পাথরে শ্বাসের দাগ

 বর্ষা নিয়ে অনেক কথা হয়, এমন এক অতিকথনের দিনে,
জারুলহিজলের বনে, যেখানে ওদের খালি শাখাগুলি ক্রমেই ভরে উঠছে,
তুমি এসেছিলে। গায়ে ছিল হলুদফুলের শাঁস, একটি সাদা ফুল ছিল আঁচলে,
সে ফুলের মাথায় মুক্তোর মুকুট ছিল। বাতাসে তোমার ঠোঁটের পাপড়ি কেঁপেছে,
দেখেছি। বনের গভীর থেকে যেন ফুলকি উড়ছে,
এমন সময় আরও দেখেছি, তুমি সেখানে তোমার ব্যক্তিগত সূর্যে কিংবা
সোনালি শীতল বসন্তের স্বপ্নে হারিয়ে যাচ্ছ, আর
পুরো পৃথিবীকে ফুলের পোশাক দিয়ে ঢেকে দিয়েছ।


রাজ্যের যত সবুজ আছে, ওরা সবাই এসে তোমাকে ভিজিয়ে দিক,
নিজেকে ভুলে আবারও খুঁজে পাও, তখন মাটিতে তাকিয়ে দেখো,
ওপরের আকাশটাকে আরও কেমন কাছের মনে হয়! দেখবে,
কারা যেন কাঠের মধ্যে প্রশস্ত কবর খুঁড়েছে, গভীর জঙ্গলে রাখা।


কোনও এক বসন্তে আমি নিজের কাছে ফিরে গিয়েছিলাম।
যাওয়ার আগে তোমাকে বলেছিলাম,
তোমার গভীরতায় যেমনি করে বোধ বাড়তে থাকে,
স্মৃতির পাখিরা তেড়ে ওঠে,
তেমনি করেই যেন আমার আত্মার জীবন্ত সৌন্দর্য
কখনওই অদৃশ্য না হয়েই জ্যান্ত হয়ে থাকে।
কাজ কিংবা ফাঁকি গাছের পাতার হিসেবে আমাকে অবসর দেয়, ওদিকে
গাছ যখন উপড়ে পড়ে, তখন শ্যাওলার আসাযাওয়া খুব সহজ হয়ে যায়।


অন্যদের মতোই, আমি, সুখের পসরা সাজিয়ে রেখেছে যে ঘর,
সে ঘরের দরোজায় কড়া নাড়লাম।
কেউ এসে দরোজা খুললেন, আমাকে তাঁর উষ্ণ হাতে স্পর্শ করলেন।
তিনি হাসলেন, তাঁর আশেপাশে কিছু সুখী মানুষ ছিল।
ওরা সবাই মিলে আমাকে সমস্বরে জিজ্ঞেস করল,
আপনি কি সুখী হতে চান?
উত্তরে বললাম, চাই না।
তারার আকাশে জ্বলজ্বলে আঁধার নীরব গুঞ্জনে পূর্ণ,
নীলনীল উচ্চতায় চোখ হাঁটে যখন, তখন
সেই তারাগুলি আপনাকে টানে?
মরুভূমিতে এবং সমুদ্রের মাঝে পথভোলা তীর্থযাত্রীরা আপনার সাথে কথা বলে?
স্বপ্নের দুঃস্বপ্ন ভেঙে জেগেওঠা একজন বন্দী হাসি ছড়িয়ে দিয়ে আপনার দিকে তাকায়?
স্বর্গীয় ঘূর্ণিগুলিতেও নিঃশব্দ, তাই দুর্দান্ত হয়ে পারদেরও ভারমুক্ত থাকতে পারেন যে মানুষ,
আপনি ঠিক সেই মানুষের মতো, যদি উপরের প্রশ্ন তিনটির উত্তরে আপনি হ্যাঁ বলেন।


আমি ভয় পেয়ে বলে চললাম, আমি আর কিছু চাই না,
আমি আমার আত্মায় শান্তিস্থাপন ছাড়া আর কিছুই চাই না,
পাখির দল ফুলের ডালে থেকে যাক, ওতেই আমার সব সুখ।
তার চেয়ে বেশি সুখ আমি চাই না।
যখন সূর্য উঁচু থেকে আরও উঁচুতে ওঠে, উষ্ণতা বাড়ায়,
তখন পৃথিবী বর্ণিল হয়, এবং বাতাস গভীরে প্রবাহিত হয়ে
সবখানে শান্তি বয়ে যায়। বিশুদ্ধ আত্মাটি আর আগের মতো বিব্রত হয় না,
ঠিক এমন সময়ই, কোনও বিশেষ শব্দগুচ্ছ না জানার বিষয়ে আপনারা সন্দেহ একটু হলেও বাড়িয়ে নিন---
কেবল আজকের সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য এবং শ্বাস ফেলেফেলে বেঁচেথাকার জন্য!


