দো বিঘা জমিন (১৯৫৩)

দো বিঘা জমিন (১৯৫৩): জীবন যেখানে শুকায়ে যায় (স্পয়লার অ্যালার্ট)

…………………………………………………………………………………………………………….

অতঃপর তাহারা সুখেশান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল। এমন গল্প কেবল সিনেমায়ই হয়। কেন? কেননা, বাস্তবজীবনে এমন হ্যাপি-এন্ডিং হয় না বললেই চলে। তাই সিনেমা কেবল সিনেমাই, আর কিছু নয়—এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবকে বাস্তবের মতো করেই দেখানোর যে চলচ্চিত্রধারা, তার নাম নিও-রিয়ালিস্ট ধারা। ইতালিতে এর সূচনা। এ ধারার গুরু ভিত্তোরিও ডি সিকার শুশাইন, দ্য বাইসাইকেল থিফ, উমবার্তো ডি. যাঁদের দেখা আছে, তাঁরা জানেন, দরিদ্র মানুষের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থাকে অবিকল তুলে এনেও কত চমৎকার ফিল্ম বানানো যায়। কল্পনার কোনো আশ্রয় নেই, যা দেখানো হবে, তা আমাদের চারপাশের জীবনে ঘটেচলা নানান কাহিনি। সেখানে আনন্দ আছে, দুঃখও আছে। বিত্ত আছে, দারিদ্র্যও আছে। সৌন্দর্য আছে, বীভৎসতাও আছে। মূলত ক্যামেরার ফোকাসকে রাস্তার ধুলোয় নামিয়ে আনার আন্দোলনই নিও-রিয়ালিস্ট মুভির আন্দোলন। অপেশাদার আর্টিস্টরা শহরের রাস্তায়, গলিতে, বস্তিতে, কিংবা একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে অভিনয় করবেন। প্রতিদিনকার নৈতিক ও আর্থিক সংকট, জীবনের কঠোর ও অন্ধকার দিক, এইসব কিছুই এ ধারার উপজীব্য। সেখানে দেখানো হবে পরাজয়, সংগ্রাম, দারিদ্র্য, শোষণ, হতাশা, যন্ত্রণা। মুভির শেষটা হবে দর্শকের মনের মতো নয়, দর্শকের জীবনের মতো। এ ঘরানার অন্যতম সফল হিন্দি ফিল্মের নাম ‘দো বিঘা জমিন’, বিমল রায়ের, ১৯৫৩ সালে বানানো, দ্য বাইসাইকেল থিফ-এর ঠিক ৫ বছর পরেই। আরো দুই বছর পর সত্যজিৎ রায়ও একই পথে হাঁটলেন। বিমল রায়ের মতো দ্য বাইসাইকেল থিফ-এর অনুপ্রেরণায় বানালেন নিও-রিয়ালিস্ট ঘরানার ক্লাসিক ‘পথের পাঁচালী’।

গল্পটা বলি। শম্ভু একজন গরীব কৃষক। দুই বিঘা জমিই তার একমাত্র সম্বল। স্ত্রী পারো, ছেলে কানহাইয়া ও বাবাকে নিয়ে তার সুখের সংসার। স্থানীয় জমিদার একটি রাসায়নিক প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য শম্ভুর জমিটা কিনতে চান। শম্ভু রাজি হয় না। তখন তিনি পুরনো কিছু কর্জ ফেরত চান। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কোর্টে গিয়ে গড়ায়। কোর্ট থেকে শম্ভুকে কর্জ পরিশোধের জন্য ৩ মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়। ব্যর্থতায়, তার দুই বিঘা জমি জমিদারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হবে। টাকা যোগাড়ের আশায় শম্ভু ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় চলে যায়। পারো গ্রামে থেকে যায় বৃদ্ধ শ্বশুরের দেখাশোনা করার জন্য। শহরে এসে শম্ভু রিকশা চালায়, কানহাইয়া জুতোপালিশ করে। ওদিকে পারো কাদাপানি ভেঙে শাকসবজি সংগ্রহ করে, একটা কন্সট্রাকশন সাইটে শ্রমিকের কাজ করে। শত বাধা ও বিপত্তির মধ্য দিয়ে তিনজন মিলে অতি কষ্টে কর্জের টাকা জমাতে থাকে। একসময়, হতাশা থেকে জোরে রিকশা চালাতে গিয়ে শম্ভু আহত হয়, কানহাইয়া চুরি করা শুরু করে, আর পারো স্বামী-ছেলের খোঁজে শহরে এসে এক লম্পটের খপ্পরে পরে সেখান থেকে পালাতে গিয়ে গাড়িচাপা পড়ে। শম্ভু স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে সব সঞ্চয় শেষ করে ফেলে। তিনজন মিলে খালিহাতে গ্রামে ফিরে যায়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর্জ পরিশোধ করতে না পারায় সে তার দুই বিঘা জমি হারায়।

