দ্য ইয়াং অ্যান্ড দ্য ড্যামড (১৯৫০)

দ্য ইয়াং অ্যান্ড দ্য ড্যামড ১৯৫০ সালের ফিল্ম। মেক্সিকান। সেসময় মেক্সিকোতে নির্মিত হচ্ছিল ইতিহাসনির্ভর সব ফিল্ম। সেগুলিতে আমরা দেখি ঘোড়ায় চড়া সাহসী পুরুষ, সুন্দরীদের প্রতি যুবকদের প্রেমনিবেদনের অপূর্ব দৃশ্য, মদ্যপান আর ফুর্তি, এইসব। তখন লুইস বুনুয়েল লিখলেন মেক্সিকো শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো শিশু ও তরুণদের দারিদ্র্য ও তার ফলে সৃষ্ট নানান সামাজিক অবক্ষয়ের গল্প। ইতালিয়ান নিও-রিয়্যালিজমের কনসেপ্টের ধাঁচে মুভি বানালেন। প্রোডাকশন, ফটোগ্রাফি, ডিরেকশন, এমন-কী অভিনয় করালেন অপরিচিত কিংবা অল্প-পরিচিত আর্টিস্টদের দিয়ে। এর ফলাফল হল দেখার মতো। মেক্সিকো অবাক হয়ে দেখল, এভাবেও সিনেমা হয়! সেসময় বড় শহরে বাস-করা সংখ্যাগরিষ্ঠ গরীব ও বেপরোয়া মানুষের জীবনবাস্তবতা, আরও স্পষ্ট করে বললে, জীবনের অন্ধকার দিকগুলি বুনুয়েল লেন্সে নিয়ে এলেন অবিকলভাবে। তাঁর সমালোচনা করা হল, তাঁর ছবি সেন্সরড করে রাখা হল। মেক্সিকোতে আলোচনার ঝড় বয়ে গেল। স্পেনের একজন নির্মাতা মেক্সিকো নিয়ে কিছু না জেনেই এমন ছবি বানান কোন আস্পর্ধায়? বেশিরভাগ মানুষের অবস্থানই ছিল দ্য ইয়াং অ্যান্ড দ্য ড্যামড-এর বিরুদ্ধে। তখন একটা ঘটনা ঘটল। ১৯৫১ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে মুভিটি সেরা পরিচালনার পুরস্কার জিতে নিল। সমালোচকদের পর্যালোচনা এবং মন্তব্য ছিল বুনুয়েলের পক্ষে। সে উৎসব শেষ হলে মেক্সিকো কর্তৃপক্ষ সিনেমার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন, সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হল, সাফল্যও এল সাথেসাথেই। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে মুভিটি ১১টি অ্যারিয়েল পুরস্কার জিতল। অ্যারিয়েল হচ্ছে মেক্সিকোর অস্কার।

এত কথা কেন টানলাম? বুনুয়েলের ক্যারিয়ার সেই মুভিতেই শেষ হয়ে যেতে পারত যদি তিনি কানের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে স্বীকৃতি না পেতেন। এরপর সিনেমা বানাতে গিয়ে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা এবং বাজেটের জন্য তাঁকে আর ভাবতে হয়নি। প্রাপ্য স্বীকৃতির অভাবে অনেক প্রতিভাই তো হারিয়ে যায়। সেদিক দিয়ে বুনুয়েল ভাগ্যবান। পরবর্তীতে কুরোসাওয়া, বার্গম্যান, ফেলিনি, গদার, কুবরিক-সহ নামী অনেক নির্মাতাই বুনুয়েল সম্পর্কে বলতে গিয়ে দ্য ইয়াং অ্যান্ড দ্য ড্যামড-এর কথা স্মরণ করেছেন। এ গুরুত্বপূর্ণ সিনেমায় স্যুরিয়ালিজমের কাজ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। পেদ্রোর স্বপ্নের দৃশ্যটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের জন্য অসামান্য সম্পদ। অন্ধ লোকটিকে যখন রাস্তার বখেযাওয়া ছেলেগুলি পেটাল, তিনি রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে রইলেন, তখন আমরা তাঁর সামনে একটা মুরগিকে দেখি। পুলিশ যখন জাইবোকে পালানোর সময় গুলি করে মেরে ফেলল, মৃত্যুর আগে জাইবোর মস্তিষ্কে দৌড়েআসা কুকুরের ছবি ভেসে ওঠে। মেক্সিকোর চলচ্চিত্রের জন্য স্যুরিয়ালিজমের এমন প্রয়োগ ছিল অভাবনীয়। বুনুয়েল তাঁর দর্শকদের জানান, বাস্তব জীবন সুখের কিছু নয়, সাধারণ মানুষের সমস্যা, আবেগ, দুর্দশা, অপ্রাপ্তি নিয়েই বাস্তব জীবন। সিনেমায় তিনি যা দেখিয়েছেন, তা বিশ্বের হাজার মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। সিনেমায় মাঝেমধ্যে কিছু বুনুয়েল জন্ম নেন, আমাদের বোধশক্তিকে স্তব্ধ করে দেন, বাস্তবতাকে নগ্নভাবে বিবেকের সামনে এনে উপস্থাপন করেন। তাঁরা আমাদের বলেন, বাস্তব জীবনে সবসময়ই ‘অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’, এমন হয় না, পৃথিবীতে এমন অসংখ্য শিশু জন্ম নেয়, যাদের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবেশের কারণে ভাল কিছু করতে পারে না, দারিদ্র্য ও অপরাধই বিশ্বের প্রকৃত আয়না, খুব ঠাণ্ডা মাথায়ও বীভৎস সব অপরাধ মানুষ করে ফেলতে পারে।

