দ্য স্টিমরোলার অ্যান্ড দ্য ভায়োলিন (১৯৬১)

২৮ বছরের আন্দ্রেই তারকোভস্কি মস্কোর বিখ্যাত ফিল্ম-স্কুল জেরাসিমোভ ইন্সটিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফির চলচ্চিত্র পরিচালনা কোর্সের ছাত্র। রোল নম্বর ৭৫৬০৬৮। সেসময় ফরাসি পরিচালক অ্যালবার্ট ল্যামোরিজের ‘দ্য রেড বেলুন (১৯৫৬)’ শর্টফিল্মটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের গ্রাজুয়েশন প্রজেক্ট হিসেবে বানিয়ে ফেললেন (তাঁর নিজের ভাষায়) ‘পোয়েটিক ফিল্ম’ ‘দ্য স্টিমরোলার অ্যান্ড দ্য ভায়োলিন (১৯৬১)’। তাঁর কাজটি সে বছর নিউইয়র্ক স্টুডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রথম পুরস্কার জিতে নেয়, এবং সে ডিপ্লোমা কোর্সে প্রথম হয় রোল নম্বর ৭৫৬০৬৮-ধারী ছেলেটি। সিনেমায় রঙের নিখুঁত ব্যবহার, শৈশবের মজার স্মৃতি, আয়নার মধ্য দিয়ে দেখা জীবনের প্রতিচ্ছবি, জলের ভেতরে আলোর খেলা, চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ইত্যাদি বিষয় নির্মাতা হিসেবে তারকোভস্কির ভবিষ্যৎ বলে দিয়েছিল। ‘দ্য রেড বেলুন’ ছবির লালরঙের সাথে তিনি মিশিয়েছেন হলুদ, সাথে নীল আকাশ আর পোশাকের রং। সাত বছর বয়সি ভায়োলিনবাদক সাশার সাথে স্টিমরোলারচালক যুবক সের্গেইয়ের বন্ধুত্ব এবং সে বন্ধুত্বকে ঘিরে কিছু সহজ গল্প, এই দুই নিয়েই তারকোভস্কি চিত্রনাট্যটি লিখেছেন। লিখতে সময় নেন ৬ মাসের কিছু বেশি সময়, তাঁর সাথে ছিলেন আন্দ্রেই মিখালকোভ কোনচালোভস্কি।

আমার চোখে তারকোভস্কির সবচাইতে সহজবোধ্য ছবি ‘দ্য স্টিমরোলার অ্যান্ড দ্য ভায়োলিন’। পরিচালকের এ ছবির পরের ছবি ‘ইভানস চাইল্ডহুড’, আর ইভানের সাথে সাশার মানসিক অবস্থানের কোনো মিলই নেই। পরের ছবিগুলি আরো অন্যরকমের, সেগুলিতে মনস্তত্ত্ব, দর্শন ও পরাবাস্তবের কাজ তারকোভস্কিকে তারকোভস্কি করতে সাহায্য করেছে। মজার ব্যাপার, এই স্টুডেন্ট ফিল্মটাকেই স্টিভেন স্পিলবার্গকে তাঁর ব্লকবাস্টার ফিল্ম ‘জস (১৯৭৫)’ নির্মাণে কাজে লাগিয়েছেন। সিনেমার শেষের দিকে। সাশা এবং সের্গেই একসাথে রাশান সোশালিস্ট মাস্টারপিস ‘চাপায়েভ (১৯৩৪)’ দেখার প্ল্যান করে, কিন্তু তা ভেস্তে যায় সাশার মায়ের আপত্তির কারণে। সের্গেই তার এক মেয়ে সহকর্মীকে নিয়ে সিনেমায় যায়। মেয়েটি দুইজনের বন্ধুত্ব নিয়ে ঈর্ষান্বিত ছিল। ঘরে বদ্ধ অবস্থায় সাশা কল্পনা করে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে সের্গেইয়ের স্টিমরোলারের কাছে। রোলারটি চলছে এক চত্বরের উপর দিয়ে, আশেপাশে অনেক কবুতর। সাশা দৌড়ে গিয়ে রোলারে উঠল, আর কবুতরগুলি সব উড়ে চলে গেলো। সে দৃশ্যে লালরঙের ব্যবহার চোখে পড়ে। মুক্তির স্বপ্ন এবং মুক্তির স্বাদ—এই দুইয়ের এক অনবদ্য দৃশ্যায়ন শিশু সাশার চোখ দিয়ে তারকোভস্কির সাথে আমরাও দেখে নিই।