সর্বকালের সেরা ভারতীয় মুভির নাম চেয়ে সার্চ করলে প্রথম ১০টির মধ্যেই ‘দো বিঘা জমিন’ থাকে। বিমল রায় ভারতের এ যাবৎকালের সর্বসেরা পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম। এই ২ ঘণ্টা ১১ মিনিটের এ মুভিতে গ্রামের গরীব মানুষের দিনলিপি এবং শহরের বস্তিবাসীর জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে। দারিদ্র্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপটি, একইসাথে দরিদ্রদের সততা ও অসততার অনবদ্য চিত্রণ এ মুভি। এ মুভিতে শম্ভু জমিটি জমিদারের হাত থেকে বাঁচাতে পারে না, এ মুভি শম্ভুদের জিতিয়েদেয়ার মুভি নয়, এ মুভি গ্রাম ও শহরের দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা, মনস্তত্ত্ব ও সংগ্রামের সৎ চিত্রায়ন। ১৯৫৩ সালের মুভিতে জীবনের যে বাস্তব চিত্রটি উঠে এসেছে, তা আজকের দিনেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। সে কারণেই মুভিটি ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। মুভি দেখে কিছু মেসেজ মাথায় গেঁথে যায়। এ মুভির অনেক দৃশ্যই চিরকাল মনে রাখার মতো। যেমন:

গরীব কৃষক শম্ভু তার পরিবারের জন্য যে ত্যাগস্বীকার করেছে, তা মনে রাখার মতো। তাকে যেকোনো উপায়েই হোক, তিনমাসের মধ্যে কর্জের টাকা যোগাড় করতেই হবে। তবে তা করতে গিয়ে সে চরম দারিদ্র্য আর কষ্টের মধ্যেও তার সততা, নিষ্ঠা, মূল্যবোধ বিসর্জন দেয়নি। অসুস্থ প্রতিবেশির রিকশা চালিয়ে সে যে আটআনা আয় করেছে, তা প্রতিবেশির হাতে তুলে দেয়। টাকাটা সে রেখে দিলেও প্রতিবেশী কোনোভাবেই জানতে পারত না। মুভিতে শম্ভুর আত্মসম্মানবোধ বিশেষভাবে চোখে পড়ে।

শম্ভু যে রিকশাটি চালায়, তা প্যাডেলের রিকশা নয়, দৌড়ে চালানোর রিকশা। যখন সে কিছু বাড়তি ভাড়ার লোভে একটা ঘোড়ার সাথে দৌড়ে পাল্লা দিয়ে রিকশা নিয়ে দৌড়াচ্ছে, তখন তাকে আর পাশের ঘোড়াটিকে পরিচালক একই ফ্রেমে দেখিয়েছেন। শম্ভুর রিকশার চাকা খুলে যায়, সে রাস্তায় ছিটকে পড়ে আহত হয়। তখন আমরা শম্ভুর জন্য কাঁদি, ঘোড়াটার কষ্টের কথাও আপনাআপনিই মাথায় চলে আসে।

সিনেমার প্রথম আধা ঘণ্টায় দেখি, গ্রামের কৃষকরা গরীব হলেও ওরা অল্পেই খুশি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সামান্য সঙ্গতিতেই সাধাসিধে জীবনযাপনে ওরা অভ্যস্ত। অপরদিকে, শহরের বস্তির জীবনটা অন্ধকার, নির্দয়, বর্বর, সহানুভূতিশূন্য। শহরের বেনিয়ারা এসে গ্রাম খেয়ে ফেলছে। নগরায়নের নামে গ্রামে কারখানা বসাচ্ছে, কালো ধোঁয়া আর দূষণ কেড়ে নিচ্ছে গ্রামের সবুজ, হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের সরল মানুষগুলি। সেই ১৯৫৩ সালেই বিমল রায় আমাদের ভবিষ্যৎ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

মানুষের বাইরের পারসোনা ভেতরটা দেখায় না। গ্রামের জমিদারটি নরম সুরে কথা বলেন, দেখলে দয়ালু মনে হয়, কিন্তু ভেতরের মানুষটি একটা বদমাশ, লোভী, স্বার্থপর, নির্দয় মানুষ। ওদিকে শহরের বস্তির বাড়িওয়ালীকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় উনি কলহপ্রিয়, কুৎসিত, নির্মম, রাগী, অথচ উনার ভেতরের মানুষটি এর ঠিক উল্টো।

