দেয়ার ওয়জ অ্যা ফাদার (১৯৪২)

স্কুল থেকে সবাই গেছে পিকনিকে। সেখানে নৌকাডুবিতে এক ছাত্র মারা যায়। শিক্ষক জানতেন না যে কিছু ছাত্র নৌকায় ঘুরছে। ওরা কাউকে বলে যায়নি। কিন্তু এ দুর্ঘটনার পুরো দায় শিক্ষক নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন। বললেন, ও তো খুবই অনুগত ছাত্র ছিল। ও কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, সেদিকে খেয়াল রাখাটা আমার দায়িত্ব ছিল। আমি খেয়াল করে ওকে নিষেধ করলে ও কিছুতেই নৌকাভ্রমণে যেত না। প্রচণ্ড দুঃখ আর আত্মগ্লানি থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন শিক্ষকতা ছেড়ে দেবেন। ছাত্রদের দায়িত্ব নেয়ার কোনো অধিকারই তাঁর নেই। শুধু পড়ানোই শিক্ষকের কর্তব্য নয়, ছাত্রদের দেখেশুনে রাখাটাও তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তিনি তা করতে পারেননি, তিনি একজন ব্যর্থ শিক্ষক। আর কখনোই তিনি ছাত্র পড়াবেন না। মা-মরা একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তিনি আরেক শহরে চলে যাবেন। শিক্ষকতা বাদে অন্য চাকরি খুঁজবেন।

করলেনও তা-ই। এমন এক আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বাবা আর তাঁর ছেলের কাহিনি দেয়ার ওয়জ অ্যা ফাদার (১৯৪২)। মুভির গল্প একেবারেই সাদামাটা, সরল। এ সিনেমায় আমরা তা দেখি, কতোটা সহজে সহজ জীবনের গল্প বলে ফেলা যায়! রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ কথা যায় না লেখা সহজে’ খুব সহজেই মিথ্যে হয়ে যায় জাপানি ফিল্মমেকার ইয়াসুজিরো ওজুর সিনেমা বানানোর নৈপুণ্যের কাছে।

নরিকি ট্রিলজি (লেট স্প্রিং (১৯৪৯), আর্লি সামার (১৯৫১) ও টোকিও স্টোরি (১৯৫৩)), লেট অটাম (১৯৬০), অ্যান অটাম আফটারনুন (১৯৬২), দি অনলি সান (১৯৩৬), অ্যান ইন ইন টোকিও (১৯৩৫) ইত্যাদি মুভি যাঁদের দেখা আছে, তাঁরা জানেন ওজুর অসাধারণত্ব সম্পর্কে। উনার সিনেমার কাহিনি খুবই সাধারণ। দেখতে গিয়ে মনে হয়, আরে, এ তো আমারই গল্প! কিংবা, আমার পরিবারের গল্পটা উনি জানেলেন কীকরে! জাপানের সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য ওজুকে দেখতেই হবে! উনার সিনেমার চরিত্রগুলি যেন আমাদের পাশের বাড়ির মানুষ, আমরা ওদের দেখলেই চিনতে পারি, ওদের সাথে আমাদের প্রায়ই দেখা হয়, কথা হয়। প্রত্যেকটা গল্পই যেন আমাদের খুব চেনা গল্প। সে গল্প জাপানি নয়, বরং চিরন্তন।

ওজুর চাইতে সরল এবং প্রাঞ্জল হওয়া খুব কঠিন। অতোটা মানবিক গল্প আমরা খুব কম ফিল্মমেকারের কাছ থেকে শুনেছি। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের আখ্যান বর্ণনায় ওজু সাবলীল, স্বাভাবিক এবং নিখুঁত। উনার সিনেমা নিরুত্তাপ, নিরুদ্বেগ চিত্তেই দেখে ফেলা যায়। দেখার সময় এবং দেখার পর এক ধরনের সারল্যমাখা মুগ্ধতা হৃদয়ে খেলতে থাকে। কোনো বাড়তি চাপ নেই, সাসপেন্স নেই, ক্লাইমেক্স নেই, নির্ভার মন নিয়ে কেবলই গল্প অনুভব করে যাওয়া। ওজুর সিনেমা দেখা যেন ভাস্কর চক্রবর্তীর গদ্য পড়া মতো। দেখার সময় যেন ঘুম পায়, কিন্তু দেখার পর কী দেখলাম ভেবে ঘুমাতেই পারি না! সে অনুভূতি বড়ো আরামের। কুরোসাওয়ার মতো ফিল্মমেকারও ওজুকে গুরু মানতেন!

ক্লাসিক ঘরানার মুভি যাঁদের পছন্দ, তাঁদের বারবার ওজু, কুরোসাওয়া, মিজোগুচি-র কাছে যেতেই হবে। এঁদের ভালো না বেসে সিনেমাদেখাকে ভালোবাসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।