতো প্রস্তুতি নেওয়ার পরীক্ষা নয়, বিসিএস বুঝেশুনে প্রস্তুতি নেওয়ার পরীক্ষা। মনে রেখো, যে বেশি পড়ে সে চাকরি পায় না, যে বুঝেশুনে বেশি পড়ে সে-ই চাকরি পায়। আবার দেখো, রিটেনেও ভালো করা না করা নির্ভর করে ওই বিষয়গুলোর উপরেই, সাধারণ জ্ঞানের উপর নয়। সাধারণ জ্ঞানে মার্কস তেমন বেশি বাড়াতে পারবে না যতই চেষ্টা কর না কেন! সাধারণ জ্ঞানে অতি পণ্ডিত, বাকি বিষয়ে অতি গর্দভ যারা, ওদের একজনকেও বিসিএস ক্যাডার হতে কখনওই দেখিনি।
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ও এই জাতীয় বইপত্র পড়া বাদ দাও তো! এত চাপ নেওয়ার দরকার কী? সত্যিই এর কোনও মানে নাই। ওসবের পেছনে সময় নষ্ট না করে সে সময়টা অন্য সাবজেক্টে দাও, লাভ বেশি হবে। আর দুই দিনের জন্য তো ওসব পড়ার দরকারই নাই। ভয়টয় পেয়ো না এত। তুমি যেটা ভাবছ, ওই যে যে মনে থাকবে না, সব ভুলে যাব, ইত্যাদি ইত্যাদি…একটা জিনিস মাথায় রাখবে, তোমাদের ব্যাচে মানে ৩৮তম বিসিএস-এ যে ফার্স্ট হবে, সেও কিন্তু এটাই ভাবছে যে পরীক্ষার হলে তার কিছুই মনে থাকবে না। তাই এত টেনশন নেওয়ার সত্যিই কিছু নাই।

: আচ্ছা, বাবা-মায়ের দোয়া কীরকম কাজে লাগে বলে আপনি মনে করেন?
: এটা কেমন প্রশ্ন, ভাই? ওই জিনিসের চাইতে বড় জিনিস আর কী আছে? তোমার কি মনে হয় আমি কেবল নিজের যোগ্যতাতেই প্রথম হয়েছি? হ্যাঁ, যোগ্যতার ব্যাপারটা তো আছেই, সাথে আছে ভাগ্য আর আমার বাবা-মায়ের পুণ্যকর্মের ফল। ভাগ্যে বিশ্বাস কর না? ঠিক আছে, তার সাথে কথা বলে দেখো যে লোকটা সবটুকু চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। কেবলই যোগ্যতার জোরে কেউ সফল হয় না, কিংবা কেবলই অযোগ্যতার কারণেই কেউ ব্যর্থ হয় না। একটা গল্প বলি। গল্প মানে সত্যিকারের গল্প। আমার মা তো আর বিসিএস বোঝেন না, তো আমি যখন বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আর পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, তখন মা সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করার সময় বলতেন, ঠাকুর, তুমি আমার ছেলেকে বিসিএস পরীক্ষায় ‘ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট’ করে দাও! অদ্ভুত প্রার্থনাই তো, তাই না? মা যদি জানতেন বিসিএস কী বস্তু, তবে ওরকম অসম্ভব প্রার্থনা করার সাহসই পেতেন না হয়তো! আমি নিজেই তো কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমি প্রথম হব। অথচ দেখো, মায়ের প্রার্থনা কবুল হয়ে গেল! কীভাবে হলো এটা? প্রার্থনার এক ধরনের শক্তি আছে। আর যে প্রার্থনা মায়ের ঠোঁট থেকে নিঃসৃত হয়, তার শক্তি তো অসীম! পৃথিবী বড়ই বিচিত্র জায়গা। এখানে কোথায় কীভাবে কোন প্রার্থনা কাজে লেগে যায়, তা কেউই বলতে পারে না। তাই কখনও ভুলেও নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু মনে এনো না, যদি তা কবুল হয়ে যায়, মহাবিপদে পড়ে যাবে। ছোটবেলায় কখনও এমন হয়নি যে মনে মনে আইসক্রিম খেতে চেয়েছ, সন্ধ্যায় দেখলে বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে আইসক্রিম নিয়ে এসেছেন? এর ব্যাখ্যা কী? কোনও না কোনও উপায়ে তোমার মনের কথাটি বাবার মনে পৌঁছে গেছে, পৌঁছে যে গেছে তা হয়তো বাবা নিজেই জানেন না। এই পৃথিবীতে যত মানুষ আছে, তারা যে যেমন প্রার্থনা করে বা মনে মনে চায়, তা সিগন্যাল আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর কোন সিগন্যাল কোথায় কীভাবে রিসিভড হয়ে যায়, তা কেউ বলতে পারে না। এটা স্রষ্টার মাস্টারপ্ল্যানের একটা অংশ, আমাদের মস্তিষ্কের সীমিত ক্ষমতায় তা বোঝা সম্ভব নয়। শুধু বাবা-মায়ের নয়, অন্য মানুষের দোয়াও কাজে লাগে। তাই মানুষের জন্য কাজ করলে ভালো। মানুষের উপকার করার চাইতে বড় আনন্দ আর কীসে আছে?