পারো যখন স্বামীর কাছে চিঠি লিখিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিবেশিনীর কাছে যায়, তখন স্বামীকে কী লিখবে, কী বলে সম্বোধন করবে, তা ভেবে তার লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখলে নারীর শাশ্বত লাজুক রূপটির কথা মাথায় আসে। শম্ভু-পারো’র মধ্যকার ভালোবাসার কিছু সারল্যমাখা দৃশ্য হৃদয় স্পর্শ করে।

দরিদ্র মানুষ যখন নিরুপায় হয়ে যায়, তখন কখনোকখনো তার চরিত্রে স্থলন আসতে পারে। কানহাইয়া যখন দেখল, কোনোভাবেই বাপ-বেটা দুজন মিলেও যথেষ্ট পরিমাণ টাকা জমাতে পারছে না, ওদিকে সময়ও শেষ হয়ে আসছে, তখন চুরির টাকা দিয়ে ঋণশোধের কথা তার মাথায় আসে। সে একটা পকেটমারের সাথে যোগ দেয়। এর পেছনে অপরাধপ্রবৃত্তি নয়, বরং দারিদ্র্য দায়ী।

শম্ভু যখন অসুস্থ, বিছানায় শোয়া, তখন কানহাইয়ার পাশে বসেই যে দুইটি ছেলে জুতোপালিশ করে, ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, এখন থেকে কানহাইয়ার বাবার চিকিৎসার জন্য ওরা শম্ভুকে প্রত্যেকে দুই পয়সা করে প্রতিদিন দেবে। ওরাও তো গরীব, তবু শম্ভুর অসুস্থ বাবার চিকিৎসায় শম্ভুর পাশে দাঁড়ানোর সাহস, উদারতা ও মানবিকতা আমাদের নাড়া দেয়।

ওরা তিনজন গ্রামে ফিরে এসে দেখে, ওদের দুই বিঘা জমি বেহাত হয়ে গেছে, সেখানে কেমিক্যাল প্লান্ট বসানোর কাজও চলছে পুরোদমে। সীমানাবেড়ার ওপাশটায় ওরা দাঁড়িয়ে কাঁদছে, ফিরে যাওয়ার মুহূর্তে একটু পিছু ফিরে নিচু হয়ে শম্ভু কী যেন উঠিয়ে নেয়। গার্ড এসে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কী উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছ? শম্ভু বলে, কিছু না, ভাই, কিছু না। গার্ড শম্ভুর কলার চেপে ধরে বলল, দেখাও কী নিয়েছ! শম্ভু হাত মেলে ধরল। দুই বিঘা জমি-র কিছু মাটি কেবল নিচে ঝরে পড়ল। যা ছাড়তে হয়, তার সবটুকুই ছাড়তে হয়। শেষ স্মৃতিচিহ্ন নেয়ার অধিকারটুকুও গরীবের থাকে না।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দো বিঘা জমিন’ আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়। আরও জেতে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, কার্লোভি ভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ সিনেমার মূল সৌন্দর্য এর অপূর্ব প্লট নয়, বরং সে প্লটকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর নৈপুণ্য। সলিল চৌধুরীর লেখা গল্প ‘রিকশাওয়ালা’ খুবই সরল, গল্পের চরিত্রগুলির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও মনস্তত্ত্ব ফুটিয়ে তোলার কারিশমাই পরিচালকের কৃতিত্ব। চরম সংকটপূর্ণ অবস্থায়ও শম্ভু তার নৈতিক অবস্থানে ছিল দৃঢ়, বাবাকে সাহায্য করার জন্য কানহাইয়ার চেষ্টা ও অস্থিরতা, স্বামী ও ছেলেকে দেখার জন্য পারোর ব্যাকুলতা—এইসবের পরিস্ফুটন অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। শহর ও গ্রামীণ জীবনের তুলনামূলক রুপায়ণ এ সিনেমার প্রাণ। গ্রাম ভেঙে শহর হবে, জমিদাররা গরীবদের কষ্টের কারণ হবে, তবু মানুষেমানুষে সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য টিকে থাকবে। বিমল রায় মুভির নাম নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা থেকে। কবিতার থিম আর মুভির থিম একই…………

শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।

বাবু বলিলেন, ‘ বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে। ‘

কহিলাম আমি, ‘ তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই।

চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো – জোর মরিবার মতো ঠাঁই। ‘

শুনি রাজা কহে, ‘ বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা

পেলে দুই বিঘে প্রস্থ ও দিঘে সমান হইবে টানা —

ওটা দিতে হবে। ‘