পঞ্চপাণ্ডব


১. সব কিছু জেনে ফেলার চেয়ে, কম কম জানাটাই, বেশিরভাগ সময় ভালো। উপযুক্ত সময় আর সঠিক বয়সের আগে অনেক কিছু জেনে যায় যে মানুষটা, সে জ্ঞানী। ঈশ্বরপ্রদত্ত কিছু উপহার হয়তো সে পেয়েছে, কিংবা জীবনের নানান অভিজ্ঞতায় বা নিজের চেষ্টায় সে অনেক কিছু জেনেছে। এরকম জ্ঞান ধরে-রাখাটা অনেক কঠিন একটা ব্যাপার। অনেক কিছুই বয়সের আগেই জেনে গিয়েছে যারা, তাদের মধ্যে মাত্র এক শতাংশের মতো মানুষ বড়ো কেউ হয় পরবর্তীতে। বাকিরা হারিয়ে যায় জ্ঞানের ভারে। জ্ঞানী মানুষের সবচাইতে বড়ো গুণটা হলো, নিজেকে সামলে চলতে জানা। জ্ঞানের ভার সহ্য করা কিন্তু খুব খুব শক্ত একটা কাজ। তবে ওই যে, এক শতাংশ মানুষ, যারা বড়ো হয়ে যায়, তারা অনেক অনেক বড়ো কেউ হয়ে যায়, একদম চোখে পড়ার মতন বড়ো মানুষ। এতটাই বড়ো যে, ওরা আপনার চোখে পড়তে বাধ্য! অল্প বয়সের অধিক প্রাপ্তির ধাক্কা সবাই সামলাতে পারে না। মাত্র কিছু মানুষ পারে। যারা পারে, ওদের ক্ষমতা আপনার আমার চোখে খুব স্পষ্ট করেই ধরা পড়ে।


২. আমাদের সমাজের নিয়ম অনুযায়ী, বাবা মারা গেলে সন্তান এতিম হয়। তবে আসল সত্যটা হচ্ছে, সন্তান এতিম হয় মা মারা গেলে। মা মারা গেলে সন্তানের দেখাশোনা করার সত্যিই আর তেমন কেউ থাকে না। বাবা তো আরেকটা বিয়ে করে নেয় সহজেই। আর সৎমা কতটা আগের ঘরের স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের দেখাশোনা করেন, তা তো আমরা দেখতেই পাই। একজন নারীর নিজের গর্ভের প্রতি অপ্রতিরোধ্য যে টান, সে এক অবিশ্বাস্য রকমের রহস্যময় জাদুর বন্ধন। তার সাথে জগতের অন্য কিছুর তুলনাই চলে না।


৩. সেক্স এমন একটা ব্যাপার, যেখানে দুজন সত্যিকারের ভালোবাসার সম্পর্কে-থাকা মানুষ প্রায় স্বর্গের কাছাকাছি চলে যায়। তবে এটাও ঠিক, সেক্স করতেই ভালোবাসা থাকাটা বাধ্যতামূলক কিছু নয়। ভালোবাসাবিহীন সেক্স কতটা সুখের, তা নিয়ে নানামুনির নানামত। আমি সে তর্কে এই লেখায় যাব না। তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, কাউকে ভালো না বেসেও তাকে ভালোবাসার কথা বলে বলে তার সাথে সেক্স করার চাইতে জঘন্য অপরাধ আর হয় না। ভালোলাগা থেকে, চাহিদার পূরণ করতে, বা অন্য যে-কোনও কারণে মিউচুয়াল কনসেন্টের ভিত্তিতে সেক্স দোষের কিছুই নয়,---সেখানে দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক থাক বা না থাক। তবে ভালোবাসার নামে সেক্স, এর চাইতে আত্মগ্লানিকর আর কিছু নেই। যারা এমন করে, ওরা যে কী করে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, আমি বুঝি না। রাস্তার কুকুরের সাথে ওদের মনোগত পার্থক্য খুবই সামান্য। এর সাথে রেইপের তেমন কী-ইবা পার্থক্য? রিয়েল মেন নেভার রেইপ; অ্যাকচুয়ালি, দে ডোন্ট নিড টু।


৪. পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর জায়গা হচ্ছে, নাপিতের দোকান বা সেলুন। দুনিয়াতে এমন কোনও বিষয় নেই, যা নিয়ে ওখানে আলাপ হয় না। আমি রাস্তার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেলুনের কথা বলছি। তারা অনেকের সম্পর্কেই অনেক কিছু জানে, আর মনের সব রঙচঙ মাখিয়ে ওসব বাড়িয়ে বুড়িয়ে বলে বেড়ায়। আবার এটাও ঠিক যে, তারা মানুষের অনেক গোপন কথাও জানে। যে কথার কোনও অস্তিত্বই নেই, তেমন কথাকেও ওরা কনফিডেন্টলি কারও-না-কারও গোপন কথা বানিয়ে দেয়। বিশ্বাস হয় না? ওসব দোকানে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। একই কথা রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের ক্ষেত্রেও সত্য। এই লকডাউনের সময়ে লোকে চায়ের দোকানে যাওয়ার জন্য রীতিমতো পাগল হয়ে গেছে কেন, জানেন? অন্যের গীবত করার নেশাটা অনেক বড়ো একটা নেশা। সেখান থেকে নিজেকে বেশি দিন দূরে সরিয়ে রাখাটা বেশ কঠিন। যাদের চাকরি নাই, তারা বেকার হলে, ওই সেলুনের আর চায়ের দোকানের লোকগুলি হচ্ছে বেকারের বেকার!


৫. সততা কিংবা আন্তরিক বন্ধুত্বের জায়গা থেকে, আপনি প্রিয়জনের সামনাসামনি দু-একটা অপ্রিয় সত্য কথা বলে,---যেটা হয়তো খুবই ছোটো কোনও ব্যাপার,---সারাজীবনের জন্য বিপদে পড়ে যাবেন; অথচ প্রিয়জনকে আপনি সবসময় তাদেরই প্রিয় মিথ্যা কথাগুলি বলে বলে, নানান ধরনের বড়ো বড়ো ক্রাইম করে গেলেও, সারাজীবনেও ওদের চোখে ধরা পড়বেন না। ভণ্ড ও বর্ণচোরা প্রকৃতির মানুষ তার নিজের ঘরে ও বাইরে, দুই জায়গাতেই ভালো থাকতে পারে। এই পৃথিবীতে মিথ্যে ও ভানেরই জয়জয়কার, ফলে ভণ্ডরাই এখানে জনপ্রিয় ও সফল। যত মিথ্যা, ততই সুখ, ততোধিক বিশ্বাস! যত সত্য, ততই অ-সুখ, ততোধিক অবিশ্বাস। আহারে, কী একটা জীবন!