: যদি চেষ্টা করলেই সফল হওয়া না যায়, তা হলে চেষ্টা করে কী লাভ?
: ভালো প্রশ্ন। হ্যাঁ, চেষ্টা করলেই তুমি সফল হবেনই, তা বলা যায় না। আমি এ জীবনে অনেক পরিশ্রমী ব্যর্থ মানুষ দেখেছি। পরিশ্রম করলে সফল হবে কি হবে না, তা অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন তুমি যে পথে বা কৌশলে পরিশ্রম করছ, সেটা ঠিক আছে কি না, তা তোমাকে খুব ভালো করে জানতে হবে। বেশিরভাগ ব্যর্থ মানুষ শ্রম ও সময় দেয়…হয় ভুল জিনিসের পেছনে কিংবা সঠিক জিনিসের পেছনেই, তবে ভুল পথে। কতটুকু পরিশ্রম করছি, তার চাইতে জরুরি হচ্ছে যেটার জন্য পরিশ্রম করছি, সেটা কতটুকু দরকার বা আদৌ দরকার কি না, তা বুঝতে পারা। আচ্ছা ধরো, সবই ঠিক আছে, মানে তুমি ঠিক জিনিসের জন্য ঠিক উপায়ে ঠিক পরিমাণে পরিশ্রম করেও ব্যর্থ হলে। সবার সামর্থ্য এক নয়, সবার ভাগ্যও এক নয়। স্রেফ দুর্ভাগ্যের কারণে ব্যর্থ হতে অনেক যোগ্য মানুষকে দেখেছি। হ্যাঁ, তুমিও তাদের দলে পড়ে যেতে পার। কে বলতে পারে! তবে এখানে একটা কথা আছে। জানো তো, এই পৃথিবীতে সবচাইতে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে সেই দুর্ভাগ্যটি, যেটার জন্য তুমি নিজেই দায়ী। ওটা মেনে নেওয়াটা সত্যিই অনেক কঠিন। যদি তুমি তোমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা না কর, মানে নিজের হৃদয়ের আয়নার কাছে নিজেই স্বচ্ছ না থাক, তবে তোমার ব্যর্থতার সম্পূর্ণ দায়ভার কিন্তু তোমার কাঁধেই, অর্থাৎ ব্যর্থতাটা তোমার প্রাপ্য। আর যদি তুমি তোমার সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার পরও ব্যর্থ হও, তবে তোমার মধ্যে অতটা দুঃখ কাজ করবে না, কেননা তুমি তোমার চেষ্টার কোনও ত্রুটি করোনি, যা পাওনি তা হয়তো তোমার নিয়তিতে লেখা ছিল না বলেই পাওনি। পুরোপুরি আন্তরিকতা ও চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও যে ব্যর্থতা আসে, তা ততটা কষ্ট দেয় না, যতটা দেয় নিজের অবহেলা ও ফাঁকিবাজির কারণে ব্যর্থতা। প্রথমটি নিয়তি, দ্বিতীয়টি প্রাপ্য। যে ব্যর্থতা আমার নিয়তি তা মেনে নেওয়া যত সোজা, যে ব্যর্থতা আমার প্রাপ্য তা মেনে নেওয়া তত কঠিন।

: আপনার চোখে একজন মানুষের সবচাইতে বড় গুণটি কী?
: অবশ্যই মানবিকতা। তোমার মৃত্যুর পর কিংবা তুমি এখন যে অবস্থায় বা অবস্থানে আছ, সেটা যেদিন থাকবে না, সেদিন যদি কোনও কিছুর জন্য লোকে তোমাকে মনে রাখে বা ভালোবাসে, তা হচ্ছে তোমার মানবিকতা। যে মানুষ মানবিক নয়, সে মানুষ পৃথিবীর তেমন কোনও কাজে আসে না। তোমার পদ, তোমার ক্ষমতা, তোমার বিত্ত একসময় শেষ হয়ে যাবে, সেদিনও যদি তুমি মানুষের মনে বেঁচে থাকতে চাও, তবে তোমাকে যা করতে হবে, তা হলো তোমাকে অবশ্যই মানবিক হতে হবে। মন্ত্রিত্ব চলে গেলে প্রাক্তন মন্ত্রীকে কেউ গোনার মধ্যেও ধরে না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখো, বুঝতে পারবে। অনেক সংসদসদস্য আছেন যাঁদের অসুস্থতার খবর শুনে লোকে তাঁদের মৃত্যুকামনা করে। একজন মানুষের জীবনে এর চাইতে বড় গ্লানি আর কী হতে পারে? তবে যে মন্ত্রী আন্তরিক ও ভদ্র, মন্ত্রিত্ব না থাকলেও তিনি কিছু মানুষের ভালোবাসা পেয়েই যান আগের মতোই। সবার কাছে নিজেকে পরিচিত করো একজন মানুষ হিসেবে, কোনও অবস্থানধারী হিসেবে নয়। যে আমলা চাকরিতে থাকাকালীন সবার সাথে দুর্ব্যবহার করে, লোকজনকে প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত করে, ক্ষমতার দাপট দেখায়, অবসরে যাওয়ার পর তাঁকে তাঁর কলিগ কিংবা সাধারণ লোকজন দূরে থাক, পরিচিত লোকজনও সালাম দেয় না। মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। এটা শেখার বিষয়, সবাই তা করতে পারে না। সময় থাকতে এটা শিখো, নইলে পরে সবার কাছেই একজন ঘৃণ্য জানোয়ার হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। একটা সময় পর প্রতিটি মানুষই পেছন ফিরে দেখে তার নিজের ছায়াটা বাদে তার সাথে আর কেউই নেই। সেই দিন সবারই খুব একলা লাগে। তখন বেঁচে থাকার জন্য কিচু মানুষের সাহচর্য লাগে, ভালোবাসা লাগে। যদি সেই দিনটির আগের দিনগুলিতে এমন কিছু না করি যার কারণে লোকের ভালোবাসা পাওয়া যায়, তবে একাকিত্ব আর বিষণ্ণতা জীবনে অনিবার্য হয়ে দেখা দেবে। জানো তো বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ার পর বেশিদিন বাঁচেন না, কেননা তখন ‘স্যার’ ডাকার আর কেউ থাকে না, সেই দুঃখেই রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান। নিজেকে এমনভাবে তৈরি করো যাতে লোকে তোমাকে সম্মান করে তোমার পদের ভারে নয়, মনুষ্যত্বের ভারে।

: দুনিয়ায় ভালোভাবে বাঁচতে চাইলে সব চেয়ে বেশি কী কাজে লাগে?
: একটা গল্প বলি। আমার এক পরিচিত চাচা আছেন। উনি অনেক ধনী ব্যবসায়ী, তবে পড়াশোনা জানেন না। তো একদিন তাঁর সাথে গল্প করার সময় আমি চাচাকে বললাম, ব্যবসা করার জন্য কোনটা সবচেয়ে বেশি দরকার? চাচা বললেন, ‘বুদ্ধি।’ কথাটা খুব সত্য। আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হচ্ছে, পৃথিবীতে চলতে গেলে যেকোনও একটা জিনিস লাগে। হয় বিদ্যে, না হয় বুদ্ধি। কিছু মানুষের বিদ্যে থাকে না বুদ্ধি থাকে, সেটা কাজে লাগিয়ে ওরা জীবনে অনেক দূর চলে যেতে পারে। আবার কিছু মানুষের বুদ্ধি থাকে না বিদ্যে থাকে, যেমন আমি ও আমার মতো আরও অনেকে। আমরাও চাচার মতোই কিছু একটা করে খাচ্ছি, ব্যবসা করতে পারছি না, তবে একটা চাকরি করছি। আর যাদের বিদ্যেও আছে বুদ্ধিও আছে, ওরা মাস্টারপিস! সে দুটোকে ঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে ওরা অনেক কিছু করতে পারে। এরকম মানুষ কম। তো চাচার কিন্তু বিদ্যে ছিল না, তবে বুদ্ধি ছিল। চাচাকে বললাম, আমি তো ব্যবসা করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি। চাচা বললেন, না বাবা, তুমি ব্যবসা করবে কোথা থেকে? আমি বললাম, কেন চাচা? আমি পারব না কেন? উনি বললেন, আরে বাবা, তোমরা তো বিদ্বান মানুষ, তোমাদের বুদ্ধি তোমাদের যতটা বুদ্ধিমান করে রেখেছে, তার চাইতে অনেক বেশি বুদ্ধিমান করে রেখেছে তোমাদের বিদ্যে। ব্যবসা করতে গেলে যে বোকা হতে হয়, বেশি-বোঝা লোক ব্যবসা করতে পারে না।…কথাটা আমার এত যে দারুণ লেগেছে! যারা বেশি বোঝে, তারা ব্যবসা করতে পারে না। যাঁরা অনেক বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়েছেন, তাঁদের প্রোফাইলটা পড়ে দেখো, তাঁদের পেছনটা ঘেঁটে দেখো, দেখবে, তাঁদের বাস্তববুদ্ধিটা বেশি ছিল। তাঁরা দুনিয়াটাকে রঙিন মনে করেননি, দুনিয়াটা আসলে যেমন, সেভাবেই দেখতে পেয়েছেন। ওঁদের বুদ্ধি আমাদের চাইতে অনেক অনেক বেশি, বিবেচনাবোধ আমাদের চাইতে বেশি, ধীশক্তি আমাদের চাইতে বেশি। আমরা তো ভাই একটা সিস্টেমে ঢুকে পড়ি, তার পর আর কী…আরাম আর আরাম! আর একজন ব্যবসা করছেন, তিনি আমাদের একটা বেতন দিচ্ছেন, সেই বেতনটা আমরা গ্রহণ করি। আমাদেরটা সহজ, ওঁদেরটা কঠিন। বিজনেস করা কঠিন, নিঃসন্দেহে অনেক বেশিই কঠিন। যার সার্টিফিকেট যত ভারী, তার অর্থসংক্রান্ত ঘিলু তত কম। বলো, তার পর বলো।

: বিসিএস ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞানের প্রিপারেশান নিয়ে কিছু বলুন।
: ওগুলো আমার লেখাতেই আছে। আমার ওয়েবসাইটে যাও। এর পর ওখানে ‘বিসিএস ও আইবিএ’ সেকশনে গিয়ে লেখাগুলো দেখো। অনেক কিছু লিখেছি ওখানে। এত অল্প সময়ে তো সব বলা যাবে না। একসময় নিয়মিতই পেপারে লিখতাম। প্রথম আলো আর কালের কণ্ঠ-এ। একেকটা লেখা অনেক যত্ন করে তৈরি করতাম। এই যেমন ধরো, গণিতে কী করে ভালো করতে হয়, এমন একটা টপিকের উপর লিখতে মাত্র হাজারখানেক শব্দের পেছনে ১০-১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করতাম। অনেক বই আর সিলেবাস ঘেঁটে ঘেঁটে পরামর্শ লিখতে হতো। কয়েক লাখ মানুষ যে লেখাটি পড়বেন, সে লেখাটিতে যা মনে আসে, তা-ই লিখে দেওয়া যায় না। অনেক দায়িত্ব আর দায় জড়িয়ে থাকে সে লেখায়। সাথে থাকে যত্ন ও ভালোবাসা। তো তোমরাও ওখান থেকে পড়তে পার। উপকারে আসবে।

: এই শেষ সময়ে ৩৮তম বিসিএস নিয়ে কিছু বলুন।
: আগেই তো বললাম।
: এরা পরে এসেছে।
: আচ্ছা। ওই সময় ছিলে কে? মানে ৩৮তম বিসিএস-এর ক্যান্ডিডেট কে কে যেন ছিল না?