সিনেমায় সাশার বয়স সাত, ভায়োলিন বাজায়। (বাস্তবের সাশা সত্যিই মিউজিক স্কুলের ছাত্র ছিল।) পাড়ার সবাই যখন ফুটবল খেলে, দৌড়াদৌড়ি করে, তখন সে ভায়োলিনের সাথে সময় কাটায়। সবাই ওকে ‘মিউজিশিয়ান’ বলে খ্যাপায়, তার সাথে দুর্ব্যবহার করে, ভায়োলিনটা দিয়ে ক্যাচক্যাচ খেলে। একদিন স্টিমরোলারচালক সের্গেই সাশাকে দুষ্ট ছেলেদের হাত থেকে বাঁচায়, তখন থেকে ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। সে সাশাকে রোলারের উপর বসিয়ে ওটা চালাতে দেয়, তা দেখে অন্য শিশুদের মধ্যে সাশা সম্পর্কে এক ধরনের সমীহভাব তৈরি হয়। একই বয়সি কাউকে বড়ো কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখলে শিশুরা ওকে ঈর্ষার চোখে দেখে। ওরা সাশার ভায়োলিনের খাপটা নষ্ট করে দেয়, যেটা পরে সের্গেই সারিয়ে দেয়। একটা দৃশ্যের কথা বলি। শাসা ভায়োলিন শিখতে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে রাস্তায় ধারে পাশাপাশি তিনটা আয়নায় সে পৃথিবীকে দেখে। একই জিনিসকে তিনটা অংশেই দেখা যায়। (সম্ভবত তারকোভস্কির ফিল্ম ইন্সটিটিউটের) উঁচুউঁচু দালানের সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলে, একটা মেয়ে কিছু বেলুন নিয়ে যাচ্ছে, একটা ছোট ছেলে রাস্তায় জমেথাকা জলে পালতোলা নৌকা ভাসিয়ে দেয়, এক মহিলার হাত থেকে কিছু আপেল মাটিতে পড়ে যায়, ঘড়িতে দশটা বাজতে নয় মিনিট বাকি, কিছু কবুতর উড়ে গেলো। লালের ব্যবহার এখানেও লক্ষণীয়। সাশা একটা আপেল কুড়িয়ে নেয়। ক্লাসে গিয়ে আপেলটা মুছে তার সহপাঠিনীর পাশের চেয়ারে রেখে দেয়। সাশা ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, ক্যামেরা ওদিকে ঘুরে গেলো। ক্যামেরা যখন আবার আপেলের দিকে ঘুরলো, তখন আপেলটির কিছু অংশ চেয়ারে পড়ে আছে।

সাশার মিউজিক টিচার বেশ কড়া। সাশাকে বলেন, গ্রামার মেনে ভায়োলিন বাজাতে হবে। সাশা স্কুল থেকে বেরিয়ে সের্গেইয়ের সাথে দেখা করে। ওরা দুইজন দেখে, একটা ছোট ছেলের কাছ থেকে ওর চাইতে বয়সে বড়ো একটা ছেলে বল কেড়ে নিয়ে ওকে কাঁদাচ্ছে। সের্গেইয়ের কথামতো সাশা মার খেয়েও ওর কাছ থেকে বলটা উদ্ধার করে দেয়। নিজের সাহসে সে নিজেই মুগ্ধ হয়। সাশা আর সের্গেই দেখে, মস্কোর পুরনো বড়বড় দালানগুলি রেকিং-বলের সাহায্যে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা যাচ্ছে রাশিয়ার সেসময়ের সবচাইতে বড়ো সাতটি দালান সেভেন সিস্টার্সের একটি। স্থাপত্যশৈলীতে রাশিয়ার বিকাশ, পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুনের দিকে যাত্রা এবং নগরায়নের একটা ছবি আমাদের মাথায় চলে আসে। সের্গেই মজা করে সাশাকে মিউজিশিয়ান ডাকে, তখন সাশা রাগ করে সের্গেইয়ের লাঞ্চটা মাটিতে ফেলে দেয়। সের্গেই তখন বলে, এই রুটি কি গাছে ধরে? অনেক কষ্ট করে আমাকে খাবার যোগাড় করতে হয়। এটা তুলো মাটি থেকে। সাশা তার ভুল বুঝতে পারে, ওরা দুজন মিলে লাঞ্চ শেয়ার করে খায়। ভায়োলিন বাজাতেবাজাতে সাশার হাতে একটা ঘায়ের দাগ তৈরি হয়, সাশা ওটা নিয়ে গর্ব করে। সে সের্গেইকে ভায়োলিন শেখার গল্প বলে, সের্গেই সাশাকে যুদ্ধের গল্প শোনায়। সংবেদনশীল মনের ভায়োলিনবাদক সাশা তার নিজের এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষকারী সের্গেইয়ের চোখে পৃথিবীটাকে কেমন করে দেখে, তাকে ও তাদের অসম বন্ধুত্বকে ঘিরে আশাপাশের সবার প্রতিক্রিয়া এবং সমকালীন রাশিয়ার খণ্ডচিত্র এ ৪৬ মিনিটের একদিনের গল্পে ফুটে উঠেছে।