রাস্তায় যারা প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করে চলে জীবন ও জীবিকার তাগিদে, যাদের কথা আমরা ভুলেও মনে করি না, সেসব দরিদ্র, অভাজন, বস্তিবাসী-দের জীবনের অকৃত্রিম দর্পণ এ সিনেমাটি। বিধ্বস্ত শৈশব ও তারুণ্য নিয়ে অনেক সিনেমাই তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেগুলির কোনোটিই দ্য ইয়াং অ্যান্ড দ্য ড্যামড-কে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। সামাজিক ভাষ্য, রাজনৈতিক উদ্বেগ, শৈল্পিক উদ্ভাবন, খ্যাপাটে সৃজনীশক্তি, তীব্র শ্লেষ, সূক্ষ্ম রসবোধ ও ভিজ্যুয়ালের অনন্য পরিমিত ব্যবহার বুনুয়েলকে ফিল্মমেকারের মধ্যে অগ্রগণ্য করে রেখেছে। এ সিনেমা বানানোর সময় বুনুয়েলের বয়স ৫০। সিনেমায় মনস্তত্ত্বের শৈল্পিক উপস্থাপন বুনুয়েলের অভিজ্ঞতার জানান দেয়, অন্যদিকে ফিল্মের সততা ও সাহসিকতা বুনুয়েলের তারুণ্যমুখর দিকটিও আমাদের সামনে নিয়ে আসে। প্রচলিত ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠানকে ভাঙার যে প্রবণতা বুনুয়েলের মধ্যে ছিল, সেটিই তাঁকে ফিল্মের আবহের প্রতি শতভাগ বিশ্বস্ত থাকতে অনুপ্রাণিত করেছে। এ সিনেমায় অন্ধ ব্যক্তি, মা, অজিতোস, মেয়েটি, তার ঠাকুরদা, এবং অন্যান্য শিশুরা—আমরা যেমন করে দেখতে চাই, সবসময়ই ঠিক তেমন করেই পর্দায় আসে না। ওদের জটিল মনস্তত্ত্ব বুনুয়েল আমাদের দেখিয়েছেন ঠিক সেভাবেই, যেভাবে ‘হওয়া উচিত’ নয়, বরং যেভাবে ‘হয়ে থাকে’। আমরা তাদের কিছু কার্যকলাপ ও ভাবনায় বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, নিরাশ হয়ে পড়ি, তবু পরমুহূর্তেই ভাবি, এমন তো হতেই পারে, ওরাও তো রক্তমাংসের মানুষ!

কিছু দৃশ্য মাথা থেকে কিছুতেই বেরোয় না। মেয়েটি যখন তার নগ্ন পায়ে দুধ ঢেলে দেয়, তখন আমাদের কিছুটা হলেও ইন্দ্রিয়চেতনা জেগে ওঠে। পেদ্রো হুট করেই ক্যামেরার দিকে ডিমটা ছুঁড়ে মারে (যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমরা লুকিয়ে লুকিয়ে আমার কষ্ট দেখছ, না?)। পেদ্রোর মা ঘর পরিষ্কার করার সময়, পা ধোয়ার সময় তাঁর বুকের সন্ধিস্থল ও উরু উন্মুক্ত হয়ে পড়লে তা দেখে জাইবোর মধ্যে কাম জেগে ওঠে। (অবশ্য সে ডাকে মা সাড়া দিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে পরিচালক আমাদের কল্পনায় ফেলে রেখেছেন।) অজিতোস মুহূর্তের ক্রোধে হঠাৎ ভাবে, এই অন্ধ বুড়োটাকে নাহয় এই পাথর দিয়ে মেরেই ফেলি! (ওর খাওয়াপরার যোগান দেন সেই বুড়োই!) পেদ্রোর মা যখন কিছু মোরগকে পেটাচ্ছেন, তখন সে দৃশ্য দেখে পেদ্রোর স্নায়ু অবশ হয়ে পড়ে যেন। বড়রা যখন নানানভাবে পেদ্রোকে মানসিকভাবে নির্যাতন ও বঞ্চিত করে, কিছুতেই পেদ্রোর ভাল হয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে তার মা বিশ্বাস করতে পারে না, আর তার ফলস্বরূপ পেদ্রো এক ধরনের বিপর্যস্ত মানসিকতায় বেঁচে থাকে, তখন তা আমাদের গভীরভাবে স্পর্শ করে। মাংসের টুকরা নিয়ে পেদ্রোর স্বপ্নের সিকোয়েন্সটা দর্শককে একইসাথে ক্রোধ ও হতাশায় নিমজ্জিত করে। কাদা ও রক্ত মাখামাখি, শুকর, গাধা, মোরগমুরগি, কুকুর প্রভৃতি প্রাণীর প্রাসঙ্গিক উপস্থিতি, প্রতিবন্ধী, নারীর নগ্ন পদযুগল……..এসব বুনুয়েলের ফিল্মমেকিং-এর প্রিয় কিছু হাতিয়ার। এখানেও তার ব্যত্যয় হয়নি।