: হ্যাঁ, ছিল। ওরা চলে গেছে।
: ভালো করেছে, আমার কথাটা কাজে লেগেছে তা হলে। হা হা হা…এখন আর নতুন কিছু পড়ার সময় নাই, পড়ার দরকারও নাই, নতুন কিছু পোড়ো না আর কারও ফোন রিসিভ কোরো না। এটা খুব ইম্পরট্যান্ট। যাদের প্রস্তুতি খুব ভালো, তাদের সাথে কিছুতেই কথা বলবে না। এটা শুনে হাসি পাচ্ছে, না? বিশ্বাস করো, এটাই কাজে লাগবে। কারণ…দেখো, পরীক্ষা তো শুক্রবার, তাই না? ওই শুক্রবার পরীক্ষার দিন তুমি হিরোও হতে পার, আবার ভিলেনও হতে পার। তোমার কোনটা দরকার? হিরো হওয়া, তা-ই তো? তাই এই সময়টাতে যেটা তোমাকে ভিলেন করে দেবে, সেটা রিসিভ করবে না। এমনও হতে পারে যে ওর কথা শুনে তোমার ভিলেন মনে হবে নিজেকে। মনে হতে থাকবে, আমি তো কিছুই পারি না, ও তো সবই পারে…হা হা হা…এই অনুভূতিটা তোমার কোনও কাজে লাগবে না। সো, এই সময়টাতে নিজেকে ভালো রাখো। এটা হচ্ছে একটা টি-টুয়েন্টি ম্যাচ। পরীক্ষা তো দুই ঘণ্টার, না? ওই দুই ঘণ্টা তোমার কি না, সেটা হচ্ছে আসল কথা। আগে কী পড়লে কী পড়লে না, সেটা দিয়ে কিছু এসে যায় না। ভালো পড়লেও পাস কনফার্ম না, খারাপ পড়লেও ফেইল কনফার্ম না। তোমার মাথাটাকে ঠিক রাখতে হবে ওই দুই ঘণ্টা। আর এটা ঠিক করে দেবে তোমার কনফিডেন্স…আত্মবিশ্বাস, তাই ওই আত্মবিশ্বাসটাকে ঠিক রাখো। আর নতুন কিছু পড়ার দরকার নাই, আগে যা পড়েছ,ওগুলোই একটু নেড়েচেড়ে দেখো। আর পড়া মনে থাকছে না, কিছুই মনে নেই, যা পড়েছি তার সবই ভুলে গেছি…এসব মনে হবেই। কোনও ব্যাপার না, এটা সবারই মনে হয়। তোমাদের সাথে যে ফার্স্ট হবে, এই মুহূর্তে তারও এটা মনে হচ্ছে। এটা কোনও সমস্যাই না। আর পরীক্ষা নিয়ে টেনশন? সে তো হবেই!পরীক্ষা নিয়ে টেনশন করাটা একটা সাধারণ ভদ্রতার মধ্যে পড়ে। তোমার পরীক্ষা, আর তুমি টেনশন করবে না, এটা আবার হয় নাকি, ভাই? আর এত ভাববার কিছু নেই তো! তোমার যা নম্বর পাওয়ার, তুমি তা-ই পাবে। কিছুই মিস হবে না। আমরা আসলে কিছু মিস করে ফেলি না; আমরা যা পাওয়ার, যতটুকু পাওয়ার, ঠিক ততটুকুই পাই। ভেবো না তো অত কিছু…আর হলে হোক একটু টেনশন, এই সময়ে টেনশন হবে না তো কী হবে, বলো? একটা ব্যাপার আছে না…