বসন্ত এসেছে। ভূমি ধূমপান করছে, সূর্য হাওয়াকে উষ্ণ করছে,
দূর থেকে বন পাতার জাল বুনছে, জল ঝরছে গাছের সাদা ফেনা দিয়ে,
ধ্বংসাবশেষে বেঁচে আছে বিষণ্ণ কিছু কুঁড়ি,
ঝোপঝাড় বেগুনি হয়ে আছে---এক ধরনের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে সেখানে………
এমন-কী খড়ের বাহুতে ঘাস জড়িয়ে যাওয়ার পরও আলো সেখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না!
সব কিছু শান্ত হবে, কেবল আবেগে পূর্ণ একটি শূন্যে বা বৃত্তে পাখির একটি গান কানে বাজবে।


শুনুন, মন্দিরের খিলানে আটকেথাকা সংগীতের মতো, হৃদয়, কোথাও কোথাও,
আকাশের শরীরজুড়ে ভূগর্ভস্থ কোনও সুখী কোটরের নির্ভাবনায় স্বর্গে উড়ে যায়।
সংগীত, শান্তি, সৌন্দর্য, উজ্জ্বলতা, আপনার মধ্যেই বাস করছে। খুঁজুন!
কীভাবে লাজুক হৃদয়টিও আপনার সাথে দেখা করতে চায় প্রসারিত অবয়বে,
বুঝে নিন। অন্যথায়, আপনার নিজের কণ্ঠস্বরই একসময় আপনার প্রহরগুলিকে খুন করবে।


সোনালি হাসির সূর্য, বিশ্বস্ত সাদা ফুল, নীড়ের খোঁজে পাখি---
কখনও মিথ্যে বলে না। যে ফুলটি হঠাৎ করেই গোটা দুঃখটিকে মুছে দেয়,
এবং তখনকার দৃশ্যটি আমাদের এই আর্দ্র পৃথিবীর মতো আন্তরিক হয়ে ওঠে,
সে ফুলের জন্যই পূর্বের সন্দেহাতীত আশ্বাসগুলি আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
প্রকৃতি---আমাদের দুর্দান্ত জীবনযাপনে নিঃশ্বাসে ও বাহুর আশ্রয়ে রয়ে যায়,
এবং কেউ যদি এমন প্রশ্রয়ে নির্ভার হয়েও মরে যায়, ধরে নিই,
সেও বাঁচতে শিখে গেছে! বসন্তের দিনে এমন মৃত্যু অবিকল জন্মের মতো
প্রশস্ত এক প্রান্ত জুড়ে সুন্দর, রৌদ্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তখন
তারই যাদুতে হাসি মেখে ফুলগুলির কুঁড়ি খোলে।
দোয়েলের শিসে সুখের সেই গানটি বাজে, যা পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে,
আর তখনই ফুলের মধ্যে আকাঙ্ক্ষার আগুন ধরে যায়, সূর্যও উন্মুক্ত হয়।


গ্রীষ্মের সন্ধেতে, দুধের গোধূলিতে দিনের আলো ঘুমিয়ে পড়েছিল---
তারার নিচে মেঘভাঙা স্বপ্ন থেকে কিছু ঘুম শিশিরের গায়ে ছিটিয়ে,
আর ফুলের ঘাড়ে গাছের বেড়েওঠা থমকে দিয়ে,
ফলের বাগানের ঝাঁকুনিতে মৌমাছির গর্জনের ছদ্মবেশে।
একেকটা যুদ্ধ সব হৃদয়েই নিঃশব্দ হয়ে পড়েছিল, সেখানে
একটি ঝোলাও ছিল, এবং সে ঝোলায় স্বর্গ নামল, এরপর
আরও কিছু সময় গেলে একটি শান্ত বিজলি আলস্য ভেঙে চমকে উঠল।
কোথাও কোনও কুঁড়েঘরে শেষ আলোটিও নিভে গেছে। এমন সময়
পৃথিবীর বেপরোয়া পাথরটিতেও স্বর্গের ইশারায় প্রশান্তির কিছু প্রতিশ্রুতি লেখা হয়ে গেল।