জাইবো এবং পেদ্রোর শেষ পরিণতি এ সিনেমার সবচাইতে শক্তিশালী দিক। জাইবোর নিয়তি আমাদের যেমন দেখতে চেয়েছি, তেমন হলেও, পেদ্রোর নিয়তি ঠিক আমাদের ‘মনের মতো’ কিংবা ‘আশানুরূপ’ হয়নি। তবু বুনুয়েল ওভাবেই তা দেখিয়েছেন, কারণ ওটাই অধিক বাস্তবিক। যে রাজার গায়ে পোশাক নেই, তাঁকে আমরা পোশাকহীন-রাজা বললেও, বুনুয়েল তাঁকে ন্যাংটা-রাজাই বলবেন। এর কারণ, ‘পোশাকহীন’ কথাটি দিয়ে রাজার ঠিক সেই মুহূর্তের অবস্থাটা নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় না। যার কাছে বেশি পোশাক নেই, দুইএকটি মাত্র পোশাক আছে, তাকেও আমরা পোশাকহীন বলে ফেলি, তবে ‘ন্যাংটা’ শব্দটার একটাই অর্থ, এবং ওটিই রাজার সে মুহূর্তের প্রকৃত অবস্থাটা প্রকাশ করে।

অরূপরতন ঘোষ অনূদিত বুনুয়েলের আত্মজীবনী ‘শেষ দীর্ঘশ্বাস’ পড়ে জানতে পারি, বুনুয়েল তাঁর সবচাইতে বাজে ও ময়লা পোশাকগুলি পরে মেক্সিকোর বস্তি ও দরিদ্র লোকালয়ে পাঁচ মাস কাটিয়েছেন শুধু সিনেমায় নির্ভুল আবহ ও চরিত্রদের ভাষা তৈরির কাজে। (‘পদ্মা নদীর মাঝি’ লেখার সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দিনের পর দিন কাটিয়েছেন ধীবরপল্লীতে। ক্লাসিক তৈরিতে এমনি করেই শ্রম ও সময় দিতে হয়।) এ সিনেমা যখন মেক্সিকোতে মুক্তি পায়, তখন সবাই মিলে সিনেমাটিকে আক্রমণ করেছিল এ যুক্তিতে যে এটি মেক্সিকো এবং মেক্সিকোর নাগরিকদের সম্মানে আঘাত করেছে। সেসময় সিনেমাটি চলেছিল মাত্র ৪ দিন। মেক্সিকো নিয়ে ফালতু সব মিথ্যে গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদার অপরাধে বুনুয়েলকে হত্যাহুমকি দেয়া হয়, শারীরিকভাবে আহত করা হয়। কান উৎসবে অভাবনীয় সাফল্য পাবার পরই বুনুয়েলকে ও তাঁর সৃষ্টিকে মেক্সিকোতে সাদরে গ্রহণ করা হয়েছিল। মেক্সিকোর ভবঘুরে, ভিখারি, রাস্তার বখাটে ছেলে, কিশোর অপরাধী, দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের অনৈতিকতা, দুর্নীতি, অপরাধপ্রবণতা, জঘন্য কর্মকাণ্ড, এবং জীবনেরযাপনের সূক্ষ্ম ও নিপাট চিত্ররূপ দ্য ইয়াং অ্যান্ড দ্য ড্যামড। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অমূল্য এ সম্পদটি বুনুয়েল সৃষ্টি করেছিলেন মাত্র ২৫ দিনে: শুটিং ২১ দিনে, সম্পাদনা ৪ দিনে।

পাদটীকা। আমি ফিল্মবোদ্ধা নই, আমার পক্ষে লুইস বুনুয়েলের কাজ নিয়ে লেখা সহজ নয়। এ লেখাটি তৈরি করার সময় আমি ‘শেষ দীর্ঘশ্বাস’ বইটি এবং ইন্টারনেটের বিভিন্ন উৎস থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছি।