দ্বিচারণ

  
 আমাদের প্রেমটা হবার শুরুতে তুমি অনেক বেশিই গুরুত্ব দিতে আমাকে; আমিই বরং দিতাম না ইচ্ছে করে। আমার তেমন কিছুই মনে হতো না তোমাকে, সেরকম কোনও টানও অনুভব করতাম না আসলে। ওদিকে তুমি ছিলে নাছোড়বান্দা। আমাকে ছায়ার মতো ঘিরে রাখতে চাইতে সবসময়ই। আমি তোমার ওরকম বেপরোয়া হওয়াটা দেখতাম আর অবাক হতাম।
  
 এরপর ধীরে ধীরে আমিও ভালোবাসতে লাগলাম, আমিও বুঝতে শিখলাম টান যে কী জিনিস! কেমন উথালপাথাল করতাম সেইসব দিনগুলিতে, মনে হলে আজও শিউরে উঠি! আমি জানি না তোমার হঠাৎ কী হলো, তুমি আমার কাছ থেকে একটু একটু করে মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছিলে, কখনও কাজের অজুহাতে, কখনওবা পরিবারের অজুহাতে। অবশ্য তত দিনে আমি গভীরভাবে ডুবে গেছি তোমার মধ্যে, তোমার ওই দুচোখেই মগ্ন আমি কখনও ধরতেই পারিনি তোমার অনাগ্রহের কারণটা।
  
 আমি যখন গভীরভাবে ভালোবাসতে শুরু করলাম, ঠিক তখনই তুমি শুরু করলে আমায় অবহেলা করা। তোমার জীবনে ভালোবাসার সুবাতাস বইছে যখন আমার দিক থেকে, আমার জীবনে তখন বইছে অবহেলার ঝড় তোমার দিক থেকে। কেন অমন করলে, তা আমি জানি না। অবহেলায় অবহেলায় আমাকে পেলে পেলে, পুষে পুষে, পিষে পিষে মারতে চেয়েছ। আমি সবই সহ্য করেছি। মরে যাইনি তবুও। হায়, মৃত্যুও অনেকসময় মৃত্যুপথযাত্রীর জন্য সহজ হয় না! সেই মৃত্যুপথ থেকে আবারও জীবনের পথে ফিরে আসাকেও মানুষ সৌভাগ্য বলে! হা হা হা…।
  
 বড্ড হাসি পায় মানুষের ওসব কথা শুনলে। কেউ কেউ এক মৃত্যু থেকে আরেক মৃত্যুতে ফিরে আসে, আর বাকিরা ওটার নাম দিয়ে দেয় কিনা সৌভাগ্য! আমি মৃত্যুকে আর ভয় করি না, পালাতেও চাই না। কারণ অহেতুক বেঁচে থেকে থেকে জীবন কাটানোর নামে আমার রোজ রোজই যে মৃত্যু হয়, তার চেয়ে বরং একেবারে মরলেই আমি বেঁচে যাই। ওমা দেখো, মৃত্যু নিয়ে অহেতুক কতগুলো কথা লিখে ফেললাম! আচ্ছা, সৃষ্টিকর্তা নাকি সব ভাষাই বোঝেন, সবই বোঝেন। এই জীবনটা যে আমার আর প্রয়োজন নেই, উনি কি সেটা বোঝেন না তবে?
  
 তো যা বলছিলাম। একটা বার শুধু দেখতে চেয়েছিলাম তোমাকে, তুমি এলে না তো এলেই না কিছুতেই! অবহেলা যে কী জিনিস, তা তোমার চাইতেও ঠিকভাবে দেখাতে চাইলে আমাকে আবারও জন্ম নিতে হবে! তখন আমিও বুঝলাম, তুমি হয়তো আমাকে ছাড়াই ভালো থাকবে। আমি পালিয়ে গেলাম বহু বহু দূরে, মানে সব যোগাযোগের বাইরে।
  
 একদিন আমি রোড-অ্যাক্সিডেন্টে অনেক আহত হলাম, আর তোমাকে কে যেন বলল, আমি মারা গেছি। হা হা হা …। ওরকম ভুল মানুষ শুধু শোনেই, ওসব ঘটে না আসলে বাস্তবে, নইলে তো মরে গিয়ে বেঁচেই যেতাম! মৃত্যু তো আর চটপটি-ফুচকার প্লেট নয় যে অর্ডারমাফিক সামনে এসে হাজির হবে! অগত্যা, কী আর করা!
  
 আমি হসপিটালে শুয়ে শুয়েই জানলাম তোমার আসার কথা। আবারও হাসলাম। সেসময়ে আমার ছোটো ভাইটা ছাড়া আর কেউ ওখানে ছিল না। ওকে দিয়েই বলে পাঠালাম, যা শুনেছ, তা সত্যিই শুনেছ, আমি আর বেঁচে নেই। আমার ভাইটা ফিরে এসে বলল, ও তোমাকে কাঁদতে দেখেছে! তুমি নাকি একবার আমায় দেখতে চেয়েছিলে। ঠোঁটকাটা বেয়াড়া ভাই আমার, তোমাকে অপমান করে বের করে দিয়েছে শুনলাম।
  
 তবে আমি এখন ভাবছি অন্য কথা। তুমি কি সাথে করে সত্যিই ফুল এনেছিলে? ও কি ঠিক দেখেছিল? তুমি হঠাৎ এত সময় পেলে কোথায় যে ফুলের দোকানেও গিয়েছ আমার জন্য? পরিবারের লোকজন আসতে দিল তোমায়? আমার দেওয়া ফুলগুলোই কখনও চেয়ে দেখত না যে, সে নিজে ফুল নিয়ে আমার শেষযাত্রা দেখতে এসেছে! আবারও হাসলাম!
  
 একগুচ্ছ ফুল তুমি যাকে বেঁচে থাকতেই দিতে পারলে না, সময় করতে পারলে না যার জন্য, তারই মৃত্যুর খবর শুনে তার জন্য এতটা টান এল কোত্থেকে তোমার মধ্যে? তার চেয়ে বরং থাকুক ওসব। আমার মৃত্যুর খবরে যার সময় মিলল আমার লাশের জন্য, তার মতন অত বড়ো মানুষের সময় আমি চাই না। আমি তোমায় না দেখে এতকাল বেঁচে থাকতে পেরেছি যখন, না দেখে দিব্যি মরেও যেতে